অভ্রদীপ ঘটক
কোভিড-জ্বরে মেয়েটা মরল। বাবাটা তার পরপরই মরল। কিছুদিন পর গভীর রাতে এক ভাই মরল। বুড়িটা কিন্তু বেঁচে থাকল। দেখি, একাই থাকে। কোথা থেকে যেন খাবার পায়। ফলমূল খায়, কোনওদিন না খেয়েই থাকে। বুড়িটা কিন্তু বেঁচেই থাকে। গ্রামে এত লোক মরল, তবু বুড়িটা আমবাগানে হাঁটতে যায়, ঘুরে ঘুরে বেড়ায় দিব্যি।
তারপর একদিন, অনেক রাতে, কোমরে ঝাঁটার কাঠি জড়িয়ে ওইদিকের জঙ্গলের পাশে পুকুরপাড়ে, নাচছে। আমি নিজে চোখে দেখেছি। জ্যোৎস্নারাত ছিল। চাঁদের আলোর রাত।
এটুকু বলার পর থামল হোপনা বাস্কে। মালদার প্রত্যন্ত গ্রামের বিখ্যাত জানগুরু।
হাইওয়ে থেকে ভেতরে অনেকটা দূর যেতে হয়। জঙ্গলের মাঝে মাটির রাস্তা দিয়ে, কালো স্করপিওর হেডলাইটে বাড়ি খায় ঝোপঝাড়। রাস্তায় ছাগল চরছে, এক মানুষ-সমান ঝোপঝাড়ের মাঝে অনেক দূর দূর একটা করে মাটির বাড়ি দেখা যায়। রাস্তা ঘুটঘুটে অন্ধকার। স্ট্রিটই নেই, তায় স্ট্রিটলাইট! শুধু গাড়ির আলোয় যতটুকু চোখে পড়ে।
একতলা ইটের বাড়ি। মাঝে উঠোন। প্রতিটা ঘরে, উঠোনে, বারান্দায় মহিলারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবারই লালপাড় সাদা শাড়ি। কিছু দূর চোখ যায়, কোণের ঘরে টিমটিমে লন্ঠনের আলোয় তেলচিটে বিছানায় শুয়ে এক অল্পবয়সী মহিলা কাতরাচ্ছে। গোঙাচ্ছে বলা ভালো। কী অস্বস্তিকর! পদ্মপর্ণা কাঠের মতো শক্ত হয়ে ক্যামেরা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার সঙ্গে এসেছি, সেই শান্তিদার এসব অঞ্চলে বেশ চেনাশোনা। শান্তিদার মধ্যে আমাদেরই আদমি ব্যাপারটা আছে— নইলে এতক্ষণে শহর পেরিয়ে, ৪০ কিমি আমবাগান পেরিয়ে, এই বিদ্যুৎহীন ডাইনি-গ্রামে, স্বয়ং জানগুরুকে বসিয়ে এতসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে আর দেখতে হত না!
বারান্দার কার্নিসে সার সার শিশি-বোতল রাখা। গোবরলেপা উঠোনে চাটাই পেতে কীসব যেন শুকোচ্ছে।
ওখানেই আমাদেরও শুকোতে দিতেন সস্নেহে।
কালো কালো দাঁত বের করে শব্দ করে হেসে উঠল হোপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝবয়সী মহিলা।
—এরপরও বলবেন, আপনারা— ডাইনি বলে আসলে কিছু হয় না! ও গিলে খাইছে সব্বাইকে।
—তো আপনি কী করলেন? আমি জিজ্ঞেস করি।
—বুড়িকে ধরে আনলাম।
—আপনি আনলেন?
—না, ওই আমার লোকজন আছে। গ্রাম্যের লোক আছে। ওরাই আনল। আনলে বুড়ি সব্বাইকে খায়ে লিবে!
—তারপর?
—রাত বারোটার পর ঝাড়লাম বুড়িকে। ওই গ্রামের ভিতর, জঙ্গলের ধারে, হাসানের বাড়ির উঠানে। বুড়িকে ঝাঁটা দিয়ে পেটালাম। ন্যাংটা করলাম, সিঁদুর দিলাম। মন্ত্র পড়লাম।
—বাহ। ওসব তো দেখা যায় না, তাই না?
—আমার ইউটিউব চ্যানেল আছে। সাবস্ক্রাইব করলেই দেখা যাবে। আপনাকে লিঙ্ক পাঠায় দিব। সব দেখতে পাবেন।
ওখানে ফোনে সিগন্যাল ছিল না আমার। কিন্তু হোপনা বাস্কে রাতে সত্যি-সত্যিই হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছিল তাঁর চ্যানেলের লিঙ্ক!
সে এক আশ্চর্য দুনিয়ার গল্প।
স্থানীয় সাধারণ মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে গ্রামকে গ্রাম— হিন্দু থেকে খ্রিস্টানে কনভার্ট করা হচ্ছে। এই মিশন যদিও ভারতে বরাবরই ছিল।
আমার এক ভাগ্নী শহরের নামী স্কুলে পড়ত, সেখানে তো ক্লাসের মধ্যেই সরাসরি খ্রিস্টানিটির প্রচার আর কনভারসন নিয়ে ব্রেনওয়াশ চলত। এ নতুন কিছু নয়।
আমরা সারাদিন ঘুরে ঘুরে কয়েকটা বাড়ি পেলাম, যারা সদ্য খ্রিস্টান হয়েছে। মিশনারি থেকে টাকা পাচ্ছে, খাবার পাচ্ছে, ওষুধ পাচ্ছে। বাড়ির কিশোর, যুবক-যুবতীরা রিল বানাচ্ছে, ইউটিউবার হতে চাইছে!
প্রসঙ্গে ফিরি আবার।
—তো, সেই বুড়ি এখন কোথায়?
—ওকে আর দেখা যায় না। কী জানি কোথায় আছে!
—ও, আচ্ছা।
আর কথা বাড়াইনি সে রাতে। ফোন নম্বর নিয়ে বেরিয়ে আসি। পরদিন রাত বারোটার পর আসতে বলেন। কালও ঝাড়ফুঁক হবে আবার! তবে ভিডিও করা যাবে না!
এটুকু ইনফো আমার আগেই ছিল, যখন এক বেসরকারি টিভি চ্যানেলের জন্য ঈপ্সিতা রায়চৌধুরি ম্যাডামের ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম। পরে ওঁর মেয়ের সঙ্গে আমার সোশাল মাধ্যমে যোগাযোগসূত্রে আরও কিছুটা জানতে পারি। ঈপ্সিতা রায়চৌধুরি ভারতের প্রথম রেজিস্টার্ড উইচ। ম্যাডাম কিছু তথ্য দেন, বাকি অংশটা ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে লুকিয়ে পড়া ২০ বছর আগের আমার ক্লাস এইটের অতি-উৎসাহী মন… আর দেশবিদেশের বন্ধু-বান্ধবীদের পাঠানো স্ক্যান করা বইপত্তর।
মধ্যপ্রাচ্যে ডায়ানা রোমান পুরাণে বর্ণিত শিকার, মূলত প্রসবের দেবী। গ্রিক পুরাণের দেবী ডায়ানা বন্য পশুদের সঙ্গে কথা বলতে পারত এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত…
এই ডায়না থেকেই ডাইনি— এরকম একটা কথাও শোনা যায়। আসামের বোরোদের মধ্যেও ডায়না দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
এসব কিছু নিয়েই তন্ত্র, শুভ সাধনা এবং মহাজাগতিক বিভিন্ন ছোট-বড় শক্তিকে নিজের মধ্যে আহ্বান করার এক প্র্যাকটিস ছিল উইচক্র্যাফট।
আবার এদিকে, ডাক, শিবের অনুচর। ডাক এক ধরনের পিশাচ। ডাকের স্ত্রী হল ডাকিনী। ডাকিনী থেকেই ডাইনি শব্দের উৎপত্তি— এ তথ্য নিতান্ত হিন্দু পুরাণনির্ভর। ডাকিনীর উল্লেখ কালিকাপুরাণেও পাওয়া যায়। ডাকিনী-যোগিনী। শিবের এই অনুচরেরা কেন মানুষের ক্ষতি করবে, তা নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব রয়েছে।
আবার ইউরোপে প্রাচীন ডাইনিবিদ্যার প্রচলন হাজার হাজার বছর আগে থেকেই। ওল্ড টেস্টামেন্টে ডাইনির উল্লেখ আছে। মেসোপটেমীয় ও ইহুদি পুরাণে লিলিথের গপ্পো আছে। যিনি কিনা আদমের প্রথম স্ত্রী। আদমকে কামনা করেছিলেন লিলিথ। এক নারী, পুরুষকে কামনা করবে— এই “জঘন্য” অপরাধে লিলিথকে ইডেন উদ্যান থেকে বিতাড়িত করা হয়। তিনি ডার্ক ওয়ার্ল্ড-এ চলে যান।
এঁকেও ধরা হয় পৃথিবীর প্রথম ডাইনি। অর্থাৎ, কোনও মেয়ের মধ্যে যদি পুরুষের মতো কামনা-বাসনা বা ছোট-বড় ইচ্ছের জন্ম হয়, তাহলেই সে নেগেটিভ— ডেভিল বা শয়তান।
হিব্রুতে লিলিথকে এক বিপজ্জনক রাক্ষসী হিসেবে কল্পনা করা হয়— যিনি যৌনভাবে আগ্রাসী এবং রাতের অন্ধকারে শিশু চুরি করেন। এই কনসেপ্ট নিয়ে হলিউডে অনেক হরর ফিল্মও আছে।
ভারতীয় তন্ত্র, রোমান গড বা ইংল্যান্ডের লোককথা— সবক্ষেত্রেই শুভ এবং অশুভ দুটি দিক আছে। ডাইনি সন্দেহে সারা বিশ্বজুড়ে রীতিমতো কর্মযজ্ঞ চলে— লক্ষ্যে, অলক্ষ্যে।
১৫ ও ১৬ শতকে প্রথম ডাইনি বিচার শুরু হয়। প্রথম থেকেই এই বিচারের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। ১৭ শতকের শুরুর দিক থেকে উইচ-হান্ট আরও প্রবল হয়ে ওঠে। খ্রিস্টান ধর্ম-উপাসকেরা মনে করত, ডাকিনীবিদ্যাচর্চা, অর্গি সেক্স ও কিছু ক্ষেত্রে মানুষের মাংস খাওয়া, নগ্ন হয়ে গোপন উপচার করা, গভীর রাতে চাঁদের আলোয় জঙ্গলে নগ্ন হয়ে একসঙ্গে প্রকাশ্যে নৃত্য— এই সমস্ত উপচারগুলো ডেভিলস কাল্টের সঙ্গে জড়িত।
অবশ্য জার্মানিতে ডাইনি শিকার শুরু হয় এরও অনেক আগে। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানিতে ১৫৬১ থেকে ১৬৭০ সাল পর্যন্ত অসংখ্য মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারা হয়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সারা ইউরোপে প্রায় ১২,০০০ উইচ-হান্টের ঘটনা ঘটেছিল।
১৮ শতকের পর থেকে বিশ্বজুড়ে এ-ধরনের ঘটনা অফিসিয়ালি কমতে শুরু করে। ইংল্যান্ডে শেষ ডাইনি শিকারের ঘটনা ঘটেছিল ১৬৮২ সালে। ১৭১২ সালে জ্যানি ওয়েনহ্যামের ঘটনা ছিল প্রথাগত ডাইনি বিচারের শেষ নজির— যেখানে সে ক্ষমা চেয়ে মুক্তি পায়। তার ক্ষমা চাওয়ার পেছনে দোষ স্বীকার ছিল, নাকি সে নির্দোষ— সেই ট্রায়ালের কোনও পরিষ্কার নথি পাওয়া যায়নি।
কিন্তু ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, রাজনৈতিক ও সামাজিক মদতেই, আজও এই উইচ-হান্ট প্রবলভাবে চলছে।
আমরা পশ্চিমবাংলার একটা জেলা থেকে আমাদের ফিল্মের কাজ শুরু করতে চেয়েছিলাম। মালদা জেলা। সেই ভিত্তিতেই এই তথ্যচিত্রের কাজ শুরু করি: My Neighbour is a Witch।
আমাদের প্রথম প্রডিউসার ছিলেন মালদারই এক সোশাল ওয়ার্কার, গবেষক এবং কাউন্সিলার সুতপা সাহা। অসম্ভব সাহসী এবং ডাইনামিক মহিলা। উনি ও ওঁর বাবা মালদা জেলার জন্য অনেক কিছু করেছেন। সুতপাদি নিজে অ্যানথ্রোপোলজি নিয়ে পড়েছেন।
আমরা কলকাতায় বারবার মিটিং করি, প্ল্যানিং করি। সুতপাদি অবশ্য বারবার আমাদের সাবধান করে দিচ্ছিলেন এই কাজ নিয়ে এগোনোর ব্যাপারে। কিন্তু আমরা খুব একটা পাত্তা দিইনি।
কিন্তু এই কাজ পরবর্তীতে এক অর্থে আমাদের কাছে লাইফ থ্রেট হয়ে দাঁড়ায়।
যা হোক, পরদিন সকালে আমরা সেই বুড়ির গ্রামে গেলাম। চারদিক নোংরা। ঘিনঘিনে পরিবেশ। কাঁচা মাটির দেওয়াল, কাঁচা ড্রেন। পাশে আমবাগান। পুকুর। তার পাশে শুয়োর শুয়ে আছে।
বুড়ির সেই জীবিত ছেলে গরু নিয়ে জঙ্গলের দিকে গিয়েছিল। আমরা অপেক্ষা করলাম। সে ফিরে এলে সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা অন করে, গলার কালো সুতোর মালায় ল্যাপেল লাগিয়ে রেডি।
ছেলে নির্বিকারভাবে বলতে থাকে…
—মা থাকত ওইদিকের ঘরে। সেদিন রাতে আমার বাচ্চাটা মার কাছে ছিল। অনেক লোক এল বাড়িতে। আমার বাচ্চাটাকে ছুড়ে ফেলে দিল। মাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। মাটাকে পুড়িয়ে মারল। আমি পালায় বাঁচলাম। ওখান থেকে চলে আসি এই গ্রামে। ওই বাড়ি আর যাই নাই।
—বাড়িটা কী হল?
—জানি না। পঞ্চায়েত নিসে বোধহয়।
সেদিন আরও কয়েকঘর ঘুরিয়ে আনল শান্তিদা।
কেউ বলছে, মা-কে মেরে বাড়ির পুকুরের পাশে ঝোপে ফেলে দিয়েছিল।
কেউ বলছে, ভাই মারা যাওয়ার পর বিধবা বউটাকে ডাইনি বলে ন্যাংটা করে রাস্তায় হাঁটিয়েছিল। তারপর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওর দুটো স্তন ছিঁড়ে ফেলে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মেয়েটি মারা যায়।
কোথাও শুনলাম এক অল্পবয়সী সাঁওতাল মহিলা, সদ্য স্বামীহারা, তিনকুলে কেউ নেই, শুধু জঙ্গলের পাশে কিছুটা জমির উপর বসতবাড়িটুকু। মহিলা শোকে প্রায় অপ্রকৃতিস্থ, সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকত তিন বছরের শিশুটিকে নিয়ে। বাচ্চাটির মাথায়, চাঁদিতে, জংলি পোকার কামড়ে ঘা হয়ে যায়। মহিলা সারাদিন ঘরে বসে মদ খেত, আর মদের সঙ্গে চাট হিসেবে শিশুটির মাথার সেই দগদগে ঘা থেকে ঘিলু খুঁটে খুঁটে খেত।
গ্রামের লোক মহিলাটির চিকিৎসার ব্যবস্থা কিংবা বাচ্চাটিকে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা— এসব কিছুই করেনি। সোজা এক খাপ বসিয়ে মহিলা-সহ শিশুটিকেও পুড়িয়ে মারে।
আর বসতজমিটা হয়ে যায় জবরদখল।
এসব নিয়ে কোনও খবর নেই, শহুরে শোরগোল নেই, মোমবাতি মিছিল কিংবা ফেসবুকীয় বিপ্লবও জোটে না এদের ভাগ্যে।
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।”
হোটেলে ফিরে আমরা ভাবি ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো। খাপ এখানে আছে। বেশ ভালোভাবেই আছে। আমরা শুটিং করতে করতে খাপে খাপ না হলেই হল আর কী!
পরদিন মালদা শহরে সারাদিন ঘুরে ঘুরে নানা লোকের সঙ্গে কথা বললাম।
ভারতবর্ষের আর পাঁচটা শহরের মতোই। মহিলারা একটু ব্যাকফুটে, আর কী। উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গের সব কটি শহর-মফস্বল-গ্রামে এই ফর্মেশন দেখা যায়।
নর্থ-ইস্টের দিকে গেলে দেখা যায় আবার মহিলা-প্রধান সমাজ। আসামের কামাখ্যা থেকে নাগাল্যান্ড, মিজোরাম— এই অঞ্চলগুলোর শহর বা পাহাড়ি এলাকায় মহিলারাই ডাইনিবিদ্যার চর্চা করে থাকেন। পুরুষদের সাহস নেই এর বিরুদ্ধে কথা বলে। আবার ডাইনি সন্দেহে হত্যাও খবরে আসে মাঝেসাঝে।
রাতে খেয়ে-দেয়ে আমরা জনা চারেক রওনা দিলাম হোপনা বাস্কের ঝাড়ফুঁকের ডেরার দিকে।
গভীর রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুধু গাড়ির হেডলাইট। আকাশ অন্ধকার, বৃষ্টি নামব-নামব ভাব। মাটির রাস্তায় সোঁদা ঠান্ডা গন্ধ উঠে আসছে।
হোপনার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রবল বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করল। আলোয় আলো হয়ে যাচ্ছে চারদিক। আমাদের ক্যামেরা রানিং।
জানগুরু হোপনা বাস্কে বাড়িতে নেই।
অনেক ডাকাডাকির পর ওঁর এক স্ত্রী জানলা দিয়ে মুখ বের করে বোধহয় আমাদের চিনতে পেরেই, দাঁড়াতে বললেন।
একটা বাচ্চা ছেলে বেরিয়ে এসে আমাদের নিয়ে চলল হোপনার ডেরায়।
পদ্মপর্ণা একা মেয়ে আমাদের দলে। ফিসফিস করে এসে আমার কানের সামনে বলে গেল, “আমাদের এখানে মেরে পুঁতে ফেললে কাকপক্ষীতেও টের পাবে না।”
আমি বললাম, “খামোখা মারা-কাটার কথা আসছেই বা কেন!”
দুপাশে জলা জমি, ঝোপঝাড়, মাঝে সরু মাটির রাস্তা। পেছনে বিচ্ছিরি অন্ধকার জঙ্গল। শেয়াল ডাকছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে শেয়াল বলে কিছু যে বাস্তবে এক্সিস্ট করে, সেটাই ভুলে গেছিলাম।
অনেক দূর যাওয়ার পর একটা গ্রাম্য মাটির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। তার পাশেই জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। গেট খুলতেই বিরাট উঠোন। চারদিকে হ্যালোজেন জ্বলছে। আলোয় আলো। উঠোনের মাঝে বেশ কয়েকজন মহিলা বসে বসে নেশাগ্রস্তের মতো ঝিমোচ্ছে। তার এক দিকে একটা একচালা খড়ের ঘরের ভেতর এক অদ্ভুতদর্শন দেবতার পুজো করা হচ্ছে। ঘরের বাইরে প্রচুর পদ্মফুল ডাঁটি-সমেত সাজিয়ে রাখা।
স্থানীয় শান্তিদা ঢোক গিলে বলল, “ইয়ে, আপনি যাবেন?”
আমি ততক্ষণে ক্যামেরা হাতে ভেতরে ঢুকে পড়েছি। অদ্ভুতভাবে কারও মুখে কোনও কথা নেই। কেউ আপত্তিও করল না। নেশায় বুঁদ পুরো গ্রাম।
হঠাৎ একজন মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত সুরে কী সব বলতে শুরু করল।
শান্তিদা দূর থেকে ইশারায় ক্যামেরা বন্ধ করতে বলছে। আমার ক্যামেরা চলছে। গেটের বাইরে অন্য ক্যামেরায় পদ্মপর্ণা।
শেয়ালের ডাক, বিদ্যুতের চমক— এসবও চলছে। আমি ভাবছি, স্বপ্ন দেখছি নাকি রে বাবা!
তারপর শুরু হল ঝাড়ফুঁক। সঙ্গে প্রচলিত হিন্দি গানের মিউজিক বাজতে শুরু করল। হঠাৎ দেখি, সবাই উত্তেজিত হয়ে উঠল। হাত উপরে তুলে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল। একটি ১৯-২০ বছরের আদিবাসী মেয়েকে ধরে ধরে নিয়ে গেল ওই ছপড়ার ঘরের ভেতর। মেয়েটি টলতে টলতে যাচ্ছে।
পদ্মপর্ণা সটান ক্যামেরা বন্ধ করে দেখি ব্যাগে ঢোকাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে উঠোনের মাঝে।
উঠোনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা শান্তিদা আর ড্রাইভার অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমাকে হাত নাড়িয়ে ইশারায় ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে বলছে।
আমি মেয়েটির দিকে ক্যামেরা তাক করতেই একজন পুরোহিত টাইপের লোক আমায় হাত তুলে ইশারায় নিষেধ করল। পরিস্থিতি ক্রমে ঘোরালো হয়ে যাচ্ছে দেখে, আমি আর দেরি না করে জোরে জোরে পা ফেলে উঠোন পার হয়ে রীতিমতো দৌড় দিলাম গাড়ির দিকে।
…সেই ফুটেজ, আজও ল্যাপটপে বসে দেখি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
মধ্যরাতে গাড়িতে বসে মনে হল— পুরুষদের পোশাক পরে ধর্মনিন্দা করা, ‘পৈশাচিক দর্শন’ অনুসরণ করা, এবং, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গির্জার বিচারের কাছে বৈপ্লবিক বক্তব্য ও যাবতীয় কাজ জমা দিতে অস্বীকার করেছিল ১৯ বছরের মেয়েটি। ১৪৩১ সালের ৩০ মে পুড়িয়ে মারা হয় ফ্রান্সের সেই ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ, জোয়ান অফ আর্ককে।
পৃথিবীর সভ্যতম, নাকউঁচু জাতির ইতিহাসে লেখা আছে নারীর মাথা উঁচু করে পথ চলার পথে বারবার চলে আসা কলঙ্কময় বাধাগুলো।
এই আদিবাসী মেয়েটির ইতিহাস, বর্তমান— কিছুই জানি না। তবু মনটা খারাপ হয়ে গেল।
আমি আর পদ্মপর্ণা পরদিন বিকেলে গিয়েছিলাম জহুরা কালীবাড়ি-সংলগ্ন গ্রামে। সেদিন অভিরূপ, আমাদের সহ-পরিচালক, ওর সদ্য কেনা আইফোন নিয়ে চলে এসেছিল জলপাইগুড়ি থেকে।
জহুরা কালীবাড়ি শহর থেকে বেশ দূরে, আমবাগানের মধ্যে দুর্দান্ত, অতি প্রাচীন এক কালীমন্দির। এর পাশেই এক গ্রাম, যেখানে নাকি কয়েকঘর ডাইনি আছেন।
যাওয়ার আগে বেশ কয়েকজনের যোগাযোগ নম্বর জোগাড় করে ফোন করেছিলাম। কিন্তু ডাইনি নিয়ে কাজ করছি শুনে কেউই সামনাসামনি আসেননি। অগত্যা, আমরাই ক্যামেরা নিয়ে ছুটছি। গতরাতের অভিজ্ঞতার পর আবার ডাইনি এনকাউন্টার করতে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল।
সব মাটির ঘর। কাঁচা-পাকা রাস্তা। পাতলা হয়ে আসা আমবাগান। রাস্তার পাশে প্রচুর জানা-অজানা দেব-দেবীর মূর্তি রাখা।
গ্রামে ঘুরে ঘুরে অভিরূপ সাহস করে জিজ্ঞেস করতে লাগল, “এখানে কেউ ডাইনি আছেন? শুনেছি এখানে ডাইনি সন্দেহে খুন-টুন…”
মিনিট পাঁচেকও গেল না।
আমরা গ্রামের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে। আর চারদিক ঘিরে প্রায় ৩০–৪০ জন গ্রামবাসী।
কিছুতেই বের হতে দেবে না। কথাও শোনে না। ক্যামেরা-ট্যামেরার পাতাল প্রবেশ হয়ে গেছে। এখন নিজেদের প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে পারলে হয়!
লোকজন কটমট করে তাকিয়ে আছে। আর আমরা একটু আমতা আমতা করলেই বলে— ক্যামেরা করছেন, মানে খবর দিবেন আমাদের গ্রাম নিয়ে। সে হতে দিব না! কোনও ডাইনি নাই। এসব ভুল খবর ছড়াবেন না।
যতই বলি— আমরা খবরের লোক নই— বিশ্বাসই করে না।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, একেবারে বোকার মতো। শেষমেশ, অনেকক্ষণ পর বোধহয় আমাদের শান্তশিষ্ট ব্যবহার দেখে ওরাই খানিক বোর হয়ে যায়। পদ্মপর্ণা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, প্রায় বাবা বাঁচা বলে ধীরে ধীরে আমাদের নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে আসে।
একটা টোটো চেপে ফিরছি। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। রাস্তায় সব্বাই আমাদের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে।
আমাদের ছবির প্রযোজক সুতপাদি এই হঠাৎ-অ্যাডভেঞ্চারের বৃত্তান্ত শুনে এই মারে, কি সেই মারে!
এর পরের পর্ব খুব সংক্ষিপ্ত।
মালদা শহরের এক অ্যাপার্টমেন্টে আমাদের তিনজনকে ডেকে ঠান্ডাভাবে জানানো হল— এই কাজটা যেন আমরা আর না করি। অর্থাৎ, ডাইনি নিয়ে তথ্যচিত্রের শ্যুটিং বন্ধ করে কলকাতায় ফিরে যাই।
এই কথাগুলি কারা বলেছিলেন, সে বলার সাহস আমার নেই।
সুতপা সাহা— আমাদের প্রযোজক, দিদি— তিনিও এরপর একা আর সাহস পেলেন না এগোতে। আমাদের বাড়িতে ডেকে, খাইয়ে-দাইয়ে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বললেন এখানেই থেমে যেতে।
অগত্যা, আমাদের ডাইনি পর্ব এখানেই ইতি টানতে হল। আমরা রাতের ট্রেনেই ফিরে যাই কলকাতা।
*সমস্ত ছবি লেখকের তোলা

