Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘রাতে শিশুরা আমাকে তাড়া করে’— যে প্রতিবাদ ইজরায়েলিদের গাজায় নিহত শিশুদের মুখোমুখি করছে

নির হাসোন

 


ভিডিও ও সাক্ষ্যগুলোতে তার এক্সপোজারের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে রোনেন নিজেকে ‘সেকেন্ডারি ট্রমা’-তে আক্রান্ত বলে মনে করেন। তিনি লক্ষণগুলো বর্ণনা করে বলেন, “আমার ঘুমের সমস্যা আছে, সহজে রেগে যাই, হতাশা অনুভব করি, শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা আছে। আমি শিশুদের স্বপ্ন দেখি, তারা রাতে আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।”

 

গাজার এক তরুণ মেয়ে রাশা আল-আরির। গত বছরের জুনে নিজের বাড়িতে বোমাহামলা থেকে সে বেঁচে গিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে সে লাল কালি দিয়ে একটি শেষ ইচ্ছাপত্র লিখেছিল যা সে নিজের পকেটে রাখত। লিখেছিল:

“আমার জন্য কেঁদো না, তোমাদের চোখের জল আমাকে কষ্ট দেয়। আমার জামাকাপড় গরিবদের দিয়ে দিও, আমার পুঁতির বাক্স, পকেটমানি, বই, খেলনা সব জিনিসপত্র আমার তুতো ভাইবোনদের মধ্যে ভাগ করে দিও। দয়া করে আমার ভাই আহমেদকে বোকো না। আশা করি, তোমরা আমার ইচ্ছাকে সম্মান করবে।”

৩০ সেপ্টেম্বর, তাদের বাড়িতে আবার বোমা পড়ে। রাশা ও আহমেদ দুজনেই নিহত হয়। রাশার বয়স ছিল ১০, আহমেদের ১১। তাদের পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছরের রাশা এই তালিকায় ১০,২২৮ নম্বরে। অর্থাৎ তার আগে ১০,২২৭ জন শিশু এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে।

১৫ বছর ধরে সন্তানধারণের চিকিৎসা করার পর মোহাম্মদ হামাদার জন্ম হয়েছিল। তিন বছর বয়সে ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর হামলায় সে মারাত্মকভাবে আহত হয়। সেদিনই প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, তার বাবা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দৌড়াচ্ছেন, মোহাম্মদকে কোলে নিয়ে প্রাণভিক্ষা করছেন। কয়েক দিন পর মোহাম্মদ মারা যায়। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, তার বাবা সন্তানের মরদেহ আঁকড়ে কাঁদছেন, তারপর তাকে সমাহিত করছেন।

গত মাসে ইরানের তাবরিজ শহরে ইজরায়েলি বোমায় ৭ বছরের তাহা বেহরুজি নিহত হয়; দক্ষিণ লেবাননের ইমান ও তালিয়া নাসের নামের দুই বোনও বিমান হামলায় মারা যায়। নাস্তিয়া বুরিক, ৭ বছরের মেয়ে, জন্ম ইউক্রেনে। সে ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বাট ইয়ামে নিহত হয়। সে ইজরায়েলে এসেছিল লিউকোমিয়ার চিকিৎসা করাতে— কিন্তু তার মা, দিদিমা, ভাই ও মাসির সঙ্গে সেও নিহত হয়। হামাস যোদ্ধাদের গুলিতে ৮ বছরের আলিন কাপশেতার ও তার ৫ বছরের ভাই এতান ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সকালে বাড়ি ফেরার পথে দিমোনায় মারা যায়।

এই সব শিশুদের একত্রে স্মরণ করেছে হিব্রু ভাষার ওয়েবসাইট ‘ফোর্সিবলি ইনভলভড’। জাতীয়তা-নির্বিশেষে ৭ অক্টোবর থেকে নিহত সমস্ত ‘যুদ্ধবিহীন’ শিশুদের স্মৃতি সেখানে সংরক্ষণ করা হয়। তাতে চোখ রাখলে বোঝা যায়, যে দুঃস্বপ্নের মধ্যে বাস করছি, তাকে আমরা কীভাবে উপেক্ষা করার চেষ্টা করছি। গাজা উপত্যকার হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে মৃত, সবচেয়ে বেশি ফিলিস্তিনি, এছাড়াও রয়েছে ইজরায়েলি, লেবানিজ, ইরানি।

ফোর্সিবলি ইনভলভড-এর প্রতিষ্ঠাতা ৫৯ বছর বয়সী আদি রোনেন আর্গভ কেন্দ্রীয় ইজরায়েলের এক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং ট্রমা থেরাপি বিশেষজ্ঞ। গত দু-বছরে তিনি হিব্রু ভাষায় গাজার মৃত্যু ও কষ্টের সবচেয়ে বড় পদ্ধতিগত নথিভুক্তকারী হয়ে উঠেছেন।

রোনেন বলেন, তিনি সবসময়ই সরকারের নীতি, দখল করা অঞ্চল এবং গাজায় সামরিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত ছিলেন। অনেকের মতো তিনিও মাঝেমাঝে কোনও বিক্ষোভে অংশ নিয়ে নিজের বিবেককে শান্ত করতেন। তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়— ২০২০ সালের ১৪ জুলাই জেরুজালেমের বালফোর স্ট্রিটে (যেখানে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন রয়েছে) বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘বাস্টিল অফ দি নাইট’-এর বিক্ষোভে অংশ নিয়ে। বিক্ষোভকারীরা সেইদিনই প্রথম পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ জলকামান ও অশ্বারোহী বাহিনী মোতায়েন করে। রোনেন সেখানে ছিলেন। এরপর তাঁর জীবন আর আগের মতো থাকেনি।

তিনি বলেন, ‘ওটা ছিল এক চিৎকার, যা কর্মে রূপ নিয়েছিল। আমি সবকিছুতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।’ পরের কয়েক সপ্তাহে, বিক্ষোভ আন্দোলন বালফোর স্ট্রিটের বাসিন্দাদের উপর কোনও প্রভাব ফেলতে না পারলে, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে নতুন এক প্রবণতা দেখা দেয়। কয়েক ডজন মানুষ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে দখলবিরোধী ও ইজরায়েলের আরব জনগোষ্ঠীর ওপর বৈষম্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন। রোনেন আরগভ এই দলে যোগ দেন এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে কার্যক্রম শুরু করেন।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি গালিলের উম্ম আল-ফাহম শহরে আরবসমাজে বেড়ে চলা হত্যাকাণ্ড দমনে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে বিক্ষোভে অংশ নেন। সেখানকার পুলিশের হিংসা তিনি ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করেন। তিনি বলেন, ‘সেই প্রথম আমি ফেসবুক লাইভ ব্যবহার করি।’ সেই ভিডিও ভাইরাল হয় এবং তিনি বুঝতে পারেন, একজন সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসাবে নিজের কণ্ঠ ব্যবহার করা তাঁর দায়িত্ব।

এরপর তিনি ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও পূর্ব জেরুজালেমের বিক্ষোভে অংশ নিতে থাকেন, নথি ও তথ্য সংগ্রহ করেন। এর পরিণতিতে ‘দ্য ডেইলি ফাইল’ নামে একটি ওয়েবসাইট চালু হয়, যেখানে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজায় ইজরায়েলি অভিযান, নিহতদের তালিকা, বসতি স্থাপনকারীদের হামলা সবকিছু নথিভুক্ত করা হয়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি গাজার পরিস্থিতি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। ২০২৫ সালের ১৫ জুলাইয়ের রিপোর্টে রয়েছে: গত ২৪ ঘণ্টায় নিহত ৯৩, আহত ২৭৮— এর সঙ্গে রয়েছে শিশুদের মৃতদেহ, বোমাবিধ্বস্ত ভবন, খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের পাশে গুলিবর্ষণ থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষের দৃশ্য।

রোনেন বলেন, “আমি দৃশ্যগুলো সুন্দর করে উপস্থাপন করতে চাই না। এসব করুণা জাগানোর জন্য নয়, বাস্তবতা যেমন আছে তেমন দেখানোর জন্য।”

ইজরায়েলি মূলধারার মিডিয়ার বিপরীতে, তার সাইট প্রতিদিনের ভয়াবহতা লিপিবদ্ধ করে। অনেক সাংবাদিক দাবি করেন, জনগণ দেখতে চায় না বলে গাজার ছবি প্রচার করা হয় না— যা রোনেনের ভাষায়  ‘অহঙ্কার’ ও ‘লজ্জাজনক’।

২০২৪ সালে তিনি আরেকজনকে নিয়ে ‘ফোর্সিবলি ইনভলভড’ প্রকল্প শুরু করেন, যাতে ইজরায়েল, প্যালেস্তাইন ও অন্যত্র নিহত শিশুদের ছবি ও নাম প্রকাশ করা হয়। গাজার জায়েন উরুক নামের এক ছেলেকে নিয়ে শুরু এই প্রচেষ্টা এখন শত শত শিশুর স্মৃতিফলক।

২০২৫ সালের মার্চে রাতের বোমাবর্ষণে ইজরায়েলের শত শত নারী ও শিশু নিহত হওয়ার পর, সেই ছবিগুলো রাস্তার বিক্ষোভে নিয়ে আসা হয়। তেল আভিভের কপলান স্ট্রিটে সাপ্তাহিক বিক্ষোভে তারা নিহত শিশুদের ছবি নিয়ে দাঁড়ান। প্রথমে ১০-২০ জন নারী ছিলেন, সংখ্যাটি দ্রুত বাড়ে।

কিছু কর্মী ছবিগুলো বিমানবাহিনীর ঘাঁটির সামনে নিয়ে যেতে শুরু করেন, যেন পাইলটরা নিজেদের কর্মের ফল দেখতে পান। কখনও কখনও অফিসাররা তাদের তাড়িয়ে দিতে বা পুলিশ ডাকতে চেষ্টা করলেও অনেক সময় তাদের সঙ্গে কথাও হয়।

রোনেন আর্গভ মনে করেন, গাজার গণহত্যা নিয়ে ইজরায়েলি সমাজে দ্রুত পরিবর্তন সম্ভব নয়। “আমরা দীর্ঘস্থায়ী ট্রমার মধ্যে আছি, আর এই সময় মানুষ সাদা-কালোর সরল দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিরে যায়। জটিল সহমর্মিতা তখন ধরে রাখা কঠিন।”

তিনি নিজেকে— অনিদ্রা, রাগ, হতাশা, শব্দে সংবেদনশীলতা, শিশুদের নিয়ে দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি লক্ষণ নিয়ে একরকম ট্রমা-আক্রান্ত হিসাবে দেখেন। ঘৃণাসুলভ মন্তব্যের জন্য তিনি সামাজিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

প্রথম দেড় বছর তিনি ‘গণহত্যা’ শব্দ ব্যবহার করতে দ্বিধায় ছিলেন, কিন্তু ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ শত শত নারী ও শিশু নিহত হওয়ার পর তিনি নিশ্চিত হন— “তা শুধু সংখ্যা নয়, তা এক সুসংগঠিত পদ্ধতি, যা রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের ঘোষণার পাশাপাশি তাদের কার্যকলাপ থেকেও স্পষ্ট।”

তিনি এও দেখেছেন যে, মৃত্যুর পর সনাক্ত করার জন্য গাজার বাবা-মায়েরা সন্তানের শরীরে নাম লিখে দিচ্ছেন। এই দৃশ্য ও জিনা আজ্জামের কবিতা ‘রাইট মাই নেম’ তাঁর মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে।

আমি এমন একটি ছবি কল্পনা করি— চাদরের নিচে শায়িত মৃত শিশুর দল, তাদের পায়ে লেখা রয়েছে নাম। আমি কীভাবে এই দৃশ্য ভুলব?

(বাকি অংশে তাঁর কর্মপদ্ধতি, প্রতিবাদের ইতিহাস, উম্ম আল-ফাহমের আন্দোলন, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে দলিল সংরক্ষণ, শেখ জাররাহতে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ, এবং ‘দ্য ডেইলি ফাইল’ নামে সাইট তৈরির কথা বলা হয়েছে— যেখানে প্রতিদিনের প্রাণহানি, হামলা, ধ্বংসযজ্ঞের সঠিক বিবরণ প্রকাশিত হয়, যা মূলধারার ইজরায়েলি গণমাধ্যমে সচরাচর দেখানো হয় না।)

তিনি বলেন, “আমি মানুষকে বোঝানোর জন্য কাজ করি না। আমার সাইটে প্রবেশ করা একটি সিদ্ধান্ত— আমি বাস্তবতাকে সুন্দর করে দেখাব না।”

তাঁর ভিডিওতে দেখা যায় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দিকে টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে এবং ‘স্কাঙ্ক ওয়াটার’ ছিটাচ্ছে। ভিডিওটি ভাইরাল হয়। তিনি বলেন, “আমি বুঝেছিলাম, একজন সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ হিসাবে আমার কণ্ঠ ব্যবহার করার দায়িত্ব রয়েছে। উম্ম আল-ফাহমে তারা আমাকে বলেছিল, ‘আপনাকে তারা বিশ্বাস করবে, কিন্তু আমাদের করবে না।” তখনই আমার মনে হয়েছিল, গল্পটা আমাকেই বলতে হবে। আমি নথিভুক্ত করার প্রভাব দেখেছি। এক সপ্তাহ পরে হাজার হাজার ইহুদি ইজরায়েলি উম্ম আল-ফাহমকে সমর্থন জানাতে বেরিয়ে আসে। তার পরের সপ্তাহে তারা আর আসেনি, কিন্তু আমি এখনও মনে করি এর প্রভাব ছিল।”

পরের ধাপে, রোনেন ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে তাঁর নথিভুক্তকরণ কার্যক্রম বিস্তৃত করেন। “আমি (প্যালেস্তিনীয়) রাখালদের কিছুটা সঙ্গ দিতাম, এবং প্রায়শই বিটা শহরের বিক্ষোভে অংশ নিতাম, যেখানকার জমিতে এভিয়াতার নামে এক বসতি স্থাপন করা হয়েছে। আমি পাশে দাঁড়াতাম, টিয়ার গ্যাসে শ্বাস নিতাম, এবং দেখতাম সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে পাথর হাতে থাকা শিশুদের মধ্যে কেমন চরম বৈষম্য রয়েছে।”

তিনি বলেন, “পাথরগুলো কখনওই পাহাড়ে থাকা সৈন্যদের কাছে পৌঁছাত না, তবুও তারা টিয়ার গ্যাস, স্টান গ্রেনেড, আর কখনও কখনও গুলি চালায়। মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝখানে এই নিষ্ঠুরতা আমাকে নাড়া দিয়েছিল। পরে আমি শেখ জাররাহ (পূর্ব জেরুজালেম) এর বিক্ষোভেও যেতাম। একবার একটি স্টান গ্রেনেডে আমার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

উম্ম আল-ফাহম ভিডিও এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও পূর্ব জেরুজালেমের অভিজ্ঞতার মিলিত প্রভাব থেকে জন্ম হয় একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের, যেখানে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের ঘটনা আপডেট দেওয়া হত। দুই-আড়াই বছর আগে এই চ্যাটগ্রুপটি এক ওয়েবসাইটের রূপ নেয়, যার নাম ‘দ্য ডেইলি ফাইল’ (হিব্রু ও ইংরেজি), যা দখলের বাস্তবতাকে— হতাহতের সংখ্যা, আইডিএফের অভিযান ও বাড়িঘর ভাঙা, বসতিস্থাপনকারীদের হামলা— নিরবচ্ছিন্নভাবে রেকর্ড করে।

৭ অক্টোবর ২০২৩-এ, রোনেন পশ্চিম তীরে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি প্রকল্পটি ছেড়ে ডেড সি-র এক হোটেলে চলে যান, যেখানে কিবুতজ বেয়েরি থেকে আসা জীবিতরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার পুরনো পেশা— ট্রমায় আক্রান্ত পরিবারগুলোর চিকিৎসা করায় ফিরে যান।

রোনেন বলেন, “বেয়েরিতে আমার দুই বন্ধু আছে, যাদের পরিবারের কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে, একজন নারী অপহৃত হয়েছেন। তাদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আমি গাড়ি চালিয়ে হোটেলে যাই। সেই ভয়াবহতায় আমার হতবাক অবস্থাতেও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বারবার সাহায্যের আহ্বান রেখেছি। আমি বাড়ি ফিরে জোরে গান চালাতাম আর চিৎকার করে কাঁদতাম। আমি পক্ষাঘাতগ্রস্ত রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর ওপর খুব রেগে ছিলাম, কিন্তু ‘বাস্তবতায় ফিরে আসিনি’ বা বিভ্রান্ত হইনি। তা আমাকে প্যালেস্তিনীয় জনগণের ওপর রাগিয়ে তোলেনি।”

পরের কয়েক সপ্তাহে, দ্য ডেইলি ফাইল আবার কাজ শুরু করে, গাজার পরিস্থিতির ওপরও মনোযোগ দেয়। তথ্যগুলো সরাসরি উপস্থাপন করা হয়, পাঠকদের জন্য নির্মম বাস্তবতা লুকানো হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ১৫ জুলাইয়ের প্রতিবেদনের শুরুতেই ছিল ভয়াবহ পরিসংখ্যান— গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৩ জন নিহত, ২৭৮ জন আহত। সেখানে এক ভিডিওয় দেখা যায়, দুই আহত শিশু হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে আছে এবং এক বয়স্ক ব্যক্তি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন কী ঘটেছিল।

রিপোর্টে গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে বোমাহামলার ফুটেজ এবং তথ্য ছিল:

নাসার পরিবারের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে তিনটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কয়েক দিন আগে ওই বোমাহামলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১২। ওদিকে বোমাহামলায় এক জনসমাবেশে ৯ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৫ জন শিশু, এবং ২৫ জনের বেশি আহত হয়েছে। আল রিমাল— বাস্তুচ্যুতদের তাঁবুতে বোমাহামলা, অনেকে আহত; তেল আল হাওয়া-২এ নম্বর আল আওদা টাওয়ারে (আবাসিক ভবন) বোমাহামলা। জারার আল-কুদরা স্কুল এলাকায় ড্রোনহামলা, একজন নিহত এবং কয়েকজন আহত। আল রাদওয়ান মসজিদের কাছে একটি বাড়িতে বোমাহামলায় চারজন নিহত। বানি সুহেইলার এক চত্বরে ড্রোনহামলায় সাতজন নিহত।

এভাবেই চলতে থাকে— গাজা উপত্যকার এক স্বাভাবিক দিনের মতো।

১৫ জুলাইয়ের রিপোর্টে দ্য ডেইলি ফাইল-এ অন্যান্য ছবিও দেওয়া হয়েছিল— স্থিরচিত্র এবং ভিডিওয় দেখা যায় ছোটদের মৃতদেহ, রক্তমাখা মুখের এক শিশু, বিস্ফোরিত ভবন, আর শত শত মানুষ বালির ওপর হামাগুড়ি দিচ্ছে, খাবার বিতরণকেন্দ্রের কাছে গুলির আক্রমণ থেকে বাঁচতে চেষ্টা করছে।

রোনেন বলেন, “কিছু ভিডিও আমি পোস্ট করি না, যেমন ছিন্নভিন্ন দেহের অংশের দৃশ্য, কিন্তু এই সাইট করুণা জাগানোর জন্য নয়। আমি মনে করি আমরা এমন এক পর্যায়ের হিংসা ও নৃশংসতায় পৌঁছেছি, যেখানে যারা সত্য জানতে চায় না, তাদের জন্য বাস্তবতাকে সুন্দর করে পরিবেশন করা মানে তাদের আসক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো। আমি ভান করতে চাই না। কাউকে বোঝানোর চেষ্টা করছি না। সাইটে প্রবেশ করা মানুষের সিদ্ধান্ত। আমি আশা করি না যে মানুষ প্রতিদিন এতে ঢুকবে, কিন্তু যদি ঢোকে, আমি বাস্তবতাকে সুন্দর করে দেখাব না।”

দ্য ডেইলি ফাইল মূলত ইজরায়েলি গণমাধ্যমের এক উল্টোপিঠের মতো। এই সপ্তাহে ইজরায়েলের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদ সম্প্রচার সাইটে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে যেখানে চ্যানেল ১২ নিউজের সম্পাদক রন ইয়রন ব্যাখ্যা করেছেন কেন গাজায় যা ঘটছে তা টেলিভিশনে দেখানো জরুরি নয়। তিনি বলেন, “এর সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা কঠিন।” আই২৪ নিউজের প্রতিবেদক আভিশাই গ্রিনজেইগ বলেন, “টেলিভিশন চ্যানেলগুলো গাজার ফুটেজ সম্প্রচার করছে না কারণ জনসাধারণ তা দেখতে চায় না।”

রোনেন বলেন, “আমি মনে করি এটা সম্পূর্ণ ঔদ্ধত্য। গণমাধ্যম তার উদ্দেশ্য ভুলে গেছে— এটা লজ্জাজনক। তারা জনগণকে পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে উৎসাহিত করছে না, শুধু তথ্যের স্রোতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। অধিকাংশ ইজরায়েলি গণমাধ্যম তার ভূমিকা পালন করছে না।”

কয়েক সপ্তাহ আগে, তিনি এবং আরও কিছু কর্মী একটি উদ্যোগ শুরু করেন, যার উদ্দেশ্য গণমাধ্যমের সিনিয়র নারী সাংবাদিকদের গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলতে উদ্বুদ্ধ করা। “আমাকে একজন শীর্ষ সাংবাদিকের ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে এক বার্তা পাঠিয়েছিলাম। লিখেছিলাম, আমি সত্যিই প্রশংসা করি যে তিনি নারীদের জন্য কাচের ছাদ ভেঙেছেন। তিনি আমাকে পরিসংখ্যান পাঠাতে বলেন। আমি কিছুদিন তাঁকে তথ্য পাঠালাম, কিন্তু তিনি আর সাড়া দেননি।”

 

দ্বৈত জীবন

এক বছরেরও আগে, রোনেন আরগভ এবং সহকর্মী কর্মী শাউল চেরিকোভার ফোর্সিবলি ইনভলভড নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ইজরায়েল, দখলকৃত অঞ্চল এবং আরও কয়েকটি দেশে নিহত শিশুদের নথিভুক্ত করা। প্রকল্পটি শুরু হয় ১২ বছর বয়সী এক ছেলে, জাইন উরুক-এর গল্প দিয়ে।

২০২৪ সালের এপ্রিলে, জাইনের একটি ছোট ভিডিও পোস্ট করা হয়েছিল যেখানে দেখা যায়, সে আকাশ থেকে ফেলা একটি খাবারের প্যাকেজ নিতে পেরেছে। ভিডিওতে (ইংরেজি সাবটাইটেল ছিল) সে অদৃশ্য এক ক্যামেরাম্যান-সাংবাদিককে আবেগের সঙ্গে এবং হাসিমুখে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে— “দুপুর থেকে চেষ্টা করছিলাম (একটি প্যাকেজ নিতে)… যখন সবাই সাহায্য নিতে ছুটছিল, আমি প্রায় মারা যাচ্ছিলাম।”

কয়েক দিন পর, আরও খাবার সংগ্রহ করার চেষ্টা করার সময় জাইন মারা যায়: একটি সাহায্যের প্যাকেট তার মাথায় পড়লে তার মৃত্যু হয়। কিছুদিন পর, ইজরায়েলি স্ট্যান্ড-আপ কৌতুকাভিনেতা আভি নুসবাউম যাঁরা আকাশ থেকে ফেলা খাবারের প্যাকেটে আঘাত পেয়ে মারা গিয়েছিলেন, গাজার সেইসব মানুষদের উপহাস করেন। তিনি বলেন, “এটা নিয়ে হাসা সুখকর নয়, কিন্তু কল্পনা করুন আজ গাজায় কেউ মারা গেল হেলিকপ্টার থেকে নিক্ষিপ্ত একটি গাইডেড মিসাইলের আঘাতে, আরেকজন মারা গেল তার মাথায় পড়া একটি ভুট্টার ক্যানের আঘাতে।” শ্রোতারা শুনে হাসাহাসি করে।

রোনেন জানান, “জাইনের হাসি, তার লাজুক চোখে এমন কিছু ছিল যা আমাকে স্পর্শ করেছিল, আমি মনে করি কৌতুকাভিনেতা অজ্ঞতার জন্য ওইসব বলছিল।”

ছেলেটির মৃত্যুর কয়েক দিন পর, গত বছর, তিনি এবং অন্যান্য কর্মীরা তেল আভিভের হাবিমা স্কোয়ারে গাজার নিহত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের (১৮ বছরের কম) ছবি নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন, যেখানে লেখা ছিল ‘ফোর্সিবলি ইনভলভড’।

সেই সময়ে, প্যালেস্তিনীয় সাংবাদিক তামের আলমিশাল গাজার অভিভাবকদের কাছে তাঁদের নিহত সন্তানদের ছবি পাঠাতে আহ্বান জানান। তিনি শত শত ছবি ও নাম পেয়েছিলেন। বেশিরভাগ শিশুদের ছবি ছিল উৎসবের পোশাকে, ক্যামেরার জন্য পোজ দেওয়া। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে, রোনেন ও তার সহকর্মীরা নিয়মিত নিহত শিশুদের ছবি ও নাম পোস্ট করা শুরু করেন।

তিনি বলেন, “মানুষ ভাবে আমি শুধু প্যালেস্তিনীয়দের ছবি পোস্ট করি, কিন্তু এটা সত্যি নয়। ইজরায়েলি, লেবানিজ, ইরানিরাও আছে।” তিনি আরও যোগ করেন, “অদ্ভুত প্রতিক্রিয়াও এসেছে: তারা খুব মিষ্টি, দেখতে তো প্যালেস্তিনীয়দের মতো নয়। কিন্তু আসল উদ্দেশ্যই তো সেটি— মানুষ হিসাবে তুলে ধরা।”

এভাবেই তৈরি হয় “এক প্রকল্প যা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে জাতীয়তার ভেদাভেদ ছাড়াই সীমান্তের দুইপক্ষের নিহত শিশুদের নাম সংরক্ষণ করে, এবং বিশ্বাস করে যে প্রতিটি শিশুর একটি নাম আছে, একটি জীবন ছিল আর পুরণ না হওয়া স্বপ্ন ছিল,” যেমন ফোর্সিবলি ইনভলভড ওয়েবসাইটে লেখা আছে।

শিশুদের ছবির সঙ্গে অল্প বাক্য এবং তথ্য যুক্ত থাকে, যেমন— ‘সে এখানে ছিল, কিন্তু আর নেই’; মিস্ক আল-শরিফ, ১ বছর বয়স, ‘তার গর্ভবতী মায়ের সঙ্গে বাস্তুচ্যুতদের ক্যাম্পে নিহত’; মুহাম্মদ আজিজ ফাদেল, ‘খাবার নিতে গিয়ে নিহত’; ‘জুরি আল-মাসরি, ৩ মাস বয়স, ‘ছিল কিন্তু আর নেই। উপযুক্ত দুধের অভাবে অপুষ্টি ও জলশূন্যতায় মারা গেছে। গাজা, ২৭ জুন ২০২৫’।

গত সপ্তাহে, নিউ ইজরায়েল ফান্ড ঘোষণা করে যে রোনেন আরগভ এই বছরের ট্রুথ টু পাওয়ার পুরস্কারপ্রাপক, যা এমন কাউকে দেওয়া হয় ‘যিনি ক্ষমতার কাঠামোর বিরুদ্ধে নির্ভয়ে ও প্রকাশ্যে অবস্থান নেন।’ ১ লক্ষ শেকেল (প্রায় ৩০,০০০ ডলার) মূল্যের এই পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তিনি তাঁর সাইট উন্নত ও ব্যবহারবান্ধব করবেন বলে জানিয়েছেন।

 

২৩ মার্চ থেকে শুরু

ইজরায়েল হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে এক রাতে শত শত গাজাবাসী শিশু ও নারীকে হত্যা করার প্রায় এক সপ্তাহ পর, ২৩ মার্চ থেকে ছবিগুলো ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বাস্তব জগতে চলে আসে— আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায়। কর্মীরা নিহত শিশুদের পোস্টার হাতে তুলে ধরে তেল আভিভের কাপলান স্ট্রিটে এসে দাঁড়ান, যখন সাপ্তাহিক বন্দি প্রত্যাবর্তনের দাবিতে হাবিমা স্কোয়ার থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দফতর কিরিয়ার দিকে যাওয়া মিছিল পাশ দিয়ে যাচ্ছিল।

“আমরা ছিলাম ১০ থেকে ২০ জন নারীকর্মী, আর আমরা গালাগাল ও বিরোধিতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয়, গালাগাল ছিল খুব কম— মানুষ মূলত আগ্রহ দেখিয়েছিল,” রোনেন বলেন, চলমান শিশু-প্রতিবাদের আয়োজকদের একজন আলমা বেক। “মানুষ বেশিরভাগই বুঝতে পারছিল না, আমাদের জিজ্ঞেস করছিল, এতগুলো শিশু?” আমাদের ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল যে বাস্তবের তুলনায় এ কিছুই নয়। কিছু মানুষ বিস্মিত হয়েছিল, কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে চেয়েছিল।

পরের সপ্তাহে আমরা ১০০টা ছবি ছাপিয়েছিলাম। যারা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন, সবগুলোই নিয়ে নিয়েছিল। তারপর আমরা ৩০০টা ছবি ছাপাই, আবারও সব ছবি নিয়ে নেয়, প্রদর্শনকারীদের সারি আরও বড় হয়েছিল। আমরা অনুভব করেছিলাম, একটা প্রাচীর ভাঙতে সক্ষম হচ্ছি।

রোনেন একমত যে গাজার ঘটনাবলির প্রতি ইজরায়েলি জনমতের দৃষ্টিভঙ্গিতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে। “শিশুদের পক্ষে নীরব প্রতিবাদের চিহ্ন ধরে রাখতে মানুষকে রাজি করানো এখন সহজ হচ্ছে, আরও মানুষ বিষয়টিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমার মনে হয় অনাহারের গল্প মানুষকে বেশি নাড়া দেয়।”

রেহোভটের ইয়ালি মেরোম এবং তার সঙ্গী মায়ান ডাক এই প্রতিবাদকে নিয়ে গেছেন বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে। মেরোম বলেন, “আমরা রেহোভটে থাকি, বিমানের ছাড়ার শব্দ শুনি, আর ভাবি এবার তারা কাকে হত্যা করতে যাচ্ছে।” “ঠিক করলাম নিচ থেকে চিৎকার না করে ছবিগুলো ঘাঁটির কাছে নিয়ে যাব। আমরা ঘাঁটির প্রবেশপথে শিশুদের ছবি নিয়ে দাঁড়াই। আমরা ‘খুনি’ বলে চিৎকার করি না, গালিও দিই না, আমরা শুধু চাই তারা তাদের কাজের ফলাফল দেখুক।”

এই প্রতিবাদগুলো সাধারণত শান্তিপূর্ণভাবেই হয়, যদিও মাঝেমাঝে ঘাঁটির উচ্চপদস্থ কর্তারা বিক্ষোভকারীদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছেন এবং পুলিশ ডেকেছেন। মেরোম যোগ করেন, “তবে কখনও কখনও তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলেন।” “একজন স্কোয়াড্রন কমান্ডার জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি কোনও পাইলট গাজায় বোমা না ফেলার সিদ্ধান্ত নেন তবে কী হবে। আমরা তাকে বলেছিলাম, পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে ভালো হবে।”

গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞ নিয়ে জনমতের ফাটল সত্ত্বেও, রোনেন মনে করেন ইজরায়েলি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাস্তবে শিগগির কোনও পরিবর্তন আসবে না। তিনি বলেন, “আমরা দীর্ঘমেয়াদি ট্রমার মধ্যে আছি, আর এই সময় মানুষ খুব সরল সাদা-কালো দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিরে যায়। জটিলতা বোঝার সুযোগ থাকে না, সহমর্মিতা সাধারণত বেশ জটিল।”

তিনি খুবই হতাশ সমাজের সেই ক্ষমতা নিয়ে, যা তার নিজের নামে সংঘটিত নৃশংসতার মুখোমুখি হতে পারে:

আমার মনে হয় আমরা বিষয়টি বুঝতে পারব কেবল অতীতের দৃষ্টিতে, প্রজন্ম পেরিয়ে, যখন আজকের সৈন্যদের নাতি-নাতনিরা জিজ্ঞেস করবে, ‘তখন তুমি কী করেছিলে?’ এখনও এটা ‘জনতার সেনাবাহিনী’, সবাই কোনও না কোনওভাবে একজন সৈন্যের সঙ্গে যুক্ত। তাহলে কি সেই প্রিয় সৈন্য, যে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, একজন যুদ্ধাপরাধী? বিষয়টিতে এখনও বিশাল দ্বন্দ্ব, বড় ফাটল রয়েছে। তাই আপাতত আমি আর্কাইভ তৈরি করছি, যার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। আমার জীবদ্দশায় এই পরিবর্তন হবে না।

ভিডিও ও সাক্ষ্যগুলোতে তার এক্সপোজারের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে রোনেন নিজেকে ‘সেকেন্ডারি ট্রমা’-তে আক্রান্ত বলে মনে করেন। তিনি লক্ষণগুলো বর্ণনা করে বলেন, “আমার ঘুমের সমস্যা আছে, সহজে রেগে যাই, হতাশা অনুভব করি, শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা আছে। আমি শিশুদের স্বপ্ন দেখি, তারা রাতে আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।”

তিনি বর্ণনা করেন, কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ও মন্তব্যকারীদের কাছ থেকে তার দিকে ঘৃণার বন্যা ছুটে আসে:

আমি পড়া বন্ধ করে দিয়েছি এবং কোনও প্রতিক্রিয়া দিই না, এক ধরনের প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মানুষ হিসাবে সত্যিই আমার মানুষের উপর বিশ্বাস ছিল। এখন মানুষকে ঘৃণা করতে শুরু করেছি। আমি অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলি। কোথাও উৎসব, অনুষ্ঠান বা পারিবারিক জমায়েত হলে আমি না যাওয়ার অজুহাত খুঁজি। এক ধরনের দ্বৈত জীবন যাপন করি, যা আমার প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ভাগ করতে পারি না। আমার ভিতরে এমন এক অংশ আছে যা, যারা এসব স্বাভাবিক করে তুলছে তাদের ক্ষমা করতে পারে না।

তিনি স্বীকার করেন যে, যুদ্ধের প্রথম দেড় বছরে, গাজায় যা ঘটছে তাকে ‘গণহত্যা’ বলা নিয়ে তিনি দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু ১৮ মার্চ রাতে ইজরায়েলের মারাত্মক বোমাহামলার পর এই সন্দেহ দূর হয়ে যায়। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ফের হামলা শুরু করেছিল, যেখানে শত শত নারী ও শিশু নিহত হয়।

রোনেন বলেন, “তার পর থেকে আমি এই ধারণার সঙ্গে একমত হয়েছি যে, বিষয়টা শুধু কতজন মারা গেছে তা নয়, যে পদ্ধতিগতভাবে কাজটা করা হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায় যে এখানে (গণহত্যা চালানোর এক উদ্দেশ্য রয়েছে), শুধু রাজনীতিবিদদের বা মাঠের কমান্ডারদের ঘোষণার জন্য নয়, বরং যা কার্যত ঘটছে তার জন্যও।”

কয়েক মাস আগে, তিনি এক মৃত শিশুর ছবি দেখেছিলেন, যার হাতে নাম লেখা ছিল। জানা গেল, বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানের শরীরের অঙ্গে নাম লিখে দিচ্ছেন, যাতে তারা মারা গেলে সনাক্ত করা যায়। সেই সময়েই আমি আরবিতে জেইনা আযযামের ‘গাজা’[1] নামে কবিতাটি পাই, যা এভাবে শেষ হয়েছে:

মা, আমার নাম লিখে দাও আমার পায়ে
কোনও সংখ্যা যোগ কোরো না
যেমন আমার জন্মের দিন বা আমাদের বাড়ির ঠিকানা।
আমি চাই না পৃথিবী আমাকে একটি সংখ্যা হিসাবে তালিকাভুক্ত করুক।
আমার একটা নাম আছে, আমি সংখ্যা নই।
মা, আমার নাম লিখে দাও আমার পায়ে
যখন বোমা আমাদের বাড়িতে পড়বে
যখন দেওয়াল আমাদের মাথা আর হাড় গুঁড়ো করে দেবে
আমাদের পা বলবে আমাদের গল্প—
যে আমাদের কোথাও পালানোর জায়গা ছিল না।

রোনেন বলেন, “আমার মনে একটা ছবি আছে— একসঙ্গে অনেক মৃত শিশু একটা কম্বলের নিচে, আর তাদের পায়ে লেখা রয়েছে নাম। এটা এমন একটা ছবি যা আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না— কীভাবে আমি ভুলব?”

 


[1] ইংরেজি শিরোনাম: রাইট মাই নেম।


*লেখাটি ‘The Children Haunt Me at Night’: The Protest That’s Forcing Israelis to Face Kids Killed in Gaza শিরোনামে হারেজ পত্রিকায় গত ২৭ জুলাই প্রকাশিত