অরুণ কে সিনহা
যদিও ঐতিহাসিকভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বহু গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল—তথাপি এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ-বিরোধী শক্তি হিসেবে কমিউনিস্টদের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। ভারতের প্রায়-অঘোষিত বেআইনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার স্বীকৃ্ত কমিউনিস্ট পার্টির যোগাযোগও সুবিদিত ছিল। এবং ১৯৪৬ সালের নৌবিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিই গৌরবজনক ও দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল। পরে প্রকাশিত প্রায় সমস্ত ঐতিহাসিক দলিল ও গবেষণাপত্রে এই সত্য নির্দ্বিধায় স্বীকৃত হয়েছে যে, বিদ্রোহী রেটিংদের ধর্মঘট ও আত্মত্যাগের পেছনে অকুণ্ঠ রাজনৈতিক সমর্থন এসেছিল কেবলমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি এবং আংশিকভাবে সমাজতন্ত্রীদের তরফ থেকে
পূর্ব প্রকাশিতের পর
২. বোম্বাই, করাচি-সহ ভারতীয় উপমহাদেশের বন্দরে নৌসেনা বিদ্রোহ— ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে জার্মানির কিয়েল বন্দরে নৌসেনা বিদ্রোহ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভারতীয় উপমহাদেশের বোম্বাই ও করাচি-সহ নানা বন্দরে নৌসেনা বিদ্রোহ— প্রথম দৃষ্টিতে এই দুই ঘটনার একসঙ্গে আলোচনা সঙ্গতিপূর্ণ বলে নাই মনে হতে পারে। আলাদা দেশ, ভিন্ন সময়কাল, পৃথক রাজনৈতিক প্রেক্ষিত— শুধু নাবিক বিদ্রোহীদের উপস্থিতির মিল আছে বলেই এদের একসূত্রে গাঁথাটা মুশকিল।
বস্তুত এই প্রশ্নটাই আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রতিক ও আধুনিক বিদ্রোহের আলোচনা ও চর্চার সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করে। যেমন, কিয়েলের নৌবিদ্রোহ জার্মানি তথা ইউরোপে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ইতিহাসচর্চার বিষয়। অন্যদিকে, ১৯৪৬ সালের বোম্বাই-করাচির ভারতীয় নৌসেনা এবং বায়ুসেনার বিদ্রোহ নিয়ে নানা আলোচনা, স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ন থাকলেও, সেই আলোচনায় কিয়েল বা ভিলহেল্মশ্যাফেনের বিদ্রোহের কোনও তুলনামূলক প্রসঙ্গ এমনকি সাম্প্রতিক গবেষণাতেও প্রায় অনুপস্থিত।
রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির (আরআইএন) রেটিং (অর্থাৎ ভারতীয় নাবিক ও নৌসৈনিক)-দের ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারির বিদ্রোহকে সাম্প্রতিক বহু আলোচনা ও বিশ্লেষণে রুশ যুদ্ধজাহাজ Battleship Potemkin-এর বিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করে দেখা হয়েছে। বোম্বাইয়ের HMIS Talwar বা Castle Barrack— যা বর্তমানে মারাঠা নৌসেনা অধিনায়ক কানোজি আংড়ের নামে INS Angre নামে পরিচিত— সেই ঘাঁটির রেটিংদের বিদ্রোহকে অনেকেই বর্ণনা করেছেন “India’s Potemkin Hour”[1] বা “India’s Battleship Potemkin moment”[2] বলে।
এই বাংলাতেও, প্রয়াত উৎপল দত্তের অবিস্মরণীয় প্রযোজনা কল্লোল-এ ‘খাইবার’ যুদ্ধজাহাজের নাবিক বিদ্রোহের মধ্যে ফিরে এসেছে পোটেমকিনের স্মৃতিকল্প। ইতিহাসের বিপরীতে গিয়ে উৎপল দত্ত ‘খাইবার’ জাহাজের নাবিকদের আত্মসমর্পণ নাটকে উপস্থিত করেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, বিদ্রোহী Potemkin আত্মসমর্পণ করেনি, তাই ‘খাইবার’-ও নাটকে তা করবে না।[3] এমনকি, বিদ্রোহের বহু বছর পরে, HMIS Talwar-এর রেটিংদের অন্যতম প্রধান মুখ বলাইচন্দ্র দত্ত (বিসি দত্ত) তাঁর ১৯৭১ সালের স্মৃতিচারণে লেখেন—
আমাদের যুদ্ধজাহাজ পোটেমকিন ছিল, কিন্তু কোনও আইজেনস্টাইন ছিল না।[4]
এই সব বাস্তবতা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নৌসেনা বিদ্রোহ বিষয়ে উপমহাদেশের সাম্প্রতিক বিবরণগুলিতেও আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসচর্চার প্রতি এক গভীর ঔদাসীন্য ও ইতিহাসবোধের অভাব বর্তমান। অথচ এই উপমহাদেশের নাবিক ও নৌসেনাদের মাত্র আট দিনের (১৮-২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬) স্বল্পস্থায়ী বিদ্রোহ এমন এক প্রাবল্যে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল যে, সরকারের অভ্যন্তরীণ চিঠিপত্রে বারংবার ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতি জাগরুক হয়ে উঠেছিল।
এই বিদ্রোহের সঙ্গে সমকালীন কোনও উপমা খুঁজতে গেলে ২৮ বছর আগে সংঘটিত জার্মানির কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহের কথাই মনে পড়ে। এই দুই বিদ্রোহের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল— রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ, অপেশাদার অথচ সংকল্পে দৃঢ় সাধারণ নাবিক শ্রেণির (রেটিংদের) স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। তাদের লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক ও সামরিক ক্ষমতার স্তরবিন্যাসে সরাসরি আঘাত হানা, বিদ্রোহী নাবিকদের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকজনতার একাত্মতা গড়ে তোলা এবং প্রয়োজনে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকা।
অন্যদিকে, এই দুই বিদ্রোহেই অভিজ্ঞ ও কুশলী রাজনীতিকদের উপস্থিতি ছিল পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতাসীন পক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে। তাঁদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বিদ্রোহীদের নিরস্ত করা, তাঁদের মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং শেষপর্যন্ত প্রভাবশালী শাসকশক্তির কাছে বিদ্রোহী নাবিকদের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা।
২ক. উপমহাদেশের নৌবিদ্রোহ সংক্রান্ত বিবিধ আলোচনা
১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নৌবিদ্রোহের পরাজয়ের পর অন্তত ত্রিশ বছর ভারত সরকারের তরফে এক কঠোর, নীরব ও শীতল মনোভাব বজায় রাখা হয়েছিল। বিদ্রোহী নাবিকদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার যে সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ সরকার নিয়েছিল, স্বাধীন ভারতের নবগঠিত সরকারও সেই সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রাখে। বোম্বাই নৌবিদ্রোহের অন্যতম প্রত্যক্ষ নায়ক বিসি দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় এই বিস্ময় ও কষ্ট প্রকাশ করে লিখেছেন—
সংশ্লিষ্ট তিনটি পক্ষই— ব্রিটিশ শাসক, রেটিং এবং জাতীয় নেতারা— তাদের নিজ নিজ স্বার্থে এমন ভাব দেখিয়েছিল যেন আরআইএন-এর বাবুর্চিরাই বিদ্রোহের মুখ্য কারণ। হায় ইতিহাস!
বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পরে বন্দি নাবিকদের বাড়ি ফেরানোর সময় তৃতীয় শ্রেণির একমুখী ট্রেনটিকিটের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল একটি চিরকুট। সেখানে লেখা ছিল— “মহামান্য সম্রাটের সেবা থেকে অসম্মানজনকভাবে বরখাস্ত…।”[5] নৌবিদ্রোহীদের বীরত্বের কোনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আজও স্বাধীন ভারতের তরফে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। বহু পরে, ৪ ডিসেম্বর ২০০১ সালে, বোম্বাইয়ের কোলাবায় কুপারেজে নৌবিদ্রোহের স্মৃতিতে একটি সৌধ উদ্বোধন করা হয়। ভারতের ‘স্বাধীন’ নৌবাহিনীর মুম্বাইভিত্তিক পশ্চিম নৌ-কমান্ডকে নৌবিদ্রোহের স্মরণে ২০২২ সালের ২৩ মার্চ সরকারি একটি অনুষ্ঠানের আয়োজক হয়ে উঠতে স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর লেগে যায়।
দেশভাগের পরে করাচি বন্দরে HMIS Hindustan যুদ্ধজাহাজের রেটিংদের সশস্ত্র বিদ্রোহ সম্পর্কে পাকিস্তানে আলোচনার বিষয়ে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। তবে বিসি দত্ত তাঁর স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন, দেশভাগের পরে যে নৌবিদ্রোহীরা পাকিস্তানে ফেরত যান, তাঁদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের আচরণ সম্মানসূচক ছিল। মুখবন্ধে তিনি লেখেন—
পাকিস্তানে যাঁরা ফিরে আসতে চেয়েছিলেন, তাঁদের পদমর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর কথা রেখেছিলেন। আমি জানতে পেরেছিলাম যে, কেন্দ্রীয় নৌ ধর্মঘট কমিটির সভাপতি এম এস খানকে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে একজন অফিসারের পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছিল।
তবে এটা স্বীকার করা উচিত পাকিস্তানের সূত্র থেকে বিসি দত্তের এই বিবৃতির কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
নৌবিদ্রোহের সংবাদপ্রকাশের উপর দিল্লির ব্রিটিশ শাসন এবং বোম্বাই প্রশাসনের তরফে অঘোষিত সেন্সর জারি থাকলেও, সমসাময়িক সংবাদমাধ্যমগুলিকে আটকানো যায়নি। বিদ্রোহটি সময়ের হিসেবে স্বল্পকালস্থায়ী হলেও দেশ ও বিদেশের সংবাদপত্রে, বিশেষ করে ব্রিটেনে, এর ব্যাপকতা ও তীব্রতা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রচারিত হয়েছিল। ভারতে আরআইএন ধর্মঘটের খবর ছাপা হয়েছিল দ্য হিন্দুস্তান, দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, বোম্বে ক্রনিকল, দ্য পাইওনিয়ার, দ্য বোম্বে সেন্টিনেল, আজ, দ্য স্টার, যুগান্তর, অমৃতবাজার পত্রিকা, দ্য পিপলস এজ, দ্য ফ্রি প্রেস জার্নাল এবং দ্য স্টুডেন্ট-এর মতো পত্রিকায়। ব্রিটেনে এ খবর নিয়ে হেডলাইন করেছিল দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ডেইলি মেইল, ডেইলি মিরর, ডেইলি এক্সপ্রেস, ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান, ওয়েস্টার্ন ডেইলি প্রেস, নটিংহ্যাম ইভনিং পোস্ট, ইভনিং নিউজ এবং গ্লুচেস্টারশায়ার ইকো। প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলিও বিদ্রোহটি কভার করেছিল, যার মধ্যে ছিল নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, লাইফ ম্যাগাজিন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাভদা। মস্কো এবং জার্মান রেডিও-তেও এই বিদ্রোহের সংবাদ সম্প্রচারিত হয়।[6]
ভারতে দ্য ফ্রি প্রেস জার্নাল-এর ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ধারাবাহিকভাবে নৌবিদ্রোহের প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে বোম্বাইয়ের এই সংবাদপত্রটি কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা বল্লভভাই প্যাটেলের রোষের কারণ হয়ে ওঠে। দ্য ফ্রি প্রেস জার্নালের তৎকালীন সম্পাদক এস নটরাজন তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন—
কিন্তু ফ্রি প্রেস-এর জন্য আরও গুরুতর পরিণতি ছিল সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ক্রোধের শিকার হওয়া। সর্দার ফ্রি প্রেস জার্নালের সম্পাদকীয় নীতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন এবং ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সদানন্দের জায়গায় তিনি থাকলে সম্পাদককে বরখাস্ত করতেন।[7]
সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে এই বিদ্রোহের খবর ব্যানার শিরোনামে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাজ্যের ডেইলি মেইল লিখেছিল— “ভারতীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহ: আমাদের পতাকা নামিয়ে দিল”; লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ একই সুরে শিরোনাম দিয়েছিল— “নৌবাহিনীর রেটিংরা বোম্বেতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করেছে”। ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান প্রথম পাতায় ব্যানার শিরোনাম করেছিল— “ভারতীয় বিদ্রোহীরা জাহাজ দখল করেছে”।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রথম পাতার শিরোনাম ছিল— “বোম্বে আগুনে ভেসে গেছে — ৫৯ জন নিহত — আগুন বোম্বেকে গ্রাস করেছে”। মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল লন্ডনের ইভিনিং নিউজ-এর একটি ছবি-সহ প্রতিবেদনের শিরোনাম। সেখানে ঘোষণা করা হয়েছিল— “আরআইএন রেটিংদের প্রকাশ্য বিদ্রোহ”, এবং
তারপর— “বোম্বে ব্যারাকে তারা অস্ত্রাগার দখল করেছে”।
স্বাভাবিকভাবেই, এমন এক উত্তাল ও সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে নৌবিদ্রোহের ঘটনাবলি নিয়ে প্রকাশনার সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমিত। ১৯৫০-এর দশকের শেষদিকে এই বিদ্রোহের প্রথম লিখিত বিবরণ প্রকাশিত হয় মূলত বোম্বাইয়ের পিপলস পাবলিশিং হাউস থেকে। ১৯৬৫ সালে উৎপল দত্ত যখন তাঁর ঐতিহাসিক নাটক ‘কল্লোল’ মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করেন, তখন তাঁকে গোপনে লালবাজার গোয়েন্দা দপ্তর থেকে শাহদাত আলি রচিত ‘নৌবিদ্রোহ’ বইটি সংগ্রহ করতে হয়। বইটি ব্রিটিশ আমলে নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত ছিল। আজকের ইন্টারনেটের যুগেও বইটির কোনও সুনিশ্চিত হদিশ মেলেনি। অবশেষে ১৯৭১ সালে এসে বিসি দত্তের রচনা প্রকাশ পায়।
নৌবিদ্রোহের ইতিহাস রচনায় আরও এক প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী বঙ্গসন্তানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে— তিনি বিশ্বনাথ বোস। বিদ্রোহ চলাকালে তিনি বোম্বাইয়ের HMIS Talwar-এর প্রাঙ্গণে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিকৃতি-সহ জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
তাঁর রচনা ‘RIN Mutiny 1946’ প্রস্তুতিতে ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদ (ICHR) আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।[8] বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে, দিল্লি থেকে। বইয়ের শুরুতেই, নামকরণের ক্ষেত্রে নিজের অটল অবস্থান তুলে ধরে বিশ্বনাথ বোস লেখেন— ভারতের প্রতিরক্ষা দপ্তর দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নৌবিদ্রোহের ভূমিকা স্বীকারে অনিচ্ছুক ছিল। বরং তারা এই ঘটনাকে ‘মারাত্মক অসদাচরণ’ (flagrant misconduct) হিসেবে চিহ্নিত করে। বিদ্রোহী রেটিংদের চাকরিজীবনের সমস্ত উপার্জন বাজেয়াপ্ত করা হয়; বরখাস্তের মাধ্যমে তাঁদের পেনশন ও ছুটিসহ যাবতীয় চাকরিজনিত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
বিশ্বনাথ বোস এ-ও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, যদিও বিদ্রোহের সময় কমিউনিস্ট পার্টি যথেষ্ট সহায়তা করেছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে তারা এ বিষয়ে উদাসীন দর্শকের ভূমিকা নেয়।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে এত ব্যাপক পরিসরের একটি বিদ্রোহ সত্ত্বেও এই উপমহাদেশে নৌবিদ্রোহ-বিষয়ক ইতিহাসচর্চা এগিয়েছে অত্যন্ত ধীর, সঙ্কুচিত গতিতে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই বিষয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনায় কিছুটা আগ্রহ দেখা দিতে শুরু করেছে।[9] তবে এখানকার গবেষণামূলক প্রবন্ধের অভাব আজও চোখে পড়ার মতো।[10] অন্যদিকে, বিদেশের গবেষকেরা কিন্তু ভারতীয় নৌবিদ্রোহ বিষয়ে সুস্পষ্ট অনুপুঙ্খ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং বিস্তারিতভাবে প্রবন্ধ রচনা করেছেন।[11] এদের মধ্যে আগের টীকায় উল্লিখিত দ্বিতীয় প্রবন্ধটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ এতে বিশদ তথ্যপঞ্জি সঙ্কলিত হয়েছে। বর্তমানে দিল্লি থেকে পরিচালিত একটি বেসরকারি ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্র ব্রিটিশ সরকারের গঠিত নৌবিদ্রোহ তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট (Commission of Enquiry Report) বিশদে প্রকাশ করেছে,[12] যা এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল।
নৌবিদ্রোহের সমর্থনে বোম্বাই-এর কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (Indian People’s Theatre Association, IPTA) একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। শিল্পী চিত্তপ্রসাদের আঁকা ছবি ও পোস্টার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র People’s Age-এ ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়। সলিল চৌধুরীর জনপ্রিয় সঙ্গীত ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে রচিত হয়েছিল নৌবিদ্রোহের সমর্থনে এবং বোম্বাই-এর মজুরশ্রেণির সর্বাত্মক হরতালের প্রেক্ষাপটে।
করাচিতে নৌবিদ্রোহের সমর্থনে প্রতিবাদকারী একে হাঙ্গল (আবতার কিশন হাঙ্গল), যিনি পরবর্তীকালে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ও অভিনেতা হন, গ্রেপ্তার হন। সেই সময় তিনি করাচি কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন।
নৌবিদ্রোহের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে HMIS Kathiawar-এর সাহসী ভূমিকা। আরব সাগরের উপকূলবর্তী গুজরাতের পোরবন্দর থেকে এই মাইন-পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত যুদ্ধজাহাজটি, HMIS Hindustan-এর আবেদনে সাড়া দিয়ে করাচির উদ্দেশে রওনা দেয়। আব্দুল করিমের নেতৃত্বে ১২০ জন রেটিং ক্যাপ্টেনকে গ্রেপ্তার করে এবং জাহাজ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। HMIS Hindustan-এর নাবিকদের আত্মসমর্পণের সংবাদ পেয়ে বিদ্রোহীরা বোম্বাই-এর উদ্দেশ্যে ফিরে আসে। সেই জাহাজেই জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে তাঁরা গেয়ে ওঠেন জোশ মালিহাবাদীর অমর কবিতা—
কাম হ্যায় মেরা তাহাইয়্যুর, নাম হ্যায় মেরা শবাব,
মেরা নাম ইনকিলাব, ইনকিলাব, ইনকিলাব।(আমার কর্তব্য হল পরিবর্তন, আমার নাম হল যৌবন, আমার নাম ইনকিলাব, ইনকিলাব, ইনকিলাব।)[13]
নৌবিদ্রোহের ইতিহাসকে বাংলাভাষায় অমর করে রেখেছেন প্রয়াত উৎপল দত্ত— তাঁর নির্দেশিত Peoples’ Little Theatre (PLT)-এর প্রযোজিত ঐতিহাসিক নাটক ‘কল্লোল’-এর মাধ্যমে। কলকাতার মিনার্ভা থিয়েটারে মঞ্চস্থ এই নাটক বাংলা নাট্যইতিহাসে এক যুগান্তকারী মাইলফলক, এবং জনসমর্থনের দর্পণে আজও অম্লান স্মৃতি হয়ে রয়েছে। ২৯ মার্চ ১৯৬৫ থেকে টানা ৮৯৫ দিন হাউসফুল প্রদর্শন হয়েছিল এই নাটক।[14]
আলোর জাদুকরী নির্দেশনায় তাপস সেন মঞ্চে ‘খাইবার’ জাহাজকে ভাসমান করে তুলেছিলেন— থিয়েটারপ্রেমী কলকাতা আপ্লুত হয়েছিল। নাটকে সঙ্গীত নির্দেশনা করেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। প্রেসিডেন্সি জেলে ছয় মাস বন্দি থাকার পর উৎপল দত্ত মুক্তি পান, এবং ১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ কলকাতার শহিদ মিনারে লক্ষ মানুষের সমাগমে অনুষ্ঠিত হয় জনতার ‘কল্লোল’-এর বিস্ময়কর এক মুক্ত আকাশের প্রদর্শন। সেই অনুষ্ঠানে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় নেতারাও উপস্থিত থেকে উৎপল দত্তকে অভিনন্দন জানান।[15]
এই নাটকের বিজ্ঞাপন কোনও মূলধারার সংবাদপত্র প্রকাশ করেনি। কলকাতার The Statesman পত্রিকা নাটকটির রিভিউ-এর শিরোনাম দেয়— “The Mutiny on Beadon Street”। আনন্দবাজার পত্রিকা নাটকটির বিরুদ্ধে সরাসরি প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার নাটক বন্ধ করতে পুলিশ ও সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়। পুলিশি হুমকি, গুন্ডাবাহিনীর ভয় দেখানো— সবই চালানো হয়েছে নাটক দেখতে আসা দর্শক ও নাট্যশিল্পীদের ওপর।
তবুও এই নাটকের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল— নৌবিদ্রোহের চেতনা জনতার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। দিনের পর দিন জেসপ কারখানার শ্রমিকেরা, ছাত্র-যুবরা দল বেঁধে স্বেচ্ছায় মিনার্ভা থিয়েটারে হাউসফুল শো-এর নিরাপত্তা রক্ষা করতেন। কলকাতার রাস্তায় নিয়মিত পোস্টারে দেখা যেত তীব্র আহ্বান—
আপনি কোন দলের? যারা ‘কল্লোল’ দেখেছে, না যারা ‘কল্লোল’ দেখেনি?
‘কল্লোল’ চলছে, চলবে।
চলচ্চিত্রজগতেও নৌবিদ্রোহ এক ঐতিহাসিক ছাপ রেখে গেছে। যদিও এ-দেশে এখনও পর্যন্ত নৌবিদ্রোহের পটভূমিতে কোনও পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি, তবুও ১৯৫৪ সালে প্রাক্তন ব্রিটিশ সেনা অফিসার জন মাস্টার্স (John Masters) রচিত উপন্যাস Bhowani Junction অবলম্বনে ১৯৫৬ সালে একটি হলিউড সিনেমা নির্মিত হয়। একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলার ভারতবর্ষে নিজের শিকড় অনুসন্ধানের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমায় নৌবিদ্রোহের পটভূমি ব্যবহৃত হয়েছে। চলচ্চিত্রটিতে খানিক অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিয়ে দেখানো হয়, কীভাবে নৌবিদ্রোহ দমন করতে রেলপথে গোর্খা সৈন্যদের দ্রুত চলাচলের সময় কমিউনিস্টদের তরফে অন্তর্ঘাতের চেষ্টা চলছিল। যদিও এটি চলচ্চিত্রিক রূপান্তর, তবুও বাস্তবেও নৌবিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসকের অন্যতম আশঙ্কা ছিল— এই বিদ্রোহের ঢেউ যদি কংগ্রেস বা মুসলিম লিগের তুলনায় কমিউনিস্টদের প্রভাব ও অবস্থানকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তোলে। সমসাময়িক সময়ের গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল এবং ভারত উপমহাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল অচিনলেক তাঁদের বিদ্রোহ-সংক্রান্ত বার্তালাপ ও রিপোর্টে একাধিকবার বিদ্রোহী রেটিংদের মধ্যে কমিউনিস্ট প্রচারের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন।
সবশেষে, সম্প্রতি ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারি, দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে প্রদর্শিত হয় ডকুমেন্টারি The Last Push। IANS (Indo-Asian News Service)-এর উদ্যোগে নির্মিত এই তথ্যচিত্রটি নৌবিদ্রোহের আবহে নির্মিত এবং এটি প্রদর্শিত হয় দিল্লির ফিল্ম ডিভিশনের প্রেক্ষাগৃহে।
আরও একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল “Meanings of Failed Action: Insurrection 1946” (ব্যর্থ প্রচেষ্টার অর্থ খোঁজা: বিদ্রোহ ১৯৪৬)— যা একটি সম্মিলিত শিল্পপ্রকল্প হিসেবে গড়ে তোলা হয় দিল্লিভিত্তিক শিল্পী ভিভান সুন্দরম, সংস্কৃতিবিষয়ক তাত্ত্বিক আশীষ রাজাধ্যক্ষ, ব্রিটিশ শব্দশিল্পী ডেভিড চ্যাপম্যান এবং চলচ্চিত্র ঐতিহাসিক ভ্যালেন্টিনা ভিটালির নেতৃত্বে। এই প্রদর্শনীর প্রধান আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়েছিল মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ বাস্তু সংগ্রহালয়ের কুমারস্বামী হলে, ২০১৭ সালের ১৭ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত। প্রদর্শনীর কেন্দ্রস্থলে রাখা হয়েছিল স্টেইনলেস স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামে নির্মিত একটি ৪০ ফুট দীর্ঘ গহ্বরযুক্ত কাঠামো— যেটি দেখতে ছিল এক ভাসমান জাহাজের জলরোধী হালের মতো। এটি ছিল একটি প্রতীকী কন্টেইনার, যার মধ্যে দর্শকদের জন্য প্রস্তুত ছিল এক অভিজ্ঞতামূলক (ইমারসিভ) অডিও-ভিসুয়াল থিয়েটার। প্রতিবারে প্রায় ৪০ জন দর্শক এই স্থাপনার ভিতরে প্রবেশ করে একটি ৪২-মিনিট দীর্ঘ শ্রবণ-দর্শন অভিজ্ঞতায় অংশ নিতে পারতেন। এই অডিও-ভিসুয়াল পরিবেশনায় অন্তর্ভুক্ত ছিল অপেরা সঙ্গীত, নামদেও ধাসালের কবিতার আবৃত্তি, বিক্ষোভকারীদের সম্মিলিত স্লোগান, এবং নৌবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের মৌখিক বয়ান। উপনিবেশ-বিরোধী বিদ্রোহের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক চিত্র এইসব উপাদানের মধ্যে দিয়ে দর্শকদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।[16]
২খ. উপমহাদেশের নৌবিদ্রোহ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া, পদক্ষেপ
সন্দেহ নেই যে বিচারপতি পিভি চক্রবর্তীর ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলির সঙ্গে কথোপকথনের যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন[17], তার পক্ষে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। নৌবিদ্রোহ শুরুর মাত্র তিনদিনের মাথায় অ্যাটলি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন ভারতে একটি বিশেষ ক্যাবিনেট মিশন পাঠানো হবে, যার উদ্দেশ্য হবে “ভারতে পূর্ণ স্বশাসনের দ্রুত রূপায়ণ।” ১৯৪৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি হাউস অফ লর্ডসে দেওয়া এক বিবৃতিতে লর্ড প্যাট্রিক লরেন্স ঘোষণা করেন, “ব্রিটিশ সরকার মহামান্য সম্রাটের অনুমোদনক্রমে ভারতে একটি বিশেষ ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের মিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই মিশনের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের সেক্রেটারি অফ স্টেট লর্ড প্যাট্রিক লরেন্স, বোর্ড অফ ট্রেডের প্রেসিডেন্ট স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং অ্যাডমিরালটির ফার্স্ট লর্ড এভি আলেকজান্ডার। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল এই সিদ্ধান্তে পূর্ণ সম্মতি জানিয়েছেন।”[18] বোম্বাইয়ের ফ্রি প্রেস জার্নাল লন্ডনের সংবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যানার হেডলাইনে ছাপে: “ভারতের জন্য ব্রিটিশ বড়মাপের নেতারা … লর্ড প্যাট্রিক লরেন্স মার্চ মাসের শেষের দিকে উড়ে আসবেন, সাংবিধানিক নির্মাণ মিশনে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং আলেকজান্ডার সঙ্গে থাকবেন।” ২৪ মার্চ ১৯৪৬ তারিখে এই ক্যাবিনেট মিশন দিল্লিতে এসে পৌঁছায়।
ভারত উপমহাদেশে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি (আরআইএন)-এর ৮৮টি নৌযানের মধ্যে অন্তত ৭৮টিই ১৯৪৬-এর নৌবিদ্রোহে কোনও না কোনওভাবে জড়িয়ে পড়ে। বহু জাহাজে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের পতাকা উত্তোলন করা হয়। আবার কিছু জাহাজ, যেমন HMIS Akbar-এ কমিউনিস্টদের লাল পতাকাও উড়েছিল। শুধু সমুদ্র নয়, উপকূলীয় ২০টি দপ্তরের নৌসৈনিক ও কর্মীরাও বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন। সব মিলিয়ে প্রায় ২০,০০০ নাবিক ও নৌসেনা এই বিদ্রোহে যুক্ত ছিলেন।
এই বিদ্রোহের প্রভাব কেবল নৌবাহিনির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আম্বালায় রয়্যাল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের ৬০০ জন সদস্য সংহতি প্রকাশ করে ধর্মঘট ও মিছিলে অংশ নেন। জব্বলপুরে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির সৈনিক ও কর্মীরা কাজ বন্ধ করে দেন। গোর্খা রেজিমেন্ট এবং মারাঠা রেজিমেন্টের সৈনিকরা যথাক্রমে করাচি ও বোম্বাইতে ধর্মঘটি নাবিকদের উপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেন। সব মিলিয়ে চারদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে ওঠে যে RIN-এর ফ্লিট অফিসার কমান্ডিং, অ্যাডমিরাল গডফ্রে, ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে এক বেতারবার্তায় বিদ্রোহীদের সতর্ক করেন— আত্মসমর্পণ না করলে বিদ্রোহী যুদ্ধজাহাজগুলি ধ্বংস করে দেওয়া হবে। তিনি নিজেই বোম্বাইতে এসে নাবিকদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন।[19]
এদিকে সিংহলের ত্রিঙ্কোমালির নৌঘাঁটি থেকে রয়্যাল নেভির সশস্ত্র যুদ্ধজাহাজ HMS Glasgow-কে বোম্বাইয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়, বিদ্রোহী নৌযানগুলিকে আক্রমণ করার জন্য। উত্তরে বিদ্রোহী নাবিকরা যুদ্ধজাহাজের কামান ঘুরিয়ে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া ও তাজ হোটেলের দিকে তাক করে পাল্টা গোলাবর্ষণের হুমকি দেন। রেটিংরা নেভির অস্ত্রাগারের দখল নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। Castle Barrack— যেখানে রেটিংরা পরিবার-সহ বসবাস করত— সেখানে শুরু হয় রীতিমতো সশস্ত্র সংঘর্ষ। বিদ্রোহীদের হতাহত হওয়ার খবর আসতে শুরু করে।
নৌবিদ্রোহ লন্ডনের শাসকদের কাছে এক ভয়ানক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত আজাদ হিন্দ ফৌজের (INA) অফিসার ও সৈন্যদের কোর্ট মার্শাল বিচার— ইতিহাসে যা ‘INA Trial’ নামে পরিচিত— ঘিরে জনমত প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। স্বাধীনতার জন্য আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই ও আত্মত্যাগ, এবং দিল্লির লালকেল্লায় তাদের বিচার চলাকালীন দেশীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচার, দেশজুড়ে গভীর সহানুভূতির সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পরে, যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া নতুন অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে ইউনিয়ন জ্যাক তথা ব্রিটিশ রাজপতাকার প্রতি আনুগত্য নিয়ে শীর্ষ ব্রিটিশ সেনানায়কেরা গভীর সংশয়ে পড়েন। এই নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকেই প্রবলভাবে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দিদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণ করতেন। এই প্রসঙ্গে Eastern Command-এর সেনাধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল টাকার রিপোর্টে জানান: “…আইএনএ-সম্পর্কিত ঘটনাবলি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমগ্র কাঠামোকেই ভেঙে ফেলার আশঙ্কা তৈরি করেছে…।”
এই পরিস্থিতির মধ্যে টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ব্রিটিশ শাসনের এক একান্ত সমর্থক, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ তারিখের সম্পাদকীয় কলামে লেখে: “দিল্লিতে বিচার চলাকালীন আইএনএ-র বন্দিদের অতিরিক্ত মহিমান্বিত করার ফলে সারা ভারতজুড়ে মন্তব্যের বন্যা বয়ে যায়। এর অনিবার্য পরিণতি ছিল কলকাতা, বোম্বে, দিল্লি ও অন্যান্য স্থানে বিদ্রোহ এবং বেসামরিক সহিংসতার উদ্বেগজনক বিস্তার…”[20]
নৌবিদ্রোহের প্রতি ভারত উপমহাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের আচরণ ছিল এককথায় ন্যক্কারজনক। উভয় দলের নেতৃবৃন্দই নিশ্চিতভাবে জানত যে, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকারের ক্যাবিনেট মিশনের হঠাৎ ঘোষণা, মূলত নৌবিদ্রোহজনিত সৃষ্ট পরিস্থিতির তীব্রতার ফলেই ঘটেছিল। তবুও, রাতারাতি ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনার সুযোগে দুই নেতৃত্বই বিদ্রোহীদের দাবির প্রতি চরম উদাসীনতা দেখায় এবং তাদের আন্দোলনকে সরাসরি খারিজ করে দেয়। বিসি দত্ত লিখেছেন:
নীতির প্রশ্ন বাদ দিয়ে, সেই সময়ে ভারতের রাজনীতিবিদরা আসন্ন ক্ষমতার উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন বা থাকবেন, তাঁদের কাছে বাহিনীর মধ্যে অনিয়ম, অবাধ্যতা একটি দুঃস্বপ্ন। … কী দুঃখজনক! কী দুঃখ, কী দুঃখজনক![21]
কংগ্রেস নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মোহনদাস গান্ধি ও তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বিদ্রোহের ন্যায্যতাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন এবং রেটিংদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কংগ্রেসের পরিচিত নেতাদের মধ্যে একমাত্র অরুণা আসফ আলি বিদ্রোহীদের পক্ষ নেন। তিনি জওহরলাল নেহরুকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে বোম্বাই এসে বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান করেন। অন্যদিকে করাচিতে বিদ্রোহী রেটিংদের এক প্রতিনিধি দল কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং সমর্থন চান। পরে আজাদ লিখে যান:
এর আগে ভারতীয় নৌবাহিনীর কিছু অফিসার করাচিতে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তাঁরা জাতিগত বৈষম্য নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে এই ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ কোনও ফল দেয়নি। … অরুণা আসফ আলি নৌবাহিনীর অফিসারদের পক্ষ নিয়েছিলেন এবং আমার সমর্থন পাওয়ার জন্য দিল্লিতে এসেছিলেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম যে অফিসাররা বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করেননি এবং তাঁদের উচিত নিঃশর্তভাবে কাজে ফিরে যাওয়া। বোম্বে কংগ্রেস আমার পরামর্শের জন্য টেলিফোন করেছিল, এবং আমি একই কথা জানিয়ে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল তখন বোম্বেতে ছিলেন এবং তিনিও আমার সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। আমি তাঁকেও বলেছিলাম নৌবাহিনীর অফিসারদের পদক্ষেপগুলি ভুল এবং তাঁদের কাজে ফিরে যাওয়া উচিত।[22]
সর্দার প্যাটেল অরুণা আসফ আলির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে মোহনদাস গান্ধিকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬-এ এক দীর্ঘ চিঠিতে লেখেন: “অরুণা স্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপ করে আগুন জ্বালানোর কাজ করেছে। প্রায় আড়াইশো লোক গুলিতে মারা গেছে, এক হাজারেরও বেশি আহত। পুলিশ অসহায় হয়ে পড়ায় সেখানে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল আপনার ছোট মন্তব্যেরও সে একটি অশালীন জবাব দিয়েছে… এভাবে সে উৎসাহিত হচ্ছে এবং যদি আমরা তাদের বেপরোয়া মনোভাব রুখে না দিই, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। শহরের দোকানপাট লুট হয়েছে, পথচারীদের জিনিসপত্র ছিনতাই হয়েছে, সরকারি ভবনে আগুন ধরানো হয়েছে, রেলওয়ে কোয়ার্টার, এমনকি একটি ট্রেনও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে যদি সেনাবাহিনীকে নামানো হয়, তাহলে তাদের দোষ দেওয়া বৃথা হবে।”[23]
সর্দার প্যাটেল তাঁর চিঠিতে যেই “দাঙ্গা, লুঠতরাজ ও অরাজকতা”-র কথা বলেছেন, তা আসলে ২২ ফেব্রুয়ারির সেই সর্বাত্মক হরতালের পরিপ্রেক্ষিতে, যা কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটির আহ্বানে আয়োজিত হয়েছিল। বিদ্রোহী নাবিকদের সমর্থনে ডাকা এই হরতালে বোম্বাই-এর মজুরশ্রেণি ও সাধারণ জনতা অভূতপূর্ব সাড়া দেন। সর্দার প্যাটেল প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে হরতালের বিরোধিতা করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল: “কোনও হরতাল বা কলকারখানা বন্ধ করা বা স্কুল-কলেজ বন্ধ করার জন্য কোনও প্রচেষ্টা করা উচিত নয়।” ধর্মঘট সমন্বয় কমিটির নেতারা প্যাটেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর মধ্যস্থতা কামনা করেন। কিন্তু প্যাটেল কঠোর শর্ত জুড়ে দিয়ে লিখিতভাবে জানান: “ধর্মঘটকারীদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করতে হবে এবং আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে। কংগ্রেস সমস্তভাবে চেষ্টা করবে যাতে রেটিংদের কোনও হয়রানি না হয় এবং তাদের বৈধ দাবিগুলি যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করা যায়।”[24]
সর্দার প্যাটেলের এই বিবৃতি ধর্মঘট কমিটির নেতাদের স্তম্ভিত করে দেয়। মুসলিম লিগের প্রধান মোহম্মদ আলি জিন্নাও ধর্মঘটী নাবিকদের নিরাশ করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬, The Hindu পত্রিকায় বোম্বাই থেকে জিন্নার এক সাম্প্রদায়িক বিবৃতিতে লেখেন: “আমি RIN-এর সদস্যদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আমার সর্বস্ব সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। তবে আমি তাঁদের অবিলম্বে ধর্মঘট প্রত্যাহার করার আবেদন জানাচ্ছি; বিশেষ করে আমি মুসলিম সদস্যদের বলছি— তাঁরা যেন থেমে যান এবং আর কোনও নতুন সমস্যা তৈরি না করেন, যতক্ষণ না আমরা এই অত্যন্ত গুরুতর পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছি।”[25]
তবে বিদ্রোহী নাবিকদের অনশন ধর্মঘট ও হরতালের আহ্বানের প্রতি সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়া এসেছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির তরফে। ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের রূপকার গান্ধির কাছ থেকে এমন অবস্থান সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল বিদ্রোহী রেটিংদের কাছে। সেই সময় গান্ধি পুনাতে অবস্থান করছিলেন। বোম্বাইয়ের রাজপথে মজুরশ্রেণির জনজোয়ার, জনতার ক্ষোভ ও রেটিংদের সংঘর্ষ তাঁকে রীতিমতো বিচলিত করে তোলে। ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দিয়ে বলেন:
ভারতে এখন যে ঘটনাগুলি ঘটছে, তা আমি বেদনাদায়ক আগ্রহের সঙ্গে অনুসরণ করছি। নৌবাহিনীর এই বিদ্রোহ এবং এর পরবর্তী ঘটনাগুলি কোনো অর্থেই অহিংস কাজ নয়। … গির্জা ধ্বংস, ট্রামগাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি পোড়ানো, ইউরোপীয়দের অপমান ও আঘাত করা— এই সবকিছু কংগ্রেস-সংজ্ঞায়িত স্বরাজের পথে পড়ে না, এবং আমার অহিংস আদর্শের সঙ্গেও এর কোনও মিল নেই। এই নির্বোধ সহিংসতা উন্মত্ততার পরিচয়। পরিচিত এবং অপরিচিত নেতাদের বুঝতে দিন তাঁরা কী করছেন এবং তারপর তাঁদের পথ অনুসরণ করুন। এমনটা যেন না বলা হয় যে কংগ্রেসের ভারত অহিংস কাজের মাধ্যমে স্বরাজ জয়ের কথা বিশ্বকে বলেছিল, এবং তার জীবনে এমন এক সংকটময় সময়ে তার কথা কাজে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ‘নির্বোধ’ শব্দটি ব্যবহার করছি, কারণ চিন্তাশীল সহিংসতা বলে একটি ধারণা রয়েছে। কিন্তু আমি যা ঘটতে দেখছি, তা চিন্তাশীল নয়। যদি ভারতীয় নৌসেনার সদস্যরা সত্যিই অহিংসা বোঝেন ও মূল্যায়ন করেন, তবে সম্মিলিত অহিংস প্রতিরোধই সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ, কার্যকর এবং পুরুষোচিত পথ হতে পারে। … যদি তাঁরা ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে কাজ করাকে ভারতের পক্ষে অপমানজনক মনে করেন, তবে তাঁরা স্বেচ্ছায় সেই চাকরি ত্যাগ করুন। সেটিই হবে সত্যিকারের অহিংস অসহযোগিতা। বর্তমানে যা ঘটছে, তাতে তাঁরা ভারতের জন্য একটি খারাপ এবং অশোভন উদাহরণ স্থাপন করছেন।
গান্ধির এই বিবৃতি বিদ্রোহী রেটিংদের মধ্যে তীব্র আশাভঙ্গের জন্ম দেয়। জাতীয় নেতাদের তরফে কোনওরকম নৈতিক সমর্থন না মেলায় তাঁরা অ্যাডমিরাল গডফ্রের শর্ত অনুযায়ী আত্মসমর্পণের পথে যেতে বাধ্য হন। কেবল অরুণা আসফ আলিই গান্ধির চাকরিত্যাগের পরামর্শের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন।
জাতীয় নেতাদের এহেন প্রত্যাখান ব্রিটিশ শাসকদের হাতে একরকম খোলাছুট দিয়ে দেয়। তারা নির্বিঘ্নে বিদ্রোহী রেটিংদের গ্রেপ্তার করে বন্দিশিবিরে পাঠানোর এবং পরে নৌসেনা ও নাবিকদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে তাঁদের বাড়ি ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়। দিল্লির কেন্দ্রীয় সংসদে ভারতের যুদ্ধ দফতরের সচিব ফিলিপ ম্যাসন সদম্ভে ঘোষণা করেন: “আমি এই নিশ্চয়তা দিতে পারি না যে কোনও শাস্তি হবে না। সরকার সেই ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার অধিকার নিজস্বভাবে সংরক্ষিত রাখবে, যারা তরুণ ও উত্তেজিত রেটিংদের বিদ্রোহে প্ররোচিত করেছিল।” সংসদে উপস্থিত কংগ্রেস বা মুসলিম লিগের সেদিন এই বর্বর উক্তির কোনও প্রতিবাদ করেননি।
প্রকৃতপক্ষে উপমহাদেশের এই স্বতঃস্ফূর্ত নৌবিদ্রোহ জাতীয় নেতাদের মধ্যেও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। এমনকি যারা সহানুভূতিশীল ছিলেন, তাঁরাও বিদ্রোহকে তারুণ্যের হঠকারিতা, কিংবা নাশকতা হিসেবে ব্যাখ্যা করে এর বৈধতা খর্ব করতে সচেষ্ট ছিলেন। প্যাটেল ১৯৪৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে জওহরলাল নেহরুকে লেখেন, “আমাদের এই ক্রমবর্ধমান সহিংসতার মোকাবিলা করতে হবে, অন্যথায় আমাদের কার্যক্রম শেষ হতে চলেছে।”
নৌবিদ্রোহের পরাজয়ের পর ২৬ ফেব্রুয়ারিতে বোম্বাই কংগ্রেসের আহ্বানে চৌপাট্টিতে আয়োজিত এক জনসভায় নেহরু ও প্যাটেল একসঙ্গে ভাষণ দেন। সেখানে নেহরু বলেন:
সাম্প্রতিক আরআইএন-এর ধর্মঘটে সাহসী যুবকরা অবশ্য ভুল করেছিল। কিন্তু আমাদের তাঁদের ক্ষমা করতে হবে এবং যেকোনও হয়রানি রোধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। সংবাদপত্রের একটি অংশে বলা হয়েছে, সর্দার প্যাটেল গ্যারান্টি দিয়েছেন যে কোনও হয়রানি হবে না; মৌলানা আজাদও একইরকম গ্যারান্টি দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের বর্তমান দাসত্বের অবস্থায় সর্দার বা মৌলানা কেউই আদতে কোনও গ্যারান্টি দেওয়ার অবস্থানে নেই। একমাত্র সরকারই তা করতে পারে। আমি কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করব, শুধু বোম্বে নয়, সারা ভারতের সমস্ত আরআইএন নাবিকদের মামলার একটি উন্মুক্ত তদন্ত করতে হবে। ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনীর (আইএনএ) অফিসারদের মতো তাঁদেরও আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে।[26]
নৌবিদ্রোহীদের ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের’ কোনও সুযোগ কেবল ব্রিটিশ কেন, নেহরুর ‘স্বাধীন’ ভারত সরকারও কোনওদিন দেয়নি। কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে যাঁরা নেহরুর সেই সামান্যতম চক্ষুলজ্জাও দেখাননি, তাঁরা তো সরাসরি নৌবিদ্রোহ পরাজয়ের বিজয়োৎসবে অংশগ্রহণ করেন। “কেএম মুন্সি ও তাঁর স্ত্রী এবং বোম্বাইয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে মীরচন্দানি ১ মার্চ ১৯৪৬ তারিখে HMS Glasgow-তে অনুষ্ঠিত ককটেল পার্টিতে যোগ দেন, যা নৌবিদ্রোহের দমন উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল।”[27] ততদিনে HMS Glasgow ত্রিঙ্কোমালি থেকে বোম্বাই বন্দরে এসে নোঙর ফেলেছে; বিদ্রোহ দমনের জন্য তার গোলাবর্ষণের আর প্রয়োজন পড়েনি।
১৯৪৭-এ ব্রিটিশ শাসন অবসানের পরেও ভারত ও পাকিস্তান, উভয় দেশই নৌবিদ্রোহের ‘ত্রাস’ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। স্বাধীন ভারতের নৌসেনা ১৯৫৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত চারজন ব্রিটিশ অ্যাডমিরালের অধীনেই পরিচালিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে পাকিস্তানে এই রেকর্ড কিছুটা সীমিত; সেখানে Rear Admiral James W. Jefford ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের নৌ-সেনাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।
২গ. নৌবিদ্রোহ ও উপমহাদেশীয় কমিউনিস্ট পার্টি
১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত উপমহাদেশে তখনও রাষ্ট্রীয় বিভক্তি ঘটেনি। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ফলস্বরূপ সীমান্তে তারের বেড়া বসানোর ইতিহাস তখনও লেখা হয়নি। জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের পরপরই তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব স্বীকৃত ছিল। একেবারে পশ্চিম প্রান্ত— গুজরাত ও রাজস্থান— ছাড়া উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র, আজ থেকে ৭৬ বছর আগে, আজকের দিনের তুলনায় মানুষের মনে লাল পতাকার প্রতি সহানুভূতি ও আবেগ অনেক বেশি প্রগাঢ় ছিল।
যদিও ঐতিহাসিকভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বহু গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল— ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে তাদের অনুপস্থিতি ও বিরোধিতা, নেফার জঙ্গলে আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগকে জাপানের ‘কুইসলিং’ হিসেবে অভিহিত করে অপমানজনকভাবে নিন্দা করা— এইসব পদক্ষেপ রাজনৈতিকভাবে মারাত্মক ভুল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তথাপি এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ-বিরোধী শক্তি হিসেবে কমিউনিস্টদের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। ভারতের প্রায়-অঘোষিত বেআইনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার স্বীকৃ্ত কমিউনিস্ট পার্টির যোগাযোগও সুবিদিত ছিল। এবং ১৯৪৬ সালের নৌবিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিই গৌরবজনক ও দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল। পরে প্রকাশিত প্রায় সমস্ত ঐতিহাসিক দলিল ও গবেষণাপত্রে এই সত্য নির্দ্বিধায় স্বীকৃত হয়েছে যে, বিদ্রোহী রেটিংদের ধর্মঘট ও আত্মত্যাগের পেছনে অকুণ্ঠ রাজনৈতিক সমর্থন এসেছিল কেবলমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি এবং আংশিকভাবে সমাজতন্ত্রীদের তরফ থেকে।
আরআইএন রেটিংদের বিদ্রোহ মূলত জাতীয়তাবাদী চেতনা, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, রয়্যাল নেভির সদস্যদের তুলনায় লজ্জাজনক বেতনবৈষম্য ও পদমর্যাদার অসাম্য ঘিরে গড়ে উঠেছিল। ধর্মঘটের মূল সংগঠক বিসি দত্ত, এমএস খান, মদন সিংহ প্রমুখদের মধ্যে কারও সঙ্গেই কোনও কমিউনিস্ট আনুগত্যের প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিদ্রোহের গোড়ার দিকে যেসব কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল, তাতে কমিউনিস্টদের কোনও প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না— যেমন, HMIS Talwar-এ বিসি দত্তের পরিকল্পনায় নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তাদের হেনস্থা করার কর্মসূচি গ্রহণ। বোম্বাই-এর কোলাবা অঞ্চলে অবস্থিত HMIS Talwar ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বিতীয় বৃহত্তম দূরসঞ্চার কেন্দ্র। এখানে নিযুক্ত রেটিংদের, যেমন বিসি দত্ত ও মদন সিংহ, কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ সঙ্কেত-বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ১৬ ফেব্রুয়ারির রাতে এখানকার রেটিংরা অনুপযুক্ত খাবারের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে Castle Barrack ও বোম্বাই নৌঘাঁটির অধিকাংশ জাহাজের নাবিকরাও ধর্মঘটে যোগ দেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে বোম্বাই শহরের মানুষ বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেন— ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসা রেটিংরা রাস্তায় মিছিল করছেন এবং HMIS Talwar-এর সঙ্কেতপ্রেরণ যন্ত্রগুলি দখলে নিয়ে নিয়েছেন। বিদ্রোহীরা দ্রুত এই যন্ত্রগুলোর মাধ্যমে নৌবাহিনীর বিভিন্ন কেন্দ্রে ধর্মঘটের বার্তা পাঠিয়ে দেন, যা চোখের পলকে সারা উপমহাদেশে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
কমিউনিস্টদের দৃষ্টিতে ‘RIN Mutiny’ ছিল রেটিংদের ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো এক ঐতিহাসিক সুযোগ। কারণ সেই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি উপনিবেশবাদ-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করত এবং সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট সদস্য সংগ্রহ ও সংগঠন গড়ার লক্ষ্যে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর এক অফিসার মেজর জয়পাল সিংহ ১৯৪৬ সালে আসামে সেনাবাহিনী থেকে পলায়ন করে আত্মগোপনে চলে যান— এটি এমন উদ্যোগের এক প্রামাণ্য উদাহরণ। মেজর জয়পাল সিংহ আমৃত্যু মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, HMIS Akbar জাহাজে অন্তত ৩০ জন কমিউনিস্ট সদস্য ছিলেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নৌবাহিনীর বহু সদস্যকে কেবল কমিউনিস্ট সন্দেহে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী এক রেটিং জানিয়েছেন, ১৯৪৫–৪৬ সালের মধ্যে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে প্রায় ৫০০টি কমিউনিস্ট ইউনিট সক্রিয় ছিল। এই প্রেক্ষাপটে নৌবিদ্রোহ কমিউনিস্ট পার্টির কাছে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের বাস্তবায়ন ঘটানোর এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয়।
রেটিংদের ধর্মঘট ও বিদ্রোহ বোম্বাই ও করাচি শহরে মিল-মজুর ও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল সাড়া ফেলে এবং প্রশাসনের দমন-পীড়ন ও গুলিবর্ষণের শিকার হয়। বিশেষ করে বোম্বাই শহরে ১৯৪৬ সালের ২১-২৩ ফেব্রুয়ারি রেটিংদের সমর্থনে মেহনতি জনতার যে প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তা ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে আছে।
কমিউনিস্টদের সমর্থিত বোম্বাইয়ের মিল-মজুরদের সংগঠন গিরনি কামগর ইউনিয়নের ডাকে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রায় ছয় লক্ষ মজদুর হরতালে অংশ নেন। স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, অফিস সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর নাগাদ গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ের হাজার হাজার কেরানি কাজ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে মিল-মজুর ও অন্যান্য হরতালকারীদের সঙ্গে যুক্ত হন। শহরের অনেক শ্রমিক এলাকা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। জাভেরি বাজারে গয়নার দোকানে লুঠ হয়; বিশেষ করে বন্ধকি ও মহাজনি খাতার রেজিস্টারপত্র জনতা আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে এলে ব্রিটিশ প্রশাসন আতঙ্কিত হয়ে মিলিটারি সাঁজোয়া বাহিনী নামায়। জনতার ব্রিটিশ-বিরোধী হিংসা চরমে ওঠে। ‘সেমিনার’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা রমেশ ও রাজ থাপার তখন বোম্বাইয়ের মফতলাল পার্কে থাকতেন। রাজ থাপার তাঁর আত্মজীবনী All These Years-এ ২২ তারিখের ধর্মঘটের কথা স্মরণ করে লিখেছেন:
বোম্বাইয়ের গোটা শহর বিদ্রোহীদের সমর্থনে পথে নেমে এসেছিল। কতজন মারা গেছে, কোন রাস্তায় বা কোন স্ট্যান্ডে এবং কীভাবে মর্গে মৃতদেহ উপচে পড়ছে— তা নিয়ে শহর জুড়ে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। হিন্দু ও মুসলমানেরা একসঙ্গে হর্নবি রোডে মিছিল করে। ব্রিটিশরা ইয়াচ ক্লাবে জড়ো হয়েছিল, তাদের দৃষ্টি বন্দরের দিকে, যেখানে ধর্মঘটী জাহাজগুলোর মুখোমুখি হয়ে কামান বসানো ছিল।[28]
পুলিশ ও পরে সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১৮৭ জন নিহত ও ১০০২ জন আহত হন; বেসরকারি হিসেবে কমপক্ষে ২৭০ জন নিহত ও ১৩০০ জন আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।[29] নিহতদের মধ্যে ছিলেন পারেল মহিলা সংঘের কোষাধ্যক্ষা এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যা কমল ডন্ডে, তাঁর সহকর্মী কুসুম রনদিভের পায়ে পুলিশের গুলি লাগে। এই পারেল মহিলা সংঘের সদস্যারাই রান্না করা খাবার ডাব্বায় করে ধর্মঘটী নাবিকদের জাহাজে পৌঁছে দিতেন।
কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘পিপলস এজ’-এ নৌবিদ্রোহ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়:
বোম্বাইতে ভারতীয় নৌবাহিনীর রেটিংদের ধর্মঘট একটি একক ঘটনা নয়; এটি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র জনগণের ঐক্যকে প্রতিফলিত করে।
পিপলস্ এজ-এর এই মন্তব্য কোনও অতিরঞ্জন ছিল না। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল ওয়ার মিউজিয়াম-এর মৌখিক ইতিহাস সংরক্ষণাগারে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এক বেনামী, নিম্নপদস্থ ব্রিটিশ অফিসারের বিবরণ, যিনি নিজেকে একজন সমাজতন্ত্রী মনে করতেন। বিপ্লব দেখার আশায় তিনি বেসামরিক পোশাকে বোম্বাই ভ্রমণে আসেন। বন্দরের ধারে সারিবদ্ধভাবে নোঙর করা বিদ্রোহী জাহাজগুলোর দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকার পর তিনি শহরের ভেতরে প্রবেশ করেন, প্রতিবাদী শ্রমিকদের ভিড়ের মধ্যে থাকতে চেয়ে। তাঁর স্মৃতিচারণে লেখা রয়েছে:
ভিড় যখন স্যান্ডহার্স্ট রোড দিয়ে যাচ্ছিল, তখন লোকজন ‘জয় হিন্দ’ আর ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’— বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক বলে চিৎকার করছিল। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কমরেডদের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছিল, তারা ভাবছিল— এটা কি সত্যিই বিপ্লবের সূচনা হতে পারে?”
১৯০৫ সালের রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ ‘পটেমকিন’-এ বিদ্রোহের পরে, বোম্বাইয়ের রেটিংদের এই বিদ্রোহ ‘কমিউনিস্ট রোমান্টিকতা’-য় এক বড় অনুপ্রেরণার স্থান দখল করে নেয়। ওই ব্রিটিশ অফিসারের মতে, “পুলিশ যেন বিক্ষোভ থামানোর জন্য তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ন চেষ্টাই করেনি। “ফলে এক পর্যায়ে এটা পুরোপুরি অসম্ভবও ছিল না যে— একটি সোভিয়েত ঘোষণা করা হতে পারে, বোম্বাই বিপ্লবীদের দখলে চলে যেতে পারে, এটি গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারে— আর কে জানে, কী ঘটে যেতে পারত!”[30]
প্রায় একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল করাচি শহরের শ্রমজীবী জনতার মধ্যেও। বন্দর শহর হওয়ার পাশাপাশি বোম্বাইয়ের সঙ্গে সমুদ্রপথে ও বিমানে নিয়মিত যাতায়াত থাকায় (দূরত্ব মাত্র ৮০০ কিমি), করাচি তখন সিন্ধুপ্রদেশের সবচেয়ে শিল্পোন্নত ও সমৃদ্ধ নগরী হয়ে উঠেছিল।
নৌবিদ্রোহে করাচি বন্দরের ‘HMIS Hindustan’-এর ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যন্য ভূমিকা। ২০ ফেব্রুয়ারি, এই জাহাজের রেটিংরা সমস্ত ব্রিটিশ অফিসারদের জাহাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সদ্য ফেরা রেঙ্গুনফেরত এই জাহাজের নাবিকরা করাচির তীরবর্তী ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, করাচিতে অবস্থানরত গোর্খা, শিখ ও বালুচ রেজিমেন্টের সৈনিকরা বিদ্রোহী রেটিংদের উপর গুলি চালাতে স্পষ্ট অস্বীকৃতি জানায়। পরে ব্রিটিশ ব্যাটালিয়ন ‘Hindustan’ লক্ষ্য করে গুলি চালালে অন্তত ছ-জন রেটিং নিহত ও তিরিশজন আহত হন; গোলাবর্ষণে জাহাজটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিদ্রোহের এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে করাচির উপকূলবর্তী Manora Island-এ অবস্থিত HMIS Bahadur, Himalaya ও Chamak জাহাজের রেটিংরাও বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন। দিল্লির অধ্যাপক অজিত জাভেদ পাকিস্তানের গবেষণা পত্রিকা Pakistan Perspectives-এ লেখেন—
HMIS Bahadur-এর পাঁচশো রেটিং সেদিন ব্রিটিশ পতাকায় অভিবাদন জানাননি, যা তাঁরা প্রতিদিন করতেন। তারা পতাকাটি নামিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেন এবং Hindustan-এর দিকে রওনা দেন। ব্রিটিশ অফিসাররা গুলি চালালে এক রেটিং শহিদ হন। কংগ্রেস বা মুসলিম লিগের পতাকা নয়, তাঁরা সর্বসম্মতিক্রমে নিজেদের মৃত কমরেডের রক্তমাখা শার্টকে পতাকা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং কামানের আওয়াজে সেই পতাকাকে সম্মান জানান। তাঁরা দেওয়ালে হিন্দি ও উর্দুতে লেখেন— ‘হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘স্বাধীনতা পেতে রক্ত দাও’, ‘স্বৈরাচারীরা, তোমাদের দিন শেষ’, ‘বিদ্রোহ নয়, ঐক্য’, ইত্যাদি। এই রেটিংরা মিছিল করে মানোরা দ্বীপের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেন, সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী স্লোগান। মানোরার বহু সাধারণ বাসিন্দা সেই শোভাযাত্রায় অংশ নেন।[31]
করাচির নৌবিদ্রোহ খুব অল্প সময়েই শহরের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে। বোম্বাইয়ের মতোই, এখানেও শুরু হয় হরতাল, শ্রমিক জমায়েত এবং বিক্ষোভ। করাচির এই সর্বাত্মক প্রতিবাদে আগুয়ান ভূমিকা নেয় কমিউনিস্ট পার্টির করাচী শাখা। ২১ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, কমিউনিস্ট পার্টি বিদ্রোহের সমর্থনে হরতালের ডাক দেয়। হরতালের আগের রাতেই পুলিশ পার্টির প্রায় সমস্ত নেতাকে গ্রেপ্তার করে ফেলে। তবুও করাচির সাধারণ মানুষ হরতালকে পূর্ণতা দেয়। প্রমোদ কাপুর লিখেছেন—
তাদের নেতাদের বন্দি করার উপযুক্ত প্রতিশোধ হিসেবে, কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীলেরা করাচি শহর পুরোপুরি স্তব্ধ করে দেয়। এই হরতালের আওতায় পড়ে সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহন। কমিউনিস্ট পার্টি যে ঈদগাহ ময়দানকে প্রতিবাদ সদর দফতর হিসেবে স্থাপন করেছিল, সেখানে সিপিআই, মুসলিম লিগ ও কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন করা হয়। … মুসলিম লিগের মাহমুদ হারুন এবং কংগ্রেসের ডঃ তারাচাঁদ ও স্বামী কৃষ্ণ প্রশাসনের পক্ষে এসে জনতাকে সরে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু উলটে ময়দানে উপস্থিত জনতা তাঁদের অনুরোধ করে, তাঁরা যেন হরতালে যোগ দেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে আধুনিক করাচির অন্যতম রূপকার জামশেদ মেহতা, সিন্ধুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী স্যার গোলাম হোসেন হিদায়াতুল্লাহ-র অনুরোধে জনতাকে ছত্রভঙ্গ হওয়ার আবেদন জানান। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হন। এই সফল হরতালে উৎসাহিত হয়ে সন্ধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টি একটি জনসভা আয়োজন করে। সেখানে রেলারাম লিলারাম, শেখ আয়াজ-সহ বহু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বিপ্লবী কবিতা আবৃত্তি করেন।[32]
অবশেষে, ২৩শে ফেব্রুয়ারি, HMIS Hindustan-এর নাবিকদের শৌর্যপূর্ণ প্রতিরোধ ব্রিটিশ কামানের সামনে পর্যুদস্ত হয়। শহিদ সাথীদের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁরা বাধ্য হন আত্মসমর্পণ করতে। HMIS Bahadur-এর রেটিং অনিল রায়, হীরা লাল এবং আকবর আলির বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শালের নির্দেশ জারি হয়। মাত্র আঠারো বছর বয়সি আজমিরের পেটি অফিসার আবদুল বাকি এবং করাচির মোবারক আহমেদ-কে বিদ্রোহের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদেরও কোর্ট মার্শালের আওতায় আনা হয়।[33]
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]
[1] Purakel, Colonel Joseph. THE FORGOTTEN STRUGGLE: INDIA’S POTEMKIN HOUR. Salute. Mar 16, 2017.
[2] Mitra, Anirban. Freedom on the Waves: The Story of the 1946 Indian Naval Mutiny. The Wire. Jan 24, 2022.
[3] Mondal, Naren. Waves of Protest against Neo-Imperialism: Kallol by Utpal Dutt. Literary Herald, Vol. 6, Issue 1. June 2020.
[4] Dutt, B C. Mutiny of the Innocents. Bombay: Sindhu Publications Pvt Ltd. 1971.
[5] Vitali, Valentina. Meanings of Failed Action: A Reassessment of the 1946 Royal Indian Navy Uprising. South Asia: Journal of South Asian Studies, Volume 41, Pages 763-788. 2018.
[6] Bose, Biswanath. R.I.N Mutiny: 1946. New Delhi: Northern Book Centre. 1988.
[7] দ্রষ্টব্য, টীকা ২।
[8] দ্রষ্টব্য, টীকা ৬।
[9] Das, Dipak Kumar. Revisiting Talwar: A Study in the Royal Indian Navy Uprising of February 1946. Ajanta Publications. 1993. এবং টীকা ৫, ৬।
[10] Kapoor, Pramod. 1946 Royal Indian Navy Mutiny: Last War of Independence. Roli Books, 2022; Deshpande, Anirudh. Hope and Despair: Mutiny, Rebellion and Death in India. Primus Books. 2016.
[11] PRIYA P. ROYAL INDIAN NAVY MUTINY: A STUDY OF ITS IMPACT IN SOUTH INDIA. Ph.D Thesis, UNIVERSITY OF CALICUT. 2014; Satapute, Somnath. Role of Naval Strike Committee during RIN Mutiny 1946. Shivaji University, Kolhapur.
[12] Spence, Daniel Owen. “Beyond Talwar: A Cultural Reappraisal of the 1946 Royal Indian Navy Mutiny”. The Journal of Imperial and Commonwealth History, Volume 43(3). 2015.
[13] দ্রষ্টব্য, টীকা ৬।
[14] Meyer, John M. “The Royal Indian Navy Mutiny of 1946: Nationalist Competition and Civil-Military Relations in Postwar India”. The Journal of Imperial and Commonwealth History, Volume 45 (1). 2017.
[15] দ্রষ্টব্য, টীকা ১০।
[16] Our Last War of Independence: The Royal Indian Navy Mutiny of 1946. Indian History Collective.
[17] Borra, Ranjan. “Subhas Chandra Bose, The Indian National Army, and The War of India’s Liberation”. The Journal of Historical Review, Winter 1982 (Vol. 3, No. 4). p. 407-439-এ উদ্ধৃত।
[18] দ্রষ্টব্য, টীকা ৬।
[19] The Royal Indian Navy made the British realise it was time to leave India. Heritage Times. Jun 16, 2025.
[20] Deboo, Khorshed. The untold story of the Royal Indian Navy’s 1946 mutiny – traced through an art installation. Scroll.in. Mar 23, 2017.
[21] দ্রষ্টব্য, টীকা ৪।
[22] দ্রষ্টব্য, টীকা ১৯।
[23] Ghosh, Kalyan Kumar. THE INDIAN NATIONAL ARMY-MOTIVES, PROBLEMS AND SIGNIFICANCE. Asian Studies: Journal of Critical Perspectives on Asia. January 1961.
[24] দ্রষ্টব্য, টীকা ১০।
[25] দ্রষ্টব্য, টীকা ১০।
[26] দ্রষ্টব্য, টীকা ২।
[27] দ্রষ্টব্য, টীকা ৫।
[28] Thapar, Raj. All These Years, A Memoir. South Asia Books. Feb, 1991.
[29] দ্রষ্টব্য, টীকা ২৩।
[30] Priya, P. ROYAL INDIAN NAVY MUTINY: A STUDY OF ITS IMPACT IN SOUTH INDIA. Ph.D Thesis. UNIVERSITY OF CALICUT, 2014.
[31] Javed, Ajeet. The United Struggle of 1946. Pakistan Perspectives, Vol. 15, No. 1. Jan-Jun, 2010.
[32] দ্রষ্টব্য, টীকা ১০।
[33] দ্রষ্টব্য, টীকা ৩১।

