Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নিউ ইয়র্কের নতুন মেয়র জোহরান মামদানি ও বৈষম্য দূর করার প্রত্যাশা

আহমাদ মাযহার

 


পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণে জোহরান মামদানি জয়লাভ করেছেন। পুঁজিবাদ যেভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করে, ডেমোক্র্যাটিক সোশালিজমের বাস্তবায়ন হয়তো তা কিছুটা প্রশমিত করতে পারবে। এখন দেখবার বিষয়, মামদানির মেয়রীয় প্রয়াসে বৈষম্য কতটা কমানো সম্ভব হয়। পুঁজিবাদের প্রতাপের মধ্যে থেকেও নাগরিকদের ন্যায্যতাবোধের অনুকূলে দাঁড়ানো মানুষ জোহরান মামদানির বিজয়ী হওয়া আমেরিকার গণতন্ত্রচর্চার সৌন্দর্যের অংশ। তবে মনে রাখতে হবে— মামদানি কোনও বিপ্লব সাধন করতে যাননি

 

অনেক দিক থেকে স্বাতন্ত্র্য নিয়ে জোহরান মামদানি নিউ ইয়র্ক সিটির ১১১তম মেয়র হলেন। একদিকে তিনি প্রথম প্রজন্মের আমেরিকায় অভিবাসী, অন্যদিকে আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম, ভারতীয় মুসলিম বাবা ও হিন্দু মায়ের সন্তান। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য হয়েও তিনি ‘ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্টস অব আমেরিকা’র প্রতিনিধিত্ব করেন। আমাদের মনে রাখতে হয়, নিউ ইয়র্ক মহানগরীর মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে হলে এখানকার অধিবাসীদের জাতিগত, ধর্মীয় ও লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যের জটিলতা সামলাতে হয়। সেদিক থেকে মামদানির মেয়র হওয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা!

মেয়র প্রার্থী হিসেবে প্রাইমারিতে অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম যখন মামদানির নাম শুনি, মনে হয়েছিল তিনি সুবিধে করতে পারবেন না। কারণ আমেরিকা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র— ধনী ও গরিবের বৈষম্য নিহিত পুঁজিবাদের গভীরে। নিউ ইয়র্কবাসী হিসাবে আমি ডেমোক্র্যাট সমর্থক, কিন্তু মন্দের ভালো হিসেবে; বড় অর্থে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানের পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তেমন পার্থক্য দেখি না। সামান্য পার্থক্য পরিচয় রাজনীতিতে, সেটাকেও ডেমোক্র্যাটদের ভণ্ডামিই মনে হয়, কারণ আইন প্রয়োগে তারা রিপাবলিকানদের মতোই আচরণ করে, এমনকি পুঁজিবাদের অনুকূল সিদ্ধান্তের সময় তারা সহজেই মিলে যায় বা প্রতিকারে উদাস হয়ে পড়ে।

ডেমোক্র্যাটদের এই ভণ্ডামো নিয়ে আমার সঙ্গে মত মিলেছিল আমার ২৮ বছর বয়সী পুত্রের, যে আট বছর ধরে নিউ ইয়র্কে অভিবাসী। এখানে সে আন্ডারগ্র্যাড করেছে, রয়েছে এখানকার কর্মজীবীর অভিজ্ঞতা। তবে জোহরানের প্রতি তার দৃঢ় সমর্থন আমাকেও আগ্রহী করে তোলে। পরে খোঁজ নিয়ে দেখি, মামদানি বার্নি স্যান্ডার্সের মতোই সমাজবাদী। আমার তখন মনে হয়েছিল, বার্নির মতো মানবিক সত্তাকে কর্পোরেট ধনীরা আমেরিকায় শক্তিশালী হতে দেবে না; মামদানি হয়তো প্রাইমারিই পার হবেন না। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর আওয়াজ পাওয়া যেতে থাকে— এবং শেষ পর্যন্ত প্রাইমারিতে কুমোর বিরুদ্ধে ব্যবধান গড়ে তিনি জয়ী হন।

রাজনীতি তো আর সহজ বিষয় নয়। কুমো প্রাইমারিতে হেরে কিন্তু হাল ছাড়েননি। পারিবারিক খ্যাতি, কর্পোরেট ধনীদের ঐক্য ও অর্থবল দিয়ে তিনি মামদানিকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মুসলিম পরিচয়কে ‘জেহাদি’ অপবাদ দেওয়া, তরুণ বয়সকে অনভিজ্ঞতা বলা, এবং নিম্নআয়ের মানুষমুখী প্রস্তাবকে বাস্তবায়ন-অযোগ্য বলা— সব কৌশলই চালানো হয়। কুমোর পক্ষে বড় মিডিয়া ও কর্পোরেট অনুদান থাকলেও, মামদানির পাশে দাঁড়ান কর্পোরেট অর্থের প্রতিকূলে তাঁর নীতিসমর্থক ১ লক্ষ তরুণ স্বেচ্ছাসেবী। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছান, সশরীরে হাজির হন বিভিন্ন নেইবারহুডে, কথা বলেন ট্যাক্সিচালক ও অন্যান্য শ্রমজীবীদের সঙ্গে, সরাসরি শোনেন তাদের কথা।

সত্তরের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ভারতীয়-সহ বহু অভিবাসী শ্রমজীবী পেশায় যুক্ত ছিলেন— ট্যাক্সি চালানো, রেস্তোরাঁ বা দোকান পরিচালনা, নির্মাণকাজে অংশ নেওয়া ইত্যাদি তাঁদের জীবিকা ছিল। আর্থিক স্থিতি পেলে অনেকে কুইন্স, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কসে বাড়ি কেনেন, কিছু ভাড়া দেন। একদিকে এটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, অন্যদিকে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে। কিন্তু ২০০০-এর দশকে ভাড়াবৃদ্ধি ও গৃহচ্যুতি ব্যাপক আকার নেয়। বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়াতে থাকেন, নিম্নআয়ের ভাড়াটিয়ারা বিপদে পড়েন। অনেক অভিবাসী পরিবার নিজেরাই মালিক, আবার অনেকে ভাড়াটিয়া— এই দ্বিধাকে মামদানি গোঁজামিল দেননি। বরং তিনি বুঝিয়ে বলেন, “একাধিক বাড়ি কিনে ভাড়া দেওয়া মানে তো ব্যবসা করা, একে তো আবাসনের অধিকার বলা যায় না।” বিশেষ করে তাঁর বিরোধিতা কর্পোরেট রিয়েল এস্টেট উদ্যোগের সঙ্গে। কারণ তরুণতর বয়সে তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তার সময় অনুভব করেছেন দিনে দিনে গৃহচ্যুতির সংখ্যা বাড়ার পেছনে কর্পোরেট রিয়েল এস্টেট উদ্যোগের মুনাফা অর্জনের অদম্য লোভ।

আমি যখন নিউ ইয়র্কে আসি, তখন বাংলাদেশি জনসমাজকে স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে তেমন উৎসাহী দেখিনি। প্রার্থীরাও আমাদের ভোটার হিসেবে খুব গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু এবার মামদানি ও কুমো উভয়পক্ষই বাংলাদেশি কমিউনিটিকে গুরুত্ব দিয়েছে। মামদানি কৃতজ্ঞতা জানান বাংলাদেশের পরিণতবয়স্ক নারীদের প্রতি, যাঁরা তাঁকে খোলামেলা সমর্থন দিয়েছিলেন।

তাঁর মুসলিম পরিচয়কে আক্রমণ করে প্রতিপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে, কারণ মামদানি তা গর্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছেন এবং ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান নিয়েছেন। প্রাইমারিতে জেতার পর তাঁকে ‘জিহাদি সন্ত্রাসী’ বা ‘হামাস সমর্থক’ বলেও অপবাদ দেওয়া হয়। কিন্তু এই আক্রমণ ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। ব্রঙ্কসের এক মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আবেগঘন ভাষণে বলেন, এই আক্রমণ শুধু তাঁকেই নয়, নিউ ইয়র্কের প্রায় ১০ লাখ মুসলিমকেও অসম্মান করে। তিনি বলেন, মুসলিমরা বহুদিন ছায়ায় থেকেছে— এখন সময় এসেছে আলোর পথে চলার।

এই অবস্থান ডেমোক্র্যাটিক ভোটারদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, অনেকেই তাঁর পাশে দাঁড়ান। মামদানি তাঁর মুসলিম পরিচয়কে দুর্বলতা নয়, শক্তিতে রূপান্তর করেন নৈতিক দৃঢ়তা, ঐতিহাসিক স্মৃতি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে। এই ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম পরিচয়ের রাজনৈতিক পুনরুদ্ধার ও ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।

ইংরেজি, স্প্যানিশ, হিন্দি এবং বাংলায় সম্ভাষণ জানিয়ে তিনি তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভঙ্গির প্রকাশ করেছেন। গাজায় হামলাকে তিনি গণহত্যা বলে অভিহিত করতে দ্বিধা করেননি। ‘গ্লোবালাইজ দ্য ইন্তিফাদা’ স্লোগানকে নিন্দা না করায় কিছু ইহুদি গোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। পরে তিনি ব্যাখ্যা দেন— এই স্লোগান ব্যবহারকে তিনি নিরুৎসাহিত করবেন; তাঁর অবস্থান ইহুদি জনগণের বিরুদ্ধে নয়, বরং ইজরায়েল সরকারের নীতির বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, নিউ ইয়র্কে এলে নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করাবেন! ইজরায়েলকে তিনি এমন এক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চান, যেখানে সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। তাঁর এই অবস্থান মানবাধিকারভিত্তিক; অ্যান্টিসেমিটিক নয়।

অপবাদ সত্ত্বেও ৪৪ বছরের নিচের ৬৭ শতাংশ ইহুদি ভোটার তাঁকে সমর্থন করেছেন। এমনকি ‘জিউস ফর জোহরান’ নামে সংগঠনও গড়ে ওঠে, যেখানে ইহুদি সমর্থকেরা তাঁর পক্ষে প্রচার চালান। মামদানি ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংলাপে আগ্রহী; তাঁর বক্তব্যে বর্ণবাদ, ইসলামোফোবিয়া ও অ্যান্টিসেমিটিজমের পার্থক্য স্পষ্ট করেন। তিনি ইহুদি ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের বার্তা দেন— যা তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে এবং বিরোধীদের অপপ্রচার ব্যর্থ করে দেয়।

কথা উঠেছিল, বয়স্ক ভোটাররা তাঁকে সমর্থন দেবেন না। কিন্তু ফলাফলে দেখা যায়, এই শ্রেণির ভোটেও তিনি পিছিয়ে পড়েননি। জোহরান মামদানি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় অনেক বেশি সরাসরি, ঘনিষ্ঠ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনি রাস্তায় নেমে, দরজায় দরজায় গিয়ে, পার্কে বসে, কমিউনিটি মিটিংয়ে অংশ নিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। এই ‘নিচ থেকে ওপরে’ প্রচারণা মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছে— ‘এই লোকটা আমাদের মতো, আমাদের পাশে দাঁড়ায়।’ বিশেষ করে তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা সাধারণত ভোটে অংশ নেয় না, তারাও মামদানির জন্য ভোট দিতে উৎসাহিত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রচারণা ছিল ‘উপরে থেকে নিচে’— যা অনেকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে।

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণে জোহরান মামদানি জয়লাভ করেছেন। পুঁজিবাদ যেভাবে বৈষম্য সৃষ্টি করে, ডেমোক্র্যাটিক সোশালিজমের বাস্তবায়ন হয়তো তা কিছুটা প্রশমিত করতে পারবে। এখন দেখবার বিষয়, মামদানির মেয়রীয় প্রয়াসে বৈষম্য কতটা কমানো সম্ভব হয়। পুঁজিবাদের প্রতাপের মধ্যে থেকেও নাগরিকদের ন্যায্যতাবোধের অনুকূলে দাঁড়ানো মানুষ জোহরান মামদানির বিজয়ী হওয়া আমেরিকার গণতন্ত্রচর্চার সৌন্দর্যের অংশ। তবে মনে রাখতে হবে— মামদানি কোনও বিপ্লব সাধন করতে যাননি; তিনি বিদ্যমান বন্দোবস্ত সম্পর্কে সচেতন। অল্প বয়সেই রাজনীতির অঙ্গনে সাধারণ মানুষের অনুকূল সক্রিয়তার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের ধারণার সঙ্গে বাস্তবের বোঝাপড়াও করতে শিখেছেন বলেই মনে হয়। তবু এ-কথাও ভুলে যাওয়া যায় না যে, বিদ্যমান বন্দোবস্তের প্রণেতারা যেমন বিত্তশালী তেমনই প্রভাবশালী। সাধারণ মানুষ-মুখী কর্মতৎপরতার পেছনে শুভকামনা থাকলেও তাদের ঐকতান বড় নাজুক। সকল নিউ ইয়র্কারের শুভকামনা ও সমর্থন তাঁকে শক্তি জোগাক— এই নাজুকতাকেও অতিক্রম করতে, এমন আশাবাদই পোষণ করে যেতে পারি আমরা।


*মতামত ব্যক্তিগত