অঞ্জুশ্রী দে
দেশজুড়ে পুরীর রথ মানেই এক অন্য উন্মাদনা, দেশি-বিদেশি ভক্তের সমাগম। পুরীর গ্র্যান্ড রোড সেই দিন লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে মুখরিত হয়, আর ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে। ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রা— তিন ভাইবোন মাসির বাড়ি, অর্থাৎ গুন্ডিচা মন্দিরের পথে যাত্রা করেন। কিন্তু এই আনন্দের মাঝেও মূল মন্দিরের এক কোণে একাকী রয়ে যান দেবী মহালক্ষ্মী। তাঁর স্বামী জগন্নাথ তাঁকে রেখেই দীর্ঘ সময়ের জন্য চলেছেন মাসির বাড়ি ভ্রমণে। তাঁকে এভাবে একা রেখে যাওয়ায় লক্ষ্মীর মনে জন্ম নেয় গভীর অভিমান ও বিরহ।
এর কয়েক দিন পর জগন্নাথ ও লক্ষ্মীর দেখা হয়। এই মধুর পুনর্মিলনের গল্পই হল ‘হেরা পঞ্চমী’। রথযাত্রা উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এটি, যা প্রতি বছর রথযাত্রার ঠিক পঞ্চম দিনে পালিত হয়। ‘হেরা’ শব্দের অর্থ ‘দেখা’ বা ‘দর্শন করা’, আর ‘পঞ্চমী’ মানে পঞ্চম দিন। এই দিনটি শুধুই একটি আচার নয়, বরং মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন, মান-অভিমান, বিচ্ছেদ ও ভালোবাসার এক বাস্তব চিত্র— অর্থাৎ দেব-দেবীর কাহিনির মধ্যে দিয়ে মানুষের জীবনের বাস্তবতাকে খুঁজে দেখা।
অভিমানের প্রকাশ: গুন্ডিচা মন্দিরের পথে
হেরা পঞ্চমীর দিন পুরীর পরিবেশ এক ভিন্ন আমেজে সেজে ওঠে। দেবী লক্ষ্মীর মান-অভিমান আর ভালোবাসার উদযাপনের জন্য এই দিনটিতে বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া হয়। দিনের শুরুতেই দেবী লক্ষ্মীকে পুরীর মূল জগন্নাথ মন্দির থেকে এক সুসজ্জিত পালকিতে করে গুন্ডিচা মন্দিরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাটি অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। হাজার হাজার ভক্ত ‘জয় মা লক্ষ্মী’ এবং ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনি দিতে দিতে দেবীর এই যাত্রার সঙ্গী হন। পালকিটি ফুলের মালায় সুসজ্জিত থাকে; তাতে নানা রকম ঐতিহ্যবাহী নকশা ও প্রতীক ব্যবহার করা হয়। চারপাশে ঢাক-ঢোল, শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস।
দেবীর সেবক ও পুরোহিতরা এই শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন— যেন এক দুঃখিনী পত্নী তাঁর স্বামীর খোঁজে বেরিয়েছেন। দেবীর চোখ যেন খুঁজছে তাঁর প্রিয়তমকে। তিনি উত্তর খুঁজছেন, কেন তাঁর স্বামী তাঁকে ফেলে রেখে চলে গেলেন। এই যাত্রাটি মূলত প্রেমের টানে স্বামীর সান্নিধ্যলাভের এক ব্যাকুল প্রয়াস।
গুন্ডিচা মন্দিরে পৌঁছানোর পর আসে সেই বহুপ্রতীক্ষিত মুহূর্ত, যেখানে দেবীর অভিমান প্রকাশ্যে আসে। গুন্ডিচা মন্দিরের সামনে ভগবান জগন্নাথের যে রথ (নন্দীঘোষ রথ) রাখা থাকে, তার একটি অংশ ভেঙে দেওয়া হয়। এটি সাধারণত রথের একটি ছোট কাঠের টুকরো বা কোনও আলঙ্কারিক অংশ হয়, যা দেবীর সেবকরা ভেঙে দেন। এইভাবেই দেবীর ক্ষোভ এবং স্বামীর প্রতি অসন্তোষের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। যেন দেবী বলছেন, “তুমি আমাকে ছেড়ে চলে এসেছ? তাহলে তোমার রথেরও এমন দশা হোক!”
এই দৃশ্য ভক্তদের মনে এক মিশ্র অনুভূতি তৈরি করে— একদিকে দেবীর প্রতি সমবেদনা, অন্যদিকে আকস্মিক ঘটনার মাধ্যমে ঐশ্বরিক নাটকের প্রতি একধরনের মুগ্ধতা। ‘রথ ভাঙার’ রীতি কেবল অভিমান নয়, বরং সম্পর্কের টানাপোড়েন ও বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ফুটিয়ে তোলে, যেখানে প্রেমের সঙ্গে খানিকটা শাসনও লুকানো থাকে।
হেরা পঞ্চমী উৎসবের গুরুত্ব নিয়ে পুরীর মন্দিরের সেবাইত জনার্দন পাণ্ডা বলেন, “রথযাত্রা হল ভগবানের গৃহত্যাগ, আর হেরা পঞ্চমী হল গৃহে তাঁর প্রত্যাবর্তনের আহ্বান। এই উৎসব আমাদের কাছে শুধু একটি ধর্মীয় রীতি নয়, বরং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের এক গভীর টানাপোড়েন। রথযাত্রায় যখন ভগবান জগন্নাথ মাসির বাড়ি যান, তখন দেবী মহালক্ষ্মী একা হয়ে যান। তাঁর সেই বিরহ, অভিমান এবং রাগের মধ্যে দিয়েই ভালোবাসার এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ভালোবাসা শুধু সুখের নয়; অভিমান ও বিচ্ছেদের ক্ষণও সম্পর্কের অংশ। এই উৎসবের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি ভালোবাসার শক্তি কতটা গভীর হতে পারে, যা দূরত্ব বা রাগকেও জয় করে।”
গোপন প্রত্যাবর্তন ও ঐশ্বরিক উপাখ্যান
ক্ষোভ প্রকাশের পর দেবী লক্ষ্মী সরাসরি একই পথে মূল মন্দিরে ফিরে আসেন না। বরং, তিনি গোপনে এবং অন্য একটি পথ দিয়ে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ফিরে যান। এই ‘গোপন’ প্রত্যাবর্তন দেবীর অভিমানকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। যেন তিনি রাগ করে মুখ ঘুরিয়ে অন্য পথে চলে গেলেন, তবু তাঁর গন্তব্য স্বামীর আবাসস্থল— মূল মন্দির। এই পর্বটি প্রেম ও অভিমানের এক চিরায়ত মানবিক চিত্র তুলে ধরে, যেখানে রাগ সত্ত্বেও সম্পর্কের টান অক্ষুণ্ণ থাকে। এটি দেখায় যে, সম্পর্কের অভিমান সাময়িক হতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা চিরন্তন।
হেরা পঞ্চমী উৎসবের গভীরতা কেবল রীতিনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে রয়েছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং লোককথা। পুরীর মন্দির-সংস্কৃতির ঐতিহাসিক নথি ‘মাদলা পাঁজি’ অনুসারে, এই উৎসবের বর্তমান রূপটি শুরু হয়েছিল রাজা কপিলেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে। এর আগে হেরা পঞ্চমী একটি সাধারণ আচার হিসেবে পালিত হত, যেখানে কেবল মন্ত্র পাঠ করা হত। রাজা কপিলেন্দ্র দেব সেই প্রথা পরিবর্তন করে একটি সোনার মহালক্ষ্মী মূর্তি তৈরি করেন এবং উৎসবটিকে আরও বাস্তব ও জীবন্ত করে তোলেন, যেন দেবীর অভিমান ও ভালোবাসার দৃশ্যটি ভক্তরা নিজের চোখে দেখতে পারেন।
পৌরাণিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই উৎসবের বর্ণনা স্কন্দপুরাণেও পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, রথযাত্রার সময় জগন্নাথ যখন তাঁর মাসির বাড়িতে যান, তখন তিনি তাঁর গোপী প্রেমিকা রাধা এবং অন্যান্য সখী-সঙ্গে আনন্দ করেন। দেবী লক্ষ্মী তাঁর এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি এবং অবহেলায় ক্ষুব্ধ হন। এই ক্ষোভ থেকেই তিনি গুন্ডিচা মন্দিরে যান এবং রথ ভাঙার মাধ্যমে তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
এই ঘটনাটি মানুষের বাস্তব জীবনের মতোই। দাম্পত্যজীবনে যখন কোনও তৃতীয় নারীর আগমন ঘটে, তখন সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়। স্ত্রীর মনে রাগ, অভিমান এবং কষ্টের জন্ম দেয়। লক্ষ্মীর রথ ভাঙার এই ঘটনা সেইসব রাগ, অভিমান এবং দুঃখের এক প্রতিচ্ছবি। এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানুষের সম্পর্কের মতোই দেব-দেবীর সম্পর্কেও প্রেম, মান-অভিমান এবং বিরহ থাকতে পারে। এই কারণে ভক্তরা ঐশ্বরিক সম্পর্কের কাহিনির সঙ্গে নিজেদের জীবনকে মেলাতে পারেন।
সামাজিক ও দার্শনিক বার্তা
হেরা পঞ্চমী কেবল এক ধর্মীয় আচার নয়; এর গভীরে রয়েছে এক সুগভীর দার্শনিক ও সামাজিক বার্তা, যা যুগ যুগ ধরে ভক্তদের অনুপ্রাণিত করে। এই উৎসব দেখায় যে দেব-দেবীরাও মানবিক অনুভূতির ঊর্ধ্বে নন। তাঁদেরও রাগ, অভিমান, বিরহ এবং পুনর্মিলনের আকাঙ্ক্ষা থাকে।
এটি ভক্তদের ঈশ্বরের সঙ্গে এক আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে, কারণ তাঁরা নিজেদের জীবনেও এই অনুভূতিগুলির সম্মুখীন হন। ঈশ্বরকে কেবল দূরবর্তী বা বিমূর্ত সত্তা হিসেবে না দেখে, তাঁদের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ককে আরও নিবিড়ভাবে অনুভব করার সুযোগ করে দেয় এই উৎসব। এটি ভক্তদের মনে করিয়ে দেয় যে ঐশ্বরিক সত্তারাও ‘মানুষের মতো’— তাঁদের মধ্যেও মানবিক আবেগ রয়েছে, যা ভক্তদের সঙ্গে তাঁদের সংযোগকে আরও দৃঢ় করে।
হেরা পঞ্চমী স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। রাগ, অভিমান, বিচ্ছেদ এবং ভালোবাসার মাধ্যমে সম্পর্কের গভীরতা আরও বাড়ে— এই সত্যই এই উৎসবের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে ভালোবাসা মানে শুধু মধুরতা নয়; মান-অভিমানের দোলাচলও সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা একে আরও মজবুত করে তোলে।
সমাজে প্রাসঙ্গিকতা
আধুনিক সমাজে, যেখানে সম্পর্কগুলি প্রায়শই জটিলতা ও বিচ্ছিন্নতায় ভরে থাকে, সেখানে হেরা পঞ্চমীর মতো উৎসবগুলি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এই উৎসব আধুনিক দম্পতিদের বার্তা দেয়— ভালোবাসায় ছোটখাটো ভুলবোঝাবুঝি, বিরহ বা অভিমান থাকতেই পারে, কিন্তু মূল কথা হল সম্পর্কের ভিত্তি যেন অটুট থাকে।
দেবীর রথ ভাঙা এবং তারপরও স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার ঘটনাটি বোঝায় যে, সম্পর্কের ভাঙন নয়; বরং ভালোবাসাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। উৎসবটি ধৈর্য, ক্ষমা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার গুরুত্ব তুলে ধরে। আজকের দ্রুতগতির জীবনে, যখন অনেকেই নিজেদের আবেগ প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন, তখন হেরা পঞ্চমী মানবিক আবেগকে প্রকাশ্যে উদযাপন করার সুযোগ করে দেয়। অভিমান করা বা রাগ দেখানো দোষের নয়, যদি তার পেছনে ভালোবাসা থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তা সম্পর্কের গভীরতা বাড়ায়।
আধুনিকতা ও বিশ্বায়নের যুগে যখন পুরনো প্রথাগুলি হারিয়ে যাচ্ছে, তখন এই ধরনের উৎসবগুলি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে এবং নতুন প্রজন্মকে তাদের ঐতিহ্য, লোককথা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাদের নিজেদের শেকড়ের সঙ্গে জুড়ে থাকতে সাহায্য করে। হেরা পঞ্চমী শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; বরং একটি জীবন্ত ঐতিহ্য, যা অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে যুক্ত করে।
হেরা পঞ্চমী পুরীর রথযাত্রা উৎসবের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এই উৎসবের কাব্যিক উপস্থাপনা প্রভু জগন্নাথ এবং দেবী লক্ষ্মীর মধ্যেকার প্রেম, বিরহ, অভিমান এবং ভালোবাসার এক চিরন্তন কাহিনিকে তুলে ধরে। এটি ভক্তদের মনে গভীর ভক্তি ও মানবিকতার বীজ বুনে দেয়, তাদের মনকে আলোড়িত করে এবং আধুনিক জীবনেও সম্পর্কের মূল্যবোধ নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সুযোগ করে দেয়।
*সমস্ত ছবি লেখকের তোলা

