Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তির্যক মিলের জীবন : ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি

ঋতব্রত মিত্র

 

–কী ব্যাপার— এত রাতে? শরীর ঠিক আছে তো সবার?

–আমার চাকরিটা আর নেই ভাই…

–বলো কী? কেন?

–জানি না। সবাই বলছে অন্যান্য কবিদের সহ্য হচ্ছিল না, তাই… সম্পাদক খুব চাইছিলেন আমি থেকে যাই, কিন্তু কিছুতেই কিছুতেই হল না…

–সুনীলদা জানেন? উনি তো বিদেশে।

–দেশে ফিরলে সব বলব…

–চিন্তা কোরো না। কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হবেই…

–কবিরাই কবিদের বড় শত্রু, বুঝেছ? কবিরাই কবিদের বড় শত্রু…

–যা ভাবছ তা তো সত্যি না-ও হতে পারে!

–না রে ভাই। দেখা হলে সব কথা বলব…

–ঠিক আছে, তুমি একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করো আপাতত। অশিক্ষিত পটুত্ব দিয়ে মহৎ কবিতা নিশ্চয়ই হয় কখনও সখনও, কিন্তু আজীবন হতে পারে না। কবিতার ভান আর অহেতুক কবিতার রাজনীতি শেষ পর্যন্ত সব নষ্ট করে দেয়।

–হয়তো তাই…

–আবার যদি চাকরি ফিরে পাও কিংবা কোনও বড় পুরস্কার— দেখবে তোমার শত্রুই সবার আগে তোমার কবিতা নিয়ে অনির্বচনীয় গদ্য লিখে ফেলেছে! নিজের লেখাটা ছেড়ো না…

–জীবনানন্দের “ভয়াবহভাবে সৎ”…

–ঠিক তাই। হয়তো আমাদের প্রত্যেকেই…। এটাই কলিযুগের ট্র্যাজেডি।

 

–এটা কী হল পিনাকীদা? মাত্রা ভুল হয়ে গেল কী করে? “এর সঙ্গে ওর/ কাণ্ডে শাখায়/ ঘর্ষণে সেই/ আগুন জ্বলছে।।”

–স্বরবৃত্তে চার মাত্রাই তো হচ্ছে সব পদে। ঠিক কোন জায়গাটা বলছ বলো তো?

–এর সঙ্গে ওর— তিনটে বদ্ধ দলের সঙ্গে একটা মুক্ত দল— আধমাত্রা বেশি হয়ে গেল না— মানে ঊন একমাত্রা? পরের সংস্করণে ঠিক করে দিও যদি মনে করো…

–পরের সংস্করণ? বাংলা কবিতার বইয়ের? তা-ও আমার লেখা? হবে না গো! আমি ফুরিয়ে গেছি…

–ফুরিয়েই যদি গেছ তবে লিখলে কী করে—

বলো ছেড়ে যাবে না, বল্‌ কোথায় যাবি মাগী, গলা টিপে
তোকে এইবার
কালো কালির সমুদ্রে চান করিয়ে আনব তবে আমি
বড়ু চণ্ডীদাসের বাচ্চা, তুই দেখে নিস!

এখানে তো রজকিনী, প্রেমিকা, সরস্বতী, আবহমান পাঠক-পাঠিকা সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

–সব মিলেমিশে তালগোল পাকিয়ে গেছে। আসলে আমার জীবনটা আগাগোড়াই অমিলে ভর্তি— ছন্দ ছাড়া—ছন্নছড়া—

–অমিল নয়, পিনাকীদা। কবিদের জীবনভর আগাগোড়াই তির্যক মিল।

–ঠিক। তুমি কৃত্তিবাসে একবার প্রসঙ্গেক্রমে লিখেওছিলে আমার কবিতার কথা— তির্যক মিলের প্রয়োগ নিয়ে—মনে আছে আমার…

 

আমার মন খারাপের সাহায্যে
হল কলেজ স্ট্রিটের বাণিজ্য
খেলাম রিজুয়ারের সাত চড়।

এছাড়াও আরও মনে পড়ে যাচ্ছে তোমার সব তির্যক মিল—

আমরা পৌঁছে গিয়েছি যে একবিংশে।
যত্নে পুঁতেছি বিষবৃক্ষটি— হিংসা।
খাচ্ছি বন্ধু-বান্ধবীদের মাংস

–ঠিক বলেছ। আমার চাকরি খেয়েছে মানে আমার মাংসই কেটে খেয়েছে— শাইলক।

–ভুলে যাও। নাহলে নিজের লেখার ক্ষতি করবে নিজেই। তোমার বাবাকে যারা খুন করেছিল তাদেরও ভুলে যাও— ভুলে থাকো সজ্ঞানে। দেখবে অবচেতনায় তারাই কবিতায় ফিরে ফিরে আসবে ঠিক…

–কিন্তু সেটাও তো বিপজ্জনক। কবিতা একই বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকবে যে…

–বোধহয় তা হবে না। কারণ তুমি তো নিজেই সচেতন সবসময়। তুমি তো দেখতে পাও—

আমাদের প্রণয়ের ফুলগুলি কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে…

আর বলতেও পারো—

…হেমন্তের শেষ, বাংলা ৯৮১—
নবাবনন্দিনী আজ খুলেছে ঝরোখা— দেখে আসি!

–হ্যাঁ, বর্তমান ছেড়ে অতীতেই পালিয়ে যাব…

–কিন্তু ফিরেও আসবে। না এসে পারবে না।

শহরে ধোঁয়াশা আর বিষণ্ণ রোগের মহামারী,
…   …   …
আবছা কুয়াশামাখা খবর কাগজে হিগ্‌স-বোসনের খোঁজ
ঈশ্বরকণার গল্প চায়ের সঙ্গেই নিয়ে আসে!

 

–বিষণ্ণ রোগের ওষুধ খাচ্ছি। বুঝলে ডাক্তার? মাঝে মাঝে খেতে ভুলেও যাচ্ছি। তোমাকে আগেও বলেছিলাম…

–ওষুধ খেতে ভুলো না। তবে লেখাই তোমার সেরা ওষুধ…

মেঘ চিরে এই সোনারঙা রোদ—
পাগলা আজকে তোমার গোলাম

নির্জন আর চিরপ্রশান্ত!

–শান্তি নেই গো, শান্তি নেই। কবিতায় ক্ষণিকের জন্য একটু সান্ত্বনা চাচ্ছি আর কী!

–সেই জন্যই লিখতে পেরেছিলে—

কথা কাটাকুটি করে আমরা সন্ধেগুলো
পার করে দিচ্ছি
দোষ দাও, বিষ ঢেলে দাও, অপমান
সহ্য করি
যেখানে তুমি আমাকে ছেড়ে দিয়ে গেলে
সেখানে এখন অশরীরী আতঙ্ক
বিভীষণের জাগরণ

কোথায় পালাব?

–কিচ্ছু লিখতে পারিনি গো? একটা লেখাও থাকবে না আমার কালের বিচারে।

–পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা একথা বলবে না বলছ—

কবিতা, তোমার কাছে চাকরি খুঁজতে গেছি
কতবার
নিজের কলিজা বেচে চলে গেছি জুয়োর আসরে।

কিংবা

তিনবার দেবদাস পড়া আছে, তবু আজও
প্রেম থেকে উঠতে পারছি না!

–নিজেকে ভাঙতে পারছি না, চাইছি কিন্তু পারছি না। পারলে হয়তো হারানো চাকরিটা ফিরে পেতাম, নিয়তি অদৃষ্ট…

–ঘূর্ণিচেয়ারে বসে আছে যে?

না রে শাশ্বত বেড়াতে যাওয়ার ওই কটা নোট জোগাড় হল না
লিস্ট থেকে ঠিক নাম কেটে দেয় ঘূর্ণিচেয়ারে বসা অদৃষ্ট
আমরা চেয়েছি শ্রমের সুযোগ, লিডার বা রাজা হতে চাইনে মা
ভগবান তুমি ক্ষুধার অন্ন, ক্ষুধা মানে খিদে হ্যাঁ হ্যাঁ হাংগার

 

–কবিতার ক্ষিদে মরে আসছে যেন। আমার তো মনে হয় প্রত্যেক কবির উচিত নিজের এপিটাফ লিখে যাওয়া।

–কেন একথা বলছ, পিনাকীদা?

–আজ নয়, অন্য একদিন বলব।

–ঠিক আছে… তোমার সঙ্গে বড় একটা দেখা হয় না…

–কিন্তু কথা হয় রোজই— মনে মনে নয়তো কবিতায়, তুমি তো লিখছ প্রচুর কিন্তু ছাপতে দিতে এত অনীহা কেন? না চাইতেই ফোনে শুনিয়ে দিচ্ছ কিন্তু হাতে দিচ্ছ না যে? লোকে কিন্তু ভুল বুঝবে, সেদিন স্বাতীদিও জিজ্ঞেস করছিলেন তোমার কথা, একদিন দেখা করে এসো। মাঝে মাঝে কী ভাবি জানো? সব মানুষের সব কথা— বলা কথা, না-বলা কথা কোথাও যেন মহাকাল প্রকৃতির বুকে জমিয়ে রেখে দিচ্ছে অবিকল। একদিন তোমাদের বিজ্ঞান সেসব টেনে বার করবে ঠিক, আমাদের প্রত্যেকের জীবনযাপন, বিশ্বাস, হাঁটা-চলা, লেখা-পড়া, সবটাই প্রকৃতির বুকে— কোনও না কোনও বিশ্বে জ্যান্ত কবিতা, অফুরান সংলাপ…

–চমৎকার বললে পিনাকীদা। এই কথা এই সংলাপ কখনও শেষ হয় না—

দশ কোটি বছর একটানা রাজত্ব করেছিল ডাইনোসর
গ্রহাণুর ধাক্কায় পৃথিবী-জোড়া প্রলয়ের জলে
সাড়ে ছ-কোটি বছর আগে লুপ্ত হয়ে গেল
জুরাসিক যুগ

……

আর আমি মৃত্যুর আগের মিনিটগুলোতেও
হ্যামলেটের ডায়লগ বলছি : ওয়ার্ডস, ওয়ার্ডস, ওয়ার্ডস…
শুধু শব্দ
আর তোমার ষোল বছরের চুলে আদর করতে
পারব না কোনওদিন

 

ধার করে অশান্তি কিনে আনা হল না আর!
এখনও মস্তিষ্ক কাজ করছে… মরে যাচ্ছি আমি
তবু বুঝতে পারছি এটা হ্যামিল্টনগঞ্জ হাসপাতাল

তরাইয়ের গরিব গির্জা, উন্মাদের মতো ওই ছুটে আসছে
ক্যারলের সুরে
একটা গান….