Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যুবরাজ ও বঙ্গললনা

স্বাতী মৈত্র

 

আগের পর্বের পর

১৮৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে কবি তরু দত্ত তাঁর বান্ধবী মিস মেরি মার্টিনকে একটি চিঠিতে লেখেন,

যুবরাজ গত সোমবার কলকাতা ছেড়ে গেলেন। আমরা ওনাকে দেখবার বেশ কয়েকটা ভালো সুযোগ পেয়েছিলাম, যদিও আমরা ঠিক ওনাকেই দেখবো, এরকমটা ভেবে রাস্তায় বেরোইনি। একবার যখন আমরা স্ট্র্যান্ডের ধারে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম, তখন দেখি উনি সেরাপিসের [যুবরাজের জাহাজ] উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন, লাঞ্চ খেতে। ওনার কোচ তখন বেশ ধীরে চলছিল, আমাদেরও, তাই আমি ওনাকে বেশ ভালো করে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমাদের কোচ দুটো একে অপরের পাশ দিয়ে গিয়েছিল, অতএব আমি ওনার প্রশান্ত, সুপুরুষ অবয়ব ও হাস্যময় নীল চোখ ভালো করে দেখতে পাই। তুমি তো ওনাকে দেখেছো, তাই না? ওনার মাথার চুল ভারী সুন্দর লালচে-খয়েরি রঙের, যদিও কপালের কাছটা কিছুটা খালি হয়ে আসছে। ওনার বিবাহের সময় রাসেল [ওয়াল্টার] স্কটের এই বহুপরিচিত লাইনগুলো একটু এদিক ওদিক করে ওনার বর্ণনা দিয়েছিলেন,

Blue was his eagle eye,
And auburn of the richest dye
His short moustache and hair.

আবার যেদিন সকালে উনি এখানকার রথী-মহারথীদের অনেককে নাইটহুড দিতে যাচ্ছিলেন, সেদিনও ওনাকে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম। বেলগাছিয়াতে ওনার জন্য যে সান্ধ্য বিনোদনের আসর বসানো হয়েছিল কলকাতার নেটিভ সমাজের তরফ থেকে, সেখানে বাবা [গোবিন চন্দ্র দত্ত] ওনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এ ছাড়াও ওনার কলকাতা আসার উপলক্ষে যে সকল নেটিভ রাজা-মহারাজারা কলকাতা আসেন, তাঁদের অনেককেই আমরা দেখেছি। কাশ্মীরের মহারাজার রত্নখচিত পাগড়িটির দাম প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা ছিল। উনি যুবরাজকে প্রচুর দামী উপহারও দিয়েছেন, যার মধ্যে ১০১টি অসামান্য সুন্দর কাজ করা কাশ্মীরি শাল রয়েছে। তার কাপড়ও সেরকম। এ ছাড়াও তিনি ওনাকে একটা হীরে-জহরতখচিত সোনার হুঁকো উপহার দেন, একটি সোনার ডিনার সেট দেন, একটি সোনার টি সেট দেন, একটি রুপোর বিছানা এবং একটি কাশ্মীরি কাজের তাঁবু (তার পোস্টগুলো সোনার) দেন। এ ছাড়াও আরও কত কিছু ছিল, আমার এখন মনে নেই। রাজকুমারীর [আলেজান্দ্রা] জন্য উপহারও এনেছিলেন তিনি। যুবরাজ এখন লখনউতে আছেন। বেনারসে একজন ধনী জমিদার ওনাকে একটি মুকুট উপহার দেন যার দাম প্রায় ৬ লক্ষ টাকা।

তরু দত্তের যুবরাজ-বর্ণনা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং কিছুটা ব্যতিক্রমীও বলা যায়। উনিশ শতকের সাত দশক কেটে গিয়ে থাকলেও সে সময়কার কলকাতায় যুবরাজকে স্বচক্ষে দেখে তাঁর রূপের বর্ণনা দিতে পারবেন, এমন মহিলা কমই ছিলেন। রামবাগানের দত্ত পরিবার সে যুগের কলকাতার অন্যতম অভিজাত ও ক্ষমতাশালী কয়েকটি পরিবারের মধ্যে গণ্য হত। এ ছাড়াও ইংল্যান্ড-ফ্রান্সে বড় হয়ে, কেমব্রিজে হায়ার লেকচার্স ফর উইমেনে অংশগ্রহণ করে আসা তরু যে কলকাতার বেশির ভাগ মেয়ের থেকেই একটু আলাদা ছিলেন, এ কথা বলাই বাহুল্য! তায় উপরোক্ত চিঠিটি আবার প্রিয় বান্ধবীকে লেখা চিঠি, অতএব তরু সেখানে অকপটে যুবরাজ-দর্শন সম্পর্কে নিজের মতামত রেখেছেন। বার্টির ফ্যাশনেবল চুল (কেতাদুরস্ত বাঙালি যুবকের “অ্যালবার্ট ফ্যাশন”!) হালকা হয়ে আসলেও যে তিনি বেশ সুপুরুষ, তা লেখিকার নজর এড়ায়নি। এ হেন সুপুরুষ যুবরাজ একটি অভিজাত পরিবারের অন্দরমহলে মহিলাদের দ্বারা আপ্যায়িত হলে উনিশ শতকের কলকাতা যে আঁতকে উঠবে, এ আর আশ্চর্য কী?

এ কথা মনে রাখা দরকার যে সে যুগে কলকাতায় এক দিক দিয়ে পাবলিক থিয়েটারে নটী বিনোদিনীর মতন মেয়েরা সমাজের নিম্নস্তর থেকে উঠে এসে মঞ্চে অভিনয়ে নামছেন, সঙ্গে জুটছে বহু তাচ্ছিল্য ও বিদ্রুপ, জুটছে যৌন শোষণ (এ বিষয়ে বিনোদিনীর “আমার কথা” অবশ্যপাঠ্য)। অপর দিকে “ভদ্র” পরিবারের মেয়েদের মধ্যে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা তখন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে অনেক ধরণের দৃষ্টান্ত স্থাপনা করছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনীর মতন অরু ও তরু দত্ত, রাজকুমারী বন্দ্যোপাধ্যায়রাও শুধু বাড়ির বাইরে নয়, একেবারে বিলাত যাত্রা করছেন। চিত্রা দেব বলেছেন, জ্ঞানদানন্দিনী প্রসঙ্গে,

জ্ঞানদানন্দিনীর সাধনার নেপথ্য ইতিহাসটি খুব পরিষ্কার নয়। সবাই জানি, তিনি স্বামীর স্বপ্নকে সফল করেছিলেন। কিন্তু কী সেই স্বপ্ন? মেয়েরা পুরুষের পাশে এসে দাঁড়াবেন শিক্ষায় যোগ্যতায় সমমর্যাদা নিয়ে, এই তো। আজকের দিনে এর গুরুত্ব অনুভব করাও শক্ত। কারণ জ্ঞানদানন্দিনী যা করেছেন তা এমনিতে হয়ত খুব কষ্টকর নয় কিন্তু প্রথম কাজ হিসাবে অসম্ভব রকমের কঠিন। আজ যখন শুনি, তিনি প্রথম বাঙালিনী, যিনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তখন সবটাই হাস্যকর বলে মনে হয়। কী এমন শক্ত কাজ? সাহসেরই বা দরকার। কী? এ নিয়ে এত হৈচৈ করারই বা কী আছে? তবু হৈচৈ হয়েছিল।

জ্ঞানদানন্দিনীর “প্রথম” হওয়াটা অবশ্যই অভিজাত উচ্চবর্ণ হিন্দু নারীদের হিসেবে — নিম্নবর্ণের মেয়েদের ইতিহাস এটা আদৌ নয়। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সাথে সাথে বাইরে আসা শুরু করেছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের মেয়েরাও — ১৮৭২ সালে অন্নদাচরণ খাস্তগির ও দুর্গামোহন দাস তাঁদের স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে প্রকাশ্যে সবার সাথে উপাসনায় বসেন, স্বয়ং আচার্যর অনুমতি নিয়ে। এর আগে মেয়েদের জন্য আলাদা চিক ঘেরা উপাসনা-স্থল রাখা দস্তুর ছিল। সমাজের বাকিদের এই নিয়ে আপত্তি না থাকায় কেশব সেনও আর এই নিয়ে কোন আপত্তি জানাননি। চিত্রা দেবের ভাষায়, “এইভাবে প্রকাশ্যে পর্দার বিরোধিতা শোনা গেল। জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অব ওয়েলসের সঙ্গে নিজের পরিবারের মহিলাদের সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। সে নিয়েও কত কাণ্ড হল!”

যুবরাজ বার্টি সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে হিন্দু জেনানা-দর্শনে গিয়েছিলেন, এ কথা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জেনানা-দর্শনের এই ইচ্ছার ফলে তিনি একরকম হোঁচট খেয়েই এমন একটি বিষয়ে স্বল্প সময়ের জন্য জড়িয়ে পরেছিলেন, যে বিষয়ে উনিশ শতকের কলকাতার শিক্ষিত-অভিজাত মহল বেশ কিছুদিন ধরেই তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত। অর্থাৎ, নারী শিক্ষা, নারী মুক্তি, এবং আধুনিক যুগের আধুনিক বাঙালি ভদ্রমহিলার উপযুক্ত জীবনযাপন। তরু দত্তর চিঠির ভাষাতে বললে,

আজকাল বাবু জগদানন্দ মুখার্জি নামের একজন বাঙালি ভদ্রলোক ও প্লিডারের নামে খুব আলোচনা হচ্ছে, কারণ তিনি যুবরাজকে নিজের [বাড়ির] জেনানামহল দেখতে দিয়েছেন। নেটিভ পরিচালিত সবকটা খবরের কাগজ ‘হিন্দু সমাজের অপমানের’ বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। যুবরাজ এমনিতে তাঁর সফরে কোন ব্যক্তির বাড়ি যাননি, এবং উনি মুখার্জিবাবুর বাড়িতে এই জন্যই গিয়েছিলেন কারণ তাঁকে কথা দেওয়া হয়েছিল যে একটি অভিজাত নেটিভ পরিবারের জেনানামহল তাঁকে দেখানো হবে। উপরোক্ত বাবুর এই ধরণের ‘স্ক্যান্ডালাস ব্যবহার’, কাগজগুলোর মতে, কলকাতার বেশির ভাগ হিন্দুই ক্ষমা করবেন না। তবে কলকাতার ডেইলি নিউজ কাগজে একটা বেশ সুচিন্তিত লেখা বেরিয়েছিল এই বিষয়ে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি বাবু [জগদানন্দ] এটাই ঠিক করে থাকেন যে তিনি তাঁর পরিবারকে অন্দরমহলের বাইরে নিয়ে আসবেন, যেমন ইংরেজ সমাজে সমস্ত ইউরোপীয়রা করে থাকেন, যদি তিনি ভদ্রজনোচিত ব্যবহারের খাতিরে তাঁর বন্ধুদের সাথে তাঁর পরিবারের আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিতে চান, তাহলে উনি সত্যিই ভালোর জন্য এই কাজটা করছেন বলতে হবে, ওনার উদ্দেশ্য মহান। কিন্তু উনি যদি কেবল যুবরাজ ও তাঁর পার্ষদদের জন্য এই একবার এটা করে থাকেন এবং সাধারণ সময়ে নিজের স্ত্রী ও পরিবারকে উনি বাকি সব হিন্দুদের মতন অন্দরমহলে বন্দী রাখতেই ইচ্ছুক, তাহলে আমরা বলবো যে যুবরাজকে ওনার পরিবারের সাথে আলাপ করানো স্রেফ একরকমের চামচাগিরি যা ক্ষমার অযোগ্য ও যার সমালোচনা হওয়া জরুরি।

এ কথা উল্লেখযোগ্য যে পাশ্চাত্য জীবনদর্শনে দিক্ষিত তরু দত্তের কাছে নারী-পুরুষের মেলামেশা বেশ স্বাভাবিক বিষয়। সুপুরুষ (চুল হালকা হয়ে আসলেও) ও রমণীমোহন নামে খ্যাত যুবরাজের সাথে মুখার্জি পরিবারের মেয়েদের খোদ জেনানামহলে আলাপচারিতার ফলে হিন্দু খতরে মে হ্যায়, এ কথা তাঁর আদৌ মনে হয়নি। আরেক বিখ্যাত দত্ত, মাইকেল মধুসূদনের মতন তাঁর পিতা ‘গোভিন’ চন্দ্র দত্তও সপরিবারে খৃষ্টান হয়েছিলেন, যার ফলে রামবাগানের হিন্দু দত্তদের সাথে তাঁদের যোগাযোগ ছিলনা বললেই চলে (ঐতিহাসিক ও লেখক রমেশচন্দ্র দত্ত এ ব্যাপারে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন, তরু দত্তদের সাথে তাঁর যোগাযোগ কোনদিন ছিন্ন হয়নি)। হয়তো — চিত্রা দেবের ভাষায় বললে — ‘বিলাতি’ হয়ে গিয়েছিলেন বলেই তিনি পুরো ঘটনাবলি সাবলীল ভঙ্গিতে, বেশ রসিয়ে রসিয়ে বান্ধবীকে লিখতে পেরেছেন। অবশ্যই, এর সাথে রয়েছে হালকা সন্দেহ — বাবু জগদানন্দ সত্যি সত্যিই নারী মুক্তিতে আগ্রহী, নাকি এটা নেহাতই চাটুকারিতা? এই সন্দেহ কিন্তু তরু দত্ত একা করেননি।

তরু দত্ত

***

হিন্দু খতরে মে হ্যায়, এ কথা তরু দত্ত না মনে করলেও ভারতীয় (পুরুষ)-পরিচালিত বাকি বেশির ভাগ সংবাদপত্রগুলো যে করেছিল, এ কথাও আমরা তাঁর জবানিতেই পাই। অমৃতবাজার পত্রিকা বলে, “হিন্দু সমাজ সব কিছু মেনে নিতে পারে, কিন্তু হিন্দু মহিলাদের অসম্মান কোনভাবেই না। যে ব্যক্তি নিজের পরিবারকে বাইরের জগতের দ্বারা অশুচি হতে দেয়, সে হিন্দু সমাজের কুলাঙ্গার, না, সে হিন্দু সমাজের শত্রু।” হিন্দু প্যাট্রিয়ট বলে, “বাবু [জগদানন্দ] তাঁর সম্মানের যে মূল্য দিয়েছেন, তাতে দেশের অনুভূতির অবমাননা হয়েছে।” এখানে দায় সরাসরি বাবু জগদানন্দ মুখার্জির, এবং তাঁর হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে শুধু তাঁর পরিবারের মেয়েদেরই নয়, কলকাতা শহরের সমগ্র হিন্দু সমাজের অবমাননা হয়েছে, তাঁদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে।

অন্দরমহল ও তার পবিত্রতা সম্পর্কে উনিশ শতকের ‘ভদ্র’ হিন্দু সমাজের যে বিশেষ মাথাব্যথা ছিল, তা আজ আধুনিক ঐতিহাসিক-সমাজ বিজ্ঞানীদের রচনায় বহু আলোচিত। বাইরের পরাধীন জগত ও তার সমস্ত ম্লেচ্ছ অপবিত্রতার থেকে দূরে থাকা ‘পবিত্র’ অন্দরমহলের সাথে সে সময়ের লেখার বহু রোমাঞ্চ জড়িয়ে। হিন্দু নারীর পরপুরুষ ও বিজাতীয়-বর্জিত অন্দরমহলে থাকাটা যে পরাজিত, পরাধীন হিন্দু সমাজের রক্ষাকবচ, এই নিয়েও বিশেষ সন্দেহ ছিলনা। সেই কারণেই বাংলা সাহিত্যের পরিচিত ট্রোপে কিনু গোয়ালার এঁদো গলি আর সদাগরি অফিসের দমবন্ধ করা জগতের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে ধলেশ্বরী নদী-তমালের বন-ঢাকাই শাড়ি-সিঁদুরের মায়াময় দুনিয়া, তার অধিষ্ঠাত্রী স্বয়ং গৃহলক্ষ্মী। হরিপদ কেরানিদের বহু আশা-আকাঙ্ক্ষার স্থান এই অন্দরমহল, দেওয়ালে বসে থাকা অপ্রাসঙ্গিক সরীসৃপ থেকে আকবর বাদশা হয়ে ওঠবার এই একটিমাত্র স্থল তার। এ হেন অন্দরমহলেও ইংরেজের বিজয়ধ্বনি বেজে উঠলে আপত্তি না উঠে যায় কেমন করে? বঙ্গমহিলার মতন রাজভক্ত পত্রিকার পাতাতেও তাই মৃদু সমালোচনা শোনা যায়,

এই সভায় [কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বারা প্রদত্ত ডি,এল্‌ উপাধি গ্রহণ উপলক্ষে সভা] আসিবার পূর্ব্বে যুবরাজ কতিপয় বন্ধু ও সম্ভ্রান্ত ইউরোপীয় মহিলার সহিত রায় জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বাটিতে বাঙ্গালী স্ত্রীলোক দেখিবার আশয়ে গমন করিয়াছিলেন। তিনি উক্ত বাবুর পত্নী কন্যা ও অপর কয়েকটি আত্মীয় স্ত্রীলোক দেখিয়া যার পর নাই আহ্লাদিত হইয়াছিলেন। বঙ্গ কুলবধূর কুলমান ও লজ্জা ইতিহাস বিখ্যাত; ইহাদিগকে অপর জাতির পুরুষদিগের দেখা দূরে থাকুক, স্বজাতি বা স্বগৃহের অন্য পুরুষদিগেরও দেখিবার সম্ভাবনা নাই। ইহারা অন্তঃপুরে মধ্যে অবগুণ্ঠনাচ্ছাদিত হইয়া কালযাপন করে। অতএব এই দুর্লভ-স্ত্রী-রত্ন দেখিতে যুবরাজ যে সাতিশয় কৌতূহল প্রকাশ করিবেন এবং দেখিয়া বলিবেন, “আমি ভারতবর্ষে আসিয়া অবধি এমন সুন্দর দৃশ্য আর কিছুই দেখি নাই,” ইহা বিচিত্র নহে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যুবরাজ-দর্শন-লাভ বিনিময়ে উক্ত সীমন্তিনীগণ কিরূপে তাহাঁদিগের এত দিনের গৌরবান্বিত কুললজ্জা বিসর্জ্জন দিয়া যুবরাজের সহিত আলাপ করিলেন্‌!!! এতদ্দেশীয় মহিলাগণের পরমসুহৃৎ ও হিতৈষিণী মিস্‌ মেরি কার্পেন্টারের সহিত একমত হইয়া আমরা বলিতে পারি যে, আমাদিগের মহিলাগণের জনসমাজে বহির্গত হইবার এখনও সময় হয় নাই।

যুবরাজের বিশেষ সমালোচনা করার দুঃসাহস বঙ্গমহিলার সম্পাদক দেখাননি — সমালোচনার তীর অতএব সরাসরি মুখোপাধ্যায় পরিবারের মেয়েদের প্রতি। লজ্জা নারীর ভূষণ জেনেও যে গৃহলক্ষ্মীগণ লজ্জার মাথা খেয়ে যুবরাজের সাথে হ্যাংলার মতন আলাপ করলেন, তাঁরা অলক্ষ্মীর সাধক। সাথে সাথে পাঠিকাদের উদ্দেশ্য তিনি এ কথাও বলে দিতে ভোলেননি যে সুদূর ভবিষ্যতে কখনো বাংলার হিন্দু মেয়েদের অন্তঃপুর ত্যাগ করার সময় হয়তো আসতেই পারে, কিন্তু এ সময় সেই সময় নয়, পাঠিকারা যেন ভুলেও মুখোপাধ্যায় গৃহের নির্লজ্জ মহিলাদের পথে না হাঁটেন — তা সে যতই সুপুরুষ যুবরাজ হন না কেন।

“কুললজ্জা বিসর্জন দেওয়ার” প্রসঙ্গে মুখোপাধ্যায় পরিবারের মেয়েরা কী ভেবেছিলেন? সে সময়ের নারী মুক্তি আন্দোলনের বিষয়ে কী ছিল তাঁদের মতামত? যুবরাজের বিচিত্র আবদার, মিস বেরিং, লেডি টেম্পলের মতন ইংরেজ মহিলাদের প্রয়াস ও বাবু জগদানন্দের উদ্যোগ — এই সবেরই হদিশ পাই আমরা ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু অন্দরমহলে যুবরাজকে আপ্যায়নের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? তরু দত্তের মতন তাঁরাও কি যুবরাজ বার্টির “প্রশান্ত, সুপুরুষ অবয়ব ও হাস্যময় নীল চোখ” ভাল করে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন? বার্টির সেই বিখ্যাত হাসি তাঁদের কেমন লেগেছিল? আধুনিক সেলেব্রিটি দর্শনের মতই তাঁরাও কি যুবরাজের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে উদ্বেলিত হয়েছিলেন? মেয়েমহলে তার আগে ও পরে আলোচনাই বা কেমন হয়েছিল?

এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বা তাঁদের জবানবন্দি, কোনটারই সন্ধান পাইনি এখনো অবধি।

ইতিহাসের এ এক অদ্ভুত বিড়ম্বনা — একদিকে নীরবতা, আরেকদিকে পুরুষ কণ্ঠের উগ্র ক্যাকোফোনি, সমাজ-সংসার উচ্ছন্নে যাওয়া-ইংরেজ দ্বারা (আরও একবার) ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা-মিশ্রিত কোলাহল।

পয়লা জানুয়ারি, ১৮৭৬। যোধপুরের মহারাজাকে অর্ডার অফ দা স্টার অফ ইন্ডিয়া খেতাব দিচ্ছেন যুবরাজ। এটি নয়া দিল্লীর ইম্পিরিয়াল হোটেলে আছে, এবং এই ছবির সূত্র ভিক্টোরিয়ানওয়েব ডট অর্গ

***

উনিশ শতকের কলকাতার ক্রমবর্ধমান জন পরিসর ও তার কোলাহল, মহারানী ভিক্টোরিয়ার নানা সঙ্গত-অসঙ্গত আশঙ্কা, এবং যুবরাজের সর্বজনবিদিত খামখেয়ালিপনা, এই সমস্ত কিছু মাথায় রেখে বার্টির সফরসূচি তৈরি হয়েছিল। তা সত্ত্বেও জেনানামহল ও তার বাসিন্দাদের দেখবার আবদারটি আদায় করে ফেলার সাথে সাথে যুবরাজ হোঁচট খেয়ে আরো এমন একটি বিষয়ে স্বল্প সময়ের জন্য জড়িয়ে পরেছিলেন যা নেহাতই কলকাতার নিজস্ব। একে সে সময়ের ভাষায় ‘দলাদলি’ বলা চলে।

আজকের কথ্য ভাষায় ‘দলাদলি’ কথাটা হয়তো কেবলমাত্র জোট বেঁধে ঘোঁট পাকানোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ইংরেজিতে যাকে ফ্যাকশনালিজম বলে। কিন্তু উনিশ শতকের কলকাতায় এই ফ্যাকশানলিজমেরও একটা নির্দিষ্ট জাতি-নির্ধারিত চরিত্র ছিল। ‘দল’ সেই সময়ের উচ্চবর্ণ হিন্দু সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল। এ কথা মনে রাখা দরকার যে নগর কলকাতা বাংলার ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব স্থান। চিরাচরিত হিন্দু সমাজ ও তার তথাকথিত সমাজপতিদের ক্ষমতা অনেকটাই শিথিল কলকাতা শহরে, অথচ বাণিজ্যের অমোঘ টানে সেখানে না গিয়ে উপায় নেই। অতএব বর্ণ হিন্দু সমাজের মনে আশঙ্কা — ম্লেচ্ছের শহরে জাতি-কূল রক্ষা কেমন করে সম্ভব? আদৌ সম্ভব কি?

ঐতিহাসিক সৌমেন্দ্রনাথ মুখার্জি বলেছেন যে অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতায় বিবাহ, জাতি পবিত্রতা রক্ষা, এবং সম্পত্তি — ইংরেজ আইনের বহির্ভূত এই ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সমাধানের জন্য কম্পানি বাহাদুর কিছু ‘জাতিমালা কাছারি’ স্থাপন করেছিলেন, যদিও সেই স্থাপনার সঠিক সাল-তারিখ জানা যায়না। জাতিমালা কাছারি নামক প্রতিষ্ঠানটি আসলে আরো পুরনো — নগেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বকোষে (১৯০৮) আমরা জানতে পারি যে সুলতানি শাসনকালে, চৈতন্য-পরবর্তী আমলে, জাতিমালা কাছারির প্রথম প্রয়োজন দেখা দেয়,

এই সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের সময় ধৰ্ম্মস্বাতন্ত্র্য ও জাতিগত পার্থক্যনিবন্ধন বঙ্গভূমে নিয়তই সামাজিক বাদানুবাদ লইয়া বিশেষ গোলযোগ উপস্থিত হইত। মুসলমান নরপতি বা সর্দ্দারগণের অনুগৃহীত ব্যক্তিই তৎকালে সমাজবাহ্য বলিয়৷ নিন্দিত হইতেন। এই সামাজিক আন্দোলন সময় সময় রাজ্যের মহা অশান্তিকর হইত বলিয়াই মুসলমান সুলতানগণ জাতিবিচারের জন্য একটি স্বতন্ত্র ‘জাতিমালা-কাছারী’ নির্দিষ্ট করিয়া রাখেন। কুলগ্রন্থে লিখিত আছে, দেবীবরের [ঘটক] অভ্যুদয়ের পূৰ্ব্বে দত্তখাস উপাধিধারী এক ব্যক্তি মুসলমানরাজের মন্ত্রী ছিলেন। তিনিই ঐ জাতিমালা কাছারির প্রধান বিচারপতি হন। তাঁহার সভায় রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণগণের ৫৭মঃ সমীকরণ হইয়াছিল।

অনুমান করা যায় যে বর্ণহিন্দুদের জটিল জাতপাতের হিসেবে না ঢুকে পূর্ববর্তী শাসকদের পন্থাই অনুসরণ করা শ্রেয় মনে করেছিলেন কম্পানির শাসকেরা। ওয়ারেন হেস্টিংসের কাগজপত্রের সূত্রে আমরা জানতে পারি যে অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতায় কম্পানির নির্দেশানুসারে গভর্নর সাহেবের প্রধান মুৎসুদ্দি অথবা বেনিয়া এই জাতিমালা কাছারিগুলির শীর্ষে অবস্থিত হতেন, ‘প্রেসিডেন্ট’ পদে। শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এই দায়িত্ব পালন করবার জন্য নবকৃষ্ণ দেব, গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, এবং কান্ত বাবু নিযুক্ত হয়েছিলেন। যদিও কম্পানির আইন অনুযায়ী সারা বাংলাতেই হিন্দু সমাজের সমস্যা সমাধান করবার কথা এই জাতিমালা কাছারির, কলকাতার বাইরে এদের ক্ষমতা কতদূর ছিল তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সৌমেন্দ্রনাথ মুখার্জি কলকাতায় বসবাসকারি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যেও এই কাছারিগুলোর প্রভাব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, কারণ খোদ হেস্টিংসের বয়ান অনুযায়ী জাতিমালা কাছারির গুরুত্ব কেবল “নিম্নবর্গের মানুষের বিতর্ক সমাধানে” দেখা যেত। উচ্চবর্ণের মানুষজন সম্ভবত বিয়ে, সম্পত্তি বা জাতপাত-কেন্দ্রিক বিতর্কের নিষ্পত্তি করতে কম্পানির কাছারিতে আসতেন না — তাঁরা যেতেন তাঁদের দলের কাছে।

কলকাতায় জাতি-ভিত্তিক এই দলসমূহের প্রথম পত্তন কবে হয়, তা বলা সম্ভব নয়। তবে এ কথা আমরা জানি যে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, নবকৃষ্ণ দেব যতদিনে কলকাতায় আসেন, সেই সময়ে কলকাতায় উচ্চবর্ণ সমাজে দুটো প্রধান দল ছিল — একটির দলপতি কৃষ্টচরণ মিত্র, এবং অন্যটির হাটখোলার দত্তবাড়ির মদন মোহন দত্ত। প্রথমে কৃষ্ণচরণ মিত্রের দলে যোগ দিলেও শীঘ্রই নবকৃষ্ণ দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থদের গোষ্ঠীপতি নির্বাচিত হন। এরপরে তিনি নিজেই একটি স্বতন্ত্র ও প্রভাবশালী দলের দলপতি হয়ে বসেন।

উনিশ শতকের সাথে সাথে কলকাতায় ধনী ও উচ্চবর্ণের ব্যক্তিত্বদের বসবাস বাড়তে থাকে, এবং সেই সাথে বাড়তে থাকে বিভিন্ন জাতি-ভিত্তিক দলের সংখ্যা। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কলিকাতা কমলালয় গ্রন্থে লিখেছেন যে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ, কুমোর, কামার, তিলি, মালী, শাঁখারি, কংশবণিক, তন্তুবায় ইত্যাদি সমস্ত জাতির দলই উনিশ শতকের গোড়ার স্থাপনা হয়, যদিও আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই সমস্ত দলের সঠিক হিসেব করা সম্ভব না। বেশির ভাগ জাতিরই নিজস্ব জাতিভিত্তিক দল ছিল, যেখানে জাতির নিজস্ব ব্যাপারস্যাপার মিটিয়ে নেওয়া হত। পাথুরিয়াঘাটা ও চোরবাগানের মল্লিকরা যেমন সুবর্ণবণিকদের দলের দলপতি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলেন। এ ছাড়াও এই সমস্ত সদস্যদের অনেকেই বৃহৎ বহুজাতির দলগুলিরও সদস্য ছিলেন। যতদূর জানা যায়, একসময় কলকাতার সবথেকে বড় পাঁচটি দলের দলপতি ছিলেন রাধাকান্ত দেব, আশুতোষ দেব, ঠাকুর পরিবার, বিশ্বনাথ মতিলাল, এবং কালীনাথ মুন্সী। এর মধ্যেও শোভাবাজারের দেব ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের দল বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো।

দলাদলির বর্ণময় ইতিহাস আমাদের এই কাহিনীর স্বল্প পরিসরে বলা নেহাতই অসম্ভব, তবে এটুকু মনে রাখা প্রয়োজন যে দল ও দলাদলির অসীম গুরুত্ব ছিল উনিশ শতকের কলকাতার অভিজাত হিন্দু সমাজে। দলপতি ছিলেন চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী। প্রদীপ বসুর ভাষায়,

কলকাতার ভদ্রলোক সমাজে দলপতিদের ছিল অপ্রতিহত ক্ষমতা। দলস্থ লোকের কাছে তিনি ছিলেন এক ভীতির ব্যাপার, কারণ তিনি ছিলেন দলস্থ সকলের জাতি, জীবন ও ধর্মের রক্ষক ও ভক্ষক। দলস্থ মানুষদের সন্তানের জন্ম, বিবাহ, শ্রাদ্ধ প্রভৃতি অনুষ্ঠানে দলপতির অনুমোদন জরুরি ছিল। তিনি ঠিক করে দিতেন কে নিমন্ত্রিত হবেন এবং কাকে নিমন্ত্রণ করা যাবে না, ক’জন ব্রাহ্মণকে ডাকতে হবে ইত্যাদি। দলের কেন্দ্রে থাকতেন ধনী ও প্রাচীন পরিবার, দলপতি সেই পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ হতেন, তাঁর নিকট আত্মীয়রা দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হতেন। তবে পরিবার সব সময় একজোট থাকত এমন নয়।…

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কলিকাতা কমলালয়’ বইতে দল সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘দলপতির অনুমতি ব্যতিরেকে কোন স্থানে গমন করা যায় না। পুনশ্চ বলি, ‘যখন যিনি দলভুক্ত হয়েন, তখন দলপতির ফর্দে তাঁহাকে নিজ নাম লেখাইতে হয় এবং যদি কোন ব্যক্তি দোষী বা অপবাদগ্রস্থ হয় তবে দলপতি দলস্থ সকলকে ডাকাইলে তাঁহার নিকট যাইতে হয়। সকলের পরামর্শে যাহা স্থির হয় তাহা দলপতি আজ্ঞা করিলেই করিতে হয়।’ ভবানীচরণ এই দলগুলিকে ভদ্রলোকের দল বলেছেন। আর বলেছেন, অনৈক্য ছাড়া দল হয় না। তবে আজকের রাজনৈতিক দলের নেতাদের মতো দলপতিকে যথেষ্ট কাজ করতে হত। রাধাকান্ত দেবের দলটি সম্ভবত কলকাতার সবচেয়ে বড় দল ছিল। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকা থেকে জানতে পারি, এই দলের প্রতি মিটিং-এ দলপতি অন্তত দুশো পিটিশনের উপর ব্যবস্থা দিতেন।

বলা বাহুল্য, বাঙালি ভদ্রলোকদের দলপতিকে রীতিমতো তোষামোদ করতে হত।

চণ্ডাল রমণীর সাথে বাস করা ব্রাহ্মণ সন্তান সম্পত্তি পাবেন না পাবেননা, জনৈক তিলি রমণীর পরিবারের একজন মহিলা এক নাবিকের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পরে তাঁর জাত থাকবে কি থাকবেনা, কোন এক মধুসূদন মিত্র তাঁর মেয়ের বিয়ে ‘ভুল’ জাতের ছেলের সাথে দেওয়ার পরে তাঁর কী হবে — এ জাতীয় গুরুতর সমস্যার বিধান দেওয়া ও ব্যবস্থা করা একেকটা দলের মূল কাজ ছিল। ভাবতে অবাক লাগলেও ‘রেনেসাঁর’ কলকাতার বুকেই ছিল জলজ্যান্ত ‘পল্লী সমাজ’, তার মাথায় ছিলেন অভিজাত জ্ঞানীগুণী অনেকেই!

এক দিকে যেমন জাতপাত বাঁচিয়ে রাখা ও সেই সূত্রে ক্ষমতার বিস্তার চলতো যথাসাধ্য, আরেকদিক দিয়ে ইংরেজ শাসনাধীন কলকাতায় যতটুকু রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা যায়, সেই ব্যাপারেও দলগুলোর যথেষ্ট নজর ছিল, প্রতিযোগিতাও কম ছিলনা। সে সময়ে ভারতীয়দের পক্ষে খুব উঁচু পদ পাওয়া সম্ভব ছিলনা, তাই যতটুকু পাওয়া যেত, তাই নিয়েও কাড়াকাড়ি পরে যেত। যেমন, ডেপুটি কালেক্টরের পদ, অথবা জাস্টিস অফ পিস পদে মনোনিত হয়ে পুরসভা পরিচালনার কাজে যুক্ত হওয়া — সেই নিয়েই তুমুল প্রতিযোগিতা চলতো। কম্পানি বাহাদুর কিছুটা মোগল ধাঁচেই ভারতীয় ক্ষমতাশালীদের খেতাব দিয়ে খুশি রাখতেন। ‘এমিনেন্ট’, ‘লয়াল নেটিভ’ জাতীয় প্রশংসা জুটতো তাঁদের ভাগ্যে, নানা সামাজিক ও শিক্ষামূলক কাজেকর্মে নিযুক্ত কমিটি বা সোসাইটিতে নির্বাচিত (যেমন স্কুল বুক সোসাইটি, বা হিন্দু কলেজের পরিচালক গোষ্ঠী) হওয়াটাও বেশ সম্মানের ও সামাজিক ক্ষমতার ব্যাপার ছিল।

দ্বারকানাথ ঠাকুরের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে যুবরাজ অভ্যর্থনার প্যারডি, বসন্তকের পাতায়। একই সাথে অভিজাতদের ‘কমিটি’-প্রীতির প্রসঙ্গে খোঁচা দিতে ভোলেননি লেখক। জাতির উল্লেখে দলাদলির ইঙ্গিতও পরিষ্কার।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য দলগুলোর ক্ষমতা ক্রমে শিথিল হয়ে আসে। পূর্ব বঙ্গ থেকে আগত নিত্যনতুন ছাত্রের দল, চাকরির টানে আসা বহু ‘ভদ্রলোক’ — এঁদের সকলকে দলের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হত না।

বাবু জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় কোন দলের সদস্য ছিলেন, তা জানা আজকে হয়তো সম্ভব নয়। তবে তিনি প্রভাবশালী ছিলেন নিঃসন্দেহে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম কমিটিতে রাধাকান্ত দেব (সভাপতি), প্রসন্নকুমার ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্রদের সাথে তিনিও ছিলেন। সরকারি গ্যাজেট ঘেঁটে দেখা যায় আলীপুর দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনা কমিটিতেও তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, হাটখোলার দত্তদের মুখপত্র — সুকুমার সেনের ভাষায় “কলকাতার কায়েতদের গালাগালি আর খিস্তি-খেউরের কাগজ” — বসন্তকে যখন বলা হয়, “বেঁচে থাকো মুখুজ্যের পো খেল্লে ভালো চোটে।/ তোমার খেলায় রাংরূপা হয়ে গোবরে শালুক ফোটে।।/ ফিব্রুদানে এক তাড়াতে কল্লে বাজি মাৎ।/ মাছ কাতুরে ভেকো হল কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ।।”, তখন সন্দেহ জাগে, হয়তো অনেকের চোখেই মুখুজ্যের পোর যুবরাজ অভ্যর্থনা যতটা না নারী মুক্তির পক্ষে নেওয়া পদক্ষেপ ছিল, তার থেকেও বেশি ছিল সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চাল। দলাদলির মূল ধারা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত তরু দত্তর মনেও যখন এ হেন সন্দেহ জেগেছিল, তখন বাকিদের মনে তা না জাগাই আশ্চর্য!

সমাজ সংস্কারের ভাষা ব্যবহার করে ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার এ হেন উদ্যোগ, অন্যান্য ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলপতিদের পিছনে ফেলে দিয়ে, সারা জাগাবে তো বটেই। তরু দত্তই তো আমাদের এটাও বলেছেন যে, “যুবরাজ এমনিতে তাঁর সফরে কোন ব্যক্তির বাড়ি যাননি, এবং উনি মুখার্জিবাবুর বাড়িতে এই জন্যই গিয়েছিলেন কারণ তাঁকে কথা দেওয়া হয়েছিল যে একটি অভিজাত নেটিভ পরিবারের জেনানামহল তাঁকে দেখানো হবে।” তাবড় তাবড় দলের দলপতি যা করতে পারেননি — স্বগৃহে যুবরাজকে একান্তে আপ্যায়ন — তাই করতে সক্ষম হয়েছিলেন বাবু জগদানন্দ।

আর তারপর?

সে প্রসঙ্গে আসব পরবর্তী (শেষ) অধ্যায়ে। সঙ্গে থাকবে বসন্তকের ব্যঙ্গ, ও রাজদ্রোহ।

মহারানী ও যুবরাজের ঠিকুজি কোষ্ঠী। বসন্তক।

***