Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আবহমান

কৌশিক লাহিড়ী

 

প্রথমবার গিয়েছিলাম বাবার হাত ধরে, পার্ক স্ট্রিট ময়দানের বইমেলায়।

সেটা বোধ হয় আটাত্তর অথবা উনআশি সাল।

সত্যজিৎ রায় এসেছেন। স্টলের বাইরে থেকে সেই সুদীর্ঘ অবয়ব দেখার চেষ্টা এবং ব্যর্থ হওয়া।

চিরঞ্জীব সেনের ‘বার্মুডা রহস্য’, দানিকেনের ‘দেবতারা কি গ্রহান্তরের মানুষ’, ‘বীজ ও মহাবিশ্ব’ আর বোধহয় অদ্রীশ বর্ধনের ‘ফ্যান্টাস্টিক্, অজিত দত্তের ‘মহাভারতের স্বর্গদেবতা’ নিয়ে বাড়ি ফেরা।

কলেজে ঢোকার পর চুরাশি পঁচাশি থেকে নিয়মিত।

একা একা। বইয়ের সাথে একা একা।

পার্ক স্ট্রিট ময়দান।

অস্তগামী সূর্যের আলোমাখা চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালের অবয়ব।

আগুন।

দুইহাত ভরা বইয়ের বস্তা নিয়ে হাওড়ায় পৌঁছানো, ভুল ট্রেনে উঠে পড়া এবং সেটা বুঝতে পেরে দরজার কাছের ভিড় ঠেলে প্ল্যাটফর্ম পেরোনোর আগের মুহূর্তে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেওয়া, বই বাঁচাতে গিয়ে চশমা ভাঙা, এভিসের ব্লু জিন্সের ভেতর দিয়ে রক্তাক্ত হাঁটু আর একচোখে কাচহীন চশমার ভেতর দিয়ে ঝাপসা চোখে বাড়ি ফেরা।

এইভাবেই দেখা পেতাম অক্ষরের ঈশ্বরদের সাথে।

কোনও দিন দেখা হত ধুতি পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘদেহী নীরেন্দ্রনাথের সাথে। আপনমনে হেঁটে চলেছেন। মনে হত দৌড়ে গিয়ে বলি, ‘কলঘরে চিলের কান্না’ আমার খুব ভাল লাগে।

সস্ত্রীক অন্নদাশংকর। ক্ষীণতনু। ধূসর স্যুট।

কখনও চোখে পড়ত এলোমেলো কাঁচা পাকা চুলে হাতে সিগারেট উজ্জ্বল চোখ একটি চেনা মুখ।

পূর্ণেন্দু পত্রী!

উনি তো আর জানেন না, ‘বুকের মধ্যে বড়ে গোলাম’ কবিতাটা আমি অন্তত সাতাত্তর বার পড়েছি!

অরুণ মিত্রের ফরাসি সৌরভ।

রত্নেশ্বর হাজরার নির্ভার অলৌকিক অক্ষরমালার কাছে শর্তহীন আত্মসমর্পণ।

স্বয়ং সুরমা ঘটকের হাত থেকে ঋত্বিকের ছবির চিত্রনাট্য পাওয়া।

আরব গেরিলাদের সমর্থন করেও সন্দীপন চট্টোর সাথে প্রবল তক্কাতক্কি।

তিস্তাপারের দেবেশের সাথে মিশে যাচ্ছেন চারাবাড়ি, পোড়াবাড়ির তারাপদ।

আমাদের কাণ্ডজ্ঞান! নইলে নীল দিগন্ত ফেলে জ্ঞানগম্যি বেশি বিক্রি হয়!

জেল থেকে সদ্য ছাড়া পাওয়া দীর্ঘদেহী, আজিজুল হক। অতটা শীর্ণকায়ে অমন জ্বলজ্বলে চোখ আমি আর কখনও দেখিনি।

ওই তো গেরুয়া পাঞ্জাবিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়! সাথে একটা চলমান মিছিল।

ও দিকে বরেন গঙ্গোপাধ্যায় সঙ্গে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তুমুল আড্ডায় মত্ত। হাসির ফোয়ারা ছুটছে। পাশে সিরাজ, স্মিতহাসি, স্বল্পবাক।

সুমন চট্টো তখন সবে কাল্ট ফিগার হয়ে উঠছেন। কবীর হয়ে উঠতে তখন ঢের বাকি।

সুধীর মৈত্র মশায়ের নরম (এবং পরম) সান্নিধ্য, হিরণ্ময় কার্লেকারের সাথে হঠাৎ সখ্য এবং ওঁর গাড়ি করে হস্টেলে ফেরা।

আবার কখনও কোনও অলৌকিক বিকেলে সারা পৃথিবীর আলো এসে পড়ত হঠাৎ কোনও স্টলের সামনে।

বুদ্ধদেব গুহ এসেছেন।

সে তো আসা নয়, আবির্ভাব!

ঋজুদা সমগ্র প্রথম খণ্ড উৎসর্গপত্রে আমার নাম!

সেই সূত্রে জীবনে প্রথমবার অটোগ্রাফ দেওয়া এক সম্মোহিত কিশোরকে!

নতুন সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকের প্রায় শেষে পৌছে স্মার্ট ফোনে, সেলফিতে, রসনা ও বিস্তৃত বাসনা-বিলাসে, আবরণে, আভরণে, নেটওয়ার্কিং-এ, বিজ্ঞাপনে, বিপননে, মাইক্রোফোনে, অনুপ্রেরণায়, ভ্রষ্ট, ধর্ষিত হই-হই মেলা থেকে ফিরে এসে অনেকদিন আগে পড়া বনফুলের একটা গল্প  মনে পড়ে যায়।

ঝাপসা চোখে, রক্তক্ষরণে।

‘পাঠকের মৃত্যু’।

 

[আর একটা কথা।

চার দশক বা সিকি শতাব্দী আগের কোনও ব্যক্তিগত বিকেলের রক্তোচ্ছাসের স্মৃতিসিক্ততা কেবলমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক বেদনাবিলাসেই সীমায়িত নয়।

আর যেহেতু পরিবর্তনটাই ধ্রুব, বদলে যাওয়াটাই নিয়ম তাই বিশ্বাস করি আমার লেখাটির শেষ অংশের শুভনাস্তিক্য সত্ত্বেও…

বইমেলা চিরন্তনী হবে।

নতুন লেখক/লেখিকাকে নিয়ে নতুন পাঠক/পাঠিকার উচ্ছাস, প্রিয় মানুষটির অটোগ্রাফ চাওয়ার বদলে তাঁর সঙ্গে সেলফি তোলার শিহরণ, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার বাৎসরিক গ্ৰুপমিটে চেনা নামের সঙ্গে মুখমিলিয়ে নেওয়ার আনন্দ, গ্রুপফি তোলার উন্মাদনা এমন মুহূর্তের মিছিল এখনও সৃষ্টি হয়, হয়ে চলেছে, প্রতিনিয়ত।

আর, প্রকৃত পাঠক, পরমা পাঠিকা মৃত্যুহীন।

বইমেলাও।]