Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যে জীবন ফেসবুকের, সেলফির… সেলেবের সাথে হয়ে যায় দেখা

চিরশ্রী দাশগুপ্ত

 

বিকাশ ভবনের ঠিক উল্টোদিকে, ২নং গেট দিয়ে মেলায় পা রাখতেই একটুকরো আমার শহর… মালদাইয়া।

আজন্ম চেনা মুখগুলো একমুখ হাসি নিয়ে আমারই অপেক্ষায়। “বাব্বা! এতক্ষণে সময় হল তোর?”

আমিও অপরিচিতের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার জেলা-শহরের ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বইমেলায় নিজের জায়গা করে নেওয়া মফস্বলের সংস্কৃতির। আগামী সাতদিনের জন্য আমাদেরও বই-অবই-কথা-হাসি-গান আর আড্ডার অস্থায়ী ঠিকানা ১৬ বাই ১৬-র এই প্যাভিলিয়নটা। একঝাঁক ঝরঝরে মুখ একডাকে হাজির গিটার কাঁধে, ওরা চঞ্চল… ওরা নতুন… ওরাও মফস্বল… এই শহরেই পড়াশুনো… এই শহরেই সাবালক হতে আসা মফস্বলী সবুজ মন আর চোখগুলোর। ফেসবুকের পাবলিক পোস্ট থেকে ওরা জেনেছে আর তাই আজ এখানে… প্রথম দেখা, প্রথম পরিচয়। গানে-কবিতায় মাতিয়ে রাখল সারাক্ষণ।

প্রাথমিক পর্ব শেষ হতেই নোটিফিকেশন এল, “মুক্তমঞ্চের সামনে ওয়েটিং। তুমি কোথায়?”

রিপ্লাই দিলেও ডেলিভারি হল না… নেটওয়ার্ক জ্যাম। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে চোখ আটকায় অভিযানে। থমকে যায় কান। “হ্যালো! হ্যালো! তুমি কোথায়? ধুর, শোনাই তো যাচ্ছে না কিছু!”

বুঝলাম, আবারও সেই জ্যামিং-এর চক্করে পড়েছে কেউ। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ পড়ল, তখনও ডেলিভার্ড হয়নি আমার উত্তর। অগত্যা আবার পা চালিয়ে মুক্তমঞ্চের খোঁজ। শিশু বইমেলা পার হতেই চোখে পড়ল… ওই তো মুক্তমঞ্চ। প্রাণপণে মোবাইল খুঁটিয়ে যাচ্ছে সৌমিত্রদা। কাছে যেতেই অমলিন সেই হাসি… “কী হে! তুমি তো দেখি, ঈশ্বরেরও ওপরে। তেমন করে ডাকলে শুনি, তাঁরও দেখা পাওয়া যায়, কিন্তু তোমার দেখা নেই। প্রায় আধঘণ্টা ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছ। ফোনে পাওয়া যায় না… মেসেজ করলে উত্তর দাও না! যাচ্ছেতাই তো!”

বাক্যবাণে বিধ্বস্ত আমি নিজেকে গুছিয়ে নিতে না নিতেই সামনে দেখি একগাল দাড়ি নিয়ে হাসিমুখে রাজীবদা। রাজীব সিংহ, আমাদের রাজীবদা। আম-মালদাইয়ার এই প্রজন্মকে হাত ধরে বাংলা সাহিত্যজগতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

‘লিটল ম্যাগ থেকে বেরিয়ে চললে কোথায়?’

‘যাওয়া কি আর যায় রে? মিডিয়া সেন্টার থেকে আজ আমার একটা বই প্রকাশ হবে, ওখানেই যাচ্ছি। চল, চল…’ অতঃপর হ্যাঁচকা টানে মিডিয়া সেন্টার… মধ্যবর্তী পথটুকু সৌমিত্রদা আর রাজীবদার আলাপচারিতার মাঝে মফস্বলী চোখ কখনও বাংলাদেশে তো কখনও গুয়াতেমালায় তো কখনও থিমে।

লিরিক্যাল বুকস-এ দাঁড়িয়ে সৌমিত দেবের উচ্ছন্নে যাওয়ার রাস্তার পাতা ওল্টাচ্ছিলাম, কাউন্টারে যিনি বসেছিলেন… বললেন, “একটা সেলফি হোক?”

লোভ তো সামলানো গেলই না, কিন্তু আমায় তো আপনি চেনেন না! বললেন, “এই তো চিনলাম।”

সেলফি শেষে আপলোড হচ্ছে দেখে বললাম, আমায় ট্যাগ করবেন প্লিজ। আপনার নাম?

নামটা শুনে চমকে উঠলাম… সামনের সারিতে সবগুলো বইতেই তো এই নামটাই দেখছি… “সামরান হুদা।”

একমুখ হাসি নিয়ে বললেন, “আমারই পাবলিকেশন।”

লেখক-প্রকাশকের সঙ্গে এমন আচমকা মোলাকাতের প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আবার হাঁটা।

কারিগরে ‘অনুপম কথা’ হাতে নিয়ে পেছন ফিরতেই কানে এল, “চেনা চেনা লাগছে!” অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে এল… “সম… রাজ্ঞী!” খানিক আগেই সৃষ্টিসুখে পেলাম ‘পৃথিবীর বাইরের শহরের’। ওখানেও এইসি কি ত্যায়সি হাতে নিয়েই দেখি, সামনে পথজুড়ে সৌরাংশু। কুশল বিনিময় মিটিয়ে আজকালে ছুটলাম শুভজিতের খোঁজে, যে কিনা বিজ্ঞাপনে বিরতি দেয় না! একে একে অভিষেক, অভীক দত্ত আর আরও আরও অনেক ফেসবুক মুখের মুখোমুখি হলাম কখনও প্ল্যানে কখনও বা আচমকাই।

বিনায়কদার সঙ্গে কাল দেখা হবে।

ফিরতি পথে আবার সৌমিত্রদা।

“কই হে! হল তোমার মেলা ঘোরা আর সেলেব দর্শন! আমায় আর পাত্তা দেবে কেন?”

প্রসঙ্গত চুপিচুপি বলে রাখি, ইনিই সেই প্রখ্যাত তথ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার, যিনি একখানা ছবি বানিয়ে তৎকালীন ভারত সরকারের চক্ষুশূল হয়ে বসেছিলেন। তাহলেই পাঠক বুঝে নেবেন, কে সেলেব আর কে শুধু দর্শনেই খুশি???

দর্শনেই সুখলাভ হেতু সবসময় স্রষ্টা নয়, সৃষ্টিতেই খুশি থাকতে হয়। ঠিক তাই, পত্রভারতী থেকে শ্রীজাত’র সদ্য প্রকাশিত যা কিছু আজ ব্যক্তিগতকে হস্তগত করেই খুশি খুশি মনে বাড়ি ফিরতে হল। খুশি হওয়াটা নিজের ওপর। চারপাশের ঝাঁ চকচকে মোড়কের আর ঝকঝকে ছাপা বই দেখে সত্যি আজ মনটা কেমন আলো আলো হয়ে যায়। বইমেলায় কারিগর-কৃতি, পাঠক, লিরিক্যাল বুকস, কলিকাতা লেটার প্রেস, প্রতিভাস আর প্রতিক্ষণের মতো বাংলা প্রকাশকদের আজকের এই ছবি মনে করিয়ে দেয়, প্রকাশনা আজ শিল্প। অপ্রয়োজনীয় কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে প্রচুর নতুন নতুন কলম এখন নিজেই নিজের লেখা প্রকাশের আগ্রহ দেখান। একজন কবি বা লেখক যতটা ভালোবাসার সঙ্গে লেখাটির জন্ম দেন, অনেক প্রকাশকও যে আজকাল ততটাই যত্ন নিয়ে বইটি প্রকাশ করেন, একথা বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। লেখক আর পাঠকের মধ্যে যে বা যাঁরা যত্ন করে এই সেতুবন্ধন করছেন, নিঃসন্দেহে তাঁদের অনেক পাওনা। একথা মানতেই হয়, ভালো লেখা কিন্তু আসলে ভালো ছাপাই দাবি করে। ভালো ছাপা নইলে কিন্তু বহু ভালো লেখাই ন্যায্য মন পায় না, রীতিমতো ইনজাস্টিস হয়। এখন থাক সেসব কথা, সে না হয় অন্য আরেকদিন হবে। হচ্ছিল নতুন বইয়ের গন্ধের কথা আর একরাশ উজ্জ্বল মুখের ভিড়ে আলো আলো হয়ে আসা মনগুলোর কথা। তিনদিনের মেলাযাপন শেষে আজ ফেরার পালা আবার সেই থোড়-বড়ি-খাড়া জীবনে আর আবারও বছরভর অপেক্ষা আর অপেক্ষার প্র্যাকটিস।। ততদিনের জন্য রসদ রইল ঝুলিতে।