Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্নেহা — নো-কাস্ট নো-রিলিজিয়ন এবং কিছু ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ

স্নেহা

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

ভেলোরের তিরুপাত্তুর। একটি তামিল মেয়ে। বয়স পঁয়ত্রিশ। সারা মুখে হাসি। আলো। কেন? যুদ্ধজয়। কোন সে যুদ্ধ? সীমান্তে? নাহ। ভেতরে যুদ্ধ। মননের ভেতরে, সমাজের ভেতরে, ঢুকে বসে থাকা নিয়মের ভেতরে। স্নেহা জিতেছেন। স্নেহা। এম.এ. স্নেহা। পুলিশ কাস্টডিতে নিহত তেলেঙ্গানার মেয়ে স্নেহলতার নামে নাম রাখা। এম এ যথাক্রমে মনিমঝি এবং আনন্দকৃষ্ণন। মা, বাবা। চেন্নাই ল’ কলেজের ব্যাচমেট। ভালোবাসা। বিয়ে। সঙ্গী কমিউনিজম, নিরীশ্বরবাদ। মনিমঝি-আনন্দ তিন মেয়ের নাম রাখলেন মিলিয়েমিশিয়ে। স্নেহা, জেনিফার এবং মমতাজ সুরাইয়া। হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলিম। ছোটবেলা থেকেই স্কুল কলেজের ধর্ম, জাতির জায়গায় ব্ল্যাঙ্ক। ফাঁকা। লড়াই শুরু। দৃষ্টান্ত। স্নেহা বড় হয়েছিলেন এমনই এক ঘরে। ঘর মানে শুধুই বন্ধন না। এটা ওটা না করার আদেশ না। ঘর মানে বিপ্লব। মনিমঝি, আনন্দ এমনই এক ঘরে থাকতেন। স্নেহার লড়াইটা অবশ্য তারপর তৈরি হওয়া আরেক জেদ থেকে। মানুষ কমিউনিটি সার্টিফিকেট পায় তপশীলি জাতি, উপজাতির তকমায়। কখনও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া গোত্রের। সেখানেও জাতি, ধর্ম চলে আসে। কেন জাতিবিহীন, ধর্মবিহীন চেতনার এমন এক সম্মান আসবে না? স্নেহা চিঠি লিখলেন। অ্যাপ্লাই। রিজেক্টেড। অ্যাপ্লাই। রিজেক্টেড। শেষবার অ্যাপ্লাই ২০১৭-র মে মাসে। রবার্ট ব্রুসের মাকড়সা। স্নেহার জীবনে অবশ্য জাল পাতত জেদ। কেন হবে না? অধিকার আছে তো? প্রমাণ আছে তো? কী সেই প্রমাণ? ছোটবেলা। স্কুল কলেজের কোনও সার্টিফিকেটে জাতি ধর্মের কথা বলা নেই। তিরুপাত্তুরের সাব-কালেক্টর, তহশীলদার দেখলেন, বুঝলেন, পাশে দাঁড়ালেন। ন’ বছরের লড়াই। অবশেষে দেশের প্রথম মানুষ হিসেবে নো কাস্ট নো রিলিজিয়ন সার্টিফিকেট। সেই স্নেহা। বিবাহিতা। স্বামী, আসলে তো প্রিয় বন্ধু। কমরেড। কে. পার্থিবরাজা। তিরুপাত্তুরের সেক্রেড হার্ট কলেজের অধ্যাপক। স্নেহার লড়াই চিনেছেন, বুঝেছে্ন,‌ পাশে এসেছেন। পার্থিবের নিজের জীবনের শুরুটা কিছুটা রক্ষণশীল হলেও পরে মার্ক্স, পেরিয়ার, আম্বেদকরের লেখা পড়ে বামপন্থায় আসা। তারপর পাশে স্নেহার মতো মুখ, হাত, স্পর্শ। ওঁদের বিয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক ধর্মমতে হয়নি। পার্থিব-স্নেহার তিন মেয়ে। নাম? অধিরাই নাসরিন, অধীলা ইরিনে, আরিফা জেসি। বৌদ্ধ, ইসলাম, খ্রিস্টান মিশে যাওয়া। মা-বাবার লেগ্যাসি ধরে রাখা। সর্বধর্মসমন্বয়ের কোনও লোকদেখানো বিজ্ঞাপন না। ভালোবাসার, সঙ্কল্পের প্রতীক। ধর্মের দিকে, বিভাজনের দিকে, ঈশ্বরের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ। ব্যক্তিগত থেকে পারিবারিক আলো। দৃষ্টান্ত। ওদের তিন মেয়ের স্কুল, কলেজেও পারিবারিক দৃষ্টান্ত। জাতি, ধর্মের জায়গায় ফাঁকা। ভারতীয় পরিচয়। ওটুকুই। ওটুকুই যে অনেক। কখনও মনে হয় হেরে যাচ্ছেন? নরম হচ্ছেন? পায়ের তলায় মাটি সরছে? নাহ। স্নেহা জানেন তাঁর এক বোনের ছোট থেকেই থ্যালাসেমিয়া। নিয়মিত ব্লাড ট্রান্সফিউশন। আজ পর্যন্ত কোনওদিন একবারের জন্যেও ঈশ্বর শব্দটার কথা মাথায় আসেনি স্নেহার। আমৃত্যু আসবে না। প্রচারের আলো? সার্টিফিকেট পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলকালাম। ফোনের পর ফোন। বিরক্ত হন? গর্ব? অহঙ্কার? আসে? স্নেহা জানেন সেসবের সময় নেই। তাঁর আলো দেখানো কাজ। শুরু করেছেন। রাস্তা এখনও অনেকটা। পুরো পরিবারের জন্য সার্টিফিকেট বের করবেন স্নেহা। কোনও সুবিধে আদায় নয়, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এখানেও। যোগাযোগ আসছে আরও অনেক স্নেহার থেকে। তাঁর বাবা মায়ের থেকে যে ট্র্যাডিশন তিনি পেয়েছেন, সেদিন থেকে কিছুটা প্রিভিলেজড তিনি। স্নেহা নিজেও জানেন। অনেকের স্কুল কলেজের সার্টিফিকেটে জাতি ধর্মের জায়গায় জ্বলজ্বল করে হিন্দু, মুসলিম …। যুক্তিতে ফেরেন বয়স বাড়লে। তাঁরা আনন্দকৃষ্ণন, মনিমোঝির মতো বাবা মা পান না। তাঁদের লড়াই? তাঁরা চাইলে কীভাবে পাবেন এমন সার্টিফিকেট? স্নেহার উত্তর, তাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হোন। কারণ তাঁদের লড়াই আরেকটু কঠিন। তবে অসম্ভব না। স্বামী পার্থিব যেমন। ছোটবেলায় কমিউনিটি কাস্ট সার্টিফিকেট আছে। স্নেহার মতো পারিবারিক কাঠিন্য, জোর কিছুই নেই। পার্থিব তাই সার্টিফিকেট পেতে আদালতে যাবেন। পাশে থাকবেন স্নেহা। জিততে দেখবেন স্বামীকে।

শেষটুকুতে কমল হাসান থাকুন। হ্যাঁ, কমল। দেশের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক অভিনেতা। টুইট করেছিলেন স্নেহাকে। কী লিখলেন? ‘ইউ হ্যাভ অ্যাকচুয়েটেড এ লং ডরম্যান্ট ডিসায়্যার অ্যামং ইন্ডিয়ান্স। লেট’স ডিসকার্ড হোয়াট নেভার বিলংড টু আস। লেট আস কাস্ট অ্যাওয়ে কাস্ট’। ধর্ম সরে যাও। জাতি সরে যাও। মানুষ, তুমি এসো…