Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জিন্নাহ ও দেশভাগ

জিন্নাহ ও দেশভাগ

সৌমিত্র দস্তিদার

 

পূর্ব প্রসঙ্গ — জিন্নাহ : অন্তরের স্ববিরোধ

আমরা এখন এমন একটা অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেখানে যুক্তি-বুদ্ধি-বিতর্ক পিছনে ফেলে বোধহীন অন্ধ আবেগ গুরুত্ব পাচ্ছে। আর আমি কিনা লিখতে বসেছি যে দেশটাকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার সমবেত দাবি উঠেছে তার অন্যতম জনক কায়েদ-এ-আজম জিন্নাহ-বৃত্তান্ত!

আমি অবশ্য কোনও জিন্নাহ জীবনচরিত বা মহান গাথা লিখতে বসিনি। দোষেগুণে বর্ণময় এই বিতর্কিত চরিত্র কেমন ছিলেন, প্রথাগত ধারণার বাইরে গিয়ে তা নিয়ে একটু চর্চা করতে চেয়েছি মাত্র। এমন একজন মানুষ, যিনি ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষিত, আদ্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত, তিনি কীভাবে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে একেবারে দেশবিভাজনের এক ও অদ্বিতীয় খলনায়ক হয়ে গেলেন— তা সত্যিই আমাদের বিস্মিত করে।

জিন্নাহকে নিয়ে লিখব মানে শুধুমাত্র জিন্নাহ-র কথাই উঠে আসবে, এরকম যান্ত্রিক বিশ্লেষণ অবশ্য করা বেশ মুশকিল। ওই সময়ের পটভূমি নিয়ে আলোচনা ছাড়া জিন্নাহ চরিত্রের কাটাছেঁড়া সম্ভব নয়। পটভূমি মানেই সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো আমরা দেখতে পাব ডাকসাইটে সব চরিত্রের ভিড়। মহাত্মা গান্ধী। জওহরলাল নেহরু। মতিলাল নেহরু। বল্লভভাই পাটেল। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। সাভারকর। বাল গঙ্গাধর তিলক। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। আরও কত শত গুরুত্বপূর্ণ নাম, যারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়ে গেছেন।

আবার কোনও কোনও নাম ইচ্ছে করেও মুছে দিয়েছে আমাদের জাতীয়তাবাদী ইতিহাস। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে জালিওয়ানওয়ালাবাগ অতি পরিচিত নাম। এই গণহত্যা ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। বস্তুত, ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মাধ্যমে যে জাতীয়তাবাদের সূচনা তা গতি পেয়েছিল বৃটিশ সরকারের দ্বারা জালিয়ানওয়ালাবাগের শান্তিপূর্ণ জমায়েতে গুলি চালিয়ে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে খুন করার মধ্যে দিয়ে। কুখ্যাত রাওলাট আইন যেভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলা চালিয়েছিল তাতে ভারতীয় মাত্রই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। আগুনে ঘি পড়ল জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের পর। সারা দেশে নিন্দের ঝড় উঠল। নাইট উপাধি ত্যাগ করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আরও একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পদত্যাগ করে ইংরেজ প্রতিনিধিকে জানিয়ে দিলেন— ‘রাওলাট আইন যেভাবে পাস করানো হয়েছে তার প্রতিবাদে আমি ইস্তফা দিচ্ছি। আমি মনে করি যে পরিস্থিতি তাতে কাউন্সিলে থেকে আমি দেশের সাধারণ মানুষের কোনও কাজে লাগব না। যে সরকার এ ধরনের কালো আইন লাগু করে, তারা আর যাই হোক নিজেকে সভ্য বলে দাবি করতে পারে না।’ এই রাওলাট আইনের প্রতিবাদেই জালিয়ানাওয়ালাবাগের জমায়েতে গুলি চালিয়েছিল জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে বৃটিশ সেনা। ওই হত্যাকাণ্ড, আগেই বলেছি, গোটা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিল। অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রামেও গতি এল। হিন্দু মুসলিম মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল বৃটিশদের বিরুদ্ধে।

মোটামুটি সবাই জানেন যে শত শত লোক শহিদ হয়েছিলেন জালিওয়ানাবাগে। অনেকের লাশ সনাক্ত করা যায়নি। ফলে তাদের পরিচয়ও কোনওদিন জানা যায়নি। এই জানা-অজানা শহিদদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম শিখ সব সম্প্রদায়ের লোকই ছিলেন। কমপক্ষে ছাপ্পান্ন জন মুসলমান সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন। নব্য হিন্দুত্ববাদের হিংস্র আস্ফালনের কালে আজ কোথায় হারিয়ে গেছেন সেদিনের আব্দুল করিম, আব্দুল কাইয়ুম, আব্দুল মজিদ, আবদুলিয়া, আবদুল্লা আরও অজস্র শহিদের নাম। হারিয়ে গেছেন সেদিন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সামনে থাকা এক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয়তাবাদী নেতার নাম। ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লড়াইয়ে তাঁর যাবতীয় অবদান। কাউন্সিল সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা, যে ইস্তফাপত্রের অংশবিশেষ কিছুক্ষণ আগেই উদ্ধৃত করলাম৷ না, একটু বোধহয় ভুল বললাম বোধহয়। শুধু ভুলিয়েই দেওয়া হয়নি, আমাদের চেনা পাঠে তাঁর নাম নেওয়াটাই যেন গর্হিত অপরাধ। তিনিই তো খলনায়ক। দেশভাগের জন্য একমাত্র অপরাধী। তিনি মহম্মদ আলি জিন্নাহ।

ইতিহাস বড় নির্মম। সে কখনও কারও অধীনতা মেনে নিতে চায় না। তাই কারওর ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাস হয়েও সারাজীবন চলতে পারে না সে। ইতিহাস অনেকটা নদীর মতো। যতই বাধা দেওয়া হোক না কেন, আপন ছন্দে চলতে চলতে নিজের গতিপথ ঠিক খুঁজে নেয়। কথায় আছে নদী যা নেয় সময় হলে তা ফেরতও দিয়ে দেয়।

তাই আমাদের চেনা ইতিহাস যতই জিন্নাহকে অস্বীকার করুক, প্রকৃত ও পক্ষপাতহীন ইতিহাস রচনায় জিন্নাহকে একতরফা গালমন্দ করে নিছক ভিলেন করে তোলা যাবে না।

মহম্মদ আলি জিন্নাহর মধ্যে ছিলেন একাধিক জিন্নাহ। এক জিন্নাহ নিঃসন্দেহে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিশ্বস্ত সৈনিক। মডারেট ও মধ্যপন্থী এক রাজনীতিক। অন্য এক জিন্নাহ, যাকে কখনও সখনও মনে হয় যেন অতিমাত্রায় স্বার্থপর, ক্ষমতালোভী, এবং কিছু পরিমাণে নিশ্চিতভাবে সাম্প্রদায়িক। একটু বোধহয় অস্থিরচিত্তও।

রাজনীতির নানা বাঁকে জিন্নাহও নিজেকে প্রয়োজনমতো বদলে নিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক কারণে ভারত ভাগ হয়েছে এটা যেমন সত্য, কিন্তু এটাও ঠিক যে দেশভাগের পিছনে আরও সূক্ষ্ম বহু কারণ ছিল। দৃশ্য অদৃশ্য বহু মাত্রা  ছিল৷ বহুমাত্রিক এই ভারতীয় রাজনীতি বুঝতে আমাদের অসহিষ্ণু অধৈর্য হলে চলবে না। দুই দেশ আসলে তো একই সভ্যতার প্রাচীন ধাত্রীভূমি।

জিন্নাহ চরিত্রের ওঠা-পড়া বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার যে জিন্নাহ শেষ বিচারে ইতিহাসের একজন অসহায় নায়ক। যিনি কালের পুতুল হয়ে দেশভাগের অন্যতম কুশীলবমাত্র। এবং ঘটনাচক্রে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা।

সাম্প্রদায়িক কারণের পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে যে দেশভাগের প্রশ্ন প্রথম জিন্নাহ নন, উত্থাপন করেছিলেন অন্য একজন। দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা প্রথম বলেছিলেন হিন্দুত্ববাদের মেন্টর দামোদর সাভারকর।ধর্মীয় মেরুকরণের সঙ্গে সংখ্যালঘু লদের স্বায়ত্তশাসন, ভারত রাষ্ট্র ভবিষ্যতে ফেডারেল কাঠামো গ্রহণ করবে না অতিকেন্দ্রায়নের পথ নেবে— এইসব প্রশ্ন জড়িয়ে ছিল দেশভাগের সঙ্গে।

এমনকি মুসলিম লিগের মধ্যেও ছিল বহু মাত্রা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরপরই যে মুসলিম লিগ ঢাকায় নবাব সলিমুল্লার নেতৃত্বে জন্ম নিয়েছিল, সে দল অনেকদিন পর্যন্ত ছিল নিতান্তই নবাব, শিল্পপতি, ভূস্বামী ও অনান্য এলিট গোষ্ঠীর সংগঠন, যার সঙ্গে আমজনতার কোনও সম্পর্ক ছিল না৷ ৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবেরও অনেক পরে সাধারণ মুসলমানের সঙ্গে লিগের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এলিট ও সাধারণ মুসলমানের যোগসূত্রের পিছনে বাঙালি মুসলমান নেতাদের একটা ভূমিকা ছিল। আবুল হাশেম, ফজলুল হক ও অবশ্যই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মুসলিম লিগকে শুধুমাত্র উচ্চবর্গীয় মুসলমানদের হাত থেকে উদ্ধার করে দরিদ্র মুসলমানের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

বস্তুত, প্রাথমিকভাবে পাকিস্তান দাবির ছিল দুই দাবিদার। সর্বভারতীয় মুসলিম লিগ পাকিস্তান চেয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হওয়ার তাগিদে৷ অন্য দিকে বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তান প্রস্তাবের পক্ষে সোচ্চার হওয়া অনেকটাই জমির প্রশ্নে। ভূমিসংস্কারের দাবিতে। লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দৌলতে যে নব্য বাবু সম্প্রদায়ের জন্ম হয়েছিল, অবিভক্ত বাংলার অধিকাংশ জমির মালিকানা লাভ করেছিল তারাই। প্রজাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিলেন মুসলিম ও নিম্নবর্গের হিন্দু। মনুবাদী সামাজিক কাঠামোয় তাদের পরিস্থিতিও ছিল অবর্ণনীয় যন্ত্রণার। হিন্দু সমাজের উচ্চবর্গের কাছে তাদের না ছিল ন্যূনতম সম্মান কিংবা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্য। মুসলমানদের অবস্থা কী ছিল তা নিয়ে আলোচনা নিরর্থক। প্রজাদের কাজ ছিল নানাভাবে জমিদারের ও তাঁর পরিবারের মনোরঞ্জন করা। অপরিসীম দারিদ্র ও লাঞ্ছনা ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। আনন্দ উৎসবে তাদের পক্ষ থেকে হাজার রকম নজরানা জমিদারকে দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক।

কখনও সখনও অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে গরীব কৃষক রুখে দাঁড়াতেন। উচ্চবর্গের হিন্দু জমিদার ও তাদের লেঠেল বাহিনী নির্মমভাবে তা দমন করত। অনেক সময় কৌশল করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দিত জমিদারের বাহিনী। ঐতিহাসিক সুরঞ্জন দাস দেখিয়েছেন যে ১৯৪০ সালের আগে পর্যন্ত অধিকাংশ দাঙ্গার মূল চরিত্র ছিল জমিদার-কৃষক দ্বন্দ্ব।

ধর্মে মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দু চাষি পাকিস্তান প্রস্তাবের ডাকে সাড়া দিয়েছিল জমিদারের অত্যাচার থেকে বাঁচতে। জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ লাখো লাখো ভুখা মানুষের মনে নিপীড়নের হাত থেকে আজাদির স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

অন্তত বাংলা ভাগের পিছনে এই সমাজ-অর্থনীতির বিষয় এড়িয়ে স্রেফ জিন্নাহকে একতরফা দায়ী করা শুধু ভুলই নয়, ইতিহাসের বিকৃতিও।

জিন্নাহ বলতেন— আমাদের দেশে প্রগতি তখনই সম্ভব যখন হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক দৃঢ় হবে। একবার ইংরেজ মেজর গোর জানতে চেয়েছিলেন— আপনি কি হিন্দু মুসলিম ঐক্য চান? জিন্নাহ উত্তর দিয়েছিলেন— নিশ্চয়ই। ঐ শুভদিনের চেয়ে আনন্দের আর কিছু আমার জীবনে হবে না।

জিন্নাহ কীভাবে জাতীয়তাবাদী নেতা থেকে একজন ‘সাম্প্রদায়িক’ নেতা হয়ে গেলেন তা নিয়ে বিশদে গবেষণা আজও হয়নি। ১৯১৬-১৯২০, ১৯২৮ তার পরে ১৯৩৭-১৯৪৭ সাল অবধি নানা সময় মহম্মদ আলি জিন্নাহকে বিবিধ জটিলতা, অপমান ও কুটনৈতিক মারপ্যাঁচের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। নিজের সম্প্রদায়ের স্বার্থে সামান্য দাবিদাওয়াও নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কংগ্রেসের কাছ থেকে। জিন্নাহের অহমিকায় তা দীর্ঘস্থায়ী গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, যা পাকিস্তান নির্মানে জিন্নাহকে কঠিন ও একবগ্গা করে তুলেছিল।

তাও জিন্নাহ অন্তত দেশভাগের একমাত্র খলনায়ক হতেন না যদি কংগ্রেস তাঁকে উপেক্ষা না করত, অথবা  জিন্নাহর ঐতিহাসিক ১৪ দফা দাবি ১৯২৮ সালেই মেনে নিত। আসলে জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবনের শুরু যে দলের হাত ধরে, সেই একদা ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেসও যে ততদিনে প্রায় পুরোপুরি দক্ষিণপন্থী হিন্দুবাদীদের কব্জায় চলে গেছে, এই হিসেবটা বুঝতেও দুঁদে ব্যারিস্টার জিন্নাহ সাহেবের ভুল হয়ে গেছিল। স্ত্রী বা মেয়ে নয়, জিন্নাহর জীবনে গভীর প্রভাব ছিল বোন ফতিমা জিন্নাহর। তিনি কিন্তু ভাইয়ের মতো উদার বা ধর্মনিরপেক্ষ কোনওটাই ছিলেন না। বরং বলা ভালো একটু বেশি মাত্রায় নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন৷ পাকিস্তান প্রস্তাব মেনে নিতে জিন্নাহকে প্রভাবিত করতে ফতিমারও সম্ভবত কিছু ভূমিকা ছিল।

তবু মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো অনেক ইতিহাসবিদেরও ধারণা যে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব তো বটেই, তার পরেও পাকিস্তান জিন্নাহর কাছে এক দরাদরির বিষয় ছিল। কংগ্রেস ভারত ভাগ মেনে নেবে একথা কায়েদ-এ-আজম চরম দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।

 

ক্রমশ