Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আন্তর্জাতিক (শ্রমজীবী) নারী দিবসের তিন মুখ

আন্তর্জাতিক নারী দিবস

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস গেল ৮ই মার্চ। সেই উপলক্ষে কোনও তত্ত্বকথায় না গিয়ে চার নম্বর নিউজডেস্কের পক্ষ থেকে রাখা হল দেশের তিন নারীর কথা। জসিন্তা কেরকেট্টা, শান্তি দেবী এবং শুভাঙ্গী যুবরাজ মন্দারে। আসুন... পড়ি...

জসিন্তা কেরকেট্টা

ঘর ছেড়ে, মাটি ছেড়ে
ছাদ ঢাকা খড়ের গাদা ছেড়ে
ওরা — প্রশ্ন করে
ও শহর
তুমি কি কখনও কুঁকড়ে গেছ
উন্নয়নে?

জসিন্তার কথা। জসিন্তা কেরকেট্টা। বছর তিনেক আগের একটি বই। আলোর বই। কী সে বই? কে জসিন্তা? কোথায় আলো? পশ্চিম সিংভূম। অধুনা ঝাড়খণ্ডের খুদপোশ গ্রাম। কোয়েল নদীর ধার। অ্যাথলিট বাবার স্পোর্টস কোটায় পুলিশের চাকরি। মা পুষ্পা অনিমা। লড়াই। পেশায় লড়াকু বাবার ঘরে এলেই শুরু হয়ে যাওয়া চিরকালীন পৌরুষ। দেখতে দেখতে বড়দাও। ছোট দুই বোনের সঙ্গে এমন এক নারীসমাজের প্রতিভূ জসিন্তা। সবার বড় বোন। পড়াশুনো। স্কুলের পড়াশুনো তখনকার বিহারের বেতিয়াতে। মনোহরপুর মিশনারি বোর্ডিং স্কুলে। ক্লাসে সেকেন্ড। চম্পারনের কাছে চক্রধরপুরের কারমেল হাইস্কুল থেকে মেধার অন্য পর্যায়ে পৌঁছনো। আদিবাসী সহপাঠীদের জেদ বাড়ানো। শিক্ষকদের রোষ। রাঁচির সেন্ট জেভিয়ের্স থেকে স্নাতক হয়ে ক্রমশ সাংবাদিকতার দিকে ঝোঁক। দৈনিক জাগরণ। প্রভাত খবর। হিন্দি ভাষাটাকে আয়ত্ত করতে থাকলেন জসিন্তা। মাতৃভাষা সাদ্রির পাশাপাশি। শিখলেন হো, মুরান্ডি, খারিয়ার মতো আদিবাসী ভাষার পাশাপাশি ইংরিজিকেও। কারণ সেই লেখা। জসিন্তার কবিতা।

প্রথম লেখা মনে পড়ে? পড়ে বৈকি। ‘বাচপান’। হিন্দিতে। পরে রাঁচির ‘রাহি’ পত্রিকায় ছোট গল্প। তারপর মাঝের অনেকটা লড়াই। যার পরিণতি দুটি দ্বিভাষিক কবিতার বই। ‘আঙ্গোর’ (Angor)। ‘জাড়ো কি জামিন’ (Land of the Roots)। যথাক্রমে কলকাতার আদিবাণী এবং দিল্লির ভারতীয় জ্ঞানপীঠের প্রকাশনায়। হিন্দি এবং ইংরাজিতে। দ্রোপদী ভারলাগের অনুবাদে জার্মান ভাষাতেও অনুদিত হয়েছে জসিন্তার কলম। লড়াই। কষ্টের স্মৃতিগুলো। কী সেই লেখা? কী নিয়ে লেখেন জসিন্তা।

হে পিতা, পূর্বসূরি
দ্যাখো, সময়ের ষড়যন্ত্র এক
কোথায় মুক্তি পাব বলো –
অনির্বাণ আগুন এক
তপ্ত পৃথিবীর ভেতর থেকে
সবকিছুই জ্বালিয়ে দেয় যেন
বাতাস, অরণ্য, মাটি
মানুষ – শরীরে, মনে …

ওঁরাও। জসিন্তার নিজের জাতি। দেশ। পরিবার। কেটে নেওয়া গাছ। শিল্পায়নে ধ্বংস হওয়া সাঁওতালি ঐতিহ্য। আসলে এখনও পরতে পরতে থেকে যাওয়া ক্রীতদাসপ্রথা, আদিবাসীদের ছোট করে দেখা তথাকথিত বড় জাতের উন্নাসিকতা। জসিন্তার কলমে এইসবই। প্রেরণা? আছে কেউ? জসিন্তার মনে পড়ে বিনোদ কুমার শুক্লার কবিতা। মনে পড়ে চন্দ্রকান্ত দেবতালে, কেদারনাথ সিং। এমনকী, মনে পড়ে বার্টোল্ট ব্রেখট। জসিন্তার মা-র কথাও মনে পড়ে। কেন মা অকথ্য মার, গালিগালাজ সহ্য করেও অবিচল ছিলেন, কেন পরিবারের সবার খাওয়ার পর নিজে খেতে বসতেন, কেন তাঁকে যেতে গেলে সামনে কোনও পুরুষকে হাঁটতে হত লেগ্যাসি মেনে, জসিন্তা এসব জানেন না। প্রশ্ন করেন। আর জানেন রাগ, প্রতিবাদ, উচ্চারণ। তিনি না বললে আর কেউ এসব নিয়ে বলবে না। তাঁকেই যে বলতে হবে। এভাবেই কবিতা মিশে যায় সাংবাদিকতায়। ক্রমশ বাঁধাধরা কাগজের চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিং-এ আসা। গুলেল ডট কম, তাহেলকার মতো কাগজে লিখছেন জসিন্তা। তাঁর কোয়েল নদীর ধারে সারান্ডা। এশিয়ার বৃহত্তম শাল গাছের বন সারান্ডা। ক্রমশ শিল্পায়নে বলি হয়ে যাওয়া এই সমস্ত অরণ্য, নদী, মাটি নিয়ে লিখে যাচ্ছেন এই নারী। ছোটবেলায় বড় জাতের ভাড়াটে গুণ্ডার হাতে খুন তাঁর দুই আত্মীয়-আত্মীয়ার নামে কীভাবে রটে গেছিল হিউম্যান স্যাক্রিফাইসের স্টিরিওটাইপ নিউজ। একজন দোষীও শাস্তি পাননি। ধর্ষণ। খুন। জমি চুরি। জসিন্তার সাংবাদিক কলমে এইসমস্ত স্মৃতি। লাল নদিয়া। জসিন্তার কবিতায় লাল হয়ে যাওয়া মাটি, নদী, শালের জঙ্গল। খনির লাল ধুলোয়।

খেদ আছে কোনও? হতাশা? লড়তে লড়তে হাঁফ ধরা। জসিন্তার মনে পড়ে সাঁওতাল ছেলেমেয়েগুলোর কথা। নিজের জাতির কথা, কষ্টের কথা বলতে পারার আগেই ওদের টোপ দেওয়া কর্পোরেট ফুটবল টুর্নামেন্ট। ছেলেগুলো লোভে পড়ে ঢুকে যাচ্ছে একের পর এক। সাজিশো কা সিক্স লেন। একটা সময়ে জাঁকিয়ে বসা মাওবাদী সমস্যা। জসিন্তার নিজেকে অপরাধী লাগে। তবু, কেউ কি বুঝবে? কেন এরা ওদিকে যায়, গেছিল? শিল্পায়নের নামে ওদের রুজি রোজগারে হাত। উচ্চবর্ণের টর্চার। মাওবাদী আন্দোলন একধরনের বাধ্যতা ওদের। আত্মরক্ষা। সেই মাওবাদী অঞ্চল, সারান্ডা, লোভনীয় লোহার খনি। মাওবাদী সমস্যা মিটতেই সরকার কর্পোরেট মিলে মাইনিং আঁতাত। আত্মত্যাগ করতে তো হয় কারওকে? জসিন্তা জানেন ত্যাগটুকু সাঁওতালদেরই প্রাপ্য। মাছ নিয়ে যাবে চিলে।

ইচ্ছে আছে মাতৃভাষা সাদ্রিতে বই লেখার। ইচ্ছে আরও অনেক কিছু। কতটা হবে? জসিন্তা জানেন না। শুধু জানেন ঝাড়খণ্ডের সিমদেগা গ্রামে চারটে বাঁধ বসলেও কোনও সেচের জল পায় না তাঁর সাঁওতাল বন্ধুরা। যারা জমি হারিয়েছেন, রিকশা চালাচ্ছেন। যারা হারাননি, জমিতে ম্যান-মেড এক বন্যার চোটে চোখের সামনে ডুবতে দেখছেন সোনালী ফসল। সাহেবগঞ্জে কয়লাখনির ফ্লাই অ্যাশে ঢেকে যাচ্ছে জমি। চাষ করতে পারছেন না আদিবাসীরা। জসিন্তা এসব নিয়ে লিখবেন। বলবেন। গর্জে উঠবেন।

ক্ষেতে হালকা বৃষ্টি
তারপরই বীজ বোনা দেখতে দেখতে
নিজস্ব এক তপ্ত বালিতে
পুড়ে যাচ্ছিল
ফুলো-র হৃদয়

হাতে অনাবশ্যক কাগজ
বাঁধের কাছে অসহায় দাঁড়িয়ে
সালো-র মা
হারানো জমির খোঁজ …

শহর, আলোর চমকে বীভৎস যেন
সবকিছুই বাঁধের করুণা —
নিভন্ত মৃদু বাতির আলোয়
ছায়া, অন্ধকার রাত্রির গভীরে
সালো-র মা চমকে চমকে ওঠেন

সোমা আজ খায়নি কিছুই
ওর জমি জলাশয় আজ
চামড়ার ভেতর থেকে বেরনো পাঁজর
অথবা বেরনো ভেতরের পাকস্থলি,
অঙ্গ, যন্ত্রণার নাড়ি ভুঁড়ি …

কান্নাকে আটকে রাখা একটা বাঁধ
জমে থাকা ক্রোধ পুষে রাখা একটা বাঁধ
একদিন ভাঙবেই
সাকুয়ার ডাল থেকে, পাহাড় থেকে
একদিন ফেটে বেরোবে ক্রোধ, বিদ্রোহ
সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে
একদিন
বইবে বাতাস, শান্ত
সোনালী ধান
কাদার পৃথিবী
না
কোনও বাঁধের পৃথিবী না …

 

শান্তি দেবী

নারীবিবর্জিত রুক্ষ এক ট্রাক-স্টপ। অতিকায় যানগুলোর বাতিল দেহাবশেষ পড়ে আছে এখানে ওখানে। ট্রাকগুলো আসে জিরোতে, মেরামত করে নেয় নিজেদের, তারপর আবার দৌড়। চালকেরা মেকানিকের সঙ্গে গল্প জোড়ে, মেকানিক দেশের অন্যতর প্রান্তের খবর গোগ্রাসে গেলে। সেসব পুরুষালি গল্পগাছা, রোজনামচা। এরকম এক ক্যানভাসে শাড়ি পরা বছর পঞ্চাশের মহিলা কোত্থেকে এলেন? কে ইনি? মেকানিকের বউ? চা-নাস্তা বা দুপুরের খাবার এনেছেন? না, ইনি নিজেই এক টায়ার-মেকানিক।

উত্তর দিল্লির প্রান্তসীমা থেকেও ষোলো কিলোমিটার দূরে সঞ্জয় গান্ধি ট্রান্সপোর্ট নগর। বিস্তীর্ণ সেই ট্রাক-হল্টে ইতিউতি ছড়িয়ে বসেছেন অগুনতি মেকানিক, টায়ার সারানোর লোকও কম নেই৷ তার মধ্যে একটি অস্থায়ী গুমটি যৌথভাবে চালান শান্তি দেবী ও তাঁর বর। বর বলতে, দ্বিতীয় জন৷ প্রথম জনের সঙ্গে গোয়ালিয়রের শান্তি দিল্লি শহরে এসে পৌঁছেছিলেন সেই পঁয়ত্রিশ বছর আগে৷ পেট চালাতে সেলাইয়ের কাজ করেছেন, বিড়ি বেঁধেছেন। সেই প্রথম জন বেশিরভাগ সময় মদেই বেহুঁশ থাকত৷ নেশার বাড়াবাড়িতে শেষে প্রাণ খোয়াল। অকালবৈধব্যে ঘাবড়ে গেলেও দমেননি শান্তি৷

কালে কালে আলাপ হল রাম বাহাদুরের সঙ্গে। আবার ঘর বাঁধা গেল৷ ট্রান্সপোর্ট নগরে দুজনে মিলে চায়ের দোকানই দিয়েছিলেন প্রথমে৷ তারপর আয় বাড়াতে দোকানে এক মেকানিককে ভাড়া করা হল। ট্রাকের টুকিটাকি সারিয়ে দিত সে, লভ্যাংশ থেকে কিছু দম্পতিও পেতেন৷ ক্রমে গেলাসে চামচ নাড়ার ফাঁকে দুজন মেকানিককে জরিপ করে করেই শিখে নিলেন টায়ার সারানোর কারিকুরি। নিজেদের টায়ার-মেরামতির দোকান হল।

তারপর তো বাড়িও তুললেন তাঁরা৷ ছেলেমেয়ে হল, তাদের বিয়েও দিলেন। ট্রাক ড্রাইভারদের সঙ্গে একরকম আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গেছে। আলাদা পরিচিতি আছে এখন সঞ্জয় গান্ধি ট্রান্সপোর্ট নগরে এই দম্পতির৷ ‘চলো, বুড়ো-বুড়ির দোকানেই টায়ার সারাই’, এমনটা বলে অনেকে। কেউ শান্তিকে ‘তাই’ বলে ডাকে, কারও কাছে আবার তিনি ‘চাচি’৷ দোকানটি কিন্তু আজও অস্থায়ী, কুড়ি বছর পরেও। মিউনিসিপালিটি তুলে দেবে কি কখনও? দোলাচলে ভোগেন প্রৌঢ় শান্তি৷

কীভাবে যে ইন্টারনেট তাঁর খবর পেল, তা তিনি নিজেও সঠিক জানেন না৷ কে প্রথম ছবি তুলে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বা কোনও ওয়েবসাইটে দিয়েছিল, সে সম্পর্কে তিনি অন্ধকারে। শুধু জানেন, এখন ‘শান্তিদেবী ট্রাক মেকানিক’ নাম লিখে সার্চ করলেই স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ভিড় করে নিজের অনেক ছবি, সঙ্গে ইংরাজিতে ‘স্টোরি’৷ ইউএন-এর ভারতীয় ওয়েবসাইটেও তাঁকে নিয়ে খবর। মহিলা টায়ার-মেকানিকের সঙ্গে দেখা করতে লোকজন প্রায়ই আসে। আরও ছবি ওঠে৷ ‘কেউ কেউ আবার এমন পোজ দিতে বলে, যেন টায়ার হাতে নিয়ে গাড়িতে লাগাচ্ছি, বা গাড়ি থেকে টায়ার খুলে নিয়ে যাচ্ছি৷ যত্তসব! ওসব তো ড্রাইভার নিজে করে! টায়ার কি মেকানিক বয়ে নিয়ে যায়? মেকানিক শুধু টায়ার সারায়।’

শহরের অজ্ঞতায় হেসে ফেলেন শান্তিদেবী৷

শান্তিদেবী বোঝেন না, তাকে ঘিরে এত হৈ চৈ কেন? বোঝেন না কোন দিগ্বিজয়ের জন্য এত প্রশংসা জুটছে৷ মনোযোগ পেতে অবশ্য ভালোই লাগে। খ্যাতির আঁচই বা মন্দ কীসে? কিন্তু শুধু তিনিই জানেন যে সংসারটা সুষ্ঠুভাবে চালানোই প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, কোনও নজির গড়া নয়। সে উদ্দেশ্যেই যত লক্ষ্মণরেখা ডিঙোনো৷ নিজের কাজে দক্ষতা আজ তাঁকে আত্মপ্রত্যয় দিয়েছে, কিন্তু পেটের দায়ই ছিল আরও আদিম ও প্রাথমিক।

সন্ধ্যা নামে। শান্তি বলেন, ‘এ কাজ তেমন কঠিন কিছু নয়।’ তাঁর পরিশ্রমী হাতে তখন সান্ধ্য চায়ের কাপ। ‘কিন্তু বয়স জানান দিচ্ছে আজকাল৷ জানি না কতদিন টানতে পারব!’ তাঁর পরে ভবিষ্যতে এ ‘পেশায় আসবে কি অন্য কোনও মেয়ে? মিউনিসিপালিটি টিকিয়ে রাখবে কি দেশের সম্ভবত একমাত্র মহিলা টায়ার মেকানিকের অস্থায়ী এই দোকান? সন্ধ্যা এবং নানা অনিশ্চয়তা নেমে আসে৷

 

শুভাঙ্গী যুবরাজ মন্দারে

এ গল্প আগুন নেভানোর, আগুনকে বাগে আনার। এবং সেই কাজটা যথেষ্ট দাপটের সঙ্গে করে থাকেন শুভাঙ্গী। শুভাঙ্গী যুবরাজ মন্দারে। চারদিকে জ্বলতে থাকা আগুনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে, আশ্চর্যভাবে মাথাটা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায় শুভাঙ্গীর। সবাই যখন আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য, মাথা ঠিক রাখতে না-পেরে পাগলের মতো এদিক থেকে ওদিক ছুটছে, তেমন পরিস্থিতিতে একেবারে নিখুঁতভাবে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তিনি।

মুম্বাই দমকলবাহিনীর কর্মী শুভাঙ্গী। প্রথম কল-এর কথা আজ আর ঠিক মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, দমকলকর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই ঘটেছিল ঘটনাটা। তখন নেহাতই জুনিয়র স্টাফ। এত দ্রুত কলে বেরোতে হয়েছিল যে, মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ারও সময় পাননি। ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর পর অবশ্য আর সেসব নিয়ে ভাবার অবকাশই ছিল না। একের পর এক কাজগুলো পরপর করে গিয়েছিলেন কেবল। বেশ বড় একটা আগুন লাগার ঘটনা ছিল সেটা। দমকলের বিশাল একটা টিম, বেশ কয়েকটা গাড়ি মিলে কয়েকঘণ্টার চেষ্টায় সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত জলের জোগান ছিল না। রিলে করে আনতে হয়েছিল অনেকটা দূর থেকে। তার সঙ্গে প্রবল ঘন ধোঁয়ায় শ্বাস আটকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি। চারপাশে কৌতূহলী জনতার ভিড় সামলাতে গিয়ে কাজ আরও কঠিন হয়ে উঠছিল। “কিন্তু শেষপর্যন্ত আগুন নিভিয়ে ফিরব বলে যখন ট্রাকে উঠে বসতে যাচ্ছি, পাশের একটি গাড়ি থেকে একজন আমাকে ‘থাম্‌স আপ’ দেখিয়ে গেলেন। সেই মুহূর্তটা আজ এত বছর পরেও পরিষ্কার মনে পড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে মনটা ভালো হয়ে যায়। দারুণ একটা অনুভূতি…” ছেলেমানুষিতে ভরা মুখে একগাল হাসি ছড়িয়ে পড়ে শুভাঙ্গীর।

এক ডজন মহিলা দমকলকর্মীর সঙ্গে চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে শুভাঙ্গী স্বপ্নেও ভাবেননি, এটা কোনওদিন তাঁর পেশা হতে পারে। পুনে শহরে বেড়ে ওঠা শুভাঙ্গীর পরিবারে কস্মিনকালে কেউ কোনওদিন পুলিশ বা দমকলে কাজ করেননি। কলেজে পড়ার বিষয় ছিল কেমিস্ট্রি। “হঠাৎই একদিন কাগজে একটা চাকরির বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। সাতপাঁচ না-ভেবেই অ্যাপ্লিকেশন ঠুকে দিয়েছিলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই পরীক্ষার ডেট জানিয়ে চিঠি আসে। যেদিন পরীক্ষা দিতে যাই সেদিনও ভাবিনি সত্যি আমি এমন একটা চাকরি কখনও করতে আসব।” মুম্বাই অগ্নিনির্বাপন বিভাগের বাইকুল্লা শাখার দফতরে বসে কথা প্রসঙ্গে বলতে থাকেন শুভাঙ্গী।

“আসলে কী জানেন, সেই প্রথমবার মহিলাদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল দমকলবাহিনীতে। আমি সেই সুযোগটা নিতে চেয়েছিলাম। বন্ধুদের অনেকেই শুনে চোখ গোল গোল করে তাকিয়েছিল। এমনকী আত্মীয়-পরিজনেরাও। বাড়ির মেয়ে আগুন নেভানোর কাজ করতে যাবে, এটা তাঁদের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। সেটাই ছিল আমার মোটিভেশন। মুখে তো আমরা অনেকেই বলি যে মেয়েরা পারে না এমন কোনও কাজ নেই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমরা অনেকেই সেটা মনে রাখি না। বলতে পারেন, আমি পরখ করে দেখতে চেয়েছিলাম আমি কতদূর যেতে পারি।” বেশ প্রত্যয়ী গলায় শুভাঙ্গী জানান।

পরীক্ষাটা ভালোই দিয়েছিলেন শুভাঙ্গী। সরাসরি অফিসার র‍্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে যান। পুনে থেকে চলে আসেন মুম্বাই। যথাসময়ে চাকরিটা পাকাও হয়ে যায়। প্রথমে জুনিয়র ফিল্ড স্টাফ হিসেবে কাজ করতে হত। কল এলে তৎক্ষণাৎ দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া। কতক্ষণের ডিউটি, কোনও ঠিক নেই। আগুন নিভিয়ে দফতরে ফিরে রিপোর্ট দিয়ে তবে ছুটি। তারপরে ক্রমে অভিজ্ঞতা বেড়েছে। দায়িত্বও। এখন দুর্ঘটনাস্থলে পুরো অপারেশন পরিচালনার দায়িত্ব থাকে তাঁর ওপরেই। শুধু আগুন নেভানোই নয়, দুর্ঘটনার কবলে পড়া সকলকে যথাসম্ভব সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা, দলের সমস্ত কর্মীর নিরাপত্তার যথাযথ দেখভাল— সবটাই শুভাঙ্গীর দায়িত্ব।

“একবার পারেলের এমটিএনএল ভবনে আগুন লেগে গিয়েছিল। আমাকে এক ভদ্রলোক জানান, অমুক রাস্তা গিয়ে গেলে পৌঁছতে সুবিধে হবে। কিন্তু তাঁর কথামতো সেই রাস্তায় ঢুকে আমরা আবিষ্কার করি একটা দশ ফুট বাই বারো ফুটের দেওয়াল। আগুনটা লেগেছিল দেওয়ালটার উলটো দিকে। দেওয়ালটাকে টপকে সেই আগুনের কাছে পৌঁছতেই আমাদের কালঘাম ছুটে যায়। তবে আমি একটা দরকারি কাজ করেছিলাম। পরের গাড়িগুলোকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, এটা ঠিক রাস্তা নয়। আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে পিছনের দলকে সঠিক তথ্য জানানো ভীষণ জরুরি,” জানালেন শুভাঙ্গী।

কাজটা যথেষ্ট বিপজ্জনক, তিনি জানেন। তবে তাঁকে নিয়ে ভয় পাওয়ার চেয়ে এখন তাঁকে নিয়ে গর্ব করতেই বেশি ভালোবাসে তাঁর পরিবার। সকাল আটটার ওয়ার্ম আপ দিয়ে দিন শুরু, তারপর থাকে দলের মধ্যে কো-অর্ডিনেশন গড়ে তোলার জন্য বিশেষ কিছু এক্সারসাইজ। এছাড়াও কল থাকলে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়তে হয়, সামাল দিতে হয়। আপাতত এইই রুটিন শুভাঙ্গীর। চোখ সামনের দিকে। লক্ষ্য? “ডিপার্টমেন্টাল হেড হতে চাই,” পাশে বসা এক পুরুষ সহকর্মীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে ওঠেন শুভাঙ্গী।

কেমন লাগে এতটা চাপ মাথায় নিয়ে কাজ করতে? প্রশ্ন শুনে এক সেকেন্ড চুপ করে থাকেন। “ছোটবেলা থেকে মাকে দেখেছি বাড়ির সমস্ত ছোটবড় অশান্তির আগুন একলা হাতে নেভাতে। বছরের পর বছর। তাঁর মা, আমার দাদিও সারা জীবন তা-ই করে এসেছেন। আমিও তো সেটুকুই করছি। তার চেয়ে বেশি তো কিছু নয়। তা হলে আর চাপ হল কোথায়?” আবার সেই ঝকঝকে হাসিটা হাসেন শুভাঙ্গী।