Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা সাভারকর কি যুক্তিবাদী ও নাস্তিক ছিলেন?

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য

 

মনে পড়ছে, কিছুদিন আগে কেউ কেউ ফেসবুকে হিন্দুত্ব, নাস্তিকতা ও যুক্তিবাদিতার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। হিন্দু হয়েও কেউ নাস্তিক ও যুক্তিবাদী হতে পারেন কিনা, এই বোধহয় ছিল তাঁদের প্রশ্ন। তখনই আমার এক ধর্মহীন বন্ধু মনে করিয়ে দিলেন, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রথম প্রবক্তা ও তাত্ত্বিক দামোদর বিনায়ক সাভারকর কিন্তু নাস্তিক এবং যুক্তিবাদী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। আমার কাছে ব্যাপারটা স্ববিরোধী মনে হলেও তাঁর কাছে নয়। তিনি ব্যাখ্যা দিলেন, এটা না হওয়ার কী আছে, নাস্তিকতা হল ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে এক ব্যক্তিগত অবস্থান, আর হিন্দুত্ববাদ হল রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে এক রকমের রাজনৈতিক অবস্থান, কাজেই এ দুটোর সহাবস্থান হতেই পারে। যাঁরা হিন্দুত্বকে ধর্ম না বলে ‘way of life’ আখ্যা দিতে পছন্দ করেন তাঁদের কাছে যুক্তিটা খুবই লাগসই। লাগসই ‘উত্তর আধুনিক’-দের কাছেও, যাঁরা ধর্মীয় মৌলবাদ ও রাষ্ট্রবাদকে আধুনিকতারই প্রকারভেদ বলে ভাবতে চান। কিন্তু আমার কাছে প্রশ্নটা খুব সোজা। আরে, রাজনীতিটাই যদি ধর্মভিত্তিক হয়, তবে নাস্তিক চেতনা কীভাবেই বা তাকে ধারণ করবে? আবার উল্টোদিকেও তো সমস্যা – তত্ত্বগত চিন্তায় এই দুটোকে যতই পরস্পরবিরোধী বলে মনে হোক, বাস্তবে যদি দুটোর সহাবস্থান সম্ভব হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তত্ত্বগত চিন্তাতেই কোথাও ভুল আছে! মানে, ‘নাস্তিকতা’, ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’, ‘ধর্মীয় ঘৃণা ও হিংস্রতার রাজনীতি’ – এই সমস্ত ধারণাগুলোকে আমরা সাধারণত যে ধরনের তত্ত্বকাঠামোয় ভাবি, সেখানেই তাহলে কোথাও ভুল হচ্ছে। বাস্তবিকই, নিজেকে ‘নাস্তিক’, ‘যুক্তিবাদী’ এইসব বলে দাবি করেন, অথচ ধর্মীয় অন্ধতা-ঘৃণা-হিংস্রতা নির্ভর রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল, এমন সব নমুনা আজকাল সোশ্যাল মিডিয়াতে আর তত বিরল নন। এই ধরনের ‘প্যারাডক্সিক্যাল ফেনোমেনন’-কে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? সাভারকর কি এ ব্যাপারে আমাদেরকে কোনওভাবে সাহায্য করতে পারেন? প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ হিন্দুত্ববাদকে বোঝার ক্ষেত্রেও, কারণ, সাভারকরই হলেন হিন্দুত্ববাদের প্রথম ও প্রধান প্রবক্তা। হিন্দুত্ববাদের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সমালোচক ও বিশ্লেষক জ্যোতির্ময় শর্মার মতে, সাভারকরের পর হেডগেওয়ার আর গোলওয়ালকরের মত হিন্দুত্ববাদী নেতারাও অনেক কিছুই লিখেছেন বটে, কিন্তু সে কেবল একান্ত অনুগামীদের চাঙ্গা করার জন্য লেখা ‘ইন্টেলিজেন্ট প্যামফ্লেটিয়ারিং’ মাত্র, হিন্দুত্ববাদের মৌলিক ধ্যানধারণায় তাঁরা সেভাবে নতুন কিছুই যোগ করতে পারেন নি।

উঁহু, না, আমার বন্ধু কিন্তু হাওয়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলেননি, সাভারকরকে নাস্তিক ও যুক্তিবাদী হিসেবে অভিহিত করাটা মোটেই তাঁর ব্যক্তিগত খেয়াল নয়। সাভারকরের প্রসঙ্গে ‘নাস্তিক’, ‘যুক্তিবাদী’, ‘আধুনিকতাবাদী’, ‘অজ্ঞেয়বাদী’- এই শব্দগুলো বার বারই ঘুরে ফিরে ব্যবহৃত হয়েছে। যাঁরা ব্যবহার করেছেন, তাঁরা সকলেই পণ্ডিত মানুষ, এবং তাঁদের মধ্যে সাভারকরের পরম ভক্ত থেকে শুরু করে তাঁর তীব্র সমালোচক লিবারেল বুদ্ধিজীবী, উত্তর আধুনিক তাত্ত্বিক হয়ে এমনকি যুক্তিবাদী আন্দোলনের অগ্রণীরা পর্যন্ত অনেকেই আছেন। সাভারকরের ভক্ত জীবনীকার ধনঞ্জয় কীর, গণতন্ত্রমনস্ক উদার আইনজ্ঞ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার এ জি নুরানি, আধুনিকতাবিরোধী সমাজতত্ত্ববিদ আশিস নন্দী, এমনকি, মূলত মহারাষ্ট্রভিত্তিক কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে শাখাওয়ালা যুক্তিবাদী আন্দোলনকারী সংগঠন ‘অখিল ভারতীয় অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি’। কেন এঁরা সাভারকর প্রসঙ্গে এই শব্দগুলো ব্যবহার করেন, তার উদ্দেশ্য একেকটি ক্ষেত্রে একেক রকম। হিন্দুত্ববাদীরা তাঁকে ‘যুক্তিবাদী’ বলতে পছন্দ করেন, কারণ, এর মধ্য দিয়ে তাঁরা বোঝাতে চান যে হিন্দুত্ববাদ কোনও প্রাচীনপন্থী ব্যাপার নয়, বরং এক অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য আধুনিক ব্যাপার, এবং সেইহেতু তাকে গ্রহণ করতে আধুনিক জীবনযাপনকারী একজন হিন্দুর সমস্যা হওয়ার কথা নয়। উল্টোদিকে এ জি নুরানি যখন তাঁর ‘সাভারকর ও হিন্দুত্ব’ গ্রন্থে সাভারকরকে ‘নাস্তিক’ বলেন, তখন সেইসঙ্গে তিনি এও বলেন যে, হিন্দুধর্ম আসলে অতি মহান, এবং সাভারকর মোটেই সেই অর্থে ‘হিন্দু’ নন, এবং সেই সূত্রে প্রত্যাশা করেন যে, এভাবে হিন্দুত্ববাদকে আক্রমণ করেও হিন্দুধর্মকে সমালোচনার দায় এড়ানো যাবে, বাঁচা যাবে ‘হিন্দু’-র রোষ থেকে (ভারতের মূলধারার বাম রাজনীতির মধ্যেও এ ধরনের প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়)। আধুনিকতাবিরোধী সমাজতত্ত্ববিদ আশিস নন্দী সাভারকরকে নাস্তিক ও যুক্তিবাদী বলেন, কারণ, তিনি হিন্দুত্ববাদকে সর্বব্যাপী আধুনিক রাষ্ট্রবাদের এক বিশেষ রূপ বলে দেখাতে চান, প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের সাথে যার নাকি কোনও সম্পর্কই নেই!

আর, মহারাষ্ট্রভিত্তিক যুক্তিবাদী সংগঠনটির অবস্থান খুবই সহজবোধ্য – তাঁরা তাঁদের রাজ্যের আইকনকে ত্যাগ করতে চান না, ঠিক যেভাবে পশ্চিমবঙ্গের অনেক যুক্তিবাদী বিবেকানন্দকে তাঁর সঙ্গে চান। তবে, এই শেষোক্ত ঘটনাটি অপেক্ষাকৃত বিচ্ছিন্ন, এবং এর প্রতিবাদও হয়েছিল। ২০১২ সালে ভারতীয় যুক্তিবাদী সংগঠনদের একটি সম্মেলনে ‘অখিল ভারতীয় অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি’-র তরফে একটি প্যামফ্লেট প্রকাশ করা হয়, যাতে সাভারকরকে মহান যুক্তিবাদী বলে দাবি করা হয়েছিল। তখন এর প্রতিবাদে যুক্তিবাদী আন্দোলনের বিশিষ্ট সংগঠক ও লেখক, মুম্বই হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি আর এ জায়গিরদার একটি প্রবন্ধ লিখে বিস্তারিত আলোচনা করে দেখান, সাভারকার মোটেই যুক্তিবাদী নন, কারণ তিনি সাম্প্রদায়িকমনস্ক ছিলেন। ‘যিনি সাম্প্রদায়িকমনস্ক তিনি নাস্তিক যুক্তিবাদী হতেই পারেন না’ – এ যুক্তিতে আমি কোনও ভুল খুঁজে পাইনি, কিন্তু অনুমান করতে পারি, সবার কাছে সে যুক্তি সমানভাবে স্বতঃপ্রতীয়মান বলে মনে হবে না। যাঁদের কাছে তা মনে হবে না, তাঁরা দাবি করবেন ধর্ম ও ঈশ্বর বিষয়ে সাভারকরের অবস্থানের একটি প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট বিশ্লেষণ ।

আচ্ছা, আসুন তবে, কেসটা একটু ঘেঁটেঘুঁটে দেখা যাক, হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান প্রবক্তা দামোদর বিনায়ক সাভারকর সত্যিই কতটা ‘নাস্তিক’ আর ‘যুক্তিবাদী’ ছিলেন। কাজটা সহজ নয়, কারণ, হিন্দুত্ব নিয়ে তাঁর অজস্র লেখা থাকলেও বিশেষ করে ‘ঈশ্বর’ নিয়ে লেখা পাওয়া কঠিন। সাভারকর খুব একটা তাত্ত্বিক মেজাজের লোক ছিলেন না, একটু কেজো গোছের মানুষ ছিলেন। হিন্দুজাতির সামরিকীকরণ হোক, রাষ্ট্রের সমস্ত প্রশাসনিক ও সামরিক পদগুলো হিন্দুরা দখল করুক এবং সেখান থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়া হোক, হিন্দুদের পক্ষে এবং খ্রিস্টান ও মুসলমানদের বিপক্ষে দমনমূলক নানা ব্যবস্থা তৈরি করা হোক, এই সমস্তই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। এইসব সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী নিয়ে কথা বলতে তিনি ভালবাসতেন, ‘ব্রহ্মের স্বরূপ’ বা ওই জাতীয় হিন্দু ধর্মতাত্ত্বিক তর্কবিতর্কে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। অথচ, তিনি খুব ভালভাবেই বুঝতেন, হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে হিন্দুত্বের সাথে ভারতীয়ত্বের এক রকমের সমীকরণ প্রয়োজন, এবং সে জন্য হিন্দু ধর্মের নানা রীতিনীতি এবং পৌরাণিক গালগল্পের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। তিনি বুঝেছিলেন, ‘কে প্রকৃত হিন্দু’ এই প্রশ্নের একটা পরিষ্কার উত্তর চাই, তা না হলে ধর্মীয় ঘৃণা আর বিভেদের রাজনীতির জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ‘আমরা-ওরা’ বিভেদরেখাটি তৈরি হবে না। এ প্রশ্নে তাঁর উত্তর ছিল, ‘হিন্দু’ হল শুধু সে-ই, এ ভারতবর্ষ যার পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি (সাভারকরের মাতৃভাষা মারাঠিতে যথাক্রমে ‘পিত্রুভূ’ এবং ‘পুণ্যভূ’) দুই-ই। মারাঠি ভাষায় ‘ভূ’ হল পুংলিঙ্গ, আর ‘ভূমি’ হল স্ত্রীলিঙ্গ। ফলে, বাংলা ‘মাতৃভূমি’ মারাঠিতে হবে ‘মাত্রুভূমি’, কিন্তু ইউরোপীয় কায়দায় ‘ফাদারল্যান্ড’ বা বাংলা ‘পিতৃভূমি’ বোঝাতে গেলে মারাঠিতে বলতে হবে ‘পিত্রুভূ’। মজার ব্যাপার, ‘ভারতমাতার’ নামে জয়ধ্বনি দিতে না পারাটা যারা দেশদ্রোহিতার প্রমাণ বলে মনে করে তারা প্রায় কেউই জানে না যে, হিন্দুত্ববাদের প্রথম এবং প্রধান প্রবক্তা স্বদেশকে ‘মাতৃভূমি’ বলতে ঘৃণা করতেন। হিন্দুরাষ্ট্রের যে পুরুষালী হিংস্র অবয়ব তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, সেখানে মাতৃমাহাত্ম্যের জন্য বিন্দুমাত্র কোনও পরিসর বরাদ্দ ছিল না। তা সে যাই হোক, এখন প্রশ্ন হল, এই ‘পিত্রুভূ’ এবং ‘পুণ্যভূ’ ব্যাপারটা ঠিক কী? সাভারকর ব্যাখ্যা করে বলেন, ভারতবর্ষে যে জন্মেছে, এ দেশ তার ‘পিত্রুভূ’। সেই অর্থে, এ দেশে জন্মানো হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সকলেই এ দেশকে ‘পিত্রুভূ’ বলে দাবি করতে পারে। কিন্তু ‘পুণ্যভূ’ বলে এ দেশকে শুধু সে-ই দাবি করতে পারবে, যার ধর্মীয় তীর্থস্থানগুলো এ দেশেই আছে। বলা বাহুল্য সে শুধু হিন্দুদের পক্ষেই সম্ভব, টেনেটুনে শিখ বৌদ্ধ আর জৈনদেরও না হয় সে দলে ফেলা গেল, কিন্তু মুসলমান আর খ্রিস্টান নৈব নৈব চ। যেহেতু মুসলমান আর খ্রিস্টানদের মূল তীর্থস্থানগুলো ভারতের বাইরে, অতএব, সাভারকরের মতে, ভারত দেশটির প্রতি তাদের আনুগত্য সবসময়েই সন্দেহজনক। ভারতবর্ষ বড়জোর তাদের ‘পিত্রুভূ’ হতে পারে, কিন্তু ‘পুণ্যভূ’ কখনওই নয়, তাই তারা কেউই সত্যিকারের ভারতীয় হতে পারে না। এখন, একজন আধুনিক ভারতীয় নাগরিক নিশ্চয়ই অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে চাইবেন, এইসব তুচ্ছ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সেন্টিমেন্ট কীভাবে আধুনিক জাতীয়তাবাদের উপাদান হতে পারে! তিনি বলবেন, আধুনিক জাতীয়তাবাদ মানে তো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী জাতির স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্ব, যেখানে আইন-প্রশাসন-বিচার-শিক্ষা কঠোরভাবে ধর্ম ও পুরোহিততন্ত্র থেকে দুরত্ব বজায় রাখবে, যেখানে জাতপাত-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তি-নাগরিকের থাকবে সমান সুযোগ ও তার কাছ থেকে দাবি করা হবে জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতি সমান আনুগত্য। সে জাতি ও রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকবে আধুনিক অর্থনীতির ওপরে, যাকে সাথ দেবে আধুনিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা ক্রমাগত পরিপুষ্ট হবে আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তি মানবিকীবিদ্যার মূল্যবোধ, শিক্ষা ও গবেষণায়, এবং যার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না প্রাচীন সংস্কার, অন্ধত্ব ও ভেদবুদ্ধি। সেখানে কার তীর্থস্থান কোথায় সে উদ্ভট বিচারের প্রাসঙ্গিকতা কী, আর, তীর্থস্থানের অবস্থান দিয়ে জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তি-নাগরিকের দায়বদ্ধতাকে মাপতে যাওয়ার যৌক্তিকতাই বা কোথায়? কিন্তু, এ বিচারের অন্তর্লীন উদ্ভটত্ব সাভারকরকে মোটেই স্পর্শ করে না, তিনি ভারতীয় অস্তিত্বের সারসত্তাটুকুকেই গড়েপিটে নিতে চান প্রাচীন পৌরাণিকতা ও ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের আধারে, এবং এভাবে প্রথমেই মেরে রাখেন আধুনিক জাতীয়তাবাদের গোড়াটি, জাতীয়তাবাদের নাম জপতে জপতেই।

সাভারকর আধুনিক ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের শৌর্য ও সমৃদ্ধি দেখে মুগ্ধ, তিনি চান তাঁর সাধের হিন্দুরাষ্ট্রও ওই রকমটি হোক, অন্তত সামরিকভাবে। কিন্তু, তিনি তাঁর স্বদেশে চান না ‘দোন কিহোতে’ আর ‘দেকামেরন’-এর মত ধর্মবিরোধী সাহিত্য, চান না চার্চ ও রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ ও তিক্ত প্রক্রিয়া, চান না গ্যালিলিও-ব্রুনোর মত ধর্ম-প্রতিস্পর্ধী বিজ্ঞান-শহীদ, চান না ধর্মতত্ত্ব ও পুরোহিততন্ত্রকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া ফরাসি এনলাইটেনমেন্ট ও ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদ, চান না নানা ধারার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। এক কথায়, তিনি হলেন খেলনার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অবুঝ শিশুটির মত, যে নাকি শো-কেসে সাজানো সুঠাম ঐরাবতটির দিকে আঙুল তুলে বায়না ধরে যে, ঐরাবতটি নয়, তাকে দিতে হবে শুধু ওর শুঁড়টি।

অকারণ ঘৃণা, হিংস্রতা ও সন্দেহপ্রবণতার মত যুক্তিবিরোধী বিষয়গুলো সব সময়ই সাভারকরীয় ‘হিন্দুত্বের’ (এবং সেইহেতু তজ্জাত ‘ভারতীয়ত্বের’-ও) অপরিহার্য উপাদান। তাঁর মধ্যে এইসব মানসিকতার শিকড় যে অতি গভীরে, সেটা বোঝা যায়, যখন তাঁর প্রধান জীবনীকার ধনঞ্জয় কীর সোল্লাসে বর্ণনা করেন তাঁর বারো বছর বয়েসের সেই ঘটনা, যেখানে তিনি তাঁর কয়েকজন বিদ্যালয়-সহপাঠীদের সাথে মিলে আক্রমণ করেছিলেন একটি মসজিদ, পাথর ছুঁড়ে ভেঙে দিয়েছিলেন তার কাঁচ ও টালিগুলো। পাড়ার মুসলমান ছেলের দল তেড়ে এসেছিল, কিন্তু হিন্দু বালকের দল সাভারকরের নেতৃত্বে পেনসিল কাটা ছুরি, লোহার কাঁটা আর রুলার সহযোগে ‘ধর্মযুদ্ধে’ লিপ্ত হয় এবং বিজয়গর্বে বাড়ি ফেরে। এই অন্তর্গত ঘৃণা এবং হিংস্রতা তিনি নিজের মধ্যে বহন করেছেন সারা জীবন, এমন কি, যখন তিনি তত সাম্প্রদায়িক ছিলেন না সেই সময়েও। প্রথম যৌবনে তিনি আকৃষ্ট হন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের দিকে, এবং ১৯০৮ সালে রচনা করেন ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে এক ঐতিহাসিক আখ্যান, যা গোপনে প্রকাশিত ও বিতরিত হয়। সে সময় তিনি বিশ্বাস করতেন, দীর্ঘ শত্রুতার ইতিহাস সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলমান একসাথে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়তে পারে, এবং ওই বইটিতে সে কথাই লিখেছিলেন। কিন্তু, এ রকম একটি বইতেও, বিদ্রোহী সিপাইরা যেখানে ব্রিটিশ ঘাঁটি আক্রমণ করে বহুসংখ্যক মহিলা ও শিশুদের হত্যা করছে, এ ধরনের ঘটনা তিনি এমন উৎসাহের সঙ্গে খুঁটিয়ে বর্ণনা করেছেন, দেখে অবাক মানতে হয়। ব্রিটিশ-বিরোধী কর্মকাণ্ডের জেরে তিনি ধরা পড়েন ও আন্দামান সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত হন ১৯১১ সালে। ওই বছর থেকেই মুক্তির আবেদন জানিয়ে চিঠি দিতে শুরু করেন, এবং পরবর্তী বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি চিঠি দেন, যার মধ্যে ১৯১৩-র চিঠিটি কুখ্যাত। সে চিঠিতে ব্রিটিশ সরকারকে ‘মা-বাপ’ ঘোষণা করে তিনি কাতর আবেদন করেন যে, তিনি মহান সরকারকে সব রকম সহযোগিতা করতে চান, এবং, অবাধ্য অথচ অনুতপ্ত সন্তানের মত মা-বাপের কাছে ফিরতে চান। শেষ পর্যন্ত সাভারকর ১৯২১ সালে কারামুক্তি পান, এবং যথারীতি ব্রিটিশ বিরোধিতা ছেড়ে ধর্মীয় ঘৃণার রাজনীতিতে পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেন। ভারত তথা হিন্দুর ইতিহাসের এক আশ্চর্য বয়ান তিনি তৈরি করেছিলেন, যেখানে প্রথমে হিন্দুরা ছিল এক দুর্ধর্ষ বীর যোদ্ধাদের জাত যারা বহিরাগত গ্রিক আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রবল পরাক্রমে লড়েছিল, কিন্তু মাঝে বুদ্ধ এসে তাদেরকে অহিংসা-ক্ষমা-দয়া-বিনয়ের ভীরু কাপুরুষ মতাদর্শে মজিয়ে দিলেন, আর তারই সুযোগ নিয়ে প্রথমে মুসলমান আর পরে ইংরেজ এসে দেশটাকে ছারখার করে দিল। এই ঘৃণা-হিংস্রতা-প্রতিশোধের অসুস্থ চক্র থেকে সাভারকর ছাড় দেন না তথাকথিত বীর হিন্দু আইকনদেরও। শিবাজী যখন মুসলমান শাসকের পুত্রবধূকে হাতে পেয়েও ফিরিয়ে দেন সৌজন্যবশত, বা চিমাজি আপ্পা ফিরিয়ে দেন বেসিনের পর্তুগিজ শাসকের স্ত্রীকে, তখন সাভারকর সরোষে অভিযোগ করেন, নারীর প্রতি এই অযথা সম্মান দেখানোর সময়ে শিবাজী ও আপ্পাজির উচিত ছিল মুসলমানের দ্বারা অত্যাচারিত হাজারো হিন্দু নারীর কথা স্মরণে রাখা!

এইভাবে সাভারকর তাঁর গোটা হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পটিকে দাঁড় করিয়ে দেন এক আশ্চর্য স্ববিরোধী প্যারাডক্সের ওপর — হিন্দু ভাল, মুসলমান খারাপ, এবং সেইজন্যই হিন্দুকে মুসলমানের মত খারাপ হয়ে উঠতে হবে! কিন্তু হায়, এই উদ্ভট প্রকল্পে কোথায় নাস্তিকতা, আর কোথায়ই বা যুক্তিবাদিতা ?

আশিস নন্দী এবং আরও কোনও কোনও বিখ্যাত পণ্ডিত সাভারকরকে নাস্তিক/যুক্তিবাদী/অজ্ঞাবাদী বলে চিহ্ণিত করেছেন ‘ঈশ্বর’ নিয়ে তাঁর বিশেষ কোনও বক্তব্যের কারণে নয়, সম্পূর্ণ অন্য দুটি কারণে। প্রথমত, সাভারকর ধর্ম ও ঈশ্বরের স্বরূপ নিয়ে হিন্দু ধর্মতাত্ত্বিক তর্কাতর্কিকে একদমই প্রশ্রয় দেননি। দ্বিতীয়ত, সাভারকর নিজের এবং তাঁর স্ত্রীর পারলৌকিক ক্রিয়া করতে চাননি বলে, গো-ভক্তির বিরোধিতা করেছিলেন বলে এবং হিন্দুদের মাছ ও ডিম খাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে। কিন্তু, শুধু এইটুকু তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে কারুকে নাস্তিক বলে মেনে নেওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার ।

প্রথমটি মোটেই নাস্তিকতা নয়, বরং আসলে এক ধরনের কৌশল। তাঁর হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচী নিয়ে কেউ যাতে এমনকি ধর্মতাত্ত্বিক তর্কও না তুলতে পারে, তার বিরুদ্ধে এ হল এক রকমের প্রতিরক্ষা। আর, বলাই বাহুল্য, প্রচলিত ধর্মীয় রীতিনীতি কেউ মেনে না চললেই সে নাস্তিক, এ এক বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত।

তাই খোঁজ করা দরকার, নির্দিষ্টভাবে ‘ঈশ্বর’ নিয়ে তাঁর কোনও লেখা পাওয়া যায় কিনা। গবেষক সিগফ্রিড উল্ফ, অন্য আরও কয়েকজন গবেষকের অনুসরণে, সাভারকরকে ‘বিলিভিং অ্যাগনস্টিক’ বা ‘বিশ্বাসী অজ্ঞাবাদী’ বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন, তাঁর একটি কবিতা পাঠ করে। কবিতাটির নাম ‘The Closed Gate of the Unknowable’। এখানে তিনি এক পরম ভক্তের মত ঈশ্বরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে বলছেন, ঈশ্বরের মাত্র একটিই বাড়ি আছে, এবং তাঁর দরজা সব সময়ই বন্ধ থাকে, ভক্ত বারবার ঠকঠক করলেও সে দরজা কখনওই খোলে না। এখানে পরিষ্কার, তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহ পোষণ করেন না, শুধু একটু হতাশা প্রকাশ করেন যে, হয়ত বা ঈশ্বরের স্বরূপ তিনি কোনওদিনই জানতে পারবেন না।

এ রকম আর কোনও লেখা আছে কি ? হ্যাঁ, অন্তর্জালে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শব্দের একটা লেখা আছে, শিরোনাম -Conceptualising “God”:The “God of Humans” v/s The “God of the universe”। মূল লেখাটি সম্ভবত মারাঠিতে, সেটি ইংরিজিতে অনুবাদ করেছেন ডঃ আদিত্য ধোপাতকর । লেখাটি আছে savarkar.org নামক ওয়েবসাইটে, এটি সাভারকরের অনুগামীদের দ্বারা পরিচালিত একটি প্রামাণ্য সাইট। তবে, এই বিশেষ রচনাটি সাভারকরের রচনা সমগ্রের ঠিক কোথায় আছে, সে সূত্র ওখানে নির্দেশ করা নেই। লেখাটিতে যা আছে, তার মোদ্দা কথাটুকু অতি সংক্ষেপে পেশ করা যাক।

আমরা ভাবি, যেহেতু এ প্রকৃতি আমাদের খাদ্য ও আশ্রয় জোগায়, অতএব এর পেছনে যে ঈশ্বর আছেন তিনি দয়ালু, এবং তিনি খালি মানুষের কথাই ভাবেন। কিন্তু আসলে, এ প্রকৃতিতে বিষ, মহামারী, বন্যা ও ভূমিকম্প, হিংস্র জন্তু, এই সবও আছে, এবং মানুষের পক্ষে উপকারী জিনিসের চেয়ে মারাত্মক ক্ষতিকর জিনিসই বরং বেশি আছে। কাজেই, ঈশ্বর আসলে ‘জগতের ঈশ্বর’ (God of the universe), তিনি মোটেই ‘মানুষের ঈশ্বর’ (God of Humans) নন। তিনি ভয়ঙ্কর নৈর্ব্যক্তিক, এবং নিজের নিয়মে জগতকে চালান, কারও ব্যক্তিগত প্রার্থনায় মোটেই কর্ণপাত করেন না (an unfazed, unperturbed cosmic power)। বস্তুত, তাঁর প্রার্থনা ও পুজোপাঠ এক স্বার্থপর ও নির্বোধের কাজ। আমার অসুখ সেরে গেলে তাঁর জয়ধ্বনি করাটা যদি কর্তব্য হয়, তো তার আগে আমাকে রোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে গালি দেওয়াটাও কি তবে অবধারিত কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় না? আমরা যুক্তি আর বিজ্ঞান দিয়ে তাঁর কর্মপদ্ধতি বোঝার চেষ্টা করতে পারি, বা যোগীর মত করে ধ্যানের অন্তর্দৃষ্টি দিয়েও তাঁকে উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু যেভাবেই যা করি না কেন, কখনওই তাঁকে পুরো বুঝতে পারব না, এবং তাঁকে প্রভাবিতও করতে পারব না। আমাদের কথায় বিশ্ব চলবে না, বিশ্বের নিয়ম বুঝে নিয়ে আমাদেরকেই বরং সেইমত চলতে হবে। সেইটা খানিক বুঝে আমরা যে নিজেদের জীবনযাপনকে খানিকটা সহজ করে তুলতে পারি, এটাই ঢের, এবং ঈশ্বরের ‘দয়া’ বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তো সে স্রেফ ওইটুকুই। আমরা হচ্ছি রাজপথের ধারের ভিক্ষুকের মত যারা নিজেরা ঝগড়া করে এবং প্রত্যাশা করে যে সম্রাট তার বিচার করবেন, কিন্তু সম্রাটরূপী ঈশ্বর আসলে তাঁর লোকলস্কর সহযোগে নির্বিকারভাবে রাজপথ দিয়ে চলে যান, ভিক্ষুকদের লক্ষই করেন না।

হ্যাঁ, তাঁর বক্তব্য একজন গড় ভারতীয় হিন্দুর তুলনায় অবশ্যই একটু বেশি যুক্তিবাদী শোনাবে (তাঁর সমকালের প্রেক্ষিতে তো আরওই বেশি করে), এবং তাতে আঠেরো-উনিশ শতকের ইউরোপীয় দর্শনের প্রভাবও স্পষ্ট। কিন্তু এ কোনও মতেই আধুনিক যুক্তিবাদ নয়, নাস্তিকতা তো নয়ই। আধুনিক যুক্তিবাদ জগতকে সম্পূর্ণ অলৌকিকতাবর্জিত এক যুক্তি-বুদ্ধিগ্রাহ্য বস্তু-সংগঠন হিসেবে বুঝতে চায়, এবং সেই হেতু নাস্তিকতা ও ধর্মবিরোধিতা তার আবশ্যিক ও অপরিহার্য উপাদান। অথচ এই লেখাটি খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যাবে যে, লেখক আদৌ নাস্তিক নন। তিনি শুধু “God of Humankind”-কে “God of the universe” দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে চান, যে God বা ঈশ্বর আদতে হলেন “unfazed, unperturbed cosmic power”। একে বড়জোর সতেরো-আঠেরো-উনিশ শতকের ইউরোপীয় ‘ডিইস্ট’ দার্শনিকদের সাথে তুলনা করতে পারা যায়, যাঁরা মনে করতেন, ঈশ্বর স্বয়ং যুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক নিয়ম-নীতি সহকারেই এই জগত বানিয়েছেন, কাজেই কারুর ব্যক্তিগত প্রার্থনায় কান দেওয়া বা জগতের নিয়মবিরুদ্ধ কোনও অলৌকিক হস্তক্ষেপ তাঁর কাজ নয়। পুরোপুরি নাস্তিক না হলেও এ ধরনের তত্ত্ব ইউরোপীয় মনীষাকে নাস্তিকতার দিকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিল, এবং ধর্মের মর্যাদাও অনেকখানিই ধ্বংস করে দিয়েছিল। ভাবুন না, ঈশ্বর যদি প্রার্থনা শুনে আমার কিছু বাস্তব সুবিধে না-ই করতে পারেন, তাহলে আর আচার-বিচার-মন্দির-শাস্ত্র-পুরুত মেনে কী হবে? তাই, সে যুগে যাঁরা ধর্মের অত্যাচার ও বুজরুকি নিয়ে সোচ্চার ছিলেন তাঁরা অনেকেই ছিলেন ‘ডিইস্ট’। এখন, হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা যদি ‘ডিইস্ট’-ও হয়ে থাকেন, সেও তো একটা মারকাটারি ব্যাপার! তাই কি? উঁহু, আশা কুহকিনী।

ভাল করে চিন্তা করে দেখলে বোঝা যায়, সাভারকার আসলে এমনকি ‘ডিইস্ট’-ও নন, এবং ‘ডিইস্ট’-দের সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের মিলটি একান্তই বাহ্যিক। প্রথমত, তিনি যেমন করে ধ্যানের সাহায্যে জগতকে বোঝার বিকল্প রাস্তার কথা বলেন সেটা মরমিয়া বিশ্বাসের কথা, ‘ডিইস্ট’-অবস্থান নয়। দ্বিতীয়ত, ‘ডিইস্ট’-রা সোচ্চার ছিলেন প্রচলিত ও শাস্ত্রভিত্তিক বিশ্বাসের অসারতা ও অমানবতার বিরুদ্ধে, আর সাভারকর সেখানে তাঁর আজন্মলালিত ধর্মকেই ‘way of life’ বলে আঁকড়ে ধরতে চান, এবং সমস্ত দেশবাসীকে তা ধরাতেও চান, আর বিধর্মীদের উচিত শিক্ষা দিতে চান — দরকার হলে বলপ্রয়োগ করেও। গোড়ায় গণ্ডগোল আর কাকে বলে! তাহলে এখন প্রশ্ন হল, ঈশ্বর নিয়ে সাভারকরের অবস্থানটা ঠিক কী ছিল? এক নজরে যাকে ‘ডিইজম’ বলে ভুল হয় তার প্রকৃত স্বরূপটা কী? আমার মনে হয়, আসলে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা সম্ভবত ঔপনিষদিক নিরাকার-নির্গুণ ব্রহ্মের বিশেষ কোনও এক ব্র্যান্ড – পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক ভারতীয়ের কাছে তা উপস্থাপিত করার জন্য ‘ডিইস্ট’ যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। ঔপনিষদিক নিরাকার-নির্গুণ ব্রহ্ম থেকে তিনি এমন এক ঈশ্বরকে নিষ্কাশন করতে চেয়েছেন, যিনি এমনিতে উদাসীন ও নিষ্ঠুর, কিন্তু উদ্যোগী বীরপুরুষকে পুরষ্কার দিতে জানেন। তাঁর দার্শনিক রচনা খুব বেশি না হওয়ায় এ কথাটা হয়ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রমাণ করা যাবে না (এ নিয়ে কোনও ভাল মানের রিসার্চ আছে কিনা জানি না), তবে তাঁর প্রগতিবিরোধী রাজনীতিটাই কিন্তু এর পরোক্ষ প্রমাণ।

শেষে গিয়ে মোদ্দা প্রশ্নটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে, একজন আধুনিক নাস্তিক যুক্তিবাদী আদৌ ধর্মীয় পরিচিতিভিত্তিক রাজনীতিটা করতে যাবেন কেন (এবং কীভাবে)? এ ধরনের রাজনীতিতে যেভাবে অযুক্তি অন্ধত্ব প্রতারণা বিদ্বেষ ইত্যাদি নিয়ে কারবার করতে হয় তা আধুনিক নাস্তিক যুক্তিবাদীর পক্ষে ভীষণ মুশকিল তো বটেই, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সেই মোটিভেশনটাই তিনি পাবেন না। একজন ধর্মবিশ্বাসী সফলভাবে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রাজনীতি করতেই পারেন, যদি তিনি তাঁর ধর্মবিশ্বাস থেকে রাজনীতিটা পৃথক রাখতে রাজি থাকেন। কিন্তু যিনি সক্রিয় ও আন্তরিকভাবে ধর্মীয় ঘৃণা ও হিংস্রতার রাজনীতিকে গ্রহণ করেছেন, তিনি কখনওই আধুনিক নাস্তিক যুক্তিবাদিতাকে ধারণ করতে পারবেন না (বা উল্টোটা)। সাভারকর এবং অরবিন্দ দুজনেই প্রথমে ব্রিটিশ-বিরোধী আধুনিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সরকারি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তা চালিয়ে যাওয়ার মত চরিত্রবল উভয়েরই ছিল না। একজন নির্ভেজাল ধর্মগুরু হয়ে গেলেন, এবং আর একজন ধর্মীয় আইডেন্টিটি পলিটিক্স শুরু করলেন – অযৌক্তিক জাতিগর্ব, অন্ধত্ব ও ঘৃণার চাষ এবং ইতিহাস-বিকৃতি যার অপরিহার্য উপাদান।

এর মধ্যে আধুনিক নাস্তিক যুক্তিবাদিতার স্থান কোথায়, তবে?

এইবারে বোধহয় দাঁড়ি টানার সময় হয়েছে, এবং আমি ঠিক তাই-ই করব, তবে তার আগে এ প্রসঙ্গে আশিস নন্দীর অদ্ভুত অবস্থান নিয়ে দু-এক কথা বলে নেব। ওপরে বলেছি, আশিস নন্দী প্রমাণ করতে চান, সাভারকর এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি আসলে ভারতীয় সমাজের আধুনিক হওয়ার প্রক্রিয়ার উপজাত পদার্থ, এবং সাভারকরকে যুক্তিবাদী নাস্তিক বলে চালানোটা এই প্রকল্পের সাথে চমৎকার যায়। যে অনায়াস দক্ষতায় তিনি সেটা করেন, তা শুনতে ভারি যুৎসই। আধুনিকতা-বিরোধী সমাজ-মনোবিদ শ্রী নন্দী তাঁর বিস্ময়কর তত্ত্বপ্রস্তাবকে দুটি দিক থেকে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতে চান – ‘ডিম্যান্ড সাইড’ বা চাহিদা পক্ষ এবং ‘সাপ্লাই সাইড’ বা সরবরাহ পক্ষ। প্রথম পক্ষটি ক্রম-আধুনিকায়িত ভারতীয় হিন্দু সমাজ, যারা পেশাগত কাজেকর্মে পুরনো স্বভূমি ছেড়ে ক্রমাগতই পাড়ি দিচ্ছে দূরদূরান্তে, এবং নানা মাধ্যমে তাদের ঘরের অন্দরেও ক্রমাগত হানা দিচ্ছে দূরদুরান্ত। স্থানীয় মন্দিরটি, স্থানীয় রীতিনীতি, স্থানীয় পুরুত ও গুরুঠাকুর, স্থানীয় আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশী, এইসবের বাঁধনে বাঁধা পড়ে থাকলে তাদের মোটেই চলে না, অথচ ধর্মের চাহিদাটুকু আছে পুরোদমে, তাই তাদের চাই নতুন এক রকমের ‘পোর্টেব্‌ল্‌’ হিন্দুত্ব, যার সাথে প্রাচীন হিন্দুত্বের খুব বেশি মিল না থাকলেও চলে। এ চাহিদার তাত্ত্বিক শিকড়টি শ্রীনন্দীকে খুঁজে বার করতে হয় সাভারকরের বহু আগে, উনিশ শতকীয় বাংলার ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের মধ্যে। এক দিকে এই চাহিদার টান, কিন্তু সেই চাহিদা মেটানোর জন্য একটা সরবরাহও তো দরকার, আর সেই সরবরাহটাই নাকি জোগাচ্ছে হিন্দুত্ববাদ। কিন্তু, ঠিক কীভাবে ?

সেটা বোঝাতে শ্রী নন্দী হাজির করেন এ প্রক্রিয়ার ‘সাপ্লাই সাইড’ বা সরবরাহ পক্ষকে। তিনি বলতে চান, ভারতবর্ষ যখন এক আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে, তখন ভারতীয় সমাজের মাথারা প্রাণপণে খুঁজছেন জায়মান ভারতরাষ্ট্রের জন্য এক জবরদস্ত সুস্থায়ী আদর্শগত ভিত্তি। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের মডেল হিসেবে তাঁরা পেয়েছেন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে, কিন্তু আদর্শগত ভিত্তির জন্য তো দেশের দিকে তাকানোটাই স্বাভাবিক, এবং সেখানে হিন্দুত্বের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। যুদ্ধবিগ্রহ ও হত্যা যেহেতু আধুনিক ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল, অতএব সেই জঙ্গি মেজাজ হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের অঙ্গীভূত হতে অসুবিধে ছিল না। শ্রী নন্দীর মতে, এইভাবে আধুনিক ভারতরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার অনিবার্য উপজাত হিসেবেই তৈরি হয় জঙ্গি হিন্দু জাতীয়তাবাদ, যা নাকি খাপে খাপে মিলে যায় ক্রম-আধুনিকায়িত ভারতীয় হিন্দু সমাজের তরফে এক নতুন ‘পোর্টেব্‌ল্‌’ হিন্দুত্বের চাহিদার সাথে, এবং এভাবেই এক সামাজিক শক্তি হিসেবে উঠে আসে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন।

হয়ত এই ঐতিহাসিক ‘অনিবার্যতা’-র কারণেই, শ্রী নন্দীর মধ্যে কোথাও খানিক সহানুভূতি রয়ে যায় সাভারকরের জন্য। তিনি স্বীকার করেন যে, ইংরেজের কাছে মুক্তির জন্য সেই কুখ্যাত দাস-সুলভ চিঠি লেখা এবং গান্ধিহত্যায় নাম জড়িয়ে পড়ার ফলে সাভারকরের নাম খুবই খারাপ হয়েছে বটে, কিন্তু তবু প্রশ্ন করেন, যিনি অত বছর ধরে জেলে অত অত্যাচার সইলেন, তাঁর আর একটু সহানুভূতি প্রাপ্য ছিল কিনা। ভারতের আলোকপ্রাপ্ত সমাজে সাভারকর বিষয়ে যে অস্বস্তি ও অস্বীকৃতি রয়েছে, তা তাঁকে যুগপৎ বিষণ্ণ ও বিস্মিত করে। সে বিস্ময়ের নিরসনকল্পে তিনি সিদ্ধান্ত করেন, ওসব ধর্মান্ধতা আর ঘৃণা কিছু নয়, আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্র ও সমাজ আসলে সাভারকরকে ভুলতে চায় নিজেরই অন্তর্গত হিংস্রতাকে ধামাচাপা দেবার জন্য। এ হল প্রকৃতপক্ষে, শ্রী নন্দীর নিজস্ব ভাষায়, ‘Rites of Exorcism in Secularizing South Asia’ – সেক্যুলারিজ্‌মের নিজেরই ভেতরকার ভূত ছাড়ানোর জন্য তার নিজেরই ওঝাগিরির ছলাকলা।

এইসব তাক-লাগানো অতিনাটকীয় তত্ত্বের সাহিত্যগুণকে কুর্ণিশ করেও বলতে হয়, এসব নাটক স্বাভাবিক যুক্তিবিচারের কাছে মোটেই ধোপে টেঁকে না। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের মডেলের জন্য সাভারকর ইউরোপের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাতেই পারেন, কারণ ও বস্তুটি ভারতীয় ঐতিহ্যে প্রাপ্য নয় (যদিও তিনি আধুনিক ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র গঠনের সত্যিকারের ঐতিহাসিক কার্যকারণগুলো বুঝতেন এমন কোনও প্রমাণ নেই)। কিন্তু, ঘৃণা আর হিংস্রতা তাঁকে ইউরোপ থেকে আমদানি করতে হবে কেন, ও দুই বস্তু প্রাচীন ভারতে কিছু কম পড়িয়াছিল বুঝি? প্রাচীন ভারতের রাজাগজাদের মধ্যে অর্থহীন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কিছু কম হত বুঝি ? আমাদের দুই প্রধান মহাকাব্যের উপজীব্য সর্বধ্বংসী যুদ্ধ নয় বুঝি? আমাদের আরেক প্রধান ধর্মগ্রন্থ গীতা স্বজন-হত্যার ধর্মতাত্ত্বিক প্ররোচনায় ভরপুর নয় বুঝি? এ সব বস্তু আমাদেরকে ইউরোপ থেকে আমদানি করতে বাধ্য হতে হবে, এ কী অন্যায় আবদার বলুন তো!

উঁহু, না। সাভারকর ও হিন্দুত্ব আমাদের আধুনিকতার উপজাত নয়, আধুনিক না হতে পারার উপজাত। আজ যখন সেক্টর ফাইভের ঝকঝকে আইটি-বালক তার প্রস্তাবিত বিবাহের শুভাশুভ নির্ধারণে ঠিকুজির শরণাপন্ন হয়, আর কপালে তিলক কেটে ভারতমাতার উন্নয়নকল্পে রামমন্দির আকাঙ্ক্ষা করে, তখন বোঝা যায়, অনাধুনিকতার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে!

 

তথ্যসূত্র

  1. ‘Hindutva : who is a Hindu ?’ Vinayak Damodar Savarkar, Veer Savarkar Prakashani, 1969
  2. ‘Six Glorious Epochs of Indian History’, Vinayak Damodar Savarkar, Trans. S. T. Godbole, 1971
  3. ‘Veer Savarkar’ by Dhananjay Keer, Popular Prakashan Bombay, 1966
  4. ‘Hindu Nationalists of Modern India’, J. Kuruvachira, Rawat Publications, 2006
  5. ‘Hindutva : Exploring the Idea of Hindu Nationalism’, Jyotirmaya Sharma, Penguin/Viking, 2003
  6. ‘The Demonic and the Seductive in Religious Nationalism : Vinayak Damodar Savarkar and the Rites of Exorcism in Secularizing South Asia’, by AshisNandy, Working Paper No. 44, February 2009, Heidelberg Papers in South Asian and Comparative Politics
  7. “Vinayak Damodar Savarkar’s ‘Strategic Agnosticism’ : A compilation of his socio-political philosophy and worldview”, by Siegfried O. Wolf, Working Paper No. 51, January 2010, Heidelberg Papers in South Asian and Comparative Politics
  8. ‘সাভারকর ও হিন্দুত্ব’, লেখক এ জি নুরানী, ভাষান্তর – কাবেরী বসু, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১৭
  9. সাভারকরের ঈশ্বর বিষয়ক লেখাটি গত ২৯/০৪/২০১৯ এখান থেকে নেওয়া হয়েছে —  http://savarkar.org/en/encyc/2017/5/23/Essay-1-Conceptualising-God-.html