Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা: প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সার্বিক অন্তর্ভূক্তিকরণে প্রধান অন্তরায়

ড. বুবাই বাগ

 

২০১৫ সালে ডিসেম্বরে’র এক রবিবাসীয় সকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী’র ‘মন কি বাতে’-তে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা ‘দিব্যাঙ্গ’ হিসেবে নতুন পরিভাষায় চিহ্নিত হয়েছেন। প্রতিবন্ধকতা অধিকার কর্মী, গোষ্ঠী এবং নাগরিক সমাজের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও অতি তৎপরতার সঙ্গে ‘দিব্যাঙ্গ’ শব্দটি প্রশাসনিক কাজে সিলমোহর পায়। যদিও প্রতিবন্ধকতাকে চিহ্নিতকরণে ভাষার পরিবর্তন একেবারে নতুন নয়। এর আগেও ২০১২-তে তৎকালীন সরকারের উদ্যোগে বিকলাঙ্গ শব্দের পরিবর্তে ‘নিষ্কর্মা’ নামে একটি শব্দের প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। তবে প্রবল বির্তকের জেরে সেই শব্দটি জনপ্রিয়তা হারায়।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে বর্তমান সরকার কেন পুনরায় নতুন নামকরণে ব্রতী হলেন? প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কিত ঐতিহ্যগত বা চিরাচরিত ব্যাখ্যায় যে ‘দৈবস্বত্বে’র (সেখানে প্রতিবন্ধকতা দেবতার দান বা অভিশাপ হিসাবে দেখা হয় এবং দেবতার করুণা লাভের মধ্য দিয়ে তা থেকে মুক্তি ঘটবে বলেও মনে করা হয়) কথা ধর্মীয় শাস্ত্রগুলিতে পাওয়া যায়, সেই চেতনার পুনরুত্থান বললে বোধহয় ভুল হবে না।

ধর্মীয় আঙ্গিকে প্রতিবন্ধকতাকে দেখা গেলেও, আদতে তারা যে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব, তা নিয়ে বোধহয় সন্দেহ নেই! তাই স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পর হলেও সপ্তদশ সাধারণ নির্বাচনে (২০১৯) প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের বিশেষভাবে অন্তর্ভূক্ত করতে নির্বাচন কমিশন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এতদিনে তাদের উপলব্ধি হয়েছে প্রতিটি ভোট সমান মূল্যবান, তাই সকল ভোটাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।

ভারতের বৃহত্তম সামাজিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ভোটাদের (২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ভোটারদের সংখ্যা আনুমানিক দুই কোটি চল্লিশ লক্ষের কাছাকাছি) সার্বিকভাবে অন্তর্ভূক্ত করতে কেন সাত দশক অতিক্রান্ত হল তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনেই (১৯৫২) সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। তত্ত্বগতভাবে সেই নির্বাচনে প্রতিবন্ধী মানুষদের আপাত অংশগ্রহণে কোনও বাধা ছিল না, তবে পরিবেশগত ও পরিকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা প্রবল ছিল।

বর্তমান নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচন কমিশন সেই সব পরিকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা দূর করে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে আগ্রহান্বিত হয়েছে। যদিও তার প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ আইনি লড়াই ছিল। প্রতিবন্ধী মানুষ আইনে (১৯৯৫) ‘সমান সুযোগ, অধিকার রক্ষা এবং সম্পূর্ণ অংশগ্রহণে’র কথা বলা হলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ অংশগ্রহণে তাদের অবস্থান ছিল বহুযোজন দূরে। সেই চেতনা থেকে প্রতিবন্ধকতা অধিকার গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার্থে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা (রিট পিটিশান ১৮৭, ২০০৪) দায়ের করেন। সেই মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন ভোটগ্রহণ কেন্দ্র এবং ভোটদান প্রক্রিয়াকে প্রতিবন্ধী বান্ধব করে তুলতে হবে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন না হওয়ায় পুনরায় ২০০৭ সালে প্রতিবন্ধকতার অধিকার গোষ্ঠী ভারতীয় ইউনিয়নে’র বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলার রায়েও প্রতিবন্ধকতার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সমস্ত নির্দেশিকাগুলির বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে একযুগ পরে এই সপ্তদশ সাধারণ নির্বাচনে (যদিও প্রথম তিন দফা নির্বাচনে সার্বিক বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা সেই নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন)।

প্রতিবন্ধকতার গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগগুলিকে সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যেতে পারে। তাদের উদ্যোগের অন্যতম হল প্রতিবন্ধী বান্ধব ভোটগ্রহণ কেন্দ্র, অর্থাৎ প্রত্যকে বুথে স্থায়ী র‍্যাম্প না থাকলে অস্থায়ী র‍্যাম্প নির্মাণ, যেখানে হুইলচেয়ার বহনকারী ভোটার বিনা বাধায় ভোটদান কেন্দ্রে অবাধে প্রবেশ করতে পারে। প্রত্যেক ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে হুইলচেয়ার মজুত রাখা। আংশিক বা সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীনতাযুক্ত ভোটারদের জন্য ব্রেইল ডামি ব্যালট পেপার, ইভিএমে ব্রেইল পদ্ধতির ব্যবহার, অপেক্ষাকৃত বড় অক্ষরে ছাপানো পোস্টারের মাধ্যমে প্রার্থী ও প্রতীক বুঝতে সাহায্য করা। শ্রবণ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ভোটারদের প্রতি যত্নশীল হতে ভোটদান কেন্দ্রে ‘চিহ্ন ভাষা’ (sign language) বোঝা ব্যক্তি বা দোভাষীর উপস্থিতি। বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতার জন্য ছবিসহ কার্ডের ব্যবস্থা ও প্রয়োজনে বিশেষ সহায়তাকারীর উপস্থিতি। সমস্ত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ভোটাদের লাইনের পরিবর্তে সরাসরিভাবে ভোটাদান কক্ষে প্রবেশে অগ্রাধিকার দেওয়া। এছাড়াও ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পানীয় জল, প্রতিবান্ধব শৌচালয়, প্রতিবন্ধকতার জন্য পৃথক অ্যাপ-এর প্রচলন এবং ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সর্বোপরি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ভোটারদের প্রতি যত্নশীল ও সংবেদনশীল ব্যবহারের জন্য ভোটকর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উপরিউক্ত পদক্ষেপগুলি প্রতিবন্ধকতার রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। কমিশন এই সুগম্য ভোটের তত্ত্বাবধান করতে জাতীয় স্তরে উপদেষ্টা কমিটি (২০১৮) গঠন করেছে। সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সব জেলায় একই ধরনের উপদেষ্টা কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা ব্যক্তিগতভাবে বা সাংগাঠনিক স্তরে। এই প্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধকতার অধিকার আন্দোলনের মূল ভাবনা ‘Nothing About Us Without Us’ যে প্রকাশ পেয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কমিশনের উদ্যোগের বাস্তবায়নের দিকে তাকালে তত্ত্ব ও বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ফারাক চোখে পড়ে। কলকাতা বা জেলা শহরের বেশ কিছু স্থানে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের ছবি সম্বলিত ব্যানারে ‘আমরাও ভোট দেব’ দেখতে বেশ লাগে। প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে, এই আশ্বাসে এক প্রকার গর্ব অনুভব হয়। সত্যিই তারা স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন অচিরেই চলে আসে।

প্রথমেই আসা যাক, চলনজনিত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ভোটারদের জন্য স্থায়ী বা অস্থায়ী র‍্যাম্প নির্মাণের প্রসঙ্গে। গ্রামীণ একালার অবশ্য বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সর্বশিক্ষা মিশনের উদ্যোগে স্থায়ী র‍্যাম্প তৈরি হয়েছিল, যার বেশিরভাগই একপ্রকার ব্যবহারের অনুপযোগী, ফলে হুইলচেয়ার বহনকারী মানুষের পক্ষে সাবলীলভাবে যাতায়াত করা প্রায় অসম্ভব। আবার অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্র রাজ্য মুখ্য নির্বাচনী অধ্যক্ষের কার্যালয়ে র‍্যাম্পের ব্যবস্থা দেখা যায় না। প্রত্যেক ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা তেমনভাবে চোখে পড়ে না। দৃষ্টিহীনতার জন্য ব্রেইল ডামি ব্যালট পেপার বা ইভিমে ব্রেইল পদ্ধতির ব্যবহার থাকলেও শ্রবণ প্রতিবন্ধকতার জন্য প্রতীকী ভাষা বুঝতে সক্ষম এই রকম দোভাষীর উপস্থিতি দেখা যায় না। প্রতিবন্ধকতার জন্য যে পৃথক অ্যাপের প্রচলন হয় তা ঠিক কত শতাংশ প্রতিবন্ধকতার পক্ষে ব্যবহারযোগ্য সেই নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রথম তিন দফা নির্বাচনে প্রাপ্ত ছবির নিরিখে বলা যায় কমিশন সুগম্য ভোট প্রক্রিয়ার যে আদর্শগত ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করেছিল, বাস্তবে তা প্রচারসর্বস্ব হয়ে গেছে। ফলে বাস্তবে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি।

নির্বাচন প্রক্রিয়ার সার্বিক অন্তর্ভূক্তিকরণ নির্ভর করে কমিশনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির সক্রিয় উদ্যোগের  ওপরেও। ভারতের বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে গর্বের। এক দশক আগে পর্যন্তও বহুদলের একটি দলও প্রতিবন্ধকতাকে রাজনৈতিক আঙিনায় সরাসরি অন্তর্ভূক্তিকরণে আগ্রহ দেখায়নি। তবে রাজনৈতিক দলগুলি যে প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল, তাও বলা যাবে না। প্রতিবন্ধী মানুষদের বৃহৎ সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী’র সম্পাদক ছিলেন বাম জমানায় রাজ্যের মন্ত্রী ও শাসকদলের রাজ্য কমিটির সদস্য। ১৯৯৯ সালে সম্মিলনী’র সম্পাদকের হয়ে নির্বাচনী প্রচারে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের অংশগ্রহণ দেখা গেছে। বৃহত্তম বামপন্থী দলে প্রতিবন্ধকতাকে যুক্ত করার প্রয়াস দেখা যায় বিংশতি পার্টি কংগ্রেসে (২০১১)।

অবশ্য গত এক দশকে ডান ও বাম উভয় দল প্রতিবন্ধকতাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে (আংশিক হলেও) অন্তর্ভূক্ত করেছে। তবে দলগুলি কখনই প্রতিবন্ধকতাকে তফশিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা নারীদের মত রাজনৈতিক আসন সংরক্ষণ নিয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা যে সংসদীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট সদর্থক ভূমিকা পালনে সক্ষম তা সাধন গুপ্তে’র জীবনের প্রতি আলোকপাত করলে বোঝা যায়। ১৯৫২ সালে দক্ষিণ কলকাতা থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখালেখি করে তিনি সংসদের আলোচনায় অংশগ্রহণ এবং মতামত ব্যক্ত করতেন। আপাত প্রতিবন্ধকতাকে অবলীলাক্রমে পরাজিত করে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তাঁর সাংসদ জীবন অতিবাহিত হয়। তা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দলগুলি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগের তেমন ক্ষেত্র প্রদান করেনি।

তবে ষোড়শ সাধারণ নির্বাচন (২০১৪) থেকে দেখা যায় একাধিক সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিবন্ধকতাকে পৃথকভাবে অন্তর্ভূক্ত করেছে। সেই চেতনা বর্তমান সাধারণ নির্বাচনী (২০১৯) ইস্তেহারেও দেখা যায়। তবে দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধকতার পক্ষে সুগম্য করেছে মাত্র একটি দল। যা প্রতিবন্ধকতার রাজনৈতিক ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা। সর্বভারতীয় দলগুলি ইস্তেহারে প্রতিবন্ধকতাকে বিশেষ স্থান দান করলেও আঞ্চলিক দলগুলি বরাবরই প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে একপ্রকার উদাসীন থেকেছে। তাদের সেই চেতনার খুব একটা পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায় না।

বর্তমান সাধারণ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইস্তেহারে প্রতিবন্ধকতার স্বার্থ কীভাবে সুরক্ষিত হচ্ছে তা দেখা যেতে পারে। ডানপন্থী একটি দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে প্রতিবন্ধকতার সার্বিক সুগম্যতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। যদিও ২০১৫ সালে ৩রা ডিসেম্বর মহাসাড়ম্বরে ‘সুগম্য ভারত অভিযানে’র সূচনা হয়েছিল। তবে সেই অভিযানের সাফল্য খুব একটা সন্তোষজনক নয়। অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের সঞ্চয়ে ফিক্সড ডিপোজিটে উচ্চহারে সুদ প্রদান। বাস্তবে ভারতের ঠিক কত সংখ্যক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ সঞ্চয় করতে সক্ষম তা নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন দেখা দেয় কারণ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের মধ্যে এক শতাংশের থেকেও কম সংখ্যক মানুষ আর্থিকভাবে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছেন।

অপর একটি ডানপন্থী দলের ইস্তেহারে প্রতিবন্ধকতাজনিত বৈষম্যের অবসানে সাংবিধানিক সংস্কারের কথা গুরুত্ব পেয়েছে। সংবিধানের বর্ণিত মৌলিক অধিকারের মধ্যে ১৪-১৮ নং ধারায় যে সাম্যের অধিকারে ‘জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ’ নির্বিশেষে সমানাধিকারের কথা বলা হলেও সেখানে প্রতিবন্ধকতার উল্লেখ না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা বঞ্চনার বা অবহেলার শিকার হন। ফলে প্রতিবন্ধকতার অধিকার আন্দোলনের অন্যতম দাবী তাদের ইস্তেহারে প্রাধান্য পেয়েছে। অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হল প্রতিবন্ধকতার সহায়ক যন্ত্রপাতি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ওপর জিএসটি মকুব করা। অবশ্য স্বাধীনতার পরবর্তীকালে দীর্ঘকাল সেই দল ক্ষমতায় থাকলেও প্রতিবন্ধকতার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের উদ্যোগ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। এমনকি জাতিপুঞ্জের অধিকার বিষয় সনদকে (২০০৬) মান্যতা দিয়ে ২০১২ সালে ‘প্রতিবন্ধী মানুষ অধিকার আইনের খসড়া’ প্রস্তুত হলেও, তা আইন রূপে বাস্তবায়িত করতে আন্তরিক ছিলেন না বলে অনেকে সমালোচনা করে।

ডানপন্থী তুলনায় বামপন্থীরা প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে কিছুটা আন্তরিক বলে অনেকে মনে করেন। ভারতের বৃহত্তম বামপন্থী দলের ইস্তেহারে প্রতিবন্ধকতার সহায়ক যন্ত্রপাতি ও সহায়ক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে জিএসটি মকুব হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৬ সালের প্রতিবন্ধী মানুষ আইনে’র সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং জাতীয়স্তরে প্রতিবন্ধকতা সম্বন্ধীয় নীতি সংশোধনের বিষয় সেই দলের ইস্তেহারে গুরুত্ব পেয়েছে। বৃহৎ সংখ্যক প্রতিবন্ধকতার স্বার্থের দিকে নজর দিয়ে প্রতিবন্ধকতাজনিত পেনশনের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে, যাতে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা মর্যাদাপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করতে পারে। তবে অনেকেই সমালোচনার সুরে বলেন পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল শাসন করলেও রাজ্যে প্রতিবন্ধী বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে একদমই আন্তরিক ছিলেন না। ১৯৯৫ সালের প্রতিবন্ধী মানুষ আইনে শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে নুন্যতম তিন শতাংশ সংরক্ষণ ব্যবস্থা কার্যকরী করতেও প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের একাধিকবার আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল।

সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে প্রতিবন্ধকতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সরাসরি অঙ্গীভূত করতে দলগুলির অনাগ্রহের বিষয়ে কৌতূহল জাগে। তফশিলি জাতি, উপজাতি বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মত প্রতিবন্ধকতা কখনই তাদের কাছে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে ওঠে না। তবে প্রতিবন্ধকতার সংখ্যাগত উপস্থিতি যে কোন পরিস্থিতিতে নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। ২০১১ সালের আদমসুমারির প্রতিবেদনে চোখ রাখলেই বক্তব্যটি জোরালো হবে। ভারতে সাত ধরনের অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এই রকম ভোটারের সংখ্যা দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ। আবার ২০১৬ সালের প্রতিবন্ধী মানুষ অধিকার আইনে সাত থেকে সেই সংখ্যা বেড়ে একুশ প্রকার স্থায়ী অসুস্থতা প্রতিবন্ধকতা হিসাবে গণ্য হয়েছে। ফলে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ভোটারদের সংখ্যা যে অনেকাংশে বেড়ে যাবে তা অনস্বীকার্য। সেই চেতনা থেকেই একটি রাজনৈতিক দল স্পষ্টভাবে চার কোটি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে।

প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সক্রিয় রাজনৈতিক অংশগ্রহণে যুক্ত করার বিষয়ে অনাগ্রহের পেছনে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বকে অনেকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করে বলেই রাজনীতির লড়াইয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে না। তবে তাদের উপস্থিতি পাঁচশো তেতাল্লিশটি লোকসভা কেন্দ্রেই রয়েছে এবং প্রতিটি কেন্দ্রেই জয়ের জন্য তাদের ভোট নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে, তা অস্বীকার করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন কমিশন আন্তরিকভাবে যদি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়, তাহলে তথাকথিত অক্ষম বা প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষেরা আগামীতে অন্যতম নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হতে সক্ষম হবে।।