Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সত্য ঘটনা অবলম্বনে

অনিন্দ্য সুন্দর রায়

 

‘আইএমপিপিএ’– ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার্স প্রোডিওসার’স অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে একটি জমকালো তথ্য পাওয়া গিয়েছে। তথ্যটি এইরকম: গত কয়েক মাস যাবৎ সিনেমার নাম রেজিস্ট্রেশনের ধুম লেগে গিয়েছে। কী সেই নামগুলি? নামগুলি ঘুরছে—ফিরছে ‘বালাকোট’, ‘পুলওয়ামা’, ‘অভিনন্দন’-কে কেন্দ্র করে। পরের বছর ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ প্রেমের ছবির বদলে বলিউড হয়তো দেশপ্রেমের ছবিই প্রসব করবে বেশি।

‘দেশপ্রেম’ নামের জিনিসটি দেদার বিকোচ্ছে– এরকমটা বললেই অনেকে রে-রে করে তেড়ে আসবেন। দেশপ্রেম কি আলু, পটল, মায় রাজারহাটের ফ্ল্যাট? কিন্তু সাফ জানিয়ে রাখতে চাই দেশপ্রেম যে বিকোচ্ছে, এ বলতে আমার কোনও লাজলজ্জা নেই। অনেক কিছুর মতো দেশপ্রেমও প্রোডাক্ট-বিশেষ। স্বাধীনতার সময়ও স্বদেশি জামাকাপড় পরার যে চল তৈরি হয়েছিল, তা বিক্রি হত দিব্যি। সে বিক্রির মাধ্যমে বিদেশি জিনিসের প্রতি যতই ঘেন্নাপিত্তি মিশে থাকুক না কেন!

আটের দশকে যখন বাজারে প্রথম ডোমেইন-নেম বিক্রি শুরু হয়, তখন আম-আদমি রেডিও কিংবা টিভিরই ঠিকঠাক মর্মোদ্ধার করে উঠতে পারেনি। ‘ডোমেইন-নেম’ সেইসব অদৃশ্য দোকানের নাম, যা আমরা ইদানিং ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফটাফট ঘুরে আসতে পারি। জিনিসপত্র দেখে, পড়ে, কিনে, ক্লিক করে, নিজের বক্তব্য ছড়িয়ে ফিরে আসতে গেলে যে ঠিকানায় কড়া নাড়তে হয় সেটাই ‘ডোমেইন-নেম’। সেই আটের দশকেই কিছু মানুষ অফিস-ফেরতা ক্লান্ত মুখ নিয়েই অতি সাধারণ কিছু শব্দের পিছনে ‘ডট কম’-এর লেজ ঝুলতে থাকা ডোমেইন কিনে রাখেন সামান্য দামে, যা নয়ের দশক এবং শূন্য দশকে এসে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হতে শুরু করে!

এখন আপনি মনে করতেই পারেন, ‘ধুর, এরম হয় না কি!’ কিংবা ‘ওয়াও, দারুণ তো, আমিও কিনব’– তবে বলে রাখি পছন্দের শব্দ পেতে গেলে, মানে যা কিনে আপনার অন্তত ‘লাখপতি’ হওয়ার সম্ভাবনা, তা খুঁজে-পেতে আপনার ভোকাবুলারির গলায় রক্ত উঠে আসবে, ডিকশনারি কাশতে-কাশতে এসে আপনাকে বলে যাবে, ‘থাক দাদা, এবার একটু আদা দিয়ে চা খেয়ে আসি।’ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের সমস্ত শব্দ কারা যেন কিনে ফেলেছে এই ইন্টারনেটের রিয়্যাল-এস্টেটে! এমনকী, ‘পুলওয়ামা ডট কম’-ও। কিনতে চান? পাবেন এবং অবশ্যই নিলামে।

ভারতীয়দের মধ্যে একটা গদগদে সেন্টিমেন্ট আছে ‘বর্ডার’ সিনেমা নিয়ে। অথচ সিনেম্যাটিক দিক থেকে জবজবে এই সিনেমাটি তদানীন্তন সময়ে বাজারে হিট করে। করবে নাই-ই বা কেন, ভারত আড়াই কেজির হাতের, ছাপান্ন-ইঞ্চি ছাতির দেশ। ভরপুর দেশপ্রেম! তার উপর নাম, ওই ডোমেইন-নেমের মতোই কেস। আগে থাকতে ইট পেতে রাখো। জাতীয়তাবাদে হালকা সুড়সুড়ি দিলেই দেশের লোকজন কাঁটাতারের উপর উঠে নাচানাচি শুরু করবে– একথা প্রোডিউসার মাত্রেই জানেন, আর প্রোডিউসার মানেই বিজনেসম্যান।

সুতরাং, সহজ অঙ্কের সূত্রানুযায়ী ‘জাতীয়তাবাদ’ ইজ ইক্যুয়াল টু ‘ব্যবসা’। ফলত, আবারও ‘এল ও সি কারগিল’। সাম্প্রতিককালের একটি সিনেমা ভারতীয়দের তুলতুলে মন নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ হ্যাচরপ্যাচর ফেলেছিল। ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’। সিনেমা হিসাবে যেমনই হোক না কেন, হলের ভেতর বসে লোকজনের আবেগ দেখে মনে হয়েছিল কোনও মিলিটারি ট্রেনিং জোনের মধ্য ঢুকে পড়েছি। এখান থেকে বেরিয়েই সবাই একযোগে হাঁটা দেবে ভার্চুয়াল সীমান্তরেখার দিকে, যেখানে যুদ্ধের প্রপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ি থেকে বছরের পরে বছর দূরে থাকা, সদাসতর্ক, প্রাণভয় টোকা মেরে উড়িয়ে দেওয়া যুবকদের– যাদের আমরা ভালবেসে ‘জওয়ান’ বলি। সিনেমার সাইড-এফেক্টে কুপোকাত তামাম ফেসবুকবাসীর অঙ্গুলিহেলনে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন বোমা-বন্ধুক-ট্যাঙ্কার নিয়ে। আর নিউজফিড ঝুলে পড়বে সিনেমার রিভিউয়ে। সিনেমা ‘সুপারহিট’ হবে। আর সিনেমার গল্প? সেই সম্বন্ধে খানিকটা আঁচ পাওয়া যেতেই পারে ইদানিংকালের খবরে আলতো করে চোখ বোলালেই।

উইং অফিসার অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তান সেনার হাতে ধরা পরার পর থেকেই দেশময় নতুন ট্রেন্ড ‘অভিনন্দন ছাঁট’। কপি-কাট-পেস্ট। ভেবে দেখুন, সিনেমার নাম কেনা নিয়ে যারা গজল্লা করছিলেন, এখনও কি তাঁরা খেপে উঠবেন! একটা সামান্য সেলুন, দাড়ি কেটে রোজগার বড়জোর ৫০ টাকা– সেখানেও ট্রেন্ড ফলো করা হচ্ছে!

একই কাণ্ড বড় পরদাতেও। যেহেতু বড়, মালমশলাও বেশি। রগরগে উগ্র জাতীয়তাবাদ, লড়াই, নায়কের চরম স্ট্রাগল, এবং যুদ্ধ জয়ের পর তার প্রেমিকার সঙ্গে সেলিব্রেশন-মিটিং, জম্মু-কাশ্মিরের কোনও একটি আপেল উপত্যকায় কোমর জড়িয়ে প্রবল নাচন-কোঁদন। অথচ, রক্তাক্ত কাশ্মীরে সেনাবাহিনী প্রাণ হাতে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে রোজ, কাশ্মীরে রক্তাক্ত আবেগ নিয়ে দিন কাটাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

১৪ তারিখের আগে কতজন ‘পুলওয়ামা’র নাম শুনেছিল, ২০১৬-র আগে কতজনই বা শুনেছিল ‘উরি’ গ্রামটির কথা? এখন মানুষ জেনেছে, জানার ইচ্ছে বেড়েছে, আর এই জানার ইচ্ছেকে বাটনার মতো শিলে বেটে সিনেমা রান্না করার সময় ভাল করে ভেজে, কষিয়ে খাওয়ানোর কথাও ইতিমধ্যে ভেবে ফেলেছেন অনেকে। দ্য শো মাস্ট গো ওন। শোক, ক্রোধ– এইসব মানবিক আবেগ যখন জোলো হয়ে আসবে তখনই এইসব সিনেমা দেশপ্রেমের ট্যাবলেট হয়ে নেমে আসবে বাজারে। তর্ক শুরু হবে আবার, সিনেমার ডায়ালগ ঠিকরে পড়বে জ্ঞানের উপর, ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ চেগে উঠবে মানুষের একঘেয়ে রুটিন। অথচ সত্য ঘটনা কি আদৌ জানতে পারব আমরা? সাহস করে দেখাতে পারবে কি কোনও পরিচালক? তাঁকে অনুমতি দেবেন কোনও প্রযোজক? যদি ছবিটি লজ্‌ঝড়ে হয়, হারিয়ে যাবে। কিন্তু সত্যিকারের ভাল ছবি, সেটা করবেন কে? কারা? কোন পদ্ধতিতে, কোন উপায়েই বা! কেউ কি গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে পারবেন, এত লাফালাফির পরেও অভিনন্দন বর্তমানকে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ ‘র’-এর কঠিন জেরা সামলাতে হবে, তিনি ‘পাকিস্তানের দূত’ হিসাবে কাজ করছেন কি না– তা তাঁর পেট থেকে বের করে আনার জন্য। শুধু আইসবার্গের উপরের ভেসে থাকা অংশটুকু নিয়েই শান্ত থাকবে দেশবাসী, আর সুড়সুড়ি একটু একটু করে এগিয়ে যাবে চুলকানির দিকে? না কি ‘যুদ্ধ চাই-যুদ্ধ চাই’ আবহে ফ্যাসিস্ট উদ্‌গার বের করতে করতে ক্লান্ত মনুষ্যপ্রজাতি স্রেফ এন্টারটেইনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট এবং এন্টারটেইনমেন্টের আশায় খপাখপ টিকিট কাটবে, টিকিট কাটবে ‘খব্রেকাওজ’তুতো স্মৃতি খানিকটা ঝালিয়ে নিতে?

সবশেষে একটি অপ্রাসঙ্গিক কথা। ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নিয়ে যে হল্লা, বা ওই বস্তাপচা আবেগচোবানো ‘বর্ডার’– এই দু’টি ছবিই যদি তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি হত, তাহলে কি দেশপ্রেমের এহেন ডঙ্কা বাজত? সম্ভবত না।

সুতরাং, ‘দেশপ্রেম’ একশো ভাগ মহৎ, সৎ হলেও দেশপ্রেমের জন্য বানানো ছবি ‘এন্টারটেনমেন্ট’ ছাড়া আদপে কিছুই না! তবে তা যে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আগে ট্রিপল সেঞ্চুরি সহায়ক, তা তো বোঝাই গেল।