Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এ যেন আরও এক পিতৃবিয়োগ

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

Precisely because the tyranny of opinion is such as to make eccentricity a reproach, it is desirable, in order to break through that tyranny, that people should be eccentric. Eccentricity has always abounded when and where strength of character has abounded; and the .amount of eccentricity in a society has generally been proportional to the amount of genius, mental vigour, and moral courage it contained. That so few now dare to be eccentric marks the chief danger of the time.

John Stuart Mill, On Liberty, 1859

এ এক সামান্য ট্রিবিউট মাত্র। কিছুই নয়। তবু হয়ত অনেক কিছুই। কেননা ব্যক্তিগতভাবে একটা মানুষের সঙ্গে আরেকটা মানুষের যে কত স্তরে যোগাযোগ থাকতে পারে। সবটাই কথা, চেনা, দেখা হওয়ার মাপকাঠিতে নয়।  আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। তার নীচে থেকে যায় যুগ যুগ ধরে জমে ওঠা মানুষী আদানপ্রদান… যা অনির্দেশ্য, একইসঙ্গে অদৃশ্য কিন্তু গূঢ় শিকড়ের টান থাকে। থাকেই।

অদ্রীশ বর্ধন। নামটার সঙ্গে ১৯৮০ দশকে যাদের বেড়ে ওঠা তাদের সামান্য সংযোগ। আমার মা সব জানে বইটা তখন ধারাবাহিকভাবে বেরুচ্ছে। সানন্দা পত্রিকায় সম্ভবত। জ্ঞান বিজ্ঞান, জিকে যাকে আমরা চলতি ভাষায় বলি, তার এক সংকলন। কিন্তু যাদের বেড়ে ওঠা সত্তর দশকে? তাদের কাছে অদ্রীশ বর্ধন আরও অনেক বেশি। সেই সম্পর্ক লতায়পাতায় গড়ে উঠেছে। জুল ভের্নের অনুবাদ আর শার্লক হোমসের অনুবাদের সাবলীল, বাঙালিয়ানায় তুখোড়, চটুল ভাষাবন্ধনে বেড়ে উঠেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রফেসর নাটবল্টু চক্রের মত চরিত্রকে ঘিরে মৌলিক লেখার বন্ধন। তারপর, আশির দশকের গোড়াতেই আবার বইমেলার কাঁচা বইয়ের, আঠা, কাঠকুটো আর রঙের গন্ধের মধ্যে আবিষ্কার হয়েছে “ফ্যান্টাস্টিক!” নামের সেই বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি করা স্টলটি। যেখানে ব্যক্তি অদ্রীশ বর্ধনই বসে থাকেন, নিজেই বিল কেটে দেন। ছোট্ট স্টল, বিশাল এক মুখ হাসি। আলাপ করেছিলাম। তখন স্কুল ছেড়েছি, কলেজে পড়ি, সম্ভবত। আমি দিলীপ রায়চৌধুরীর মেয়ে। লজ্জা লজ্জা ভাবে বলেছিলাম। উনি যেন অবাক ও বিধুর হয়ে আমার হাত চেপে ধরেছিলেন। আহা! ইশ!… আপ্লুত হয়ে আর কিছুই বিশেষ বলেননি তিনি। যেই অদ্রীশ বর্ধন ছিলেন আমার বাবার তেমন বন্ধু যিনি লেখার জন্য বাবাকে অতিষ্ঠ করে মেরেছেন আরও বহু আগে। যখন তাঁর পত্রিকার নাম ছিল “আশ্চর্য!” আর পত্রিকার প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার পাশাপাশি বইয়ের প্রকাশনাও এগোচ্ছিল অত্যন্ত সাবলীলভাবে, কেননা আমাদের বাড়িতেই তো আছে আলফা বিটা সিরিজের সেইরকম বইগুলো। আমার বাবার লেখা অগ্নির দেবতা হেফেস্টাস-ও যার মধ্যে একটি বই।

সুতরাং এই যে আশি আর সত্তর দশকের সম্পর্ক বললাম, অদ্রীশ বর্ধনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তার চেয়ে অনেক বেশি সুড়ঙ্গলালিত। কারণ সে সম্পর্কের শুরু আমার জন্মের কয়েক বছর আগেই। পিছিয়ে যেতেই হবে, কারণ প্রদীপ জ্বলার অনেক আগে থেকেই তো সলতে পাকানো হয়ে আছে।

১৯৬৩ সালে আশ্চর্য! পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। এক প্রবল এনার্জেটিক তরুণ, প্রাইভেট কম্পানির কাজে সারাভারত এদিক ওদিক চষে, চাকরি ধরে আর ছেড়ে, ফিরে এলেন কলকাতার বুকে। তারপর শুরু হল এই নতুন, অজানা, অচেনা পথে হাঁটা।

পত্রিকার আত্মপ্রকাশের সেই অমোঘ মুহূর্তেই আকাশ সেন ছদ্মনামে আশ্চর্য! পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিজেকে তুলে আনলেন অদ্রীশ বর্ধন।

“ভূতের গল্প যেমন ভূতেদের জন্য নয়, কল্পবিজ্ঞানের গল্পও বৈজ্ঞানিকদের জন্য নয়”— এ আপ্তবাক্য তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। দাদা ডঃ অসীম বর্ধন হলেন প্রকাশক, আর অদ্রীশ লিখে চলতে লাগলেন নানা নামে, বাঁহাতে ডান হাতে। পত্রিকার পাতা ভরে উঠতে লাগল। এসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন দুজন। এক প্রেমেন্দ্র মিত্র, যিনি এই কল্পবিজ্ঞানধর্মী কাহিনির এক বিশেষ লেখক। কিন্তু তাঁর লেখার নাম তিনি দিয়েছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প। অদ্রীশই প্রথম কল্পবিজ্ঞান শব্দবন্ধের জন্ম দিলেন। প্রেমেন্দ্রের উৎসাহ অনুপ্রেরণায় অদ্রীশ এই কাজে অগ্রসর হয়েছিলেন, কথিত আছে। আর ছিলেন ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য। এই দুই লেখকের উপদেশ সম্বল করে, আর প্রধান পৃষ্ঠপোষক সত্যজিৎ রায়ের সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক-নান্দনিক চেতনায় ভর দিয়ে আশ্চর্য! এক ভিন্ন জায়গা করে নিল।

ষাটের দশকে যাঁরা তরুণ, এমন অনেক মানুষ, যাঁরা অন্যথায় সাহিত্য পাঠক, কবিতা পাঠক, তাঁদের মনে তুমুল আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল আশ্চর্য! পত্রিকা। এখনও অনেকের মুখে শুনতে পারি সেই স্মৃতিচারণ। আর আমার জন্ম একেবারে পঁয়ষট্টিতে। ষাটের মধ্যবিন্দুতে। বড় হয়ে উঠতে উঠতে বাড়িতেই দেখতে পাই সেই অনেক অনেক পুরনো সংখ্যা “আশ্চর্য!” পত্রিকার। কী যে মায়া, কী যে রহস্যময়তা সেসব পত্রিকার পাতায় পাতায়।

আর যা যা গল্পগাথা থেকে আমি রচনা করি আমার মৃত পিতৃদেব দিলীপ রায়চৌধুরীকে নিয়ে, তার অধিকাংশতেই মাখামাখি অদ্রীশ বর্ধনের গল্প!

বাবার কল্পবিজ্ঞান লেখার ঠিক শুরুটা কবে? মনে হয় ১৯৬৩তেই! অর্থাৎ হুবহু মিলে যাচ্ছে তা “আশ্চর্য!” পত্রিকার জন্মলগ্নের সঙ্গে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের এবং অবশ্যই প্রায় সমবয়সী বন্ধু অদ্রীশ বর্ধনের আগ্রহে দিলীপের এই জঁরের লেখালেখি শুরু ধরে নেব।

যদিও তার আগে পরে অন্যান্য লেখালেখি তিনি নিশ্চয় করেছেন। কিন্তু ১৯৬৩ থেকে নিয়মিত লেখেন অদ্রীশ বর্ধনের আশ্চর্য! পত্রিকায়। নিয়মিত কল্পবিজ্ঞান লেখালেখি ও স্বীকৃতির সময়টা মাত্রই দু তিনবছরের। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬র ভেতরে যে কটি কল্পবিজ্ঞান গল্প লেখেন দিলীপ, সেগুলি একটির থেকে আর একটি উত্তরোত্তর আকর্ষক হয়ে উঠেছে। দুঃখের বিষয় এর পরেই ১৯৬৬র সেপ্টেম্বরে তিনি এনসেফেলাইটিস-এ বিদায় নিলেন। ফলত, নতুন বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান পাওয়ার সুযোগ আমরা পেলাম না।

এবিষয়ে বাবার প্রধান উপদেষ্টা, যেমন অদ্রীশ বর্ধনেরও, ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রই। বাংলা সাহিত্যের সেই বহুমুখী প্রতিভা। ব্যক্তিগত সম্পর্কটা গভীর। প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন দিলীপের পিতৃদেব মানে আমার ঠাকুরদাদা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীর বাল্যবন্ধু। সাউথ সাবার্বান স্কুলের সহপাঠী। আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়িটিও তো কালীঘাটমুখী হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটেই। সেখানে, কল্পনা করে নিতেই পারি, পিতৃপ্রতিম মানুষটি আমার বাবার ছাত্রাবস্থায়, যেহেতু বাবা রসায়ন নিয়ে পড়ছেন এবং বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে অতিশয় আগ্রহী, কল্পবিজ্ঞান রচনার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তো বাবার ছিলই, তার সঙ্গে যুক্ত হল, সাহিত্য আর বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটানোর উশখুশে উত্তেজনা, প্রবলভাবে মেতে যাওয়া।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের উশকানি, বাবার আমেরিকা থেকে ফেরা এক গাদা মার্কিন এসএফ কালেকশন নিয়ে— জন কার্নেল সম্পাদিত নিউ রাইটিংস ইন এসএফ (কর্গি বুকস ১৯৬৪), ১৯৫৫র সংস্করণে অ্যালডাস হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড, বেস্ট এসএফ থ্রি, এডমান্ড ক্রিস্পিন-এর সম্পাদনায় (ফেবার)— সে বইগুলি এখনও আমার সযত্ন প্রশ্রয়ে আছে, ঝুরঝুরেপ্রায় হলদে পৃষ্ঠা সহ), এবং বাংলায় কল্পবিজ্ঞান রচনা করতে শুরু করা। এগুলো সবই একই সময়ে ঘটেছে। যে সময়ে অদ্রীশ বর্ধনের এই উদ্যোগ, এবং কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশের অ্যাডভেঞ্চার। আর এক সদ্যপ্রয়াত লেফটেনান্ট কল্পবিজ্ঞানের, সেই রণেন ঘোষ, যিনি হয়ে ওঠেন কালক্রমে অদ্রীশের ডানহাত, তাঁর মুখেও এই উত্তেজনাময়, উৎসাহপূর্ণ দিনগুলোর কথা শুনেছি… রাস্তার ধারে বসে উনুনে সেঁকা পাঁপড় আর মুড়ি খেতে খেতে রকে বসে জল্পনা হয়েছে তাঁদের কল্পবিজ্ঞান নিয়ে… কল্পনা করে নিয়েছি সেসব আড্ডায় আমার পিতৃদেবও অংশ নিচ্ছেন হয়ত বা।

আমার আশৈশবের গন্ধ শোঁকার সেই সব আশ্চর্য! পত্রিকার কপি, সেইসব উত্তেজক গল্প, বা বেতার জগৎ থেকে কাটা ছবিতে বাবা, অদ্রীশ, প্রেমেন্দ্র, সত্যজিতের ‘সবুজ মানুষ’ পাঠের জন্য আকাশবাণীর স্টুডিওতে বসে থাকা ছবি… এই সবের একটা রাসায়নিক কম্পাউন্ড হল আমার মাথার মধ্যে অদ্রীশ বর্ধনের ছবি।

আমার জগত, আমার হয়ে ওঠা, আমাদের প্রজন্মের একটা বিশেষ অংশের বড় হওয়ার পথে সাই ফাই-এর প্রভাব, আর সদ্য হয়ে উঠতে থাকা পাঠকচিত্তে, অসংখ্য মৌলিক ও অনূদিত কাহিনির রচয়িতা অদ্রীশের সোনাবাঁধানো কলমটির ছায়া, সব কেমন যেন মিলেমিশে আছে। ওতপ্রোত হয়ে আছে। আছে তাঁর ও সত্যজিৎ রায়ের উদ্যোগে ঘটানো সাই ফাই সিনে ক্লাবের দুর্ধর্ষ সব অ্যানেকডোট। আছে পাতায় পাতায় মজার কার্টুনে ভরা আশ্চর্য!-তে নানা নামের অন্তরাল থেকে অদ্রীশের সেই দারুণ রসবোধসম্পন্ন লেখাগুলো, সায়েন্স ফিকশন লাইব্রেরি, এসএফ পত্র মৈত্রী ক্লাব। সব মিলিয়ে যেন এক অ্যাডভেঞ্চারের ঝুলি।

আমি কিন্তু সেই আশি দশকের পর অদ্রীশ বর্ধনকে আর চোখে দেখিনি। যাইনি তাঁর কাছে। শেষ বেশ কিছু বছর স্মৃতিও চলে যাচ্ছিল তাঁর। বয়স ও অসুস্থতা গ্রাস করছিল তাঁকে। তবু নব নব রূপে যোগাযোগ যেন ফিরে এসেছিল। নতুন প্রজন্মের বিশ্বদীপ দে, সন্তু বাগ, দীপ ঘোষ প্রমুখ কল্পবিশ্ব পত্রিকা ওয়েবে প্রকাশ করতে শুরু করার সময়ে আমার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়, আমার পুরনো আশ্চর্য!-র কালেকশন স্ক্যান করে ডিজিটাইজ করে তারা। ওরাই বলত অদ্রীশ বর্ধনের কথা। ওরা নিয়মিত অদ্রীশ বর্ধনের কাছে যেত। অধ্যাপক ও কল্পবিজ্ঞান লেখক ও কল্পবিজ্ঞান ঐতিহাসিক অনীশ দেব, হ্যাঁ তিনিও আমার ও অদ্রীশ বর্ধনের মধ্যে ছিলেন আরেক সেতু। এই সব মিলিয়েই তো আমাদের “কল্পবিজ্ঞান পরিবার”টি! সদস্য সংখ্যা বেশি না হলেও, খুব টান আমাদের ভেতরে। অস্বীকার করার নয় তা। সব মিলিয়ে অদ্রীশ বর্ধনের প্রয়াণ আমার কাছে যেন তাই, দ্বিতীয় পিতৃবিয়োগ।

জে এস মিল অন লিবার্টি-তে বলেছিলেন, খ্যাপাটে হওয়া ভালো, যে সমাজে সবাই একেবারে মাপে কাটা, বৈশিষ্ট্যহীন, যে সমাজে এক্সেন্ট্রিক লোক নেই, সে সমাজ ভয়াবহ। আজকাল আমাদের চার পাশে তাকালে অদ্রীশ বর্ধনের মত আশ্চর্য, ফ্যান্টাস্টিক মানুষ চোখে পড়বে না। জীবনের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ধুলোয় উড়িয়ে দিয়ে একটা আইডিয়া বা আদর্শের জন্য পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছেন যিনি। এই সব মানুষ আমাদের ছোটবেলায় অনেক দেখেছি। তাই এত কাছের মনে হয়েছে তাঁকে। তাঁর কাজ শুধু একটা বইয়ের তালিকা না। তাঁদের এই কল্পবিজ্ঞান মাতলামি শুধু বিদেশি লেখার নকল বা অনুকরণ অনুপ্রেরণা না। এক প্যাশনেট অভিসার। যার ফলে তৈরি হয়েছিল গোছা গোছা সাহিত্য, নতুন সাহিত্য— যার শিকড় এ বাংলাতেই।

সেই প্রজন্মের প্রায় প্রতিজনই ছিলেন ঈষৎ অন্যরকম। ঈষৎ খ্যপাটে। একে একে যাঁরা  ইদানীং আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি চলে গেলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, গেলেন মৃণাল সেন। আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের শৈশব থেকে একটা একটা করে ইঁট, কাঠ, পাথর খসে খসে যাচ্ছে। আমরা বৃদ্ধ হচ্ছি আরও।