Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বামপন্থা-বিরহিত ভারত?

বিজয় প্রসাদ ও সুধন্ব দেশপান্ডে

 

বিজয় প্রসাদ ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক এবং মার্ক্সীয় চিন্তক। ট্রাইকন্টিনেন্টাল: ইন্সটিটিউট ফর সোশাল রিসার্চ-এর কার্যনির্বাহী প্রবন্ধক এবং লেফটওয়ার্ড বুকস প্রকাশনা সংস্থার প্রধান সম্পাদক। সুধন্ব দেশপান্ডে দিল্লির বামপন্থী নাট্যদল জন নাট্য মঞ্চের অভিনেতা ও পরিচালক। লেফটওয়ার্ড বুকস-এর অন্যতম সম্পাদক।

প্রতি রাতে প্রতি দু’জন ভারতীয়ের মধ্যে একজন পেটে খিদে নিয়ে ঘুমোতে যান। সংখ্যার নিরিখে এঁরা প্রায় সত্তর কোটি। এই পরিসংখ্যান ম্যাকিনসে-র, যদিও আমাদের দেশের দুর্দশার কথা জানতে ম্যাকিনসে-র মত কোনও কনসালট্যান্টের প্রয়োজন পড়ে না। পথেঘাটে, ক্ষেতেখামারে চোখ রাখলেই এর ছবি দেখতে পাওয়া যায়। কৃষিজীবীদের দুর্দশা (কৃষকদের আত্মহত্যার ফলে যার কথা আমরা জেনেছি) আর শহরাঞ্চলের দুর্দশা (বস্তির সংখ্যাবৃদ্ধি দেখে আমরা যা আন্দাজ করতে পারি) আমাদের অনেকের কাছেই এখন জলভাত। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রণীত নীতিগুচ্ছ প্রায় অর্ধেক ভারতীয়ের সমস্যার কোনও সমাধান করতে অপারগ। এর অবধারিত ফল হিসাবে জন্ম নেয় বঞ্চনা আর বিষণ্ণতার বোধ, আর আবেগের কাঁটা বারবার ছুঁয়ে ফেলে ক্ষোভ।

কৃষক ও শ্রমিকের, আদিবাসী ও দলিতের কণ্ঠস্বর চাপা দেওয়াটাই এখন রীতি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এই কণ্ঠস্বরকে অগ্রাহ্য করে মধ্যবিত্তের কাছে নিজেদের ধ্যানধারণা প্রচার করে থাকেন। ভাবটা এমন, যেন এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলির নিয়ামক। এ-কথা প্রমাণের জন্য খুব বেশি বেগ পেতে হয় না, যে ১৯৯১ সাল থেকে সরকারের নীতির প্রকৃত উপকারভোগী মধ্যবিত্তেরা নন। বস্তুত, এই উপকারে উপকৃতেরা ভারতের দশ শতাংশ মানুষ, যাঁদের হাতে দেশের পঁচাত্তর শতাংশ সামাজিক সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে। এ-দেশের মূলমঞ্চে বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। চিন্নাবালাইয়ার (অন্ধ্রপ্রদেশের পারিগি মণ্ডলের একজন আত্মহননকারী কৃষক), বা গয়ায় অনার কিলিং-এর বলি ষোল বছরের মেয়েটির, অথবা এঁদের মত লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত, দুঃস্থ মানুষের স্বর এই মঞ্চে অপাংক্তেয়।

 

রাস্তার মোড়ে অ্যামপ্লিফায়ার

কৃষক, শ্রমিক, নারী, দলিত, আর এঁদের মত অন্য যাঁরা, আমাদের দেশের বামপন্থীরা, আর বাম আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীরাই এঁদের কণ্ঠস্বরের অ্যামপ্লিফায়ার। সেকেলে, কালবিপর্যয়ের শিকার, বা প্রান্তিক নগণ্য শক্তি— ভারতের বামপন্থীদের বিষয় এই ধরনের কথাবার্তা একটু কান পাতলেই শোনা যায়। তবু ২০১৮ সালে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতি অবহেলার প্রতিবাদে যতটুকু জনবিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে, এই বামপন্থীরাই ছিলেন এ-সবের কেন্দ্রে। গত বছর মহারাষ্ট্রের কৃষকদের লং মার্চের ফলে শহুরে মধ্যবিত্তের কিছু অংশ এই কৃষকদের সমস্যা সম্বন্ধে কিছুটা হলেও অবহিত হয়েছেন। যার ফল এক রবিবারের সন্ধ্যায় মুম্বাইয়ের শহরতলিতে মার্চারদের সাদর গ্রহণ। কৃষকেরা যখন জানলেন যে পরের দিন পরীক্ষা আছে, তাঁরা নিজেদের লোটাকম্বল তুলে নিয়ে হাঁটলেন সারা রাত, এবং পৌঁছলেন আজাদ ময়দানে। কৃষকদের এই সংবেদন মুম্বাইয়ের হৃদয় জিতে নিয়েছিল। কথায়-কথায় ‘কৃষক’ বলা এক, আর নিখিল ভারত কিসান সভার নেতৃত্ব দিয়ে লং মার্চের মাধ্যমে তাঁদের দুর্দশার কথা সকলকে জানানো আর এক। এই কিসান সভা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র গণসংগঠন। চাষবাসের সমস্যার দুর্ভোগ একলা বহন করে চলা, আর একাই নিজের দুর্দশার ফল ভোগ করে চরম কষ্ট পেয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলা, এই একলা কষ্টভোগকে বহুর লড়াইয়ে পরিণত করতে পারাটাই, একে রাজনৈতিক চেহারা দিতে পারাটাই এই সংগঠনের সাফল্য।

গত বছর বা আরও কিছু আগের থেকে সারা দেশে পুঁজিবাদের ওঠাপড়ার ফলে ঘনিয়ে ওঠা বিপদ ও এই বিপদের মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। আশা (ASHA) আর অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বিক্ষোভ, শ্রমিক আর কৃষকদের দিল্লি অভিযান, ২০১৯-এর জানুয়ারির গোড়ায় সাধারণ ধর্মঘট— জনবিক্ষোভের কয়েকটা উদাহরণ। এই সমস্ত জনবিক্ষোভ গড়ে তোলার কেন্দ্রে ছিল বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক ও ভাগচাষীদের সংগঠনগুলো। ভয়ঙ্কর গোরক্ষক আর অনার কিলিং-এর খুনিদের বিরুদ্ধে লড়াইটাও করছে বামপন্থী আর বাম-উদারপন্থী সংগঠনগুলোই। রাজস্থানে কৃষকদের জমায়েত এই সমস্ত বিক্ষোভের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বল। মহারাষ্ট্র আর দিল্লির কৃষক মার্চ, আর এই সমস্ত বিক্ষোভ কৃষকদের দুর্দশাকে আলোচনার বিষয় করে তুলেছে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিসগড়ে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-র পরাজয়ের মাধ্যমে সূচিত রাজনৈতিক পালাবদলের পিছনেও এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এতদসত্ত্বেও ভোটের ময়দানে বামপ্রার্থীদের সাফল্য না-পাওয়া ভারতীয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ার এক দুঃখজনক প্রকাশ— যেখানে সাফল্যের প্রধান উপাদান জাতপাতের বিভাজন আর অর্থের জোর।

 

কেরলের উদাহরণ

ডিমনিটাইজেশন ও জিএসটি-র বিপর্যয়, দৈনিক লিঞ্চিং আর সাম্প্রদায়িক হানাহানির খবর, মনীষাচর্চার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অবিজ্ঞানচর্চার অত্যাচার নামিয়ে আনা, আলোচনায় জঘন্য ভাষার ব্যবহার— এত কিছু সহ্য করতে করতে দেশের ওপর বিষাদের মেঘ নেমে আসে। এদিকে কেরলে লেফট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সরকার অন্য পথে হেঁটে সামাজিক নিয়মের অনমনীয়তা ভাঙতে পদক্ষেপ নেয়। কেরল সরকার প্রতিটি সরকারি স্কুলের ছাত্রীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দেবার প্রকল্প নেয়, যাতে রজঃস্রাবের ‘সামাজিক কলঙ্ক’ থেকে তারা মুক্তি পায়। অন্যলিঙ্গদের অধিকার আলোচনায় আসে, এবং কিছু অন্যলিঙ্গের মানুষকে কোচি মেট্রোর টিকেট কালেক্টর পদে নিয়োগ করা হয়। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এবং তাঁর মন্ত্রীসভার অন্য সদস্যেরা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির সক্রিয় প্রতিরোধ করেন।

এর পরের ঘটনা বিধ্বংসী বন্যার সময়ের। কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য আকারে ছিল স্বল্প ও গতিতে শ্লথ। বিজেপির মত দল কিভাবে ট্র্যাজেডির মোকাবিলা করে, এ ছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ত্রাণ ও পুনর্বাসন, বিশেষ করে গরীব মানুষের, অনেকটা সময় নেয়। সম্প্রতি কেরলে যাবার এবং অনেকটা ঘোরাঘুরি করার সুবাদ যা দেখলাম, তাতে মনেই হল না এই রাজ্য এমন ভয়ঙ্কর বন্যার সম্মুখীন হয়েছিল। এর কৃতিত্ব প্রাপ্য কেরলের মানুষের, এবং অবশ্যই জনমুখিনতার সংস্কৃতির। রাজ্যের জেলেরা যেমন করে নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তা সত্যিই দৃষ্টান্তস্বরূপ। এবং এমন দৃষ্টান্ত কিছু কম নয়।

এর সঙ্গে ছিল রাজ্যের বামপন্থী সরকারের দৃঢ় মনোভাব আর বীরোচিত স্থৈর্য। বন্যাত্রাণের কাজ হয়েছে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে। এই মনোভাব মোদি সরকারের মনোভাবের থেকে অনেকটাই আলাদা, কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যের প্রকারে বা পরিমাণে এমন সদিচ্ছার ছাপ ছিল না। এই মনোভাব হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর একদম বিপরীত মেরুতে— যারা এই বিপুল বিপর্যয়ের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক রঙ আর জাতের বিচার করছিলেন।

 

বিয়িং হিউম্যান

ধরে নেওয়া যাক আমাদের দেশে বামপন্থা বা কোনও বামপন্থী নেই। এই অবস্থায় এমন আর কেউ কি আছেন যিনি বা যাঁরা শ্রমিক ও কৃষকের কথা, সর্বহারা মানুষের কথা বলবেন? এমন কেউ আছেন যিনি বা যাঁরা এইসব মানুষের স্বপ্নপূরণে সচেষ্ট হবেন? এমন কে আছেন যিনি শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকার-সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের আদেশ পালন করবেন, বা পথে মহিলাদের অধিকারের দাবীতে মহিলাদের দিয়ে মানবশৃঙ্খল তৈরি করবেন? কে আছেন যিনি বিভাজনের ওপরে যুক্তিকে, ব্যক্তিসম্পদের ওপরে সামাজিক সুরক্ষাকে প্রাধান্য দেবেন? বহু বছর আগে আকবর ইলাহাবাদি গেয়েছিলেন, “তোমরা মানুষ ছিলে, বহু কষ্টে মানব হয়েছ”। এই “বহু কষ্টের” জায়গাটুকুতেই বামপন্থীদের, বামপন্থার বাস। এ-ছাড়া মানবতার বাঁচা অসম্ভব।

 

মূল লেখার লিঙ্ক: https://www.thehindu.com/opinion/lead/an-india-without-the-left/article26848040.ece