Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চমকি বুখার: অগ্রাধিকার পাক অপুষ্টির বিনাশ

শচীন কুমার জৈন

 

এদেশে শিশুরা সংখ্যা বই কিছু নয় আর। উন্নয়নের আলোচনায় আমরা কেবল শিশুমৃত্যুর হার, নবজাতকের মৃত্যুর হার, অপুষ্টির হার, শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন অপরাধের পরিসংখ্যান আর মৃত শিশুদের সংখ্যা গণনা করে চলেছি। গত এক মাস ধরে মুজফফরপুরের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটে চলতে দেখছি। এই অঞ্চলে অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিন্ড্রোম (এইএস)-এর ফলে প্রায় দু’শোর মত শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ভাববার কথা এই, যে ১৯৯৫ সালে এই অঞ্চলে এইএসের প্রথম ঘটনা স্পষ্টভাবে সামনে এলেও এই ২৫ বছরে এই রোগের মূলগত কারণ চিহ্নিতকরণ করা এখনও সম্ভব হয়নি। মোদ্দা কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক জোট বাঁধাবাঁধি নিয়ে সক্রিয় বিহারে গত পাঁচ বছরে ১০০০-এর অধিক শিশুর জান নেওয়া এই রোগের কারণ-বিষয়ক গবেষণা, অবেক্ষণ বা চিকিৎসার জন্য কোনও অত্যাধুনিক ভাইরোলজিকাল ল্যাবরেটরি তৈরি করে ওঠা সম্ভব হয়নি। শিশুদের অপুষ্টির মাত্রাতিরিক্ত হারকে লুকিয়ে রাখা, আর সংসদ থেকে শুরু করে বিধানসভাগুলোতে জোর লাগিয়ে প্রমাণ করা, যে আমাদের দেশে অপুষ্টি শিশুমৃত্যুর কোনও কারণই নয়— উন্নয়ন বা বিকাশের কাহিনি প্রচার করবার ক্ষেত্রে এ হল এক আবশ্যিক উপাদান। বিহারে লিচুকে এইএসের, আর এইসেসকে শিশুমৃত্যুর কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। অপুষ্টি আর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দুরবস্থাই যে শিশুমৃত্যুর মূল কারণ, শাসনব্যবস্থা এ-কথা স্বীকার করে নিতে অরাজি।

এনসেফেলাইটিস একধরনের বায়োকেমিকাল অসুখ। মুজফফরপুরের ঘটনার তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণে জানা যাচ্ছে যে লিচুই মৃত্যুর মুখ্য কারণ। লিচুর মধ্যে থাকা মেথিলিন সাইক্লোপ্রোপিল গ্লাইসিন লিচু খাবার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুধাপীড়িত অপুষ্ট শিশুদের শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা এতটাই কমিয়ে দিচ্ছে, যে তার ফলে জীবনসঙ্কট ঘটছে। এই অঞ্চলের দরিদ্র বঞ্চিত মানুষেরা জুন মাসে বাগানে বাগানে লিচু তোলার কাজ করে থাকেন। লিচু সংগ্রহ কেন্দ্রে পৌঁছে ফসল জমা করবার তাড়ায় এঁরা ভোর চারটেয় বাগানে পৌঁছে যান। লিচু তুলে জড়ো করবার কাজে জুটে যায় পরিবারের সকলেই। ভোরে ওঠার তাড়ায় এঁরা শুয়ে পড়েন তাড়াতাড়ি, অনেক সময় পেটে কিছু না দিয়েই। পরেরদিন ভোরবেলা লিচু তোলার সময় ওখান থেকেই কিছু খেয়ে নেন। এইভাবেই চলে দিনের পর দিন।

বিহারে প্রতি বছরেই এই অসুখ, সঙ্গে অন্যান্য অসুখবিসুখ মিলে, অনেক শিশুর প্রাণ নেয়। ভেলোরের সুপ্রতিষ্ঠিত ক্রিশ্চান মেডিকাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক টি জেকব জন ও তাঁর সহকারী ডক্টর অরুণ শাহ প্রায় দু’বছর এই নিয়ে কাজ করে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। ওঁদের বক্তব্য, এই চমকি-বুখার বা এনসেফেলাইটিস নিজে কোনও রোগই নয়, বরং অনেক রোগের সমূহ। এনসেফ্যালোপ্যাথি— যা মূলত মস্তিষ্কের রোগ— হিসাবে এই রোগকে দেখা হচ্ছে। স্মৃতিহ্রাস, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, ডিমেনশিয়া, দীর্ঘ অচেতনতা, শারীরিক গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের অসাফল্য, এমন কী মৃত্যু— এ-জাতীয় নানান অসুবিধা এনসেফ্যালোপ্যাথির কারণে দেখা যেতে পারে। এই নিয়ে হওয়া কাজকর্ম থেকে কিছু সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা ভারত ছাড়া ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। উত্তর ভিয়েতনামে এ-বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে জানা যায়, এই ধরনের রোগের ঘটনা কেবলমাত্র মে থেকে জুলাই মাস, অর্থাৎ লিচু তোলার সময়টুকুতেই পঞ্জীকরণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে এই রোগের প্রকোপে পড়া জেলাগুলিতেও (বিহারের মুজফফরপুর, পূর্ব চম্পারন, সমস্তিপুর, বৈশালী আর ভাগলপুর) মে-জুন মাসেই এই কাজ করা হয়ে থাকে।

ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল আর অ্যামেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনও এই রোগের কারণ অনুসন্ধানের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। এই কাজ শুরু করবার আগে ধারণা করা হয়েছিল, লিচু উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিক, সার অথবা ব্যাকটিরিয়ার কারণেই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এই তত্ত্ব অনুসারেই প্রতিরোধের পরিকল্পনা তৈরি করবার কথা ভাবা হচ্ছিল। গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেল, কারণ ভিন্ন। দেখা গেল, এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের রক্ত শর্করা বা ব্লাড গ্লুকোজের স্তর ৭০ মিলিগ্রাম বা তারও কম। অপুষ্টি, সঙ্গে রাতের অনাহার ছিল রক্ত শর্করা কম হবার কারণ।

ডক্টর টি জেকব জনের বক্তব্য, লিচুতে মেথিলিন সাইক্লোপ্রোপিল গ্লাইসিন (এমসিপিজি) নামের উপাদান থাকে। এর আরেক নাম হাইপোগ্লাসিন-এ। যেসব শিশু অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিন্ড্রোমের শিকার, তাদের অধিকাংশেরই বয়স পাঁচ বছরের কম, এবং তারা প্রায় সকলেই সবথেকে দরিদ্র শ্রেণির। এইসব শিশুরা রাতে খালি পেটে শুয়ে পড়ে, লিচু খায় এবং পরদিন সকালে এইএসের শিকার হিসাবে এদের পাওয়া যায়। এদের মধ্যে অসুখের কোনও লক্ষণ সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় না। রাতে অভুক্ত অবস্থায় শুয়ে পরদিন সকালে লিচু (পুরো পাকার আগের অবস্থায়) খেলে এই রোগের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়। লিচুর এমসিপিজির কারণে অপুষ্ট শিশুর শরীরে রক্ত শর্করার স্তর নেমে যায়, এবং শিশুটি হাইপোগ্লাইসিমিয়া এনসেফ্যালোপ্যাথির শিকার হয়। এমসিপিজি লিভারের গ্লাইকোজেন থেকে গ্লুকোজ সংগ্রহ করতে শরীরকে বাধা দেয়। এর ফলে শরীরের কর্মক্ষমতা কমে আসতে থাকে। অপুষ্ট শিশুদের ক্ষেত্রে গ্লাইকোজেনের পরিমাণ এমনিতেই অনেক কম থাকে। এ অবস্থায় এদের ওপর এমসিপিজি-র প্রভাব অনেক গভীর ও ব্যাপ্ত হয়।

জার্নাল অফ এভিডেন্স বেসড মেডিসিন অ্যান্ড হেলথকেয়ার পত্রিকায় ২০১৮ সালে প্রকাশিত সুধীর, সঞ্জীব কুমার এবং মাধব শরণ প্রসাদ-লিখিত নিবন্ধের (https://jebmh.com/assets/data_pdf/1_Sudhir%20-%20FINAL.pdf) থেকে জানতে পারছি, এইএসের শিকার শিশুদের বয়স এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। এই নিবন্ধের জন্য গবেষণায় ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে ৯২টি অসুস্থ শিশুর তথ্য নেওয়া হয়। এদের মধ্যে প্রত্যেকেই, শতকরা একশো ভাগ, অপুষ্টির শিকার। শতকরা আটানব্বই ভাগ শিশু মজুর অথবা অনিয়মিত কৃষিকর্মের সঙ্গে জড়িত এমন পরিবারের সদস্য।

এইএসের কারণে মৃত্যুর মূলে যে অপুষ্টি, এই সত্যটা এতদিনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় (২০১৫-১৬, চক্র ৪) দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে বিহার দেশের অপুষ্টির রাজধানী। এ-ও সত্য, অপুষ্টির প্রতিরোধ বা পুষ্টি সুরক্ষিত করবার মত নীতি এখানে অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। বিহারে ৪৮.৩ শতাংশ শিশু রুদ্ধ বিকাশের শিকার, এবং সাত শতাংশ শিশু গভীর অপুষ্টির বলি। বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্যবিষয়ক পত্রিকা দ্য ল্যান্সেটকৃত খবর অনুযায়ী— পাঁচ-অনূর্ধ্ব শিশুমৃত্যুর ঘটনার ১৯ শতাংশ ঘটে স্বাভাবিকের থেকে ওজন কম হবার কারণে, ১৪.৫ শতাংশ খর্বতা বা রুদ্ধবিকাশের কারণে আর ১৪.৬ শতাংশ অপুষ্টির কারণে।

দ্য ল্যান্সেট-অনুযায়ী অত্যন্ত কম ওজনের শিশুদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৫.৫ গুণ থেকে ১৬.৫ গুণ বেশি হয়ে থাকে। এই সম্ভাবনা নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে ৩.৯ থেকে ১০.৪ গুণ, ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে ২ থেকে ২.৭ গুণ, আর হামের ক্ষেত্রে ৪.৬ থেকে ৯.১ গুণ হয়ে থাকে। এই কারণেই ভারতে শিশুমৃত্যুর সবথেকে বড় কারণ হিসাবে অপুষ্টিকে মানা হয়। বিহারেও এইএসের বলি তাই অপুষ্ট শিশুরাই।

এ কথা উল্লেখ করা জরুরি, যে আমাদের দেশে সরকার বা সমাজ জন্মের প্রথম শুভক্ষণ থেকেই অভুক্ত থাকার পাঠ দিতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নতির দাবী করতে থাকা আমাদের দেশে ৪১.৬ শতাংশ শিশু জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ পায়। বিহারে ৩৪.৯ শতাংশ শিশু জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ পায়। ভাবতে পীড়া হয়— বিহারে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের মাত্র ৭.৫ শতাংশের পর্যাপ্ত আহার মেলে। ভারতে ৯.৬ শতাংশ, মধ্যপ্রদেশে ৬.৬ শতাংশ, উত্তরপ্রদেশে মাত্র ৫.৩ শতাংশ শিশু পর্যাপ্ত আহার পায়। জন্মের থেকে দু’বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ শিশু অনাহারে পালিত হয়। এমতাবস্থায় লিচুর মত উপকারী ফলসেবনের অর্থও মৃত্যু।

আজকের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর সমস্ত অপুষ্ট শিশুদের এক তৃতীয়াংশ ভারতে বাস করে। আর, শিশুমৃত্যুর হার বেশি, এমন দেশগুলির মধ্যে ভারতও সামিল রয়েছে। তবুও শিশুদের পুষ্টি আর স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করতে হলে আগে শত শত মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা হয়। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে কিছুদিন হইচই চলে, তারপর যথারীতি শান্তিকল্যাণ। অদরকারি রাজনৈতিক বিষয়গুলো সব সময় শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের বিষয়গুলোকে পিছনে ফেলে সামনে চলে আসে। ভারতের কোনও রাজনৈতিক দলই বিগত নির্বাচনের ঘোষণাপত্রে এই বিষয়গুলোকে স্থান দেবার কথা ভেবেও দেখেননি। যুদ্ধ, বিভাজন আর হিংসা— এই নিয়েই ঘটে গেল আমাদের সাধারণ নির্বাচন। শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ব্যাপার ভুলে থেকে রাজনৈতিক দলগুলো পার পেয়ে গেলে সমাজই বা কেন অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিন্ড্রোম নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে? সরকারের কাছে এই সমস্যা সমাধানের দাবী জানাতে যাবে?

সরকারের তরফে এখন কোন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? শুরু হয়েছে ১০০ বিছানার হাসপাতাল আর আধুনিক ল্যাবরেটরি তৈরির প্রক্রিয়া। রোগের প্রতিরোধে এই ব্যবস্থা কতটা কাজে লাগবে? কেউ জানে না! আমাদের দেশের শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি এতটাই প্রবল, যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুই একমাত্র ভবিতব্য। এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন পুষ্টি সুরক্ষিত করা, সাফ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রভূত উন্নতিসাধন করা এবং শিশুদের উন্নতির লক্ষ্যে সার্বিক কার্যপ্রণালীর অন্তর্গত পুষ্টি বিবর্ধন কার্যক্রমের প্রসার ঘটানো সবথেকে জরুরি, ২০০ শিশুর মৃত্যু হয়ে যাবার পরেও যার ছিটেফোঁটা কোথাও চোখে পড়ছে না। অপুষ্টির অবসানের নামে বরং বিজ্ঞাপন অভিযান চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেশে এখনও পুষ্টি বিবর্ধনের লক্ষ্যে এমন কোনও নীতি নেই, যা অপুষ্টির মূলগত কারণগুলো— যেমন রোজগার, লিঙ্গবৈষম্য, স্বাস্থ্যের অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ইত্যাদি— এগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনানুগ ব্যবস্থা নিতে শাসককে বাধ্য করতে পারে। অপুষ্টিকে যদি অগ্রাধিকার দেওয়া না হয়, তবে এই শাসনব্যবস্থা সত্যিই এই সমস্যার সমাধান চায় কী না— এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।