Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কাফিরনামা… ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়…’

রাণা আলম

 

২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫। দাদরির কাছে বিশারা গ্রাম। সেখানে মহম্মদ আখলাকের বাড়িতে গোমাংস রাখার অভিযোগে চড়াও হল স্থানীয় গ্রামবাসীরা। মহম্মদ আখলাক এবং তার ছেলে দানিশকে প্রচণ্ড মারধোর করা হয়। ঘটনাস্থলেই মহম্মদ আখলাকের মৃত্যু হয়। একজন অভিযুক্ত বিচার চলাকালীন মারা গেছেন আর বাকিরা জামিনে আপাতত মুক্ত। ২০১৭ সালে রাজস্থানের সড়কে পেহলু খানকে পিটিয়ে মারা হয় এবং তার খুনের ভিডিও ছড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে জোরালো পুলিশ কেস করা হয়নি।

নিউজ১৮-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১২ সালের পর থেকে গোরক্ষাজনিত অজুহাতে খুন হয়েছেন ৮৮ জন এবং এদের মধ্যে ৮৬ জনই খুন হয়েছেন বিজেপি শাসনকালে। এবং মব লিঞ্চিং সংক্রান্ত একটি তথ্য, এই ‘লিঞ্চিং’ কথাটা এসেছে ভার্জিনিয়ার এক কর্নেল চার্লস লিঞ্চ এর নাম থেকে। উক্ত ব্যক্তি প্রায়ই নিজের বাড়ির সামনে অবাধ্য ব্যক্তিদের শাস্তি দিতেন প্রকাশ্যে। ১৯২১ সাল অব্দি পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকাতে মব লিঞ্চিং-এর শিকারদের মধ্যে সিংহভাগই হলেন কালো মানুষেরা। এবং কালো মানুষদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যেই মূলত এই রকম লিঞ্চিং-এর আয়োজন করা হত। মানুষ কখন একটি ভিড়ের অংশ হয়ে হিংসাত্মক কাজে জড়িয়ে পড়ে তার একাধিক সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যা আছে। ১৮৯৬ সালে গুস্তাভ লে বন তার বই, ‘দ্য ক্রাউড— আ স্টাডি অফ দ্য পপুলার মাইন্ড’-এ দেখান যে ভিড়ের মধ্যে মানুষ তার ভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থান থেকে বেরিয়ে সংগঠিতভাবে ভাবনাচিন্তা করে এবং কাজে অংশগ্রহণ করে। ত্রিপাঠী (২০১৬)-র মতে ‘কালেক্টিভ ভায়োলেন্স’ আদতে আমাদের সামাজিক পরিচয় নির্মাণের বাই প্রোডাক্ট যেখানে একটি ব্যক্তি তার ব্যক্তিপরিচয় হারিয়ে ভিড়ের সংগঠিত পরিচয়ের অংশ হয়ে দাঁড়ায় এবং অন্ধভাবে সেই ভিড়ের অনুসারী হওয়াটা আসলে ‘কালেক্টিভ আইডেন্টিটি’র প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। আবার স্পিভাক যে ব্যক্তির সামাজিক পরিচয় নির্মাণে ‘আদার’-এর কথা বলছেন তা আদতে এই কালেক্টিভ ভায়োলেন্সের স্বরূপ বুঝতে সাহায্য করে। আলপোর্ট (১৯২৪) এর মতে ব্যক্তি কোনও ভিড়ের অংশ হলে তার ব্যক্তিপরিচয় হারায় না, বরং ব্যক্তিঘৃণা সমষ্টির আকার ধারণ করে। এই প্রসঙ্গে অর্চিতা কাশ্যপ ২০১৮-তে ফার্স্টপোস্টে লিখেছিলেন যে মব ভায়োলেন্সের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক বিপন্নতা এবং দারিদ্র্যের যোগাযোগ খুব স্পষ্ট। কোনও জায়গায় অসংগঠিত ভিড় বা ‘মব’ কিরকম আচরণ করবে তার উপর গোটা তিনেক থিওরি দিয়েছেন ডক্টর উইন্ডি জেমস তার ‘দ্য সাইকোলজি অফ মব মেন্টালিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স’ নামের প্রবন্ধে। এর মধ্যে প্রথমটি হল ‘Contagion Theory’। যেখানে বলা হচ্ছে যে অসংগঠিত ভিড় তার সদস্যদের উপর একধরনের সম্মোহন বিস্তার করে যার ফলে তারা আবেগের বশবর্তী হয়ে অযৌক্তিক কাজে লিপ্ত হয়। দ্বিতীয়টি হল ‘Convergence Theory’। যার বক্তব্য হল যে ভিড়ের নিজস্ব কোনও চরিত্র থাকে না, বরং যারা অসংগঠিত ভিড়ের অংশ হয় তারা নিজেরা একই ধরনের আক্রমণাত্মক মানসিকতা পোষণ করে, যে কারণে তাদের হিংসাত্মক আচরণ ভিড়ের আচরণকে ‘কনস্ট্রাক্ট’ করে থাকে। তৃতীয় থিওরিটি হল ‘Emergent-Norm Theory’। যেটি আদতে আগের দুটি থিওরিকে একসঙ্গে বিবৃত করছে এবং যার মতে অসংগঠিত হিংসাত্মক ভিড় আসলে একইরকম আক্রমণাত্মক স্বভাবের অধিকারী একদল মানুষের সমষ্টি যারা ভিড়ের মধ্যে একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

১৭ই জুন, ২০১৯, ঝাড়খন্ডে চোর সন্দেহে ধরা পড়েন তাবরেজ আনসারি নামে এক যুবক। তার আসল নাম জানার পর তাকে উন্মত্ত জনতা ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করে। এবং বলেও শেষরক্ষা হয়নি। গণপিটুনিতে তার মৃত্যু ঘটে। তাবরেজ আনসারি খুন হওয়ার দুদিন পরে কলকাতা শহরে হাফিজ মহম্মদ শাহরুখ হালদার নামের এক তরুণ মাদ্রাসা শিক্ষককে ট্রেনের মধ্যে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে জোর করা হয়। তিনি সেটা না করাতে তাকে পার্ক সার্কাস স্টেশনে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। এই ঘটনাতেও এখন অব্দি কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেছিলেন লাগামছাড়া উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে। ২০১৯ সালে তিনি আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে পা রেখেছেন। উন্নয়নের দাবীগুলি আপাতত পিছনের সারিতে। তার অ্যাজেন্ডায় ঠাঁই পেয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। আর এই মেরুকরণের ধারাপাতেই খুন হচ্ছেন মহম্মদ আখলাক, পেহলু খান, আফরাজুলেরা। ধর্মীয় বিদ্বেষের দোহাই দিয়ে জাস্টিফাই করতে আসরে নামছেন রাজনীতিবিদরা। আসিফার ধর্ষক ও খুনিদের সমর্থনে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন জম্মু কাশ্মিরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। ভারতবর্ষকে গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাওয়ার স্বপ্ন এইমুহূর্তে ভীষণ বিপন্নতার মুখোমুখি। সুতীব্র মেরুকরণের বিষ আমাদের পরিচিতিকে ছিন্ন করছে ধর্মীয় বেড়াজালের পরতে। অবশ্য, এই মেরুকরণে আমাদের প্রতিবেশী দুই দেশ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেরও অল্পবিস্তর দায় থেকে যাচ্ছে। এই দুটি ইসলামিক দেশেই সেখানকার সংখ্যালঘুদের অবস্থা সঙ্গীন। আমাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা বিদ্বেষে সুড়সুড়ি দিতে হিন্দুত্ববাদীরা এই প্রতিবেশী দেশদুটিতে সংখ্যালঘুদের উদাহরণ তুলে ধরেন।

চোর সন্দেহে ধৃত তাবরেজ আনসারিকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলিয়ে পিটিয়ে খুন করা এবং হাফিজ মহম্মদ শাহরুখ হালদার ‘জয় শ্রীরাম’ না বলতে চাওয়ায় তাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। এবং নিছক মব ভায়োলেন্স দিয়ে এই প্রবণতাকে সম্পূর্ণ ব্যখ্যা করা যাবে না। মব ভায়োলেন্স আপাতভাবে অসংগঠিত হয়। কিন্তু বর্তমান ভারতবর্ষে ঘটে যাওয়া মব ভায়োলেন্সের ঘটনাগুলি চরিত্রগতভাবে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। স্বাধীন সংবাদ সংস্থা দ্য ক্যুইন্ট রিপোর্ট করছে যে ২০১৫ থেকে আমাদের দেশে ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে মব লিঞ্চিং-এ। এদের মধ্যে অধিকাংশই দলিত এবং সংখ্যালঘু। এবং এই অধিকাংশ মব লিঞ্চিং-এর কারণ হচ্ছে গোরক্ষা। এটা নিছক সমাপতন হতে পারে না। খুব পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো ঘৃণার ধারাপাতে সংখ্যালঘুদের আবশ্যিক শত্রু হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিক ভাষ্যে আর সোশাল মিডিয়ায় নিরন্তর ‘ফ্যাব্রিকেটেড’ প্রচারে। বরং এই গোরক্ষাজনিত অজুহাতের পিছনে আছে সংখ্যাগুরুর সযত্নলালিত ধর্মীয় ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। তাবরেজ আনসারিকে দিয়ে জয় শ্রীরাম বলানোর যে উল্লাস তার মধ্যে দিয়েই উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির চেহারাটা প্রকট হয় যেখানে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর উপর আধিপত্য দেখাতে উদগ্রীব। মেজরিটির সোশাল আইডেন্টিটি কনস্ট্রাকশনের ক্ষেত্রে ডমিন্যান্স বা আধিপত্য একটি জরুরি ফ্যাক্টর। এই আধিপত্য সোশিও-কালচারাল স্টেটমেন্ট তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। যে কারণে ওপার বাংলায় দুর্গাপূজা নিছক হিন্দুদের উৎসব এবং এপার বাংলায় ঈদ মুসলমানের পরব হয়ে থেকে যায়। সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়া বৃদ্ধ সংখ্যালঘু ভিখারি দম্পতিকে গালাগাল দিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানোটা সেই আধিপত্যবাদ প্রকাশেরই অংশ। হিটলারের জার্মানিতে ইহুদিদের সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হয়ে থাকতে হত। উগ্র ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের সামনে এদেশের সংখ্যালঘুদের সেই দিন দেখতে হবে কিনা সেই আশঙ্কা থাকছে পুরোমাত্রায়।

আমাদের বহুত্ববাদের দেশে বর্তমান শাসকেরা একটি মেজরিটি-বেসড ন্যারেটিভ নির্মাণ করতে চান যেখানে সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা অনিচ্ছা অনুযায়ীই যে সংখ্যালঘুকে চলতে হবে সেটা সমঝে দেওয়াটা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায়। ভালো সংখ্যালঘু বা দ্য গুড মাইনরিটি তিনিই যিনি সংখ্যাগুরুর বেঁধে দেওয়া টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন মেনে চলেন। এবং এদেশে থাকতে হলে যে আমাদের হুকুম মেনে চলতে হবে সেটা বোঝানোর উদ্দেশ্যেই হয়ত গোরক্ষার গিমিকে খুনগুলিকে উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মোড়কে জাস্টিফাই করা হচ্ছে।

মুশকিল হচ্ছে এই ঘটনাগুলো আমাদের দেশে দেখতে অভ্যস্ত নই, আমরা জেনে এসেছি এগুলো পাকিস্তানে হয় যেখানে কুখ্যাত ‘ব্লাসফেমি’ আইনের ফাঁকে ধর্মদ্রোহের দায়ে সংখ্যালঘুদের উন্মত্ত সংখ্যাগুরু অনায়াসে পিটিয়ে মারতে পারে বা বাংলাদেশে হয় যেখানে স্রেফ ভয় দেখিয়ে সংখ্যালঘুর ঘরবাড়ি দখল করা যেতে পারে। সেখানে প্রশাসন খুব বাধ্য না হলে চোখ বন্ধ করে থাকতেই ভালোবাসে। এখানকার হিন্দুত্ববাদীরা তাদের বিরোধীদের ক্রমাগত পাকিস্তান পাঠাবার হুমকি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে বোধহয় এই দেশটাকেই ‘হিন্দু পাকিস্তান’ বানাতে চান। খালি আগুন যে ধর্ম বেছে পোড়ায় না এই সত্যটা ভুলে যান।

গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ ক্রমশ উগ্র হিন্দুত্ববাদের দিকে পা বাড়াচ্ছে। আমরা দেখেও দেখছি না অথবা উটের মতন বালিতে মুখ গুঁজে রেখে ভাবছি প্রলয় হয়ত পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে। একদিন আচমকা ঘুম থেকে উঠে নিজের ঘর উঠোন বিদ্বেষের ঘরবসতি না হতে দেখা অব্দি হয়ত আমাদের ঘুম ভাঙবে না।

তথ্যসংক্রান্ত কৃতজ্ঞতা: দ্য ক্যুইন্ট, স্ক্রল, দ্য ওয়্যার, দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নিউজ১৮, দ্য হিন্দু, মিতাক্ষরা মেধি এবং জাস্টিন টেলর
হেডার ছবি: রূপক দে চৌধুরী, রয়টার্স
ইনসাইড ছবি: https://www.newsclick.in/mob-lynching-who-spread-poison