Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অসঙ্গতির সঙ্গত — ৪র্থ পর্ব

হিন্দোল ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

অসঙ্গতির সঙ্গত বিষয়ে লিখতে লিখতে বা লেখার কথা ভাবতে ভাবতে নিজের মধ্যেই কত যে অসঙ্গতি টের পাই বলার না। আমি নিজে তো অসঙ্গতিতে পূর্ণ। মাঝেমাঝে মনে হয় আমার কোনওকিছু নিয়েই লেখার খুব একটা অধিকার নেই। একটা চরম অসঙ্গতির জায়গা তো হল মৃত্যুভয়। একটা কথা আমার মনেই হয়, কারও মৃত্যু হলে, বা কেউ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে, এমন সময় নিজের মধ্যে যে প্রবল বিষাদ এবং অসহায়তা তৈরি হয়, তার সিংহভাগ জুড়ে থাকে মৃত্যুর প্রতি একধরনের আতঙ্ক। এই আতঙ্কে আমি বহুদিন ধরেই ভুগছি। মানসিক অসুখ বলা যায় একে। এখন তো আরও অনেক বেশি চেপে ধরেছে আমায় এই আতঙ্ক। বন্ধুবান্ধবকে যখন পড়ে থাকতে দেখছি কোমায়, যখন কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন চিরকালের মতো, তখন নিজের মধ্যেই একধরনের অসহায়তার জন্ম হচ্ছে। ‘আমার দুঃস্বপ্নপগুলি তুমি শোনো তথাগত, ভয়ে আমি ঘুমোতে পারি না’— সেই জয়দা লিখেছিলেন কবে! তবে কি আমাদের জীবনের অধিকাংশ লেখাই আসলে দুঃস্বপ্ন? এ কথা অনস্বীকার্য, যে আমি আমার সারাজীবন কাটিয়ে দিলাম স্বপ্ন দেখে দেখে। কখনও সচেতনভাবে আবার কখনও সচেতন না থেকেই। বাস্তব বিষয়ে প্রশ্ন আসেই সে কারণে, যে জীবনটা বাস্তবে যাপন করছি, তার কতটা অস্তিত্ব আছে, আর যে জীবনটা স্বপ্নে যাপন করছি, তারই বা কতটা। বাস্তবের প্রেক্ষিত থেকে দেখলে স্বপ্নের জীবনের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। কিন্তু আমার যাপনটা তো তাই বলে মিথ্যে হয়ে যায় না। অনেকে বলতেই পারেন, একজন বোকা মূর্খ লোক যদি তার স্বপ্নে যাপন করেন, তবে কার তাতে কী!

কারও কিছু নয়, কিন্তু ভাবি অন্যরকমভাবে। এই যে জীবনটা যাপন করছি, সিংহভাগ স্বপ্নে এবং কিছুটা বাস্তবে, এভাবেই সারাজীবন বাঁচতে বাঁচতে একটা সময় একজন মানুষ মৃত্যুর দিকে চলে যায়। কিন্তু মৃত্যু কি আরও একটা বড় মাপের স্বপ্নের মধ্যে চলে যাওয়া? এখানে এসে থমকে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না, কারণ মৃত্যু যে কী, সে সম্পর্কে কেউই তেমন কিছু বলতে পারে না। অনেকটা এভাবেও বলা যায় যে মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের অসমাপ্ত ধারণাগুলির জন্যই, সমস্ত দর্শনের সূত্রপাত। তবে মৃত্যুই কি আমাদের বড় একটা জীবনবোধের দিকে নিয়ে যায়? এইখানে একটা বড় মাপের দার্শনিক অসঙ্গতির প্রশ্ন চলে আসেই। মৃত্যু যদি একটা বড় মাপের জীবনবোধ হয়, তবে জীবন থেকে যা জীবনকেই সরিয়ে দিচ্ছে, তা-ই বড় মাপের জীবনবোধে জড়িয়ে রেখেছে আমাদের। কিন্তু সেই জীবনবোধ আমাদের এমন এক শূন্যতার কাছে নিয়ে যায়, এমন এক নীরবতার কাছে নিয়ে যায়, যার তেমনভাবে বেঁচে থাকার উদযাপন নেই। কারণ সমস্ত ধর্মের  সূত্রে তো রয়েছে মৃত্যু সম্পর্কে এবং জীবন সম্পর্কে মানুষের এক চূড়ান্ত কৌতূহল। মানুষের সমস্যা বা মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অসঙ্গতির জায়গাটি হল বৃহত্তর কোনও প্রশ্নের সমাধান-ই সে করে উঠতে পারে না। কারণ যত সে সমাধানের দিকে যায়, তত সে বুঝতে পারে এ সব প্রশ্নের কোনও সমাধান নেই, আবার এ সব প্রশ্ন করে যাওয়া ছাড়া তার জীবনের আর কোনও উদ্দেশ্যই  নেই। সেই যেমন যুধিষ্ঠির বককে প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন— মানুষ জানে সে মারা যাবে, কিন্তু সে আশা রাখে সে কোনওদিন মরবে না। ঠিক তেমন। বা, অনেকটা তেমন। কিন্তু আমরা কজন এই অমীমাংসিত প্রশ্নের দিকে লক্ষ্য রেখে জীবনকে চালনা করে যেতে চাই? আমাদের জীবন মন সেই প্রশ্নের দিকে কখন সামগ্রিকভাবে ধাবিত হয়? যখন আমাদের কাছে নীরবতার এক গভীর জিজ্ঞাসাচিহ্ন আসে। তার আগে আমাদের অস্তিত্ব থাকে অস্থির, ঝড়ে অসহিষ্ণু এক পাতার মতো। কিন্তু তার পরে থাকে মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভিতরে ভিতরে অস্থির এবং অশান্ত এক গাছের মতো। যে অশান্তি বাইরে থেকে দেখা যায় না, যে চাঞ্চল্য অসহিষ্ণুতা নয়, বরং নিয়ে আসে এক পরম সহিষ্ণুতা।

তবে কি কোথাও সঙ্গতি বলে কিছু নেই? সর্বত্রই কি রয়েছে তীব্র অসঙ্গতি? মানুষ ধর্মের সৃষ্টি করেছিল একটা সময় সামাজিক কারণে। কিন্তু সেই ধর্মের মধ্যে বৃহত্তর যে সমস্ত জিজ্ঞাসা আছে, সেগুলি সব-ই অশান্তই করে। কথা হল, সেখানে ঈশ্বরের যে বোধ উঠে আসে, তার সঙ্গে আমাদের ধর্মের অনুষঙ্গে রচিত ঈশ্বরের কোনও সম্পর্ক নেই। যদি এই মহাপ্রকৃতিকেই আমার ঈশ্বর হিসেবে আমরা উপাসনা করি, তবে এই মহাপ্রকৃতিকে ধ্বংস করার কোনও বাসনা আমাদের মধ্যে আসতে পারে কি? এখানে আসে মানুষের আরও বড় অসঙ্গতি। জানলায়, ফ্ল্যাটের বারান্দায় গাছের ডাল পাতা ঢুকে আসছে বলে আমরা গোটা একটা গাছ কেটে ফেলি। আমরা থাকতে পারি না এই মহাপ্রকৃতির সঙ্গে। অথচ আমাদের তৈরি করা এই বাসস্থানের, ঘরের পৃথিবীতে প্রকৃত প্রস্তাবে কী থাকে? সাময়িক আরাম। সাময়িক ভুলে থাকা। সাময়িক নিরাপত্তা। কিন্তু জীবনের বৃহত্তর জিজ্ঞাসার কাছে এসে দাঁড়ালেই আর এসব বিষয়ের কোনও অর্থ থাকে না। ওদিকে আমাজন পুড়ছে, এদিকে দলমার জঙ্গলেও আগুন ধরে গেছে। আমরা জঙ্গল সাফ করছি, গাছ কেটে ফেলছি। আর ভাবছি এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে। তা হয়ত হবে। কিন্তু মানুষ নিজেকে এভাবে প্রকৃতির ধ্বংসকারী করে তুললে প্রকৃতি কি তাকে আপনা থেকেই একদিন আলাদা করে দেবে না? মানুষ নিজেকে কি প্রকৃতির চেয়ে বড় বলে মনে করে? এই অহঙ্কার মানুষের কেন? সত্যি কথা বলতে গেলে, মাঝেমাঝে মনে হয়, আমরা পৃথিবীকে যে কাব্য, সাহিত্য, বিজ্ঞান দিচ্ছি, তাতে পৃথিবীর কিছু এসে যায় না। প্রকৃতি সে সব শুনে হয়ত মৃদু মৃদু হাসছেন। কারণ আমরা আদৌ কিছু আবিষ্কার করছি না। খুঁজে পাচ্ছি, যা প্রকৃতির কাছে চরম শূন্যতার আগের শূন্যতার সময়হীনতার সময় থেকেই রয়েছে। আমরা কিছুই করছি না। করতে পারি না। কিন্তু আমরা নিজেদের ভাবছি অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই, যখন-ই আমরা ভিন গ্রহের প্রাণীদের কথা ভাবি, তখন-ই আমরা কল্পনা করি কদর্য দেখতে, প্রযুক্তিগতভাবে অতি বুদ্ধিমান এবং হিংস্র কিছু প্রাণীকে, যাদের লক্ষ্যই হল কোনও অজ্ঞাত কারণে মানুষের ক্ষতি করা। গান শিল্প কবিতা এসব মানুষের সৃষ্টি, মানুষের মধ্যে কিছু বোকাদের সৃষ্টি, এসবের সঙ্গে সভ্যতার কোনও সম্পর্কে নেই। সভ্যতা সম্পর্কে, উন্নত জীবনধারা সম্পর্কে আমাদের অসঙ্গতির ভাবনার কথাও মাথায় রাখতে হবে। যেখানে আমেরিকা সেই সব ভিন গ্রহের প্রাণীদের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়ে নেয়। যেখানে আমরা ভেবেও দেখি না, যদি আমাদের চেয়ে উন্নত কোনও গ্রহে উন্নত কোনও সভ্যতা থাকে, তবে সেখানে প্রাণীদের মধ্যে কবিতা, শিল্প, সঙ্গীতের চর্চাও আমাদের চেয়ে উন্নত মানের হতেই পারে। এই যে আমরাই ভেবে যাচ্ছি ভিন গ্রহের প্রাণীরা আসছে আর পৃথিবী ধ্বংসের মুখে, তা হয়ত ঐসব উন্নত প্রাণীরা করবেই না। হয়ত আমাদের চেয়ে অতি বুদ্ধিমান বলেই সেখানে আর হিংসা নেই। আমাদের চেয়ে অতি বুদ্ধিমান বলেই হয়ত তারা আমাদের মতো সাম্রাজ্যবাদী নয়। তারা অলস, তারা জ্ঞানচর্চা করছে, তারা জীবন সম্পর্কে আরও অনেক বেশি বোধ সম্পন্ন। আর তাই হয়ত তারা কোনওদিন-ই আসছে না। বা, হয়ত তারা এসেছিল কোনও একদিন। কিন্তু আমাদের নিজেদের মতো বেড়ে ওঠার অধিকার দিয়ে চলে গেছে নিজেদের গ্রহে। কিন্তু আমেরিকা তা মানবে না বলেই তাদের নিয়ে কোটি কোটি ছবি তৈরি হবে যার আসল কথা পৃথিবী বিপন্ন এবং তাকে বাঁচানোর একমাত্র ক্ষমতা আমেরিকার।

হায় সভ্যতা! যে পৃথিবীতে মানুষ আত্মহত্যা করার মতো লক্ষ লক্ষ জঙ্গল পুড়িয়ে দেয়, সে পৃথিবীতে ভিন গ্রহের প্রাণীরা এসে কী আর ক্ষতি করতে পারে? মানুষের চেয়ে বড় মানুষের শত্রু, প্রকৃতির শত্রু আর কে আছে?

 

(চলবে)