Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আর্থিক মন্দার গভীরে

সত্যব্রত ঘোষ

 

 

দিন এনে দিন খাওয়া মানুষরা তো বটেই, অধিকাংশ সাধারণ মধ্যবিত্ত ভারতীয় নাগরিক অনুভব করছেন তাদের হিসেবি জীবনে এখন অল্পবিস্তর ছন্দপতন চলছে ও চলবে। দৈনন্দিন বাজারসামগ্রীর আগুনে দাম তাদের চোকাতেই হবে, আবার মাসান্তে নিশ্চিত রোজগারটুকুও অনিয়মিত হওয়ার সম্ভাবনা এখন প্রবল। অন্যদিকে, শিক্ষিত যুবসমাজও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, পরীক্ষার দামী মার্কশিট আর সার্টিফিকেটের ভারের মতো বেকারত্বের যন্ত্রণাকেও তাদের বহন করে যেতে হবে। কারণ, আমাদের দেশে দৈন্যদশা আপাতত প্রকট। এই আর্থিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রককে সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। ‘অচ্ছে দিন’ আনবার জন্য দীর্ঘকাল ধরে শোনা বিভিন্ন পদক্ষেপের সোচ্চার ঘোষণাগুলি সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে সদর্থক শোনালেও ভারতের কৃষকদের দুর্দশা দেখে, কার্যক্ষেত্রে সেগুলি আদৌ কতটা উপকারী, তা নিয়ে সন্দেহ আমাদের ছিল। পাশাপাশি, এই অনুসন্ধিৎসাও জন্মেছে যে ‘অচ্ছে দিন’-এর জোরদার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও মোদি সরকার ছয় বছর শাসন করেও কেন এমন দুর্দিন আসতে দিল।

দিন দশেক ধরে রিপাবলিক টিভির মতো নিউজ চ্যানেলের হোতারা চিৎকার করে প্রায়ই বলে চলেছেন যে, বিরোধীরা গেল গেল রব তুলে দেশবাসীকে আতঙ্কগ্রস্ত করবার পরিকল্পিত চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু এহেন দেশপ্রেমীরাও পরবর্তী বাক্যগুলিতে স্বীকার করছেন যে শাসক দল যতই গোলাপি ছবি (বাজেটে উল্লেখিত পাঁচ ট্রিলিয়ন টাকায় পাঁচের শেষে ১২খানা শূন্য আছে!) আঁকুক না কেন, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যাঁয়’। সম্প্রতি পি চিদাম্বরম এবং ডি শিবকুমারের গ্রেপ্তার এবং হাজতবাসের মধ্যে দিয়ে শাসকপক্ষ প্রমাণ করতে উৎসুক ২০১৪ সালের আগে ইউপিএ সরকারের বিভিন্ন নেতা অঢেল দুর্নীতি ঘটিয়ে দেশের বর্তমান আর্থিক সঙ্কট ডেকে এনেছেন। এই যুক্তির সারবত্তা যে নেই তা বলছি না। তাই তা অগ্রাহ্য না করে বর্তমান আর্থিক মন্দার যুক্তি তর্ক আর গল্পে আরেকবার ফিরে যাওয়া যাক একটু তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।

একথা অস্বীকার করা যাবে না যে মোদি ২.০-র শুরুর মাসগুলির সঙ্গে ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় শাসনকালের শেষের সময়টির অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। ২০১২-১৩ সালে মনমোহন সিং-এর প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষ মাসগুলিতে দেশে শাসনব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণের ক্ষমতাটির পক্ষাঘাত ঘটে, যাকে পলিসি প্যারালিসিস হিসেবে তখন চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেই আর্থিক অচলাবস্থা কাটাবার জন্য তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রমুখ শিল্পপতিদের প্রাণপণ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও জনসমক্ষে নানাবিধ ঘোষণার মাধ্যমে দেশবাসীকে বোঝাতে চাইছেন আর্থিক দুরবস্থা কাটানোর জন্য যথাসম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এর জন্য তিনি ব্যবসায়ী মহলে যারা সম্পদ অর্জন করছেন, তাদের পিঠ চাপড়াতে একেবারেই দ্বিধান্বিত নন। এই পিঠ চাপড়ানির মাধ্যমে তিনি যে বার্তাটি পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন যে দেশের আর্থিক নীতি নির্ধারণে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার শুধু আমলাদের উপরই নয়, সফল ব্যবসায়ীদের সদর্থক চিন্তার উপর নির্ভর করছেন। মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্ষেত্রেও দেখা গেছিল এই আমলা-নির্ভর ব্যবস্থা বলবান।

ব্যবসায়ী মহল এবং শাসক দলের মধ্যে যে ফাঁকটি জন্মায় ইউপিএ সরকারের সায়াহ্নে যখন কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া গান্ধি এবং তাঁর কিচেন ক্যাবিনেট সহ ন্যাশনাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল (NAC)-ই বাজারের নীতি নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করত। ছয়-সাত বছর আগে দেশের আর্থিক প্রগতির ক্ষেত্রে NAC যে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়, তেমনিই এক নেতিবাচক ভুমিকায় এখন অবতীর্ণ হয়েছে আরএসএস-এর শাখা সংস্থা ‘স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ’ (SJM)।

সংস্থাগত এই চাপগুলির কারণে বর্তমান আর্থিক মন্দা – এমনটা বললে ভুল হবে না। ইউপিএ সরকারের ক্ষেত্রে যে পলিসি প্যারালিসিস পতনের অন্যতম কারণ হয়েছিল, বর্তমানে SJM তার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। অবশ্য ফারাকও আছে। মোদি সরকারের কাছে নিজেকে শুধরে নেওয়ার জন্য আগামী চার বছর সময় আছে, যা মনমোহন সিং-এর ছিল না। তাছাড়া, মোদি যেভাবে বাড়ির কর্তা হয়ে দেশ ও দশের ভালো নিয়ে মনের কথা বলতে পারেন, মনমোহন সিং-এর ক্ষেত্রে সনিয়া গান্ধির নজর এড়িয়ে তেমন কিছু করা সম্ভব ছিল না।

তবুও মোদি যেমন তাঁর প্রিয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুদূর বিদেশে লগ্নি এবং বেকারদের কর্মসংস্থানের উপায় খুঁজতে পায়ের নীচে সর্ষে ফুল ফুটিয়েছেন, মনমোহন সিং-ও ২০০৪ থেকে তেমনই বিদেশভ্রমণে ব্যস্ত ছিলেন, বিশেষ করে ২০০৯ সালে – যখন ইউপিএ জোট থেকে সিপিআই(এম) বার হয়ে যায়। তাঁরা বার হবার পরেও বাম-মনস্ক NAC কিন্তু শাসনক্ষমতার কলকব্জা নড়িয়ে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সম্ভাবনাগুলি দুর্বল করে গেছে। মোদির ক্ষেত্রে আগের বন্ধুরা আশাহত হয়েছে, কারণ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসবার প্রথম পর্বে প্রিয় ব্যবসায়ী মহলকে দেওয়া মস্ত মস্ত প্রতিশ্রুতিগুলি তিনি পালন না করে হাউসিং, টয়লেট, বিদ্যুৎ, গাস সরবরাহ, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি জনমনোরঞ্জনী কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তবে মনমোহন সিং-এর আমলে সকলের খাদ্য ও শিক্ষার অধিকার জাতীয় জনকল্যাণের প্রয়াসগুলির তুলনায় মোদি নিজের সরকারের সাফল্যকে আন্তর্জাতিক বাজারে অনেকটা ভালোভাবে বেচতে পেরেছেন।

কিন্ত আর্থিক মন্দার ক্ষেত্রে আমরা যা লক্ষ করছি যে দেশের অর্থনীতি এবং প্রশাসনব্যবস্থা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটির প্রসার ঘটানোর প্রতি একেবারেই অনুকূল নয়। নির্বাচনে জেতার লক্ষ্যে মোদি যতই জাতীয়তাবাদী দাবি ওঠান না কেন, কার্যক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও ঘটেনি। আবার অন্য দিক থেকে দেখলে বলতে হয়, মনমোহন সিং যেমন দুর্নীতি এবং পলিসি প্যারালিসিস-এর সাঁড়াশি চাপে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ভুলতে বসেছিলেন, তেমনই জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে মোদি এখন অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে দেশ ও দশের নজর সরাতে বেশি উৎসাহী।

কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার এই মানসিকতার ফলাফল যে অনভিপ্রেত হতে পারে, তা তো আমরা দেখছি। যেমন দেখা যাচ্ছে কাশ্মিরে ৩৭০ ধারাকে লুপ্ত করার জন্য একটি রাজ্যকে প্রায় স্তব্ধ করে দেওয়া হল। এখন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবেও যদি কাশ্মিরের জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক না হয়, তাহলে মোদি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সারা ভারতের সঙ্গে কাশ্মিরকে সমন্বিত করবার লক্ষ্য যতই সাহসী হোক না কেন, প্রায় মাসাধিক কাল ধরে চলা কাশ্মিরব্যাপী কারফিউ ক্রমশ আপামর মানুষের কাছে বিপদবার্তাই প্রেরণ করছে।

একইভাবে, ২০১৬ সালে মোদি সরকার এমনই নাটকীয় উপায়ে কালো টাকা উদ্ধারের জন্য দেশের ৮৫% টাকা হাওয়ায় অদৃশ্য করে দেয়। নোটবন্দির সেই পর্বটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও কাশ্মিরের অচলাবস্থা কিন্তু আন্তর্জাতিক মাত্রায় সমালোচিত হবে যদি না পাকিস্তান নিজের অবস্থান থেকে সরে আসে। আগামী দিনে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য অপসারণের সময়ে পাকিস্তানের ভূমিকাটি ইতিবাচক না হলে মধ্য তথা পশ্চিম এশিয়া মহাদেশে সঙ্কট ঘনীভূত হবে। সেক্ষেত্রে ভারতের অর্থনীতিতেও তার অভিঘাত স্বাভাবিক।

মনমোহন সিং সমালোচিত হয়েছিলেন অর্থব্যবস্থাকে প্রায় স্তব্ধ করে দেওয়ার কারণে। কিন্তু মোদির ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ব্যর্থতার পাশাপাশি কাশ্মিরের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব রয়েছে। আচমকা বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণকে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী সংগঠন এবং নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদরা যে বিশেষ ভালো চোখে দেখছেন না, তা বলাই বাহুল্য। গতকাল রাত অবধি আমরা দেখেছি চন্দ্রযান ২ নিয়ে মোদি সরকার দ্বারা আয়োজিত উল্লাস এবং উৎসবের বহর। গভীর রাতে অবতরণের শেষ মুহূর্তে বিক্রম-এর সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনাটা শুধুমাত্র প্রাযুক্তিক আর রইল না। দেশের আর্থিক সঙ্কট এবং মেরুকরণের রাজনীতির অন্ধকার দিকটিও যেন প্রতীয়মান হয়ে মোদি সরকারের ব্যর্থতার প্রথম প্রতীক হয়েই তা পরবর্তীকালে দেখা হবে।

এখন যদি দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলিকে এড়িয়ে গিয়ে সরকার জাতীয়তাবাদের জিগির জিইয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর হয়, ৩৭০ ধারার অপসারণের পরবর্তী ধাপ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে উৎসাহী হয়ে ওঠে, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মির দখলে মনসংযোগ করে, সাধারণ ভারতীয় নাগরিক তার দৈনন্দিন সঙ্কট ভুলে সরকারের সাফল্যে নিজের ও সন্তানসন্ততির বর্তমান ও ভবিষ্যতের বলিদানকে কতটা ভালো চোখে দেখবে, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েই গেল।