Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শীর্ষেন্দুর ‘অসমাপ্ত’ উপন্যাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা

বিশ্বজিৎ রায়

 

শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘অসমাপ্ত’ নামের উপন্যাসটি নিয়ে শীর্ষেন্দুর ভক্ত পাঠকেরা সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। বিরক্তি প্রকাশ সঙ্গত। উপন্যাসটি লেখক শেষ করেননি। শেষ করেননি কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য। আখ্যানের কৌশল হিসেবে এই অসমাপ্তিকে ব্যাখ্যা করা বা সমর্থন করা আমার জ্ঞান-বুদ্ধি মতে অসম্ভব। শীর্ষেন্দু দীর্ঘ দিন ধরে লিখছেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর স্থানটি সন্দেহ নেই কথাকার হিসেবে পাকা জায়গা করে নিয়েছে। এই উপন্যাসের অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি যদি পড়ে থাকত ভবিষ্যতে তা অসমাপ্ত খসড়া পাণ্ডুলিপি হিসেবে প্রকাশ পেতেই পারত, যেটুকু লিখেছেন তার মধ্যে শীর্ষেন্দুর রচনা-রীতির ছাপও রয়েছে। 

পুজো-সংখ্যায় লেখা ছাপার ক্ষেত্রে সময়ের চাপ থাকে, ঠিক সময়ে লেখা না দিলে ছাপা মুশকিল। জয় গোস্বামীর ‘মনোরমের উপন্যাস’ লেখার সময় এমন চাপের শিকার হয়েছিলেন লেখক। যতদূর মনে পড়ছে ‘মনোরমের উপন্যাস’ প্রকাশিত হয়েছিল সাধারণ সংখ্যা দেশে, যদিও তা পুজোতে ছাপার কথাই ভাবা হয়েছিল। শীর্ষেন্দুর ‘অসমাপ্ত’র ক্ষেত্রেও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত। তাতে লেখক পাঠক উভয়েরই লাভ— লেখকও উপন্যাস পুরো শেষ করতে পারতেন, পাঠকও গোটা লেখা পড়তে পেতেন। তা যখন ঘটেনি, তখন কী আর করা যাবে। তবে কেউ বলতেই পারেন কাজটা ভালো হয়নি। এ একরকম তঞ্চকতা। উপন্যাস ও উপন্যাসবাহী পুজো-সংখ্যা দুই ‘সাংস্কৃতিক পণ্য’। পাঠক পয়সা খরচ করে কেনেন। আধখানা উপন্যাসের পুরো-দাম তাঁরা দেবেন কেন?

এই সব বাইরের কথা ছেড়ে এবার একটু ভেতরের কথায় আসি।

শীর্ষেন্দুর এই অসমাপ্ত নামের উপন্যাসটি বাংলা-সাহিত্যের একটি বিশেষ সঙ্কটের চিহ্নবাহী। শীর্ষেন্দুর উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন তাঁর কলমে একই সঙ্গে দুই বিপরীত অনায়াসে খেলা করে। বাস্তবকে কীভাবে ভাষার অবয়বে ধরতে হয় সে ম্যাজিক শীর্ষেন্দু জানেন। ছোট ছোট ডিটেল আর অনবদ্য সংলাপ তাঁর লেখাকে মধ্যবিত্ত কখনও উচ্চ-মধ্যবিত্ত জীবনের জলছবি করে তোলে। দৈনন্দিন ঘটনার মধ্য থেকে হালকা ও গভীর দার্শনিকতাকে তিনি বের করে আনতে পারেন। সেই দার্শনিকবোধ, সত্তা-জিজ্ঞাসা কখনও তীব্র কখনও পেলব নিরাসক্ত। বাস্তবের পাশাপাশি কাল্পনিকতা আর অসম্ভবকেও ধরতে পারেন তিনি। তাঁর ভূতের গল্পে, কল্পবিজ্ঞানের গল্পে সেই অসম্ভব আর কাল্পনিকতার সরস প্রয়োগ চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে তিনি এমন গঞ্জের কথা লেখেন যেখানে গোলকায়ন পূর্ববর্তী আধুনিক ভারতীয় অর্থনীতির সমস্ত চিহ্ন রয়েছে। ঠিক যেন নোয়ার নৌকা।  ভূত, পড়তি জমিদার, অপয়া, দেশজ বিজ্ঞানী, কাপালিক, বাংলা মাধ্যম স্কুল, ডানপিটে ছেলে-ছোকরা, রাশভারি অভিভাবক, বিধবা পিসি— শীর্ষেন্দুর নৌকায় সব্বাইকে খুঁজে পাওয়া যাবে। বাস্তবতা আর কাল্পনিকতাকে বিপরীত বলে মনে হলেও তিনি দক্ষ কারিগর বলে দুই বিপরীতকে একই কড়াইতে পাক করেন। যেমন পিসিমার জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা বড়ি শুকোতে দেওয়া। পিসিমার বাস্তবের ভূগোল তো সুবিস্তৃত নয়। তাই এইটুকুই তাঁর বাস্তব ও এই তাঁর বড় সমস্যা। সেই সমস্যাটিকে কাল্পনিকতার বহরে যখন হাজির করেন শীর্ষেন্দু তখন দেখা যায় পিসিমা দিব্য আকাশযানে চেপে আকাশে ছড়িয়ে বড়ি শুকোচ্ছেন, রোদের অভাব হচ্ছে না। এর পেছনে কেউ অবশ্য সর্বংসহ হিন্দু-আধ্যাত্মিকতারও অবদান খুঁজে পেতে পারেন। সেখানেও এমন সর্বগ্রাহী পরিসর আছে— কত কুঁচো দেবতা আর দেবী যে হাস্যমুখে লোকায়ত বিশ্বাসে ঢুকে পড়েন। প্রতিটি সমস্যা সমাধানের জন্য একজন দেবী— শীর্ষেন্দুর কল্পবিজ্ঞানও এমন, ছোট ছোট বাসনা পূর্ণ করার জন্য ছোট্ট ছোট্ট যন্ত্র।

‘অসমাপ্ত’ উপন্যাসে চারটি অধ্যায় লিখেছেন তিনি। এক আর তিন মনসারামের জবানি, দুই আর চার আরেকটি পরিবারের গল্প। এমন ছক শীর্ষেন্দুর গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘দূরবীন’-এ ছিল। মনে পড়ে ছেলেবেলায় আমার কোনও কোনও বন্ধু জোড় সংখ্যক পরিচ্ছেদগুলি আগে পড়ত, তারপর বিজোড় সংখ্যক পরিচ্ছেদগুলি। পড়া হয়ে গেলে দুই মনে মনে মিলিয়ে নিত। ‘দূরবীন’ দুই পরিবারের কথা নয়, দুই সময়ের কথা। একটি কাছের, অন্যটি দূরের। কাছের সময়ের ইতিকথা আর দূর সময়ের ইতিকথা মেয়েদের বিনুনির মতো জোড়ে-বিজোড়ে গাঁথা হয়েছিল। এখানেও মনসারামের জবানিতে একটি পরিবারের ছবি পাওয়া গেল— যৌথ পরিবার, শিক্ষিত ব্যবসায়ী তারা। মনসারাম মর্জিনা বলে একটি মেয়েতে মজেছে। মর্জিনা আর মর্জিনার বাবা যতটুকু পড়া গেল সুবিধের নয়। মর্জিনার বাবা কৈলাসবাবু নানা জনের কাছে ধার করেন কিন্তু শোধ করেন না। আর মর্জিনাও বাবার যোগ্য, মনসারামকে বঁড়শিতে গেঁথে জল থেকে তুলেছে।

শীর্ষেন্দু উদ্ধার করি। স্থান ডায়মন্ড হারবারের হোটেল।

‘আচ্ছা বোকা তো! ওই বিছানায় শুচ্ছ কেন? আমার সঙ্গে শোবে এসো।’
‘তোমার সঙ্গে?’
‘আমার সঙ্গেই তো সারাজীবন শুতে হবে। ট্রায়াল দিয়ে নাও। দরজাটা লক করে এসো।’
তারপর যা হয় তাই হল। নিজের লণ্ডভণ্ড সাজগোজ, রূপটান আর চুল গুছিয়ে নিল মর্জিনা। মনসার মনে হল, ‘ইজ ইট আ ট্র্যাপ?’

এরপর মনসা মর্জিনার কী হল আমরা জানি না। শীর্ষেন্দু এই উপন্যাসের গোড়ায় মনসারামের জবানিতে একটি ছবি এঁকেছেন। তাৎপর্যবাহী ছবি। ‘টিকটিকিটা আরশোলাকে প্রায় অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে। চালাক আছে। পাখনাগুলো খাচ্ছে না, শুধু বডিটা।’ এই ছবিটাই হয়তো মনসা-মর্জিনা সম্পর্কের ছবি।

অসমাপ্ত উপন্যাসের জোড় সংখ্যক পরিচ্ছেদে আছে আরেকটি যৌথ পরিবারের ছবি। পিউ বলে কমবয়সী মেয়েটি সে পরিবারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারটি আনন্দময়। পিউ তার কাকিমাকে ছোটমা বলে ডাকে, কাকুকে বুধো। ছোটমা মোটা-সোটা। তাকে জিমে যাওয়ার কথা বলে পিউ। জানি না সে শেষ অবধি জিমে যায় কি না! জানি না কারণ সেকথা লেখার আগেই অসমাপ্ত ছাপা হয়ে গেছে। বোধহয় জিমে যাবে। কারণ স্বাস্থ্যচর্চার এই ক্ষেত্রটিই জোড়-বিজোড়কে মেলাতে পারে। মনসারামের সঙ্গে মর্জিনার আলাপ জিমেই। ছোটমা জিমে গেলে দুই অংশের তাল মিলে যায়। তবে তাল যে এভাবেই মিলবে তা নাও হতে পারে। মনসারামের ঘটনা কলকাতার, আর ছোটমা মৌসুমির বাড়ি মফস্‌সলে। মফস্‌সল কলকাতা লাগোয়া কি না বলা নেই। লাগোয়া হলে জিম করতে তাকে কলকাতায় পাঠানো যেতে পারে। ছোটমা মৌসুমির বাচ্চা হবে কি হবে না ক্রাইসিস আছে। দাম্পত্যের এই যৌনতা বাদে আর কোনও বেদনা নেই তার জীবনে— এই বেদনা বড় হলে মুখ-শুকিয়ে যায়, পিউ তা দেখে।

এরপর গল্পটিকে আপনারা আপনাদের মতো প্রলম্বিত করতে পারেন— সে আপনাদের হাত যশ। তবে এই গল্পের শরীরে শীর্ষেন্দুর ছোঁয়া ভাষার মধ্যে পেলাম। সেখান থেকেই কয়েকটা সমস্যা উঠে এল।

বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তিনজনের সংলাপের হাত চমৎকার। বিমল কর আর রমাপদ চৌধুরী দুজনেই একসময় কলম তুলে রেখেছিলেন। তার একটা কারণ এই বদলে যাওয়া নতুন সময়কে তাঁরা আর চিনতে পারছিলেন না, চেনার জন্য যে শ্রম করতে হত বয়স ও শরীরের জন্যই তা পারছিলেন না তাঁরা। শীর্ষেন্দু তাঁর এই উপন্যাসে যে চরিত্রগুলিকে এনেছেন তাঁদের হাতে নতুন সময়ের নানা উপকরণ দিয়েছেন বটে তবু যেন চরিত্রগুলি অবলম্বনহীন।

উপন্যাসে তিনবন্ধুর সংলাপ।

টুলু মোবাইলে অনেকক্ষণ ধরে একটা গ্রাফিক্স ডিজাইন করছে। মুখ না-তুলেই বলে, ‘এবার একটু ধম্মেকম্মে মন দে অরুণ, একটু ধ্যানট্যান কর। ধ্যানের ঠেলায় দেখবি সিগারেট খসে গেছে।’

আবার আরেক জায়গায়,

‘অ্যাই মনা, মর্জিনার কয়েকটা ছবি আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠা তো। এক্ষুনি। আমাকে তো দেখাসইনি।’
আমি বললাম, ‘এ কি বিয়ের কনে নাকি যে, দেখাতে হবে!’
‘আরে পাঠা না বাবা, একটু জিনিসটা দেখি। অরুণ যেমন ঢলে পড়েছে তাতে মনে হচ্ছে শি ইজ হট।’
আমি বলি, ‘পাঠাচ্ছি বাবা পাঠাচ্ছি।’

পড়তে পড়তে মনে হয় মোবাইল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রাফিক্স আছে বটে তবে সংলাপ চব্বিশ বছরের এখনকার কলকাতার ছেলেদের নয়। সময়ের বাস্তবতার সঙ্গে চেষ্টা করেও শীর্ষেন্দু তাল মেলাতে পারছেন না।

বেশ কয়েক মাস আগে কলকাতা বেতারের অনুরোধে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। সঞ্জীব বলছিলেন এই সময়টাকে তিনি ঠিক চিনতে পারেন না। তাই এখন লেখার সময় একটা কৌশল করেন। অতীতের কথা লেখেন— সে সময়টাকে তিনি চেনেন। বাস্তবতা ক্ষুণ্ণ হয় না। এই সমস্যা বোধহয় কম বেশি সব লেখককেই ভোগ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে ভাষার যে চাল ‘তিনসঙ্গী’র গল্পে তার থেকে একেবারেই অন্যরকম চাল-চুলো। বদলে যাওয়া সময়ের ভাষাকে ধরতে চাইছেন প্রবৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ।

‘অসমাপ্ত’ পড়ে তাই মন খারাপ হয়ে গেল সবদিক থেকেই।

শরৎকাল এমনিতে অতীতবিধুর, স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তাই শীর্ষেন্দুর আধখানা উপন্যাস বন্ধ করে তাঁর পুরনো লেখা উল্টে-পালটে পড়তে বসি।