Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জনপ্রিয় হয়েও দলে প্রথম সারির নেতা হতে পারেননি গুরুদাস

গুরুদাস দাশগুপ্ত | রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব

প্রশান্ত ভট্টাচার্য

 

তিনি কোনওদিনই প্রথম সারির নেতা হয়ে উঠতে পারেননি। পাঁচের দশকে গণ আন্দোলনে ছাত্রনেতা হিসেবে যোগ দিয়ে ১৯৫২ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন গুরুদাস দাশগুপ্ত। ১৯৫৪ সালে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের আসানসোলের সম্মেলন থেকে রাজ্য কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। তবে বেশি দিন ছিলেন না। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন নন্দগোপাল ভট্টাচার্য। দলের প্যাঁচ-পয়জারে ওস্তাদ নন্দগোপালদের চাপে একটু যেন পিছিয়েই পড়েন গুরুদাস দাশগুপ্ত।

এরই মধ্যে চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন দেখা দিল। পার্টি বিভক্ত হওয়ার পর গুরুদাস থেকে গেলেন সাবেক পার্টিতেই।

পার্টি ভাগ হলেও ছাত্র, যুব, ট্রেড ইউনিয়ন, শিক্ষক ফ্রন্ট ইত্যাদি তখনও ভাঙেনি। তবে ভাঙনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। রাইট সিপিআই আর লেফট সিপিআই হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির দুটি অংশের পরিচয়। লেফট সিপিআই হল সিপিআই(এম)। প্রথমে গণ সংগঠনগুলো না ভাঙলেও পরবর্তীকালে সেগুলোতেও ভাঙন শুরু হল। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্তর সরাসরি হস্তক্ষেপে যুব সংগঠন ভাঙা হল। পার্টির দৈনন্দিন কাজ থেকে দূরে থাকা, দমদমের একটি স্কুলে মাস্টারি করা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর খোঁজ করলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। দীনেশ মজুমদারকে সভাপতি ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সম্পাদক করে তৈরি হল আলিমুদ্দিন স্ট্রিট পরিচালিত যুব সংগঠন, গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন, যা এখন ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন। ছাত্র আন্দোলন ছেড়ে তখন গুরুদাস সদ্য যোগ দিয়েছেন একটা স্কুলে। সেই সময় সিপিআইয়ে কিছুটা হলেও কলকে পেলেন গুরুদাস দাশগুপ্ত। আলাদা যুব সংগঠন গড়ার গরজেই সেদিন বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় গুরুদাসকে সামনে রেখে ভিন্ন যুব সংগঠন গড়ে তুললেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত নিখিল ভারত যুব ফেডারেশন রাজ্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করে গেলেন গুরুদাস। কিন্তু দলের ভিতরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে গুরুদাসের তেমন করে পদোন্নতি হল না। তাছাড়া, জরুরি অবস্থার সময় সিপিআইয়ের ইন্দিরা গান্ধির পাশে থাকাটা পছন্দ ছিল না গুরুদাসের। মানতে পারেননি সঞ্জয় গান্ধির সংবিধান বর্হিভূত ক্ষমতাও। তবুও রাজ্য নেতৃত্বে তেমন করে জায়গা হল না গুরুদাসের। বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। তাঁর কাছের ছাত্রনেতা গুরুদাসের সমবয়সি নন্দগোপাল ভট্টাচার্য বিশ্বনাথের অনুগামী হওয়ার দৌলতে দলের ভেতরে তাড়াতাড়ি গুরুত্ব পেলেন এবং নেতা হয়ে উঠলেন। সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও গুরুদাস দাশগুপ্ত সেই জায়গায় কোনওদিনই পৌঁছতে পারেননি। সাইড লাইন থেকে তিনি শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। হয়ত সেখানে খুঁজলেন রাজনৈতিক দিশা। তবে মূলত হোয়াইট কলার ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট হলেন। ব্যাঙ্ক কর্মচারী ইউনিয়ন দেখতে শুরু করলেন। এআইটিইউসি নেতা কমলাপতি রায়ের মৃত্যুর পর গুরুদাস সিপিআই পরিচালিত ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের প্রথমে রাজ্যে প্রধান হলেন পরে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হয়ে উঠলেন। ২০০১ সালে এআইটিইউসির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন গুরুদাস দাশগুপ্ত। টানা ১৭ বছর এই শীর্ষ পদে থাকার পর অব্যাহতি নেন তিনি। স্বাস্থ্যের কারণ দেখিয়ে তিনি সরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন শেষ বাঙালি যিনি সর্বভারতীয় শ্রমিক নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তবু দলের রাজ্য নেতৃত্বে বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে, কোনও স্তরেই গুরুদাস দাশগুপ্ত প্রথম সারিতে উঠে আসতে পারেননি। কমিউনিস্ট পার্টির আন্তঃপার্টি সংগ্রাম বা মতাদর্শগত সংগ্রামের নামে বরাবরের মতোই দ্বিতীয় সারির নেতা হিসাবে থেকে গেলেন। দলের সর্বোচ্চ পদ পেলেন কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-সাধারণ সম্পাদক।

ভারতের প্রাচীনতম শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি-র শততম প্রতিষ্ঠাদিবস, ৩১ অক্টোবর চলে গেলেন সংগঠনের একসময়ের সাধারণ সম্পাদক গুরুদাস দাশগুপ্ত। তাঁর রাজনৈতিক দল সিপিআই সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার সকাল ছ’টা নাগাদ কলকাতার চেতলার বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর স্ত্রী ও এক মেয়ে রয়েছেন। বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। অশীতিপর নেতার দেহ রাখা হয়েছিল পিস হাভেনে। শুক্রবার সিপিআই রাজ্য দফতরে দেহ আনা হয়। সেখানে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পর শেষকৃত্য হয় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। গুরুদাস দাশগুপ্তর প্রয়াণে শোকাহত রাজনৈতিক মহল। আমাদের ভারতীয়ত্ব হল মরলে মানুষ মহান হন। তাই তাঁর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাষ্ট্রপতি তাঁর শোকবার্তায় লেখেন, ‘সিপিআই নেতা ও শ্রমিক আন্দোলনের নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তর সংসদে বলিষ্ঠ উপস্থিতি ছিল। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা তথা গোটা দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হল।’ প্রধানমন্ত্রী ট্যুইটে লিখেছেন, ‘নিজের রাজনৈতিক ভাবধারা ও আদর্শে গুরুদাস দাশগুপ্ত নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। সংসদে ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।’ শোকবার্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘সাংসদ এবং শ্রমিক সংগঠনের নেতা হিসেবে ওঁর অবদান মনে রাখবে দেশ।’ শোকজ্ঞাপন করে ট্যুইট করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল-সহ প্রায় সব দলের রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সিপিআই(এম)-এর তরফেও শোকবার্তা জানিয়ে ট্যুইট করা হয়েছে।

গুরুদাস দাশগুপ্তের জন্ম ১৯৩৬ সালে, বাংলাদেশের বরিশালে। বাবার নাম ছিল দুর্গাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত আর মা নাম নীহার দেবী। ছোটবেলা থেকেই বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হন গুরুদাসবাবু। আশুতোষ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৫ সালে বিয়ে করেন জয়শ্রী দাসকে।

শ্রমিক আন্দোলন থেকে লাল কার্পেটে। সংসদীয় রাজনীতিতে গুরুদাস দাশগুপ্তর প্রবেশ ১৯৮৫ সালে। ওই বছরই রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হন। এর পর ২০০৪ সালে পাঁশকুড়া থেকে জিতে লোকসভার সাংসদ হন।

২০০৯ সালে ঘাটাল কেন্দ্র থেকে লোকসভার সাংসদ নির্বাচিত হন গুরুদাস দাশগুপ্ত। তবে ২০০০ সালে পাঁশকুড়া উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্রম সরকারের কাছে হেরে যান গুরুদাস। লোকসভা এবং রাজ্যসভা মিলিয়ে তিনি পাঁচ বারের সাংসদ ছিলেন। তিনি Most vocal parliamentarian-এর স্বীকৃতিও পেয়েছেন।

বলতে দ্বিধা নেই, স্পষ্টবাক, সৎ এই রাজনীতিকের জীবনাবসান আমাদের আরও দরিদ্র করল। আজকের লোলুপ, শঠ, অমানবিক রাজনৈতিক নেতাদের বিপ্রতীপে গুরুদাস ছিলেন এক ভিন্ন তলের মানুষ।

কালো টাকা ধরা নিয়ে এখন কত বুক চাপড়ানোর শব্দ পাই। বাজার গরম করা কথা শুনতে পাই। যাকে এক কথায় বলা যায় ড্রামাবাজি। অথচ গত শতাব্দীর নয়ের দশকে দেশের বৃহত্তম বিজনেস হাউসের শুল্ক ফাঁকি ধরিয়ে দিয়ে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা উদ্ধারের সন্ধান দিয়েছিলেন গুরুদাস দাশগুপ্ত। পুরস্কার স্বরূপ তার একটি শতাংশ আয়কর বিভাগ তাঁকে দেয়। যা কোটি টাকার ওপর। পুরো অর্থই তিনি দিয়ে দেন পঞ্জাবের সৎপাল ডাং প্রতিষ্ঠিত গরিব ছাত্রদের বিদ্যালয়ের উন্নয়নে। একে যদি দেশপ্রেম না বলি, তবে কি মোদি-শাহদের নাটককে দেশপ্রেম বলব!

বাইলাডিলা খনি বেচে দেওয়ার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে রুখে দেওয়া, হর্ষদ মেটার শেয়ার কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আনা, মারুতি কারখানা নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন গুরুদাসকে অনেকটাই জনপ্রিয়তা দেয়। ২জি স্পেকট্রাম মামলায় গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। এই গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-সহ দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে উত্তাল হয় সংসদ এবং গোটা দেশ। সেই মামলায় সাংসদ হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন গুরুদাস।

সজ্জন, ভদ্র মানুষ হিসেবে বাংলা সহ গোটা দেশের রাজনীতিতে এক বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন গুরুদাস। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারাও অন্য চোখে দেখতেন কমিউনিস্ট পার্টির এই শ্রমিক নেতাকে। এই জায়গায় তাঁর সঙ্গে মিল ছিল বহিষ্কৃত সিপিএম নেতা প্রয়াত সাইফুদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে। গুরুদাসের লেখা বই The securities scandal… A report to the nation হই হই ফেলে দিয়েছিল জাতীয় রাজনীতিতে। আমাদের তথাকথিত দেশপ্রেমী শিল্পপতিরা একসময় কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন যাতে সংসদে পা না পড়ে গুরুদাসের। তবু জামার ওপরের বোতাম খোলা এই দৃঢ়চেতা রাজনীতিক কিন্তু দমেননি। দলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির নেতা হিসেবেই শেষ করলেন নিজের কমিউনিস্ট জীবনচর্চা। নিভে গেল সংসদীয় বাম রাজনীতিতে একডাকে চেনার মতো কোনও বাঙালি মুখ।