Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছেলেমেয়েগুলো যেন থাকে দুধেভাতে…

মৃণাল চক্রবর্তী

 

১৯৮১ সালে আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্স পড়তে ভর্তি হই। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েদের মতোই একেবারে এম-এ পাশ করে বেরোই ১৯৮৭-তে। আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু ডিপার্টমেন্ট তুলনামূলক সাহিত্য। সেটা ছিল সেলেব ডিপার্টমেন্ট। এর মধ্যে নবনীতা দেবসেনকে দেখেছি বহুবার। ওই বয়েসে আমি শুধু তাঁর কয়েকটা কবিতা দেশ পত্রিকায় পড়েছিলাম। আর কয়েকটা গল্প। তাঁকে সব সময় হাসতে দেখতাম। সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলার সময় বা অন্যান্য অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর হাসি এবং অদ্ভুত বন্ধুতার টুকরো কানে নিয়ে হেঁটে গেছি। শ্বাসকষ্টে ভুগতেন, যতটা দরকার ততটা অক্সিজেন ঢুকত না ফুসফুসে। তাতে কী? যেভাবে দাপিয়ে বেড়াতেন কখনও মনে হয়নি শরীরের খুঁটিনাটি ছুঁতে পারত ওঁকে।

কিন্তু আমি লেখক, অধ্যাপক, চিন্তক নবনীতা দেবসেনকে নিয়ে লিখছি না। আমি লিখছি আমার এক খুব ভালো বন্ধুর মাকে নিয়ে। নবনীতাদিকে নিয়ে নয়, আমাদের মাসিমাকে নিয়ে। আমার বন্ধুর নাম অন্তরা সেন, আমাদের পিকো। বাড়ির বড় মেয়ে, আমার ব্যাচমেট, দর্শনের ছাত্রী। তবে ও যা খুশি পড়তে পারত। আমার গল্প পিকোদের বাড়ি নিয়ে, যার নাম ভালো বাসা। পারিবারিক এক মনীষাকেন্দ্র। তখন এমন দু-চারটে দেখা যেত। বন্ধুরা, আমি তখনকার সময় নিয়ে লিখছি।

পিকোর সঙ্গে ব্যাপক বন্ধুত্বের সুবাদে ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ি একবার। মায়ের ব্যবহারে খুব তফাত দেখিনি। কিছুক্ষণ কথাবার্তা সেরে আমাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে নিজের ঘরে, একতলার ঘরে, যেখানে শুধু বই আর বই, সেখানে ঢুকে গেলেন। আমরা নানান রকম চ্যাং-ব্যাং করতে করতে দোতলায় পিকোর ঘরে ঢুকে গেলাম। আমরা মানে ১৮ থেকে ২১-২২এর কয়েকটা ছেলে-মেয়ে। সেই শুরু।

ঘরেই সিগারেট খাওয়া যেত। ভিসিয়ার-এ সিনেমা দেখা যেত। চেঁচামেচিও হত। ঝগড়া। আঁতেল বাচ্চাদের মান-অভিমান। নিচে অন্য একটা পৃথিবী ছিল, সেখানে নবনীতা দেবসেন পড়তেন, লিখতেন। ওপরের হুল্লোড়ে তাঁর কিছু এসে যেত না। কখন এক সময় ফোন আসত। টুকরো-টুকরো কথা আর হাসি শোনা যেত। আবার সব চুপচাপ। ওপরে তখন হয় ব্রে খেলা হচ্ছে, বা ডামশেরাডস। অথবা ওয়েস্টার্ন সিনেমা চলছে: চার্লস জনসন, বাড স্পেন্সার, টেরেন্স হিল, ক্লার্ক ডগলাস, জন ওয়েন। একটা শেষ হচ্ছে তো আর একটা চলছে। গরমের ছুটি।

আমি যে পরিবার এবং পরিবেশ থেকে গিয়েছিলাম, সেখানে মা এক বিশেষ প্রোটোটাইপ ছিলেন। তিনি যতই অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন হোন না কেন, তাঁকে সব কাজ সেরেও মা থাকতে হত। দুর্দান্ত গান গাইলেও, অনেক বই পড়লেও, দারুণ নাচিয়ে হয়েও বিয়ের পরে নাচ ছেড়ে দিয়ে মা হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হত। সেই সব জাঙ্ক মাথায় নিয়ে আমি এক অন্য মাকে দেখলাম যিনি দায়িত্বটাকে বাড়াবাড়ির জায়গায় নিয়ে যেতেন না, ছেলেমেয়েদের জীবনে ঠিক যতটুকু বলার, তাই বলতেন। এক অপার-অসীম নিজস্ব জগতে থাকা মাকে আমি প্রথম দেখি ওই বাড়িতে। এত ভালো লাগে যে বলার নয়। আজ মনে হয় শুধু ভালো লাগার কথা ভেবেই যদি ওঁর আরও কাছে যেতে পারতাম জীবন-ছাত্রের চোখ নিয়ে, আখেরে নিজের শিক্ষা হত। পারিনি। বড্ড সম্ভ্রম ছিল, খুব অশিক্ষার কমপ্লেক্স। বাচ্চা ছিলাম, বদ্ধ আবহাওয়ায় বড় হয়েছিলাম। তখনও পালক গজায়নি, বোল ফোটেনি।

এই ছিলেন, থাকবেন, নবনীতা দেবসেন। নিজের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে পিকো নেমন্তন্ন করেছিল। সেদিন খুব হুল্লোড় হল। উনি একইরকম হুল্লোড় করে গেলেন অতিথিদের সঙ্গে বাংলায়-ইংরেজিতে। মনে হল, কোথায় বয়েস বেড়েছে ওঁর? বুড়ো হয়ে চলেছি আমরাই। ইয়েতস-এর একটা লাইন (অন্যান্য স্মরণযোগ্য অনেক লাইনের মধ্যে) ছিল মনিউমেন্টস অব আনএজিং ইন্টেলেক্ট। নিজের মৃত বন্ধুদের নিয়ে উনি লিখেছিলেন। এই পদবন্ধ কাল রাতে বার বার মনে পড়েছে।

এইসব মানুষদের স্মৃতি নিয়ে, এক জনপ্রিয় মধ্যমেধার জগতে বড় থেকে বুড়ো থেকে হাবড়া হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বড় বেদনার মত লাগে এক-একটা মৃত্যু। সাহসী মানুষ কমে আসছে। আমাদের মতো ভিতু বা ইশুকেন্দ্রিক প্রতিবাদী বা ট্রোলিং-খ্যাত মানবগোষ্ঠী ছাড়া আর কিচ্ছু পড়ে থাকছে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেলেন কদিন আগে। যৌবনে তাঁকে কত আক্রমণ করেছি আমরাই, প্রাতিষ্ঠানিকতার বাপান্ত করে রুগ্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি যেখানে সেখানে। এখন বোঝা যাচ্ছে এবারে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা অনেকটাই নিয়ে যাচ্ছেন। পরলোকে বিশ্বাস করলে খুব সুবিধে হত। যেন সেখানে এঁরা সবাই দিব্যি আছেন, স্নেহের হাসি হাসছেন আমাদের বোকামি আর অমেধা নিয়ে। কিন্তু আমরা এই স্নেহের যোগ্য নই। ওরকম কোনও দুনিয়াও নেই কোথাও।

তাই শুধু অপেক্ষা করে যাওয়া, ক্রমে দেখতে থাকা একের পর এক মনিউমেন্টস ভেঙে যাওয়ার আখ্যান। কোন কালে এক বাঙালি কবি লিখেছিলেন, পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল, আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। এগ্যে না, আমাদের কোনও এক্তিয়ারই নেই সাহেব যে প্রত্যুত্তরে লিখে যাব, পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল, আমার পিতামাতা স্বপ্নে থাক। কবি সন্ততি লিখেছেন বলে পিতামাতা লিখলাম, নাহলে বাবামা-রা লিখতাম।

কী লিখতাম তাতে কিছু এসে যায় না। হিন্দুস্থান রোডের সেই বাড়িটার একতলায় আর একটা জীবন বয়ে চলবে। যৌবনের কথা শুধু মনে করাবে না, মাঝবয়েসে আর বুড়ো বয়েসে এক আমোদগেঁড়ে সন্ততিদের খোঁচা দিয়ে বলবে, নে, আমরা তো চললাম, এবার সামলা।

একের পরে এক বন্ধু-বাবা-মা চলে যাচ্ছেন। আমরা পটাপট ছবি পোস্ট করে ট্রিবিউট দিচ্ছি সম্ভবত একটাও লেখা না পড়ে, একটাও কাজ না দেখে। এই ভয়াবহ শূন্যতায় আর একজন পথযাত্রী চলে গেলেন। আমাদের পেছনে, বহু পেছনে, রেখে।