Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সমকাজে সমবেতন: পার্শ্বশিক্ষকদের আন্দোলন ও এই সরকার

সাত্যকি দেবনাথ

 

দিন সাতেক উপোস  করে মরে যায় মানুষ আজকাল এমন বেইমান হয়েছে? হয়ত এটাই ভাবছেন বর্তমান সরকার।

বাইশ জন হাসপাতালে, রাস্তায় গড়াচ্ছে ৪৮০০০-এর ভবিষ্যৎ। রাজ্যের প্রথম শিক্ষা-শহিদ রেবতী রাউত আর ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া সন্দেশখালির তাপস বর। ১৩ দিনে পা দেওয়া পশ্চিমবঙ্গ পার্শ্বশিক্ষক সমিতির আমরণ অনশন মিলিয়ে দিয়েছে রাজ্যের নানা প্রান্তের শোষিতদের। তেরো দিন সমাজ রাজনীতির পরিসরে অনেক, মাটির মানুষদের বদলের গল্প শোনানোর জন্যে৷ গল্প যদিও একটাই— ক্ষমতাসীন শাসকের চরিত্র বদলায় না, সময় তার আসল চেহারা বের করে আনে কেবল। সেই ‘বদলা নয় বদল চাই’ শ্লোগানেরও অনেক আগের শ্লোগান ছিল ‘সমকাজে সমবেতন’, আজ যা ন্যায্য দাবি হওয়া সত্ত্বেও শহরের রাজপথে লুটোচ্ছে৷

একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাই। সাল ২০০৪। প্রথম ইউপিএ সরকারের কার্যকালের শুরুতে, ভারতবর্ষের শিক্ষার অধিকার আইন তখনও আলোচনার স্তরে। সর্বশিক্ষা অভিযান সম্পূর্ণ করার জন্যে সহায়ক হিসাবে পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ শুরু হল পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায়। মৌখিক ইন্টারভিউয়ের ভিত্তিতে স্থানীয় বেকার ছেলেমেয়েদের উচ্চপ্রাথমিকে ২০০০/- আর প্রাথমিকে ১০০০/- টাকার মাসিক ভাতার বিনিময়ে সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা। লক্ষ্য ৬-১৪ বছর বয়স পর্যন্ত পিছিয়ে পড়া শিশুদের পড়াশুনায় ফিরিয়ে আনা। ক্লাসরুম ভিত্তিক ১:৪০ অনুপাত ধরে শিক্ষক ঘাটতি মেটাতে স্কুলে স্কুলে তৈরি হল পার্শ্বশিক্ষক পদ— ব্লকে ব্লকে নির্দেশিকা গেল। সপ্তাহে ১৬টা ক্লাস, লক্ষ্য পড়াশুনার মানোন্নয়ন— বিশেষভাবে তাদের জন্যে যারা ক্রমাগত দূরে সরছে ক্লাসরুম থেকে, অভাব কেড়ে নিচ্ছে যাদের শিক্ষার মৌলিক অধিকার। পাঁচ বছর পর, ২০০৯-এ যোগ হল ড্রপ আউট চাইল্ড ট্র‍্যাকিং-এর কাজ। অর্থাৎ স্কুলছুট বাচ্চাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের স্কুলে ফেরানোর জন্যে অভিভাবকদের বোঝানো— স্কুলছুটের হার কমানো, শিক্ষার আলোতে ফিরিয়ে আনা দারিদ্র‍্যসীমার নিচে বসবাসকারী অংশকে। সাল ২০১০। রাজ্যে সপ্তম বামফ্রন্ট তখন রামধনুরঙা বিপ্লবী গণপরিষদের ঝড়ঝাপটা সামলাচ্ছে। সেই সময় পার্শ্বশিক্ষকরা আন্দোলনে নামলেন। দাবি, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির সাথে সাযুজ্য রেখে পার্শ্বশিক্ষকদের ভাতা বৃদ্ধি। অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত এবং মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে পেশ হওয়া সেই দাবি স্বীকৃতি পায় অল্পদিনেই। অবসরের নির্দিষ্ট  বয়স স্থির হল ৬০ বছর, ৩ বছর অন্তর ৫% হারে ভাতাবৃদ্ধি, আর অবসরকালীন এক লাখ টাকা বরাদ্দ হল পার্শ্বশিক্ষকদের জন্যে। এগিয়ে আসা বিধানসভা ভোটের বাধ্যবাধকতায় পূরণ করা সম্ভব হয়নি বাকি দাবি-দাওয়া। কিন্তু বিদায়ী সরকার পথ দেখিয়ে গিয়েছিল, আপসহীন অবস্থানে থাকলে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ খরচ বাড়ানো যায়। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরের গল্পটা শুধুই বঞ্চনা, শোষণ আর অপমানের— যা আজ টেনে রাস্তায় নামিয়েছে প্যারাটিচারদের৷ ২০১০-এর আন্দোলনে “বোবাকালাদের সরকার”কে সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান ছিল রাণী রাসমণি রোডের সেই জমায়েতে। ফলের রস খাইয়ে অনশন ভাঙিয়েছিলেন পার্শ্বশিক্ষকদের যারা— ২০১১ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তারা আজ নিজেরাই মুখ লুকানোর জায়গা পান না। এনসিটিই অনুমোদিত প্রোজেক্টে গত পনেরো বছরের শিক্ষাসহায়ক এঁরা, যার বেতনখাতে স্থির হয়েছিল প্রথম ৫ বছর কেন্দ্রীয় ও রাজ্য শেয়ার হবে ৯০-১০% হিসাবে। পরে সেটা নেমে আসবে ৭৫-২৫% এবং ৬০-৪০% এ। ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে পিএবি (প্রোজেক্ট অ্যাপ্রুভাল বোর্ড) রিপোর্ট অনুযায়ীই শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের অধীনস্থ শিক্ষাদপ্তর প্রাথমিকে প্রায় ১৪ কোটি এবং উচ্চপ্রাথমিকে প্রায় ২২ কোটি টাকার প্রাপ্য বেতন বরাদ্দ কেটে রেখে বাকি অংশটি কনসোলিডেটেড পে, সোজা কথায় থোক টাকা হিসাবে বেতন দিয়েছে পার্শ্বশিক্ষকদের। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে এসে বরাদ্দ বেড়েছে। বেড়েছে সরকারের কেটে নেওয়া অংশও। প্রাথমিকে ২৭ কোটি এবং উচ্চ প্রাথমিকে ৪৬ কোটি টাকা তুলেছে এখনও অব্দি রাজ্য সরকার পার্শ্বশিক্ষকদের বেতন খাতে। পার্শ্বশিক্ষকদের এই আন্দোলনের অভিমুখ তাই একেবারে নির্দিষ্ট— সমকাজে সমবেতন এবং কর্মীর মর্যাদা আদায়।

তাদের প্রদত্ত দাবি-দাওয়াগুলো—  ১) পূর্ণ শিক্ষকের মর্যাদা প্রদান, ২) ভাতার বদলে গ্রেড পে এবং ব্যান্ড পে নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট বেতনকাঠামো, ৩) ডাই ইন হারনেস অর্থাৎ মৃতের পরিবারকে চাকরি, ৪) সিপিএফ বা কমপ্লিমেন্টারি প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ইপিএফ বা এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড-এর আওতায় আসা, ৫) মহিলাদের জন্যে সিসিএল চালু এবং আরও কয়েকটি, যেগুলো একজন কর্মীর মৌলিক দাবি হতে বাধ্য। গত পাঁচ বছরে লাগাতার সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা,  মুখোমুখি কথাবার্তার সুযোগ চেয়েও এক উপেক্ষা আর খুচরো বিদ্রুপ ছাড়া কিছু পাননি প্যারাটিচাররা। গ্রামের এক একটা স্কুলে মিড ডে মিল থেকে শুরু করে দৈনন্দিন ক্লাস (এলিমেন্টারি সেকশনের মধ্যেই), ব্লক লেভেলের ইলেকশন ডাটা স্ক্রুটিনি থেকে সেনসাস মায় নির্বাচনী দায়িত্ব পর্যন্তও সামলেছেন যারা— তাদের সমকাজে সমবেতন কেবল শ্রমিকের অধিকার নয়, সময়ের দাবিও বটে৷ পার্শ্বশিক্ষকদের এই আন্দোলনকে সরকারের বা বলা ভালো শাসকদলের একটা বড় অংশ দেখাতে চায়, বিগত বামফ্রন্ট সরকারের চাপিয়ে যাওয়া দায় হিসাবে৷ এই দৃষ্টিভঙ্গি কার্যত ভিত্তিহীন এবং অপমানজনক। পার্শ্বশিক্ষকদের বেতনের ৬০% টাকা অর্থাৎ ২০,০০০ টাকা তো এই নবনির্বাচিত সরকারই প্রস্তাব দিয়ে আ্যপ্রুভাল করিয়েছেন, তখন তাদের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি কেন? আর যে সময় পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে, তখন স্কুল সার্ভিস কমিশনেও বিএড আবশ্যিক ছিল না। পার্শ্বশিক্ষকরা নিয়মিত শিক্ষকদের মত চাকুরিরত অবস্থায় ট্রেনিং সম্পূর্ণ করেছেন। নিয়োগ নীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকলে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাওয়া টাকার ৬০% এই সরকার তাহলে নিচ্ছে কোন অধিকারে? কেন্দ্রীয় সরকার ও সমগ্র শিক্ষা অভিযান নিয়ে বর্তমান রাজ্য সরকার কেন বলছেন না যে ওঁদের যোগ্যতা নেই তাই এত টাকা নেব না? কেন দশদিন পেরিয়ে গেলেও অনশনকারীদের সাথে দেখা করতে চাইছেন না শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়— ২০১০-এর রানি রাসমণি রোডের সমাবেশে যিনি বোবাকালার সরকারকে উপড়ে ফেলতে বলেছিলেন? কেন হস্তক্ষেপ করছেন না মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী— এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রশাসনিক বৈঠকে মাইক হাতে যার সক্রিয়তা পড়া ধরা দিদিমণির চেয়ে কম কিছু না। “এসব প্রশ্ন কখনও কোরো না, বোবাকালা হয়ে থাকো”— গান রাস্তা চিনিয়ে দেয়, স্লোগান মনে করায় লড়াই শেষ হয়ে যায়নি। মৃত রেবতী রাউত, মৃত্যুর সাথে লড়াই করা তাপস বর জানতে চাইছেন কেন্দ্রের দেওয়া প্যারাটিচার খাতে ৯১৩ কোটি টাকা কোথায় গেল? সরকার চুপ। যারা আমাদের সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন, আনুগত্যের নামে হকের লড়াই ছাড়তে শেখাননি, সেই শিক্ষকরা এই শহরের রাজপথে নেমে এসেছেন নিজের রুটিরুজির লড়াই লড়ছেন। জমায়েত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, “একজন শিক্ষকের নাম বলুন যাকে বামফ্রন্টের সময়ে চাকরির জন্যে অনশন করতে হয়েছে।”— উত্তর মেলেনি। একটি ছাত্রের মৃত্যু, একজন শিক্ষিকার মৃত্যু, ক্ষয় লেগেছে শিরদাঁড়াতে। এসএসসি মেরিট লিস্টে নাম থাকা প্রার্থীদের ২৮ দিনের অনশন ভাঙতে পুলিশ বৈশাখের রোদে মাথার ওপরের ত্রিপল খুলিয়েছিল। মেয়েদের বাথরুম বন্ধ করিয়েছিল। সেই ভিড়ের প্রতিবাদী মুখরা সোচ্চারে বলেছে, জেলার তৃণমূল নেতারা ১৫ লাখের প্যাকেজ রেডি করে বসে আছেন, গেলেই চাকরি। আমরা প্যাকেজ ছেড়ে রাস্তা বেছে নিয়েছি। তাঁরা ভোলেননি, লাঠি চলেছে, নিগৃহীত হয়েছেন উস্থি আন্দোলনের নেত্রী পৃথা বিশ্বাস, বিজিটিএ মুভমেন্টে লাইট নিভিয়ে রাতের অন্ধকারে ব্লাউজ ছেঁড়া হয়েছিল শিক্ষিকাদের৷ রাস্তা না ছাড়া সব পার্শ্বশিক্ষকের নাম তাই আজ অধিকার। অসীম দাশগুপ্ত মহাকরণ অলিন্দ থেকে প্রত্যেকবার বাজেট বরাদ্দের সময় বলতেন “মাননীয় শিক্ষক শিক্ষিকাগণ”। তার সমালোচনা করছেন যিনি, সেই পার্থবাবুর নেত্রী চোদ্দতলা থেকে শিক্ষকদের “ঘেউঘেউ”তে নামিয়েছেন। একশো মিটার দূরে মোচ্ছবে বাংলা। আর পথে এবিটিএ, এবিপিটিএ সহ আটটি বাম শিক্ষক সংগঠন। কারণ শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব।