Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অন্তেবাসী — নবম পর্ব

পীযূষ ভট্টাচার্য

 

অষ্টম পর্বের পর

তখন কেবলমাত্র জানতাম রক্তের রং লাল। রক্তের যে এত বিভাজন থাকতে পারে তা বুঝে উঠবার বয়সে পৌঁছাইনি। কিন্তু এখন মাঘনিশীথে অন্তরপীড়িত কোনও জন্তুর জান্তব চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলে আমি তখন ভেতরের আমি থেকে নিঃসঙ্গ হয়ে যাই। তখন আমার রক্ত নয়, শরীর প্রশ্ন ছুড়ে দেয়— পশুর বিবর্তনের মধ্যে আমার পৃথিবীতে আসা যদি হয়ে থাকে, তবে সেই পশুরক্ত কোথায়? মানুষের জন্য মানুষের রক্ত কেবলমাত্র প্রয়োজন হবে কেন?

যেন উৎসমুখ হারিয়ে গেলে সামনের দিকে চলা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না বলে প্রতিটি পদক্ষেপই হয়ে ওঠে ভীষণ অসহায়। তার ফলে অহেতুক রক্তপাতের ভেতর ডুবে গিয়ে বুঝে নিতে চাই এক পাঠক্রম। মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্তের যদি এতটাই প্রয়োজন তবে কেন অহেতুক রক্তপাত?

কেননা সেদিন ছিল বেলুদির জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত সন্ধানের দিন। যা নির্ধারিত হয়েছে এমনই এক বিরল গোত্রে তা মেজমাসির ছেলে কালুদার শরীরে সঞ্চারিত নয়। কালুদার রক্ত পরীক্ষা করে জানা গেছে সেও বাতিলের দলে।

তখনই খোঁজ শুরু হয় অপরিচিত কোনও একজনের যার রক্তের গোত্র বেলুদির রক্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কালুদার কাছ থেকে কার্শিয়াংয়ের স্টেশন মাস্টার খবরটা পেয়েই সোনাদার স্টেশন মাস্টার মেসোমশাইকে ওভার করে দেয়। তারপর দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত পাহাড়ি ট্রেনের প্রতিটি স্টেশনে একই আর্তি ‘ও নেগেটিভ’ গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু মেসোমশাই এই খবরটা কোয়ার্টারে পৌঁছতে দেননি। কেননা তার ভয় মাকে নিয়ে। খবরটা পেলেই মা যে কোন পদ্ধতিতে কার্শিয়াং পৌঁছে যাবে তা তার জানা। কিন্তু দ্বিতীয়বার আপ ট্রেন আসার আগে মেসোমশাই ডাউনের সব স্টেশন মাস্টারকে একটি মাত্র কথা ‘কোনও কি ব্যবস্থা হল?’ জানা ছাড়া অন্য কিছু না-করার মধ্য দিয়ে উদাসীনভাবে আপ ট্রেনের চলে যাবার ছাড়পত্র করে দেয়।

তারপরে কী মনে করে কোয়ার্টারে ঢুকে সটান আলমারি খুলে নিজের চাকরি সংক্রান্ত কাগজপত্রের মেডিক্যাল টেস্টের রক্তের গ্রুপটা দেখে নিয়ে নিজেকেই নিজে শুনিয়ে বলেন— না মিলছে না।

তার মাথাতে তখন একটাই চিন্তা— ও নেগেটিভ। এ কোন নেতিবাচক রক্ত খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না! মা চা খাবে কিনা জানতে চাইলে উনি অন্যমনস্কের মতন বেরিয়ে যান। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে মাকে বলেন— তৈরি হয়ে নে, তোকে একবার কার্শিয়াং যেতে হবে।

‘ট্রেন আসতে তো অনেক দেরি?’ ‘তোরা বাই কারে যাবি। মিশনারিদের এক নান যাবে, ওর রক্ত ও নেগেটিভ।’

সারাদিন মানুষটা যে কেন বাড়িতে একবারের জন্যও আসেনি, খাবারও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাবলু খাবার নিয়ে যাবার সময় বলে, ‘আজ আবার বড়সাহেবের আসবার দরকার পড়ল!’

মার কিছুতেই রামছাগলের মালকিনের নাম মনে পড়ছিল না বলে শেষ পর্যন্ত বলে ওঠে— রামছাগলের মাকে একবার পাঠানো যাবে? খুকুর দেখভাল করত— ‘সে হবে’খন’ বলে মেসোমশাই নেমে যেতেই মা তৈরি হতে শুরু করার মধ্যেই রামছাগলের মালকিন চলে এল।

ডলিদি তখনও ঘুমোচ্ছে, ওকে যদি রক্ত দিতে হয় এই ভয়ে আজ আর যায়নি। এমনকি নিখুঁত, আপাতত শেষতম পলায়ন যেন এই ঘুম, তাই ওকে বাদ দিয়েই সব কিছু ঘটছে। মা বেরিয়ে গেল কোনও কথা না বলে। মা যদি যাবার সময় কিছু বলে যেত তবে এতটা নিঃসঙ্গতায় ডুবে যেতাম না। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাবলু তার অন্তস্থলের নীরবতা নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আবছাভাবে টের পাচ্ছিলাম রক্ত পাওয়া না-পাওয়ার মধ্যে যুদ্ধ করে যাচ্ছে বেলুদির মুখটা। প্রথম দেখার দিনে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল মা— খবরদার হাসবি না। সে কথা মনে পড়ে যেতেই কেঁদে উঠলাম।

বাবলুই সেই বয়সে বুঝতে পেরেছিল— এই কান্না ক্ষণিকের। তার অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে— এবারে একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

‘বাইরে চল, ফুলমাসির গাড়ি এল কিনা দেখি’, বারান্দা থেকে দেখলাম নীচে স্টেশন, সেখানে রাস্তা, মা দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে মেসোমশাই। গাড়ি এসে থামল, মেসোমশাই দেখে নিলেন নান আছে কিনা— মাকে উঠিয়ে দিলেন গাড়িতে। ড্রাইভার কিছু একটা বলতেই গাড়ি চলতে শুরু করে দেয়।

আমরা যে দাঁড়িয়ে আছি সেদিকে একবারের জন্যও তাকায়নি মা। ‘ও নেগেটিভ’ শোনার পর থেকে বরফের মতো কঠিন এক দেওয়াল তুলে নিজেকে কেন যে আড়াল করে ফেলেছিল সেদিন তা না বোঝা সত্ত্বেও ‘ও নেগেটিভ’ যে মারাত্মক গোছের কিছু বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

অনেক পরে বড় হয়ে বুঝে যাই একেই বলে শীতবোধের স্থাপত্য।

 

গাড়ির হেডলাইট স্টেশন চত্বরকে আলোকিত করে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই আলো একবারই মাত্র কোয়ার্টারের জানালার শার্সিতে দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল। ঘরটা এক মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে আবার ফিরে গেল স্বস্থানে। বারান্দায় তখন আমরা, অর্থাৎ বোন বাদে সকলেই, এমনকি ডলিদিও। মাসি, কালুদা যে আসবে তা জানা, কিন্তু মিশনারি নান কী জিনিস জানা না থাকায় চরম বিস্ময়ে দেখি মারই সমবয়সি এক মহিলা উঠে আসছেন। প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল— ইনিই তবে ‘ও নেগেটিভ’।

কিন্তু ঘরে ঢুকেই ‘ও নেগেটিভ’ গলায় ঝোলানো যিশুর ক্রুশ চিহ্ন দিয়ে আমাদেরকে বললেন— প্রভুর দয়া বর্ষিত হোক। ওই একটামাত্র বাক্য উচ্চারণ শেষ হতে না হতেই বাড়ির সকলেই শশব্যস্ত হয়ে পড়ল উনি কোথায় বসবেন, কী খাবেন ইত্যাদি নিয়ে। ততক্ষণে অবশ্য রামছাগলের মালকিন দুটি স্টোভ জ্বালিয়ে দিয়েছে। একটাতে গরম জল, অপরটিতে চা-জলখাবারের জন্য। ডলিদি অবশ্য সঙ্গে আছে— ওকে তো রক্ত দিতে হবে না সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার পরই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে দ্রুত। ঘুমের ভিতর যদি কোনও স্বপ্ন দেখে থাকে, ডলিদি সেই ছাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্য স্টোভের বার্নারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না গরম হয়ে রং পালটিয়ে লাল হয়ে উঠছে। সেটা হয়ে যেতেই যেন নিজের খোলস থেকে নিজেকে মুক্ত করে চিৎকার করে ওঠে— জল গরম হয়ে গেছে, এবার তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে নাও।

মা অবশ্য একথা শুনেই নানকে ফিসফিসিয়ে বলে— আমাদের পোশাক তার চলবে কিনা?

উত্তরে নান হেসে ওঠেন— চলবে না বললে তুমি কি নানের পোশাক এনে দিতে পারবে? প্রভুরও এরকমই ইচ্ছা যখন তোমার একটা শাড়ি দাও…।

মাকেই প্রথমে যেতে হল হসপিটালের জামাকাপড় পালটাতে কেননা আমার বোন তখন কাঁদছে, ওর কান্না একমাত্র মাই থামাতে পারে। সেজন্য নান ধমকে ওঠে, ‘ওর ফিডিং দরকার— তাড়াতাড়ি করো।’ মা তড়িঘড়ি কাপড় পালটে বোনকে নিয়ে বসতেই কান্না থেমে যায়, কিন্তু এর মধ্যেই নান দেখতে পান মা মেরির অসীম করুণা। তাই কোনও কারণ ছাড়াই তিনি নিজের বুকের ওপর শূন্যতার মধ্যে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে নিলেন।

এই পর্যন্ত যা ঘটছে তার সঙ্গে বিশেষ পরিচয় নেই। যিশু বা মা মেরির সম্পর্কে কোনও ধারণা না-থাকার জন্য এর পরে কী ঘটবে তা জানার জন্য নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে থাকলাম। কিন্তু যখন নান মার দেওয়া শাড়িটারি পরে ঘরে এলেন, তখন এতটাই হতবাক যে নিজের অজান্তে বলে উঠি— একদম মার মতন লাগছে!

কথাটা যে বোকার মতন বলা হয়ে গেল তা বুঝতে পেরে মায়ের পেছনে লুকিয়ে থাকলাম যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি বলে উঠলেন— আমরা তো মা।

তারপর সব স্বাভাবিক। উনি আমাদেরই একজন হয়ে গেলেন। মেজমাসি চা-জলখাবার নিয়ে ঘরে ঢুকতেই নান তাকেই জিজ্ঞেস করেন— জোসেফকে খবর দেওয়া হয়েছে কিনা?

পিছনে দাঁড়ানো ডলিদির হাতে মোমবাতি দেখে আশ্বস্ত হয়ে বললেন— সব ব্যবস্থা স্টেশন মাস্টার সাব করে ফেলেছেন।

তিনি যে প্রতিদিন ঘুমোতে যাবার আগে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করেন তা দার্জিলিংয়ের স্টেশন মাস্টার জোসেফ ছাড়া অন্য কারও জানবার কথা নয়। সেই সময়ে তার একমাত্র চাওয়া—মোমবাতির শিখার মধ্যে ভেসে উঠুক তার প্রভুর মুখ। যতক্ষণ শিখা জ্বলবে অপলক চোখে খুঁজে চলবেন সেই মুখ— যেন অনির্দেশ্যের উদ্দেশ্যে সেই আহ্বান— একবার দেখা দাও…

কালুদা আর বাহাদুর স্টেশন থেকে একটা ক্যাম্প খাট ঘরের মধ্যে এনে পেতে দিয়ে জানিয়ে দেয়, সে, বাহাদুর আর ড্রাইভার স্টেশনের ঘরে ঘুমাবে। তাদের জন্য কয়েকটা রুটি বানিয়ে দিলেই চলবে, বাকিটা বাহাদুর রান্না করে নেবে।

তখনই নানের কাছে মেজমাসি জানতে চান, সে কী খাবে, রুটি না ভাত, দুটোই কিন্তু হবে।

–তবে, রুটি।

 

যতক্ষণ পর্যন্ত নানের প্রার্থনা শেষ হবে ততক্ষণ জেগে থাকবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লাম শোয়ামাত্রই। কিন্তু একটা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম। স্বপ্নে ছিল আলোছায়াময় এক প্রান্তর, সেখানে আমি কি হারিয়ে গেছিলাম না নিছক এক প্রান্তরের দৃশ্যই শুধু ছিল? সেখানে যাবার ভীতিতে ঘুম ভেঙে যায়। জেগে উঠে দেখি নান নিজের ক্রুশচিহ্নটি খুলে বাঘের আলমারিতে হেলান দিয়ে রেখে সামনে মোমবাতির উজ্জ্বল শিখার দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টে।

মা কিন্তু মৃদু স্বরে নিজেকেই শোনাচ্ছে— নারসিংহী চ বরাহী সিদ্ধিদাত্রী সুখপ্রদা। ভয়ঙ্করী মহারৌদ্রী মহাভয়বিনাশিনী।

আমি শুধু বুঝলাম মাও জেগে আছে। কেবলমাত্র মোমবাতির শিখা মৃত বাঘের মুখের ওপর তিলকের প্রতিবিম্ব হয়ে দুলছে। এই ছায়াভ্রমের মধ্যে আবার কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না!

 

এরপর আগামী সংখ্যায়