Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মৃত পাখিদের গান — ১১শ পর্ব

অবিন সেন

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ষোলো

তন্ময় সামন্তর মনটা আজ ভালো নেই। সকালেই গিন্নির সঙ্গে একচোট ফাটাফাটি হয়ে গেল। তবে এমনটা তার কাছে নতুন কিছু নয়, রোজ সকালে গিন্নির কাছে ঝাড় খাওয়াটা একটা মোটিভেটিং ব্যাপার। এর ফলে সে যেন বেশি বেশি করে কাজে মন বসাতে পারে। তবে আজকের ব্যাপারটা তার কাছে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। কিছুই না, সে পাশের ক্লাবের দুর্গাপুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নাটকে সামান্য একটা রোল পেয়েছে। অফিসের কাজকর্মের চাপে সেই নাটকের মহড়ায় রোজ থাকা হয় না, তাই আজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু নাটকের প্র্যাক্টিস করছিল। ফলে বাজারে বের হতে দেরি হয়ে গেল। আর যায় কোথায়, গিন্নি পুরো ভিসুভিয়াসের মতো ফেটে পড়ল। কিছুক্ষণ তোড়ে অগ্নিবর্ষণ করে গিন্নি যখন থামল ততক্ষণে সামন্ত জামাকাপড় পরে ব্যাগ হাতে অফিস বেরিয়ে পড়েছে। না আজ সে বাজারও করবে না, বাড়িতে খাবেও না। অফিসটাকে আজ তার ভীষণ শান্তির জায়গা বলে মনে হল। তার হঠাৎ বোধোদয় হল, বাড়িতে থাকার থেকে খুনি বদমাশদের সঙ্গে সময় কাটানো ঢের ভালো। তবু বাড়ি থেকে বের হবার সময়েও গিন্নির শাসানি শুনল সে,

–না খেয়েদেয়ে যে চুলোয় যাচ্ছ যাও। ফিরে তো সেই এখানেই আসতে হবে, তখন মজা দেখাব।

সামন্ত এত বড় শাসানি গ্রাহ্য করল না। সকাল আটটার সময়েই অফিসে পৌঁছে গিয়ে সে একটু যেন স্বস্তি পেল।

ঠান্ডা মাথায় সে রাহুল বৈদ্যর কেসটা নিয়ে ভাবতে বসল। কেসটা শুরু হয়েছিল একটা সম্ভাব্য খুনের তদন্ত হিসাবে। প্রথমে তারা নিশ্চিত ছিল না যে এটা সত্যিই একটা খুনের কেস কিনা! মনে হয়েছিল আত্মহত্যা হলেও হতে পারে। অথচ এই দোলাচলের কেসটাই তাদের একটা সিরিয়াল কিলিং কেসের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যদিও এটাকে তারা কোনওভাবেই পাবলিকলি ডিসক্লোজ হতে দেয়নি। তবু দুটো খুন আর টেলি অভিনেত্রী নিখোঁজ হওয়াকে কেন্দ্র করে মিডিয়ায় একটা নাড়াঘাঁটা চলছে। মনে হয় বেশিদিন এটা চাপা থাকবে না। কিন্তু তাদের হাতে সূত্র বিশেষ নেই। শুধুমাত্র সম্ভাব্য একটা তদন্ত অভিমুখের হদিশ তারা পেয়েছে। তারা বুঝতে পারছে টালিগঞ্জের সিনেমা পাড়া আর কালীঘাটের রেড-লাইট এলাকার মধ্যে একটা যোগ সূত্রে আছে। কিন্তু অন্ধকারটা পরিষ্কার করতে এখনও ঢের বাকি। প্রবাল সেন তাকে টালিগঞ্জ পাড়ায় তদন্ত করে দেখতে বলেছে, আজ সে সেই নিয়েই বেরোবে। ওই এলাকায় তার এক ইনফর্মার আছে। তাকেই কাজে লাগাতে হবে। ভাবল তন্ময় সামন্ত।

সে রাহুল বৈদ্যর ফাইলটা টেনে নিয়ে বসল। মৃত রাহুলের ছবিগুলো দেখছিল খুঁটিয়ে। কেমন যেন শান্তভাবে রাহুল মৃত্যুর অন্ধকারের ভিতরে বসে আছে। কী যেন শান্তি! মৃত্যু এসে তার সামনে বসে আছে অথচ তার কোনও ভয় নেই, মৃত্যুর কাছে তার কোনও অভিযোগ নেই। এমনটা কেন! মৃত্যু কি তার কাছে হঠাৎ করে এসে গিয়েছিল? না না তেমন কেন হবে! সে এক চেনা মৃত্যুর মুখোমুখি বসেছিল। কিন্তু তার ঠোঁটে লেগেছিল এক ক্লান্ত অসহায়তা। তার যেন কিছু করার ছিল না, কেবল মৃত্যুকে শান্তভাবে গ্রহণ করে নেওয়া ছাড়া। আর একটা মদের গ্লাস বাথরুমের বেসিনে রাখা যেটাতে কোনও আঙুলের ছাপ নেই। একেবারে পরিষ্কার করে মুছে দেওয়া হয়েছে। এমনটা কেমন করে হবে? সে ছবিটা আবার ভলো করে লক্ষ করে, রাহুলের কানের কাছের দাগগুলো কিসের হতে পারে? তন্ময় চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে ভাবতে বসে। এমন কালশিটে পড়া দাগ তার হাতের কবজিতেও ছিল। তবে কি তার হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছিল! নিশ্চয়ই তাই।

কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে।

টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ায় তার এক পরিচিত ইনফর্মার নান্টু সাঁতরা। নান্টু টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের বাইরে ফুটপাথে সিডি-ডিভিডি নিয়ে বসে। এককালে সে পাইরেটেড সিডি বিক্রি করার কারণে সামন্তর হাতে ধরা পড়েছিল। জেলও খেটেছিল কয়েক দিন। নান্টুর তখন চরম দুর্দশা। প্রেমে পড়ে এক পতিতাকে বিয়ে করে তখন সে ঘরছাড়া। কোনও রকমে একটা বস্তির ঘর ভাড়া নিয়ে জীবন সংগ্রাম নামক এক কঠিন লড়াইয়ে ব্যতিব্যস্ত। তার তখন কতই বা বয়স হবে। বাইশ তেইশ। তার সতেরো বছর বয়সী নাবালিকা স্ত্রী অন্তঃসত্তা। নান্টু একদিন জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে সামন্তর পায়ে পড়েছিল। সে বুঝেছিল ছেলেটি ভিতরে ভিতর এখনও সাচ্চা, তার মনের ভিতরটা তখনও পচে হেজে যায়নি। আর নান্টু ছিল সিনেমাপাড়ার যাকে বলে ‘খাস খবর’। এই পাড়ায় কে কী করছে, কে কোথায় ছিপ ফেলছে সব তার নখদর্পণে। সামন্ত কিছু গুরুতর খবরের বিনিময়ে নান্টুকে ছেড়ে দেয়। সেই থেকে নান্টু খুব বিশ্বস্ত একটা সোর্স। তন্ময় সামন্তর কিছু প্রচ্ছন্ন মদতে নান্টুর ব্যবসা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। স্ত্রী পুত্র নিয়ে তার অবস্থা এখন সচ্ছল। সে প্রকাশ্যে সাতে পাঁচে থাকে না, কিন্তু সিনেমাপাড়ার সে যেন সঙ্গোপন একজোড়া সজাগ চোখ কান।

সামন্ত সরাসরি নান্টুর ওখানে যাবে না। সে একবার ডাঃ দিবাকর সোম সাহেবের কাছে যাবে। সোম সাহেব কলকাতার এক মেডিকেল কলেজে পড়ান। ভদ্রলোকের ক্রিমিনাল সাইকোলজির উপরে দারুণ এক বই আছে। সেই সূত্রে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ। নানা সময়ে সোম সাহেব পুলিশকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশিকা দিয়ে সাহায্য করেছেন।

সোমসাহেব সকালের দিকটা বাড়িতেই পড়াশুনা নিয়ে থাকেন। তিনি আলাদা প্র্যাক্টিস করেন না। অকৃতদার, ঝাড়া-হাতপা মানুষ। এক সর্বক্ষণের কাজের লোক গোপাল সর্বদা নিজের মানুষের মতো তাঁকে আগলে রেখেছেন। না হলে বইপাগল ভোলেভালা মানুষ হয়ত নাওয়াখাওয়া ভুলে সারাদিন বই মুখে দিয়েই দিন কাটিয়ে দেবন। গোপালের কড়া শাসনে এমনটি হবার জো নেই।

সামন্ত সরাসরি তাঁর বাড়িতেই চলে এসেছে। সোমসাহেব পড়ার ঘরে একটা আরামকেদারায় বসে মহাভারত পড়ছিলেন। ইদানিং মহাভারতের চরিত্রদের অপরাধ মানসিকতার উপরে তিনি একটা বই লিখছেন। গোপালের সঙ্গে সামন্ত ঘরে ঢুকতে সদাহাস্যময় মানুষটি বই থেকে মুখ তুলে তাকালেন। তন্ময় সামন্তকে দেখে তার সারা মুখে এক অমলিন হাসি খেলে গেল। সদালাপী বিনয়ী কৌতুকপ্রিয় সামন্তকে তিনি পছন্দ করেন খুব। সকৌতুকে বললেন,

–গুরুতর কিছু মনে হচ্ছে! না হলে এত সকাল সকাল তো তোমার পদধূলি পড়বার নয়।

যথারীতি অভ্যাসের বসে সোমসাহেবকেও সে স্যার বলেই ডাকে। একটু ম্যাড়ম্যাড়ে বিকেলের মতো হেসে বলল,

–হ্যাঁ স্যার। একটা গুরুতর সমস্যায় পড়েছি। তাই আপনার কাছে এসেছি। একটু যদি দিকনির্দেশিকা পাই।

সোমসাহেব বই রেখে তার দিকে ঘুরে বসলেন। বললেন,

–তদন্তে আর কে আছে আপনার সঙ্গে?

চেনা পরিচিতের বাইরে তিনি আর আজকাল সূত্র দিয়ে সাহায্য করেন না। বলেন, ‘চারদিকে বড্ড পলিটিক্স আজকাল।’

সামন্ত বলল,

–আপনি কি প্রবাল সেনকে চেনেন? উনি আমাদের ফোর্সের নন। আমাদের অর্ক মিত্র সাহেবের বন্ধু। মিত্রসাহেব অ্যাকচুয়ালি আমাকে ওনার সাজেশন নিয়ে চলতে বলেছেন।

সামন্ত যেন আরও কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।

সোমসাহেব উচ্ছ্বসিতভাবে বললেন,

–প্রবাল সেন যখন এই কেসে আছে তখন আবার আমার কাছে এসেছ কেন?

সামন্ত যেন কথাটা ঠিক বুঝতে পারে না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সে সোমসাহেবের দিকে তাকায়।

সোমসাহেব বললেন,

–তুমি বোধহয় প্রবালের সঙ্গে আগে কাজ করোনি। তাই তাকে সম্যক জানো না। জানলে আর আমার কাছে আসতে না। ক্রাইমের বিষয়ে ওর থেকে ভালো এক্সপার্ট ওপিনিয়ন তোমাকে তোমাদের ফোর্সের কেউই হয়ত দিতে পারবে না। ও আমার কাছে আসে মাঝে মধ্যে। অনেকদিন দেখা হয়নি ওর সঙ্গে। শেষবার দেখা হয়েছিল ওর বৌভাতের নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে। প্রবালকে বোলো একদিন আমার কাছে আসতে।

সোমসাহেব এক মুহূর্ত থামলেন। নিজের মনে কী যেন ভাবলেন। তারপরে বললেন,

–বলো। শুনি তোমার কেসের বিষয়টা।

সামন্ত ধীরে সুস্থে তাঁকে আপ-টু-ডেট তাদের তদন্তের বিষয়টা বলে গেল।

সোমসাহেব মন দিয়ে শুনলেন। চোখ বুজে আরামকেদারায় হেলান দিয়ে। মাঝে কোনও প্রশ্ন করলেন না। আজ তাঁর তাড়া ছিল না। সেকেন্ড হাফে তিনি একবার মেডিকেল কলেজে যাবেন।

সামন্তর বলা শেষ হয়ে যাবার পরেও তিনি চার পাঁচ মিনিট তেমনি চুপ করে বসে থাকলেন।

সামন্তও কোনও কথা বলে না। গোপাল কফির পেয়ালা রেখে গিয়েছিল। সে কফি ও সেই সঙ্গে উপাদেয় এক প্লেট কুচো নিমকির সৎকার করায় মনে দিয়েছিল।

সোমসাহেব যেন ধ্যানভঙ্গ হলে পরে সোজা হয়ে উঠে বসলেন। বললেন,

–এবার বলো, পার্টিকুলার কোন জিনিসটা তুমি ক্লিয়ার করতে চাইছ আমার কাছে?

সামন্ত টেবিলে রাখা তার ফাইলটা খুলে রাহুল বৈদ্যর মৃত দেহের ছবিগুলো সোমসাহেবের হাতে দিল। তারপরে আঙুল দিয়ে ছবিতে রাহুল বৈদ্যর কানের পাশের দাগগুলো দেখাল। সেই সঙ্গে হাতের দাগগুলো।

সোমসাহেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো দেখলেন। সেই সঙ্গে সামন্তর কাছ থেকে ডেডবডির পজিশনের বিষয়, মৃত্যুর সময় ইত্যাদি জেনে নিলেন। তার পরে আবার ছবিটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে, অরুণ কর আর রেখা দাশের মৃত্যুর বিষয়ে ডিটেলে জেনে নিলেন, তার সঙ্গে প্রবালের ভিউ পয়েন্টের কথাও তিনি শুনলেন।

তার পরে চুপ করে বসে কিছু ভাবলেন বেশ কিছুক্ষণ। শেষে বললেন,

–প্রবাল ঠিকই বলেছে। এটা একটা সিরিয়াল অফেন্সের কেস। এবং খুবই কমপ্লেক্স মেন্টালিটির এক অপরাধী। আর দারুণ ধূর্তও। আর তুমি যে দাগ দুটোর কথা বলছ আমার মনে হচ্ছে খুন করার আগে খুনি খুব শক্ত একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে ভিকটিমের চোখ বেঁধে দিয়েছিল। মনে হচ্ছে যেন খুনি তার ভিকটিমের সামনে বসে মদ খেয়েছে আর সেই সঙ্গে একটা বিচার করেছে ভিকটিমের। বিচার শেষে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। লক্ষ করো, খুনি সোফায় বসেনি। সে একটা উঁচু টুলের উপরে বসেছিল জজের মতো।

সামন্ত অবাক হয়ে শুনছিল। এমনটা যেন তারা ভাবেনি। সে বলল,

–কিন্তু রাহুল বৈদ্য বসে বসে শুনছিল কেন? সে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেনি?

–খুনি যদি ভিকটিমের পরিচিত হয়, আমি তেমন সম্ভাবনাই দেখতে পাচ্ছি। পরিচিত দু-জনে বসে মদ্যপান করেছে। তার পরে ভিকটিম নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে বা তাকে বিশেষ কিছু একটা বুঝিয়ে তার হাত বেঁধে দিয়েছে। এই ধরনের খুনিরা দারুণ ইনটেলিজেন্ট। সে এটাকে হয়ত আত্মহত্যা হিসাবে চালাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে সে কপালে গুলি করার লোভও সামলাতে পারেনি। কপালে গুলি করার লোভটা একটা প্যাশনের মতো কাজ করেছে। এই লোভের কাছে খুনি যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

তিনি একটু থামলেন।

তার পরে আবার বললেন,

–রাহুল বৈদ্যর পরিচিত এই খুনি। খুবই পরিচিত। আর খুনের মোটিভ কী? এই ক্ষেত্রে খুনের মোটিভটা খুব জরুরি। মোটিভটা ভালো করে না বুঝলে খুনির প্রোফাইলিং করা শক্ত হবে। আর সেটা না হলে খুনিকে ধরাও শক্ত হবে। আমার মনে হয় খুনি এখনই থামবে না। তার একটা উদ্দেশ্য আছে। সে এখন যেন নিজেকে মৃত্যুদূত ভাবছে। কিন্তু কেন?

সোমসাহেব উঠে পড়লেন। তিনি স্নানে যাবেন। গোপাল অলরেডি দুবার ডেকে গিয়েছে। পায়ে চটিটা গলাতে গলাতে বললেন,

–একদিন প্রবালকে সঙ্গে নিয়ে এসো। কেসটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। তার পরে খুনির একটা প্রোফাইল বানানো যাবে। তার আগে তোমরা রাহুলের পরিচিতির বৃত্তটা ভালো করে অনুসন্ধান করো।

সামন্তও ঘাড় নেড়ে উঠে পড়ল।

 

এরপর আগামী সংখ্যায়