Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছাত্রদের থেকে আদর্শবাদ ফের একবার শেখার সময় এখন

নাতাশা বাধওয়ার

 

একজন চিত্রনির্মাতা এবং 'My Daughter’s Mum' এবং 'Immortal For A Moment' বইদুটির রচনাকার নাতাশা বাধওয়ার জানিয়েছেন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া-য় ঘটে যাওয়া পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদে সোচ্চার ছাত্রীদের কথা। মূল লেখাটি ইংরাজিতে লাইভমিন্ট-এ প্রকাশিত। বাংলায় তর্জমা করেছেন সত্যব্রত ঘোষ

কমবয়সী প্রতিবাদীরা সাংবিধানিক অধিকারের লড়াইয়ে আজ সারা দেশে রুখে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদীদের প্রথম সারিতেই আছে মেয়েরা। জামিয়া মিলিয়া এবং আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের উপর যে আক্রমণ ঘটেছে, তার প্রতিবাদে সমস্ত দেশ সাড়া দিয়েছে।

এই নিয়ে লিখতে বসে আমার একটা অসুবিধা হচ্ছে। কারণ, যতবারই আমি অনুজ্ঞা নামে জামিয়া মিলিয়ার আইনের ছাত্রীটির ভিডিওটা দেখছি, যেখানে সে প্রকৃত শিক্ষার অর্থ এবং সংবিধানের প্রতি তার দায়বদ্ধতা বিষয়ে টেলিভিশনের সাংবাদিকদের সামনে একটি চার মিনিটের সাক্ষাৎকারে নিজেকে ব্যক্ত করছে, আমার চোখদুটি বারবার ভিজে যাচ্ছে।

এমনটা নয় আমি জোর করে কাঁদছি। স্বতঃস্ফূর্ত এই আবেগ যে কীভাবে আমার মধ্যে জেগে উঠল, তা ভেবেই আমি অবাক। সাধারণত অনলাইনে নিউজ-ক্লিপ বিশেষ দেখি না, বিশেষ করে যেগুলি ভাইরাল হয়ে যায়, সেগুলি। এইধরনের সাউন্ড বাইট উৎপাদনের জন্য যে কাঠখড় পোড়াতে হয় তা গত পনেরো বছর ধরে নিউজ টেলিভিশনে কাজ করবার সুবাদে দেখে আমি ক্লান্ত এবং নিরাশ হয়ে পড়েছি। তবুও এটা বুঝতে পেরেছি যে এখন আমরা ইতিহাসের একটা বিশেষ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি।

“আমার নাম অনুজ্ঞা,” জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার আইন বিভাগের ছাত্রীটি একদল সাংবাদিকের বাড়িয়ে ধরা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষনিক সাক্ষাৎকারটিতে নিজের পরিচয় দিয়ে শুরু করছে। “আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকে চারপাশটা লণ্ডভণ্ড করে ছাত্রছাত্রীদের উপর লাঠি চালিয়েছে, টিয়ার গ্যাস শেল ফাটিয়েছে। এমনকি যারা লাইব্রেরি, মসজিদ অথবা হোস্টেলে নিজেদের ঘরে ছিল, তাদেরও বাদ দেয়নি। আজকে ভারতের সংবিধান বিষয়ে পরীক্ষা ছিল। আমি গতকাল পরীক্ষার জন্য শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু ওরা সংবিধান নিয়ে যে কাণ্ড ঘটাল, তারপরে সংবিধান নিয়ে কীইবা পড়ব আমি?”

অন্য এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে অনুজ্ঞা জানতে চায়, “ছাত্ররা কী অন্যায়টা করেছে? তাঁরা তো শুধু প্রতিবাদটুকু করছিল, তাই না? পড়াশুনা করে লাভটা কী বলুন, যদি না আমরা সেই শিক্ষাকে সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে পারি? শুধুমাত্র কয়েকটা যন্ত্র চালাব বলে আমরা এত কষ্ট করে লেখাপড়া করি না। অবিচারের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ানোর জোর দেয় শিক্ষা। যারা অত্যাচারিত, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা দেওয়ার জন্যই তো আমরা লেখাপড়া করছি।

“আমি মুসলিম নই আঙ্কল, তবুও আমি এই প্রতিবাদের একটা অংশ,” সারা দেশ জুড়ে নাগরিক সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যে আন্দোলন চলছে, যা ভারতের নাগরিকত্বের জন্য ধর্মকে প্রাধান্য দেয়, সেই বিষয়ে কথা প্রসঙ্গে অনুজ্ঞা বলে, “আমাদের ঘরের লোকগুলিকে যখন বেছে বেছে আলাদা করা হচ্ছে, তখন আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না।

“ওরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে হানা দিয়েছে। এতদিন অবধি এটাই আমাদের থাকবার পক্ষে সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা ছিল। এখন আর তা মনে হচ্ছে না আমার। আমরা এটাও জানি না আমাদের বন্ধুরা আগামীকাল থেকে ভারতীয় হিসেবে চিহ্নিত হবে কি না। নিজের ঘরেতে থাকা সত্ত্বেও আমি যদি আক্রান্ত হই, তাহলে দেশের কোনও জায়গাতেই আমি নিজেকে সুরক্ষিত বলে ভেবে নিতে পারছি না,” রাঁচি থেকে আসা মেয়েটি নিজের আবেগকে আর সংযত রাখতে পারে না।

আরেকটি ভিডিও আমাদের মনকে সত্যিই নাড়া দেয়। তাতে দেখা যায় জামিয়া মিলিয়ার একদল মেয়ে একটি ছেলেকে লাঠির আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পুলিশদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমরা দেখি ছেলেটাকে ফুটপাতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে মেয়েরা উর্দিধারীদের ফিরে যাওয়ার জন্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।

যে পরিস্থিতিতে একজনকে পিটিয়ে মারবার জন্য ভিড় জমে, তখন উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীদের উচিৎ চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে এভাবেই এগিয়ে এসে গণপিটুনির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আমি নিজের মনে ভাবছিলাম এসব। তারপর ট্যুইটে ভিডিওটা শেয়ার করলাম। ইতিমধ্যেই তা ভাইরাল হয়ে গেছে। মেয়েগুলির এই বাস্তব-জীবনে সাহসিকতার পরিচয়ের প্রশংসা করে হাজারের বেশি মানুষ নিজেদের প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন।

এই বছরের শুরুর দিকে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার এজেকে মাস কম্যুনিকেশন রিসার্চ সেন্টারের বার্ষিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের কিছু বলবার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। সেখানকার একদা ছাত্রছাত্রীদের পেশাদারি কৃতিত্বের জন্য সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। অডিটোরিয়ামের মঞ্চে ওঠবার পর মনে পড়ছিল কীভাবে কুড়ি-বাইশ বছর বয়সে এই ক্যাম্পাসে ছাত্রজীবনে আমি আবিষ্কার করেছিলাম আমার আদর্শবাদ। টেলিভিশনে এতগুলি বছর ধরে সাংবাদিকতা করবার পর সন্দেহ হতে শুরু করেছিল, একজন ব্যক্তির কি পরিবর্তন আনবার শক্তি আছে? তবুও দেখলাম এখানে এসে কারওয়াঁ-এ-মহব্বত-এর মিডিয়া টিমের এক অংশ হিসেবে যেন নতুন করে আমি আমার বিশ্বাস ফিরে পেলাম।

এই সপ্তাহে ক্যাম্পাসে এসে ছাত্রছাত্রীদের দেখে এবং তাঁদের প্রতিবাদের ধরনগুলি দেখে নতুন শক্তি সঞ্চয় করছি। ওদের প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বর শুনে আমরা শুধু বিস্মিত নয় শ্রদ্ধাবনতও বটে। ওরা কী অদ্ভুতভাবে ব্যক্তি ও রাজনীতিকে মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দেওয়ার শক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছে।

বহুজন টিভি নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত একটি জনপ্রিয় ভিডিওতে কীর্তি নামের একটি মেয়েকে দেখলাম। সংবিধান এবং নাগরিকত্ব বলতে কী বোঝানো হয়, তা সহজ কিন্তু মর্মস্পর্শীভাবে ব্যাখা করছে। “ডক্টর বি আর আম্বেদকর ভারতের মানুষের জন্য সংবিধান রচনা করেছিলেন। এবং আমাদের তাতে মালিকানা আছে,” মেয়েটি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছিল যে মানুষের মতামত না নিয়ে তাই সংবিধানে কোনও পরিবর্তন করা যাবে না। “আমরা এখানে সবাই নাগরিক, আমরা প্রত্যেকে জড়ো হয়েছি প্রতিবাদ জানাতে। আমরাই ভারত। আমরাই ঠিক করব ভারত কেমন হবে।”

আমি যখন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি আর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রছাত্রীদের পাশে বসে আশ্বাস দিচ্ছি তখন বাড়িতে আমাদের দুই মেয়ে লুইসা মেরি অ্যালকটের ‘লিটল উইমেন’ পড়ায় মগ্ন। চিরায়ত এই উপন্যাসটি অবলম্বনে গ্রেটা জারউইকের বানানো ছবিটার ট্রেলার ইতিমধ্যেই দেখেছে ওরা। এবং নিজেদের ক্রিসমাসের গিফট হিসেবে দেওয়ার জন্য ওরা ছবিটা দেখবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

নাগরিকত্বের অধিকার রক্ষায় যে মেয়েরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাঁদের পাশাপাশি আমার মেয়েরাও উপন্যাসটি পড়বার সময়ে তরুণসমাজের শক্তি, আদর্শ এবং সৌহার্দ্যবোধের যে মুহূর্তগুলিকে আত্মস্থ করছে, সেই ব্যাপারে নিজেদের আবেগজনিত প্রতিক্রিয়া বিষয়ে তারা অবহিত নয়। আমার এগারো বছরের মেয়েটি উপন্যাসে এক বোনের মৃত্যুর বর্ণনা পড়ে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে দেখলাম। তারপরে আনন্দাশ্রু ভরা চোখ নিয়ে প্রথমবারের জন্য বইটা পড়া শেষ করল।

“এই বইটায় যে শব্দগুলি আছে, তার মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি, মা,” আমার বড় মেয়েটি বলল। নারীদের আভ্যন্তরীণ যে জগৎ, তার কথা খুব সুন্দরভাবে লেখা আছে বইটাতে। বোনেরা একে অন্যের পাশে থেকে নিজেদের আকাঙ্খাগুলি চিনতে সাহায্য করতে পারে এবং তা সত্যি করবার জন্য যে শক্তি আর মেধার প্রয়োজন, তা একত্রিতও করতে পারে।”

বছর শেষ হতে চলল, ক্রিসমাসও এসে গেল। যন্তর মন্তরে দাঁড়িয়ে বহুজন টিভির সাংবাদিককে কীর্তি যে কথাগুলি বলেছিল প্রিয় পাঠক, সেগুলি আবার বলে আমার লেখা শেষ করলাম।

যখন আমি বাড়ি থেকে আসছি, তখন আমার মা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তুই এতে যোগ দিলে আন্দোলনের কী সুবিধা হবে। প্রশ্নটা শুনে একই সঙ্গে আমি হেসে ফেলি আর কাঁদি। এই বিশাল জনসমুদ্র দেখুন। এখানে আমরা প্রত্যেকে এক একটি ব্যক্তি। কিন্তু একত্রিত হয়েছি বলেই আমরা এখন এতটা শক্তিশালী যে আমাদের ভয়ে পুলিশ আর প্যারামিলিটারি ডাকতে হয়েছে সরকারকে। আমরা সেই ভারতের নাগরিক, যে ভারতে আমরা আছি। আমরাই থাকব।