Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ডক্টর আরমিডা ফার্নান্দেজের অসম্ভবের লড়াই

ডক্টর আরমিডা ফার্নান্দেজের অসম্ভবের লড়াই

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

‘একদিন ইংলন্ড থেকে ফিরে এসে আরমিডা বলল, চলো আমরাও হিউম্যান মিল্ক ব্যাঙ্ক বানাই।’ হাসতে হাসতে ডাউন দ্য মেমরি লেনে জয়শ্রী মোদকার। সায়ন হাসপাতালে আরমিডার সহকর্মী। আরমিডা বলতে আরমিডা ফার্নান্দেজের কথা বলছি। এক অসম্ভবের কথা বলছি। প্রিয় পাঠক, আসুন, গোড়া থেকে শুরু করি…

কর্নাটকের ধারওয়ারের সাহিত্যের অধ্যাপকের মেয়ে। গোয়ানিজ পরিবার। মেয়ে ডাক্তার হতে চায়? নিমরাজি বাবা। নাছোড় মেয়ের লড়াই। মুম্বইতে এসে জীবনের উচ্চশিক্ষা। বিয়ে। স্বামী রুই পাশে এলেন। সায়ন হাসপাতালের নিওন্যাটাল কেয়ার ইউনিট চালু করলেন। ভারতের কোনও হাসপাতালে এই প্রথম। তবে এখনও পর্যন্ত গল্পটা সীমার মধ্যে। আরমিডা সীমাটা ভাঙলেন কীভাবে? ধারাভি বস্তির মায়েরা সায়নে আসতেন। পুরসভার হাসপাতাল। হাইজিন নেই। সিস্টারদের অসাবধানতা। পরিণতি ষাট থেকে সত্তর শতাংশ মর্টালিটি। অথবা নবজাতক সুস্থ হলেও মা চলে যাচ্ছেন অকালে। আরমিডা বুঝলেন সমস্যাটা ফর্মুলা দুধে। কন্টামিনেশন। বন্ধ করলেন। অক্সফোর্ড থেকে ফিরে সেদেশ থেকে আইডিয়া এল। মায়েদের বোঝালেন। স্তন্যপান করাতে পারেন না এমন মায়েদের আশার আলো জাগালেন সুস্থ স্বাভাবিক অন্য মায়েদের বুঝিয়ে। ১৯৮৯। দেশের তথা এশিয়ার প্রথম হিউম্যান মিল্ক ব্যাঙ্ক তৈরি হল। গল্পের এখানেই শেষ নয়। একটা দিক হল। ধারাভির কাছাকাছি বস্তিতে ক্রমাগত শিশুকন্যা ধর্ষণের খবর ছড়াল। আরমিডা দেখলেন। বীভৎসতার পরিমাণ বুঝলেন। কীভাবে লড়াই চালাবেন? বস্তিতে বস্তিতে ঘুরলেন। বুঝলেন এভাবে হয় না। একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার। সময় দরকার। কিন্তু এনজিও? আরমিডা পড়াশুনো করা মানুষ। কীভাবে সামলাবেন এনজিও? এত বাইরের কাজ? তবু, উপায় তো নেই। এনজিও হল। নাম হল। ‘স্নেহা’। এই স্নেহার একজন বস্তিবাসিনী বেনিফিশিয়ারি থেকে আজ সংখ্যাটা দু লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার। সদস্য চারশো। মহারাষ্ট্রের সবকটি জেলায় এমনকী দেশের মোট ছটা রাজ্যে স্নেহার কাজ। সদস্য। কীভাবে হল এতটা? কী করল স্নেহা? ধর্ষণ আটকানো, রেপ ভিক্টিমদের পুনর্বাসন, নারী সম্মান ও অধিকারবোধ প্রতিষ্ঠা, মা এবং সন্তানের স্বাস্থ্য। দেশজুড়ে রেপ ভিক্টিমদের পাশে দাঁড়ানোর প্ল্যাটফর্ম নির্ভয়া ফাউন্ডেশনের পথ দেখাল আরমিডার স্নেহা।

অনেকটা, অনেকটাই পথ পেরিয়ে আসা। তবু, এছাড়াও কিছু থাকে। আরমিডার পরিচিত এক গাইনোকোলজিস্ট প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে আর ফিরলেন না। সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। পথচারীরা ছিলেন। চেষ্টাও ছিল। পারলেন না। আরমিডা জানতেন, এটা হত না, যদি না বেসিক একটা প্রশিক্ষণ থাকত। কার্ডিয়াক মেসেজের। এত তাড়াতাড়ি হয়ত যেতে হত না মানুষটাকে। আর যাতে না হয়, তাই তো ‘আই কেয়ার’। আরমিডা পথচারীদের প্রশিক্ষণ দিলেন। ফিজিকাল এমার্জেন্সিতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে কীভাবে রোগীর পাশে থাকা যায়। একটা প্রশিক্ষক ঠিকমতো কার্ডিয়াক মেসেজে বাঁচিয়ে দিতে পারেন একটা জীবন। এই ‘আই কেয়ার’ থেকে ‘কানেক্ট অ্যান্ড কেয়ার’। আরমিডার স্বপ্নের আরেক জানলা। দূর দেশে থাকা ছেলেমেয়েদের বাবা মা। একা। অবসাদ। তা থেকেই অনেক আত্মঘাত, মৃত্যু। কানেক্ট অ্যান্ড কেয়ার তৈরি করে সেইসব মানুষদের এক ছাতার নিচে আনলেন। রুপোলি চুলে তৈরি হল বেঁচে থাকার অসম্ভব এক মন্ত্র।

এইটুকু পরিসরে আর কত….! ডক্টর আরমিডা ফার্নান্দেজ এখন ছিয়াত্তর। তাঁর সায়ন হাসপাতালের নিওন্যাটাল কেয়ার ইউনিটের ডিন পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। স্নেহার অফিসিয়াল সর্বোচ্চ পদেও থাকতে পারছেন না অসম্ভব কাশিজনিত কিছু সমস্যার জন্য। ফুসফুস বাধা দিচ্ছে। শরীর বাধা দিচ্ছে। বয়স? মৃত্যুবোধ? আরমিডার ডিকশনারিতে সেসব নেই। এখনও নিয়মমতো পাঁচ ঘণ্টার বেশি ঘুমোন না। বান্দ্রার ভারত মহাসাগর দেখতে পাওয়া বাড়িতেই রোগী আসেন। সহকর্মীরাও। স্নেহা, আই কেয়ার বা কানেক্ট অ্যান্ড কেয়ারের সদস্যদের সমস্তরকম সহযোগিতা, পরামর্শ। কামারাদেরি। রাত্রে শুতে যান আরমিডা। চেতনায় রোমিলা প্যালিয়েটিভ সেন্টারের সদস্যদের চোখমুখ। সেন্টারের ইতিহাস। ঘুমের ভেতরও জেগে থাকে এসব। কারণ সেন্টারের নামটা আরমিডার বড় প্রিয়। রোমিলা। বছর ষোলোয় লিম্ফোমায় পড়ল। রেডিয়েশন। তারপর স্তন ক্যানসার। রোমিলা চলে গেল বছর তিরিশের কোঠায়। রোমিলা ফার্নান্দেজ। আরমিডার একমাত্র সন্তান। কন্যা। ক্যানসার। আরমিডা রবীন্দ্রনাথ পড়েননি। তবু, শোক থেকে বেরিয়ে ক্যান্সারের রোগীকে মানসিকভাবে দাঁড় করানোর জন্য খুলেছিলেন রোমিলা প্যালিয়েটিভ সেন্টার। যা আরমিডাদের জাগিয়ে রাখবে, শোকের ভেতরেও বাঁচিয়ে রাখবে আরও অনেক দিন…