Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অণুপরিমাণ

মৃন্ময় চক্রবর্তী

 

অন্ধ দুর্দশার থেকে স্নিগ্ধ আঁধারের দিকে

চাঁদটা গড়িয়ে পড়বে নাকি এখনই? ঝোপের ভেতরে ফুটে আছে জোনাকির রাতফুল। আলোগুলো ঝিঁঝিঁর মতো ডাকছে। ঝুপ ঝুপ ঝুপ! শব্দ হচ্ছে পাহাড়ের নীচে। দুজন মানুষ মাটি কাটছে। ঝুপ ঝুপ ঝুপ।

আসু দ্যাখসো, কবরখান বেশ বড় হইসে। কেউ কথা বলল তাদের মধ্যে, তারপর আর কথা নেই। ঝুপ ঝুপ ঝুপ ঝুপ শব্দ আর ঝিঁঝির গান। খানিক পর উত্তর এল, হ মাধব, আমাগো দোনো পরিবারের জাগা হইবো। তুমি কাইল একখান অস্তর যোগাড় কইরো, হাত দিয়া আর কত কাটবা মাটি!

দিনের উদাসীন আলো এসে আবার সব মুছে দেয়। তখন নির্জন পাহাড়ি বনে হাওয়ার মর্মর। দিন ফুরোলেই আবার জোনাকির ফুল, আলোর ঝিঁঝিঁডাক, ঝুপঝুপ কোদালের শব্দ। প্রতিদিন মানুষ বাড়ে একজন, দুজন। কবর বড় হয়। কেউ কথা বলে, মাস্টার হুইনছনি, কাল নেতায় আইয়া কইসে আমাগো নাকি সমস্যা নাই। কাগজ নাই তো কী হইসে কোম্পানিরা নাকি আমাগোরে কাজ দিবার চায়!

পাহাড়ের মাথার উপর থেকে পেঁচার ডাক ভেসে আসে। উড়ে যায় প্রবীণ বাদুড়। আবার সব চুপ হয়ে যায়। ঝুপ ঝুপ শব্দ ভাসে। জোনাকির ঝিঁঝিগান উড়ে বেড়ায়। কবরটা দিনে দিনে বড় থেকে আরও বড় হয়। আবার কেউ কথা বলে ওঠে, আসুদ্দিন, কোম্পানিরা ক্যান কাজ দিবার চায় বুঝলা না? দ্যাশ নাইদের কাজ দিবার চায় ক্যান? স্যাজের নাম শুনছ? স্যাজের লগে নার্সির পিরীত বুঝলা না মাধব!

স্যাজ কী মাস্টার?
চোষণের কারখানা। বেতন নাই, সময়ের সীমা নাই, বারো ঘণ্টা, চৌদ্দ ঘণ্টা, আঠারো..
যাদের কাগজ নাই তাদের চাকরি ক্যামনে?
তাতেই তো সুবিধা আসুদ্দিন। জিব্বার বারণ নাই বুইজ্জোনি!
ওরা আমাগো দ্যাশহীন কইরা দাস বানাইতে চায়?

আবার সব চুপচাপ। আবার ঝুপঝুপ ঝুপঝুপ। জোনাকির ঝিঁঝিঁডাক। বুড়ি চাঁদ পাথরে গড়ায়।

কবর অনেক বড় হইসে মাস্টার। আমাগো মাটি থ্যাইকা সরাইতে পারব না আর। হ, একখান গোটা দ্যাশের মাইনসের জাগা হইব। ঝুপঝুপ ঝুপঝুপ।

রাত গিয়ে দিনের উদাসীন আলো এসে আবার সব ঢেকে দেয়। পাহাড়ি হাওয়ায় তখন পাতার মর্মর।

 

হাজার বছর আগে

ধীরেন গাবতলা বাসস্ট্যান্ডে আসার আগেই বাসটা বেরিয়ে গেল। নিঝুম তেঁতুলতলায় একজন মাত্র যাত্রী নেমেছে। সবে সন্ধ্যা নামল এরপর নাকি আর একখানা মাত্র বাস মিলবে।

রাস্তাটা প্রাগৈতিহাসিক। পিচের বংশ নেই। নৌকোর মত দোল খেতে খেতে বাসগুলো গাড্ডা পেরোয়। ছুটলে কি ধরা যায় বাসটা? আবার কখন বাস আসবে কে বলতে পারে। স্ট্যান্ডের একমাত্র চা-দোকানে ঝাঁপ পড়ছে। ধীরেন আবছা অন্ধকারে উড়ন্ত ধুলোর পিছনে ছোটার প্রস্তুতি নিতেই হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে এগিয়ে এল যাত্রীটি। বলল, দাবাবু চলি যাচ্ছিলে নাকি? কি আশ্চয্যি! আর আমি তোমার জন্যি মাছ নে এলুম। এই দ্যাকো কি বড় বড় বোগো মাছ, আজকাল পাওয়া যায় না বুইলে! চলো ঝোল খাবে।

ধীরেন কিছু বলার আগেই যমদূতের মত কালো প্রকাণ্ড হাত ওর বাহু আঁকড়ে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এল বুকের কাছে, বলল লাস্ট বাস চলি গেছে, এর পরে আর বাস নেই, ঝেটা শুনোচো ওই আশায় থাকলি ভোর হয়ি যাবে। হেঁটে কলকাতা যাবার মতলব এঁটোচো মনি হচ্ছে দাবাবু, হে হে। চলো গরীবের ঘরে নয় একটা রাত থাকলে। খেয়েদেয়ে পাশের ঘরের বুনোর মা গান দেচে, শুনবে অকন।

রাত হয়েছে। আঁশটে গন্ধে ভরা বোগোমাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে অন্ধকার দাবায় বসে আছে ধীরেন। চাঁচের খাঁচার ভেতর শালিকটা ঝটপট করে উঠছে মাঝেমাঝেই।

রতন হালদারের উঁচু দাওয়া থেকেই দেখা যাচ্ছে বুনোর উঠোন। সেখানে মনসার ভাসান গান হচ্ছে। হ্যাজাক জ্বলছে শোঁ শোঁ করে। আলো একবার কমছে আবার বাড়ছে। খুব ভিড় চারদিকে। লোক যাচ্ছে আসছে। বাইরে এদিক ওদিক হাঁড়িয়া, তাড়ি, চুল্লুর আসর বসেছে। ওদের চারপাশে উড়ছে মাতাল জোনাকি।

ও যেখানে বসে আছে তার পাশেই একটা বকুলগাছ। ফুল ফুটেছে দেদার। গন্ধে তন্ময় হয়ে ধীরেন ভাবছে তার ভাঙা চাল, নোনাখসা ঘরের কথা। সেখানে কোনও বকুলগাছ নেই, মনসার ভাসান নেই, হ্যাজাকের আলো নেই। চাঁদ মুছে যায় স্ট্রিটলাইটে। নর্দমায় মাছি ওড়ে দিনে, সন্ধ্যায় মশা ভনভন করে। বর্ষায় ঘরে ঢোকে জল। গরমে হাওয়াকে কান ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে সিলিং ফ্যান হাঁপিয়ে যায়।

যদিও এখানেও ছেঁড়াফাটা মানুষ, কারও ঘরে ধানের গোলা নেই, অথচ কী মিঠে হাওয়া, জ্যোৎস্নামোড়া পথ, ধানমাঠ, মাতাল জোনাকি। ভাল্লাগে না ফিরে যেতে। যমদূত কি তাকে আরও কিছুদিন রেখে দেবে।

ধীরেন আচমকা তার পিছনের অন্ধকার গাছতলায় চুড়ির শব্দ পায়, হাসির শব্দ পায়, শ্বাসের শব্দ পায়। সে চমকে ওঠে। পিছন ঘোরার আগেই সামনে ধেয়ে আসে সেই কালো কুচ্ছিত হাত, দাবাবু নাও বিড়ি খাও। সে বিড়িটিড়ি খায় না, কিন্তু নেয় ধরায়। তারপর রতন হালদারের ছেলে ঘরে ঢুকে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় অন্ধকারে। কিছুক্ষণ জ্বলে ওটা তারপর দেখে দপদপ করে জোনাকিরাই জ্বলছে।

ওদিকে কান্নার রব ওঠে। লখিন্দরকে সাপে কেটেছে। ভেসে আসে বিষণ্ণ সঙ্গীত। আড়বাঁশি বাজায় দলের কালোভূত একটা ছোকরা। ভিড়টা আধোঘুম জাগরণে ঢুলছে দেখতে পায় ধীরেন।

সে ধীরে ধীরে উঠোনে নেমে আসে। মাথার উপর ডানার আওয়াজ পায়। বাকচা উড়ে যাচ্ছে, দেখে। চালে খসখস শব্দ ওঠে। জুলজুলে পেঁচার চোখের সার্চলাইট ঘুরছে, দেখে। মাথার উপর মড়ার খুলির মত চাঁদ ঝুলে আছে দেখতে দেখতে ওর মনে হয় এই পৃথিবীটারও তো অনেক বয়স হল।

ও বকুলগাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। তার ইচ্ছে হয় হাজার বছর ধরে সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। রাত কি ফুরিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি? অনেকদিন তো রাত জাগা হয়নি!

 

সহযাত্রী

শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠেছি। সাউথ সেকশানে বরাবরই প্রচণ্ড ভিড় হয় অফিস টাইমে। সিট পাওয়া দূর অস্ত, ঠিকমতো দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া কঠিন হয় পড়ে। আমি কয়েকটি মাত্র স্টেশন পরেই নামব বলে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কারণ কিছুটা ঠেলাঠেলি হলেও সহজে নামতে পারব। ট্রেন ছেড়ে দিল, হাওয়া এসে লাগল গায়ে। কামরার গুমোট আবহাওয়ায় একটু স্বস্তি বোধ করলাম।

একজন অন্ধ বাউল গান গাইছে, বেশ মধুর গলা। শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে গেলাম। লালনের পদ গাইছে লোকটা “এমন মানব জনম আর কি হবে/ মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে”। বাইরের হাওয়া আর অন্দরের গান ভুলিয়ে দিল যে পার্কসার্কাসে গাড়ি ঢুকছে। হৈ চৈ শব্দ কানে যেতেই ঘোরমুক্ত হয়ে দেওয়াল সেঁটে দাঁড়ালাম। যা লোক নামল তার তিনগুণ লোক উঠল। হঠাৎ আমার পায়ের উপর একটা বোঝা সশব্দে আছড়ে পড়ল। আমি চমকে উঠলাম। অতিদ্রুত আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ক্ষিপ্রবেগে পা সরিয়ে নেবার ঈঙ্গিত দিয়েছিল বলে রক্ষা পেলাম, যদিও বুড়ো আঙুলে সামান্য চোট লাগল। আমি প্রচণ্ড রেগে বোঝার মালিককে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালমন্দ করতে শুরু করে দিলাম। আমার দেখাদেখি আরও কিছু প্যাসেঞ্জারও চেঁচাতে শুরু করল, “ভেন্ডারে যেতে পার না?… কোনও বোধবুদ্ধি আছে তোমার … যত্তসব ইডিয়েট … মানুষকে খুন করে ফেলবে …. এরা বড় বেপরোয়া হয়ে উঠছে বুঝলেন দাদা ভালো ভাষা এরা বোঝে না …. লাথি মেরে ফেলে দাও না বোঝাটা …. ট্রেনে কাঠকুটো নিয়ে যাচ্ছে বুঝুন ঠ্যালা … এরা মানুষের বাচ্চা না …” ইত্যাদি। লোকটা চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কোনও উত্তর করল না! ভিড় ট্রেনে হরহামেশাই এইসব ঝগড়া ঝামেলা হয়, দশ মিনিটও লাগে না ঝগড়া থামতে, নতুন প্রসঙ্গ এসে পড়তে। আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। কালো খর্বকায় লোকটা তখনও মাথা নীচু করে ছিল। ওর শরীরের উন্মুক্ত অংশগুলোয় চামড়া ফুঁড়ে হাড় উঁকি দিচ্ছে, গালের হনু দুটো অস্বাভাবিকভাবে উঁচু হয়ে ওর কোটরাবদ্ধ চোখদুটোকে খানিকটা আড়াল করেছে। কেমন যেন মায়া হতে লাগল। কত খারাপ গালিগালাজ করেছি লোকটাকে ইস, একটুও প্রতিবাদ করেনি। ধীরেধীরে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কাঁধে হাত রেখে বললাম, এভাবে কেউ বোঝা নামায়? আমার পাটা তো ভেঙেই দিয়েছিলে একটু হলে! লোকটা চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। দেখলাম ওর কোটরাগত মণি টলমল করে উঠেছে।

বাবু সেই ভোরে বের হই ঘর থেনে। এখন ফিরচি। ঘরে ছাবালগুলো না খেয়ে আচে। এই গাড়িটা ধরতে না পারলে একঘণ্টা বসে থাকা। কিচু মনে করবেন না গো বুঝতে পারিনি, বলেই মাথা নীচু করল লোকটা। আমি জানতে চাইলাম বাড়ি কোথায়! লোকটা বলল, ক্যানিং বাবু, সেখেনে নেমে ভেন ধরে যেতে হবে, হেড়োভাঙা চেনেন বাবু? ওই ওখেনে। এই জ্বালানি নিয়ে যাব তবে রান্না হবে তবে আমার বাচ্চারা খাবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন তোমার বউ? লোকটা মাথা নামিয়ে বলল, সে মাগী ভেগে গেচে। শুনে চুপ করে থাকলাম আমি। কী বলব এখন এসবই হচ্ছে আকছার।

আবার সেই শুরু করল, আমি বাবু মুসলমান। বিহারে বাড়ি। এদেশে এসে এদেশি মেয়ে বিয়ে করেছিলাম ভালবেসে। তার প্রতিদান এই। লোকটার কথাগুলো বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম। কথা ঘোরাতে আমি বললাম কাল তোমাদের পরব গেল না কী একটা যেন? হ্যাঁ শবেবরাত, কিন্তু গরীবের আবার পরব কী? আমি কিচুই মানাই না বাবু, কী হবে মানিয়ে? আমার বাচ্চাদের কে ভাত দেবে? লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে দেখল আমাকে ভালো করে। উত্তরের অপেক্ষা করল। আমি বললাম তুমি দাড়ি রাখো না টুপি পরো না, তোমার সমাজ, মৌলবি মৌলানা মোল্লা মাতব্বররা কিছু বলে না তোমাকে? লোকটা হঠাৎ সোজা হয়ে যেন দম নিল, তারপর বলল, কে কী বলবে আমাকে, দুটো ভাত দেবার মুরোদ আছে ওদের? আমি রাত তিনটেয় ঘুম থেকে উঠে ভাত রান্না করে রেখে আসি বাবু, আবার এখন গিয়ে রান্না করব। নামাজ রোজার টাইম কোতায়! এক নামাজি হারামখোর আমার বউটাকে ভাগিয়ে নিয়ে গেল, এই তো ধর্ম! কেউ কিচু করল? আমার বাচ্চাদের দেখার কেউ নেই!

একে একে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। আমার গন্তব্য এসে গেল, এবারে নামব। আমি লোকটাকে বললাম, তুমি আবার একটা বিয়ে করছ না কেন? লোকটা যেন আঁতকে উঠল, না বাবু কভি নেহি! আমাদের সমাজে অনেক বিয়ের চল আছে কিন্তু আমি পারব না! আমার বাচ্চারা এতিম হয়ে যাবে। ওদের আমি খুব প্যায়ার করি বাবু! আমার বউটার কোনও দিল নেই বাবু, বাচ্চাদের ফেলে কী করে চলে গেল এ্যাঁ, কই আমি তো পারি না! জানেন বাবু আমাদের বিহারি মুসলমানদের মধ্যে হারামি লোক বেশি, এরা বাঙালি মুসলমানদের খারাপ করে দিয়েচে। আমার বউটা কী ভালো ছিল আগে… আমি তো অনেকদিন বঙ্গালে আচি, আমি জানি। বাঙালিরা ভালো ছিল… অনেক ভালো ছিল!

ট্রেন গমগম শব্দে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেল। আমি লোকটার পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম, কিছু মনে কোরো না ভাই, অনেক খারাপ কথা বলেছি তোমাকে! লোকটা আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল, তাতে কী হয়েচে বাবু আপনি বড় ভাল লোক, আমার মত ছোট মানুষের সঙ্গে কত কথা বললেন….

ট্রেন থামল আর ভিড়ের স্রোত আমাকে নামিয়ে দিল প্ল্যাটফর্মে, পিছন ঘুরে লোকটাকে দেখতে পেলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার অন্দর আর্দ্র হয়ে উঠল, কানে বাজতে লাগল, বাবু আপনি বড় ভালো লোক….. আর তার সঙ্গে হয়তো দেখা হবে না, কিন্তু আমি বুঝেছি তার চেয়ে ভালো লোক হয়ে ওঠা অনেক কঠিন, অনেক শক্ত কাজ!