Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভয় হতে তব অভয় মাঝে

আশীষ লাহিড়ী

 

চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর সম্পাদকীয় দপ্তর আমার কাছে একটি প্রশ্ন রেখেছিলেন। ২০১৯ সালের মে মাসে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, এবং সংসদের দুই কক্ষে নিজেদের সংখ্যার জোরে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেইসব কর্মসূচির বাস্তবায়নে যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছেন, সেগুলো প্রকারান্তরে দলটির আজন্মলালিত হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাগুলিই কিনা? কেন্দ্র সরকারের সমালোচকরা যা বলছেন, অর্থাৎ সত্যিই কি হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া সূক্ষ্মভাবে শুরু হয়ে গেল? নাকি আমাদের ভয়টা অমূলক? আমরা কি আসলে সব বিষয়ে অতিপ্রতিক্রিয়া দিচ্ছি অর্থাৎ যাকে বলে ওভাররিঅ্যাক্ট করছি?

আমি অবশ্য মনে করি, ভয় পাওয়ার কারণ অবশ্যই আছে। তবে সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে একটি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা বলেই শুরু করি। সম্প্রতি একটি বিশেষ কাজে চন্দননগর গিয়েছিলাম, সেখান থেকে আমারই এক তরুণ বন্ধুর সাথে ট্রেনে বসে গল্প করতে করতে হাওড়া ফিরছিলাম৷ সিরিয়াস কোনও আলোচনা নয়, এমনিই ঠাট্টা-ইয়ার্কি, হাসি-মশকরা করছিলাম। ঠিক সেই সময়, আমাদের পাশে বসা আরেকটি ছেলে, তাঁকে ছেলেটিই বলছি… কারণ তাঁর বয়স বোধকরি বছর পঁয়ত্রিশের বেশি নয়, সুদর্শন, কথাবার্তায় বোঝা যায় সুশিক্ষিতও, সে হঠাৎ বলে উঠল— “আচ্ছা, আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, এই যে চারপাশে যা ঘটছে, তা সম্ভবত আপনাদের পছন্দ হচ্ছে না… আপনাদের ঠিক মনে হচ্ছে না… তাই না?” আমি একটু অবাকই হলাম। তাকে প্রশ্ন করলাম, এইসব বলতে সে ঠিক কী বোঝাচ্ছে৷

–“হ্যাঁ, মানে এইসব বলতে এই এনআরসি, সিএএ…!”
–“অবশ্যই। শুধু আমি কেন, কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের লোকই এইসব পছন্দ করছে বলে তো মনে হয় না।”
–“ঠিক এইখানেই কথা! আপনারা কিছু বলার আগে একটু ভালো করে জানুন ব্যাপারটা কী হচ্ছে। আপনারা কি এ বিষয়ে যথেষ্ট পড়াশুনো করে কথাগুলো বলছেন?”

এই থেকেই নানান তর্ক উঠে পড়ল। তর্কের একটা পর্যায়ে এসে আমি তাকে বললাম আমরা যদি এই পুরো বিষয়টিকে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে না বসাই, তাহলে কেউই হয়তো যথেষ্ট গভীরে গিয়ে বিষয়টির তাৎপর্য অনুভব করতে পারব না। এবং এক্ষেত্রে সেই ইতিহাসের সূত্র হলেন সাভারকর। সাভারকার বলেছিলেন যে এই দেশে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে তিনি নিজেকে নাস্তিক বলতেন, ধর্মের পথে হাঁটতেন না, তিনি তাঁর কথাবার্তায় বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন, প্রাচীনকালে হিন্দুদের সমাজে কী কী ভুলভ্রান্তি হয়েছিল, তিনি তা নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছেন, অথচ আশ্চর্যজনকভাবে, এই তিনিই রাষ্ট্রটাকে একটি হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার করার কথা বলেছিলেন। পাশাপাশি তিনি হিন্দুদের সংজ্ঞা দিচ্ছেন এইভাবে, যাদের পুণ্যভূমি এই ভারতবর্ষ তারাই প্রকৃত হিন্দু। সোজা বাংলায় বললে, মুসলিমরা প্রকৃত অর্থে ভারতীয় নয়, খ্রিস্টানরা তো নয়ই। খ্রিস্টানদের সংখ্যা এদেশে নগণ্য, অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে ভয় পাওয়ানোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুরাষ্ট্রের ভিত্তি। স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতে এই কথাগুলো এতদিন তাত্ত্বিক ধুম্রজালের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল, অবশ্য হ্যাঁ.. কখনও কখনও আমরা দেখেছি একদল লুম্পেন এসে বাবরি মসজিদ ভেঙে দিয়েছে, কখনও আমরা দেখলাম যে গুজরাটে বেছে বেছে মুসলমান নিধন করা হল, কিন্তু তারপর আবার যেন ধীরে ধীরে একটা প্রগতিশীলতা ও মূলস্রোতের দিকে ফিরে আসার একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে… এরকমটাই চলছিল। কিন্তু এইবার, এই ২০১৯ সালে পৌঁছে আমরা দেখলাম, এই সমস্ত লক্ষণ ও উপসর্গগুলি যেন একটা পরিণতির দিকে, একটা culmination-এর দিকে চলে যাচ্ছে… যে হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হবেই… come what may। তাতে কে কী বলল, কে মরল, কে বাঁচল, দেশের অর্থনীতির হাল কী হল, কারও কিচ্ছু জানার দরকার নেই, কারও কিছু যায় আসে না… শুধু ওই এক সিঙ্গল-পয়েন্ট অ্যাজেন্ডা… হিন্দুরাষ্ট্র যার কথা সাভারকর বলে গিয়েছিলেন, আজ সেই হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার দিন এসে গেছে। এমনকি মাত্র কদিন আগে সুপ্রিম কোর্টেও অযোধ্যার রামমন্দিরের স্বপক্ষে রায় বের করে নেওয়া গেছে৷ এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, সেদিন ট্রেনে ছেলেটির সঙ্গে ঠিক এই ইস্যুতেও জোর বিতর্ক হয়েছিল। সেই ছেলেটি বলছিল, “সুপ্রিম কোর্ট, দেশের সবচেয়ে বড় সাংবিধানিক অথরিটি, তাকে তো আপনাকে মানতে হবে।” “হ্যাঁ, আমি তো তাকে মানছি। এবং মানছি বলেই সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে আমি ব্যথিত। কারণ এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি ভারতের সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।” আমি তাঁকে আরও বললাম, সংবিধান লঙ্ঘন করার কথা বলা হচ্ছে এই কারণে, যে সুপ্রিম কোর্ট একদিকে স্বীকার করে নিচ্ছেন যারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে তারা অন্যায় করেছে, কাজটা চরম অপরাধ, পরক্ষণেই আবার অপরাধীদের পক্ষেই রায় দিচ্ছেন, একই নিঃশ্বাসে সেই অপরাধী পক্ষের হাতেই ওখানকার মালিকানা তুলে দিচ্ছেন এবং তাদের ওইস্থানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিচ্ছেন। এর স্বপক্ষে যুক্তি কী? না এখানেই ভগবান রাম জন্মেছিলেন, এটা নাকি দেশের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের বিশ্বাস। তাহলে কী দেখলাম আমরা? আমরা দেখলাম, দেশের যারা মেজরিটি, যেহেতু তারা বিশ্বাস করে যে অযোধ্যার ওই ঘটনাস্থলের তলায় একটা মন্দির ছিল, যার কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। অর্থাৎ যে সুপ্রিম কোর্ট ন্যায়নীতির কথা বলে, সংবিধানের কথা বলে, হিংসা পরিহার করে, এ ক্ষেত্রে সেসবের পরোয়া না করে, খোদ সর্বোচ্চ আদালতকে দিয়েই শিলমোহর মারিয়ে এটা দেখিয়ে দেওয়া গেল যে ভারতের সংবিধানও যদি হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের পথে বাধা হয়ে আসে, তবে সে বাধাও অতিক্রম করার মতো ক্ষমতা এরা অর্জন করে ফেলেছে। এটা কি ভয় দেখানো নয়? আর এনআরসি বা সিএএ প্রসঙ্গে একটা কথা বারবার বলার চেষ্টা হচ্ছে, এর ফলে ভারতীয় মুসলিমদের কোনও সমস্যা হবে না। বারবার এভাবে বলাটাও বেশ সন্দেহজনক, ঠিক যেমন আমাদের সেই প্রবাদটা— ‘ঠাকুরঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি’র মতো শোনাচ্ছে। কেন, বারবার আলাদা করে ‘মুসলমানদের কোনও ভয় নেই’ একথাটা বলতে হচ্ছে কেন? আজকের কাগজেই তো দেখলাম, সরকারপক্ষের একজন নেতা-মন্ত্রী খোলাখুলি বলছেন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে মুসলিম ব্যাতীত অন্য ধর্মের মানুষজন এলে তাদের আশ্রয় দেওয়া হবে, কিন্তু যদি কোনও মুসলিম এদেশে আসে তাহলে তাকে নিয়ে ওদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তার মানে এই প্রত্যেকটা জিনিসকে আমি যদি এককথায় নামিয়ে আনি, এটা হচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলমানকে ভয় দেখানোর একটা ব্যাপক বর্ণাঢ্য কর্মসূচি। যে ভয়টা এতদিন শুধুমাত্র রাজনীতির দিক থেকে ছিল, এখন আইনও সেই ভাষায় কথা বলতে শুরু করল।

এই যে দেশজুড়ে একটা ভয়ের আবহ তৈরি হল, এবং এতে করে দাঁড়াল এই জিনিসটা, যে মুসলমানদের তো ভয় পাওয়ানো হচ্ছেই, এছাড়াও যারা এই জিনিসটা মেনে নিচ্ছেন না, যারা মনে করছেন বর্তমান সরকারের এই মতাদর্শ দ্বারা আমাদের সংবিধানের মূল নীতি লঙঘন করা হচ্ছে, মানবিকতার উল্লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তাদেরও ভয় দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ এটা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, আমরা যা বলছি তা যদি বিনা প্রশ্নে, অক্ষরে অক্ষরে মেনে না নেওয়া হয়, একটা সময়ের পর আপনাদের ওপর আঘাত আসবে। আপনি একজন আর্বান নকশাল হিসেবে চিহ্নিত হবেন। রামচন্দ্র গুহ-র মতো একজন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, তাঁকে অবধি টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তা তিনি কী বলেছেন? তিনি শুধু এইটুকু কথা বলেছেন, চারপাশে যা হচ্ছে তা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের লক্ষণ নয়, তা একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের লক্ষণ। এই সাধারণ কথাটা বলার জন্য রামচন্দ্রের মতো একজন অ্যাকাডেমিকের যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে তো আমরা যারা সাধারণ নাগরিক, যাদের রামচন্দ্র গুহ-র মতো গ্ল্যামার নেই, মাথার পেছনের হেলো-টা নেই, এমন অগণিত মানুষ যারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন, তাদের সঙ্গে কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। তাদের তো রীতিমতো রাস্তায় ফেলে পেটানো হবে, ধরে জেলে নিয়ে যাওয়া হবে, উত্তরপ্রদেশে যেমন হচ্ছে। তার মানে ব্যাপারটা এসে দাঁড়াচ্ছে এই জায়গায়, যে তোমরা যদি আমাদের এই কর্মসূচির সঙ্গে সম্পূর্ণ অর্থাৎ শতকরা একশো ভাগ, নিরানব্বই ভাগও নয়, সহমত না হও, তাহলে তোমাদের জন্য খুব দুর্দিন আসছে। এই কথাটা খুব পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আইনের দিক থেকে, রাজনীতির দিক থেকে, প্রচারমাধ্যমের দিক থেকে, শিক্ষাক্ষেত্রে, যে যেখানে এতটুকু dissent দেখাচ্ছেন (অন্য যে শব্দটা, decent,  সেটা তো দেশ থেকে উঠেই গেছে, শুধু dissent-টাই টিঁকে আছে), তাদের পুরোপুরি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে আমাদের পুরোপুরি সমর্থন না করলে তোমরা বাঁচতে পারবে না।

এই ভয়ের আবহটা তো তৈরি করে দেওয়া হয়েছেই, এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার তেমন কোনও লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি, এর ভালো দিক যেটা, সেই যে মাও সে তুং-এর কথাটা, যেখানেই অত্যাচার, সেখানেই প্রতিরোধ, ঠিক সেভাবেই আজ এই ইস্যুটাকে কেন্দ্র করে যেভাবে সাধারণ মানুষ, ছাত্রসমাজ একজোট হয়েছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন, পথে নেমে প্রতিবাদ করছেন, এটাও মস্ত বড় একটা জিনিস। কিন্তু তার ফলে, ও পক্ষ, যারা ভয়টা চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তারা যে কিছুটা পিছিয়ে এসেছেন এমন তো কোনও লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। তার মানে সারা দেশে এতগুলো লোক একজোট হয়ে যে প্রতিবাদটা করছে, সেটাও তারা খুব একটা পরোয়া করেন না৷ অর্থাৎ এর পেছনে একটা গায়ের জোরের ব্যাপার রয়েছে, যা এরা দেখিয়েই চলেছেন। মাঝখান থেকে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী সেদিন বললেন যে ২০১৪-র পর থেকে এনআরসি নিয়ে নাকি মন্ত্রীসভায় কোনও আলোচনা হয়নি। ডাহা মিথ্যে। সংসদে দাঁড়িয়ে খোদ অমিত শাহ সারা দেশের এনআরসি কার্যকর করার কথা ঘোষণা করেছেন। ২০১৯-এই প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ভাষণে ‘উইপোকা’ ‘ঘুষপেটিয়া’ প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। আজ যে তাঁরা সত্যিই এই ইস্যুতে পিছু হটলেন, তার লিখিত প্রমাণ কই? এনআরসি-র প্রথম ধাপ যে এনপিআর বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার, সেটা তো এখন দেশের বহু রাজ্যে চালু আছে। আসলে প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এইসব বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে সাধারণ মানুষের মনে ভয় ও অনিশ্চয়তার আবহটাই আরও জোরদার করছেন। এই বিভ্রান্তিমূলক অস্বচ্ছ কথাবার্তার জন্য, কথা ও কাজের অমিলের জন্যেই সরকারকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। অথচ কোনওরকম অস্বস্তিকর প্রশ্ন করলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উত্তর না দিয়ে ঘুরিয়ে বলছেন, সরকারের উপর ভরসা রাখুন। আসলে এখানে শ্রী শাহ ঠিক মানুষের ভরসা চাইছেন না, সম্মতি চাইছেন। সুকুমার রায়ের সেই ছড়াটির মতো বলতে চাইছেন, ‘ভয় পেও না, ভয় পেও না, তোমায় আমি মারব না’৷ অথচ, পরক্ষণেই চোখ পাকিয়ে কামড়ে দেবেন বলে ভয় দেখাচ্ছেন। এই ভয়টাই সরকারের আসল চেহারা।

সেদিন বই-চিত্র-এ একটি অনুষ্ঠানে বন্ধুবর চন্দন চ্যাটার্জির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ওঁদের দিল্লিতে বাঙালিদের নিয়ে একটি সংগঠন রয়েছে। চন্দন বলছিলেন, তিনি নিজে অসমে গিয়ে দেখে এসেছেন, ওখানে বাঙালিদের ওপর কী অমানুষিক অত্যাচার নামিয়ে আনা হয়েছে। অজস্র ডকুমেন্ট যদি একজনের কাছে না থাকে, তাহলে সে যেকোনও মুহূর্তে বিপদের পড়ে যেতে পারে— এইরকম একটা ভয়ের আবহে সেখানকার বাঙালিকে প্রতিনিয়ত বাঁচতে হচ্ছে।

পাশাপাশি, আরেকটা প্রতিযুক্তি তোলার চেষ্টা হচ্ছে৷ যারা সরকারের নীতির সমর্থন করছেন, তারা বলছেন, ওদেশ থেকে মুসলিমরা আসতে যাবে কেন? আর এলেই বা আমরা তাদের গ্রহণ করবই বা কেন? বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রধানত ইসলামি রাষ্ট্র, ওখানকার হিন্দুরা অত্যাচারিতরা হয়ে এলে বরং আশ্রয় দেওয়ার দরকার আছে৷ এর উত্তরে একটা কথাই বলবার, যে ইতিহাসকে বাদ দিয়ে কি কোনও কিছু বিচার করা যায়? আর আপনারা বলছেন, এইটা বাংলাদেশ, এটা পাকিস্তান, আর এটা ভারতবর্ষ, কিন্তু আসলে এটা তো ভারতীয় উপমহাদেশ, একটা সময়ে যা অখণ্ড ছিল। সেদিন ব্রিটিশরা যে খেলাটা খেলে গেল, আমরা স্বাধীনতার এতদিন পর সেই নোংরা খেলাটাই চালিয়ে যাচ্ছি। নানারকম যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি যে দেশটা আসলে একসময় একটাই দেশ ছিল। কোনও এক সকালে নিজেদের ক্ষমতার পিঠে ভাগ করতে গিয়ে নেতারা দেশটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলেন, সাধারণ মানুষেরা কী চায় তা জানার কোনও চেষ্টা না করেই। এই যে ধর্মের ভিত্তিতে দেশটা ভাগ করা হল, দেখা গেল যে সেটা টেঁকে না, টিঁকলে পাকিস্তানকে আর ভেঙে দু-টুকরো হতে হত না। তাই ধর্মের ওপর ভিত্তি করে একজন মানুষ নাগরিক না বেনাগরিক, দেশি না বিদেশি, এই বিচারধারাটা আমাদের বর্জন করতে হবে৷ ইতিহাসে প্রমাণিত যে এটা সম্ভব নয়। আর সেইজন্যই একটা ভুল জিনিসকে, একটা মিথ্যে জিনিসকে যদি গায়ের জোরে চাপাতে হয়, তাহলে একটা ভয়ের আবহ তৈরি করতেই হবে৷ এখন ঠিক তাই হচ্ছে।

এখানে আরও একটা কথা আছে। দেশভাগের সময় যে মুসলমানেরা দ্বিজাতিতত্ত্ব মানলেন না, এ দেশের মানুষকে বিশ্বাস করে যারা এদেশেই থেকে গেলেন, এতদিন পর বিজেপি সরকার তাদের মনের মধ্যে ভয় ঢোকাতে শুরু করল, যে তারা শুধুমাত্র মুসলমান বলেই অন্যদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত। বিদেশ থেকে যিনি আসছেন, তাকে আমরা বিদেশি বলে না ডেকে হিন্দু বা মুসলিম বলে ডাকছি। অর্থাৎ তৎক্ষণাৎ আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছি, এ দেশে যে সংখ্যালঘুরা আবহমানকাল ধরে আছেন, তাদেরকে আমরা কিছুটা অন্যচোখে দেখছি। এরা ঠিক ভারতীয় নয়, এরা যেন ভারতীয়দের মধ্যে একটি বিশেষ সম্প্রদায়, যাদের আমরা আলাদা করে সনাক্ত করে রেখেছি। এই কথাটা হয়ত এত স্পষ্ট করে আজ বলা হচ্ছে না, কারণ মোদি-শাহরা তো ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে, এই কথাগুলো হয়তো আজ থেকে দু-বছর পর বলা হবে। ওরা একটা একটা করে হার্ডল টপকে টপকে এগোচ্ছেন। যেমন, সুপ্রিম কোর্ট আজ বাবরি মসজিদ নিয়ে যে রায় দিয়েছেন, সেটা কি আমরা কোনওদিন কল্পনা করতে পেরেছিলাম যে এ জিনিস সম্ভব হবে? ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াল যে, যারা ভেঙে দিল তাদেরই হাতে একটা উপহার তুলে দেওয়া হল। তারপরে বলা হচ্ছে, দেখো, আমরা কত মহৎ যে মুসলিমদেরও দু-এক একর জমি দিচ্ছি। এটা খুব আশ্চর্যের যে এরপরেও ভারতবর্ষের মুসলমানরা কিন্তু বিদ্রোহ করেননি, তারা কী অসামান্য পরিণতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন যে তারা বুঝেছেন যে এর পেছনে এমন একটা নোংরা জিনিস কাজ করছে যে একে প্রশ্রয় দিলে আখেরে ভারতবর্ষেরই ক্ষতি হবে। তাদের ওপর যে এত বড় একখানা অবিচার হল, তা সত্ত্বেও তারা কোনও দাঙ্গাহাঙ্গামা করেননি, কেউ কেউ অন্যভাবে প্রতিবাদ করেছেন, সে তো আমাদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে দেশের মুসলিম সমাজের এই বিচক্ষণতা কী একটা আশ্চর্যের বিষয় নয়?

পক্ষান্তরে, আমরা কী করছি! আমরা সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের স্বরে বলছি, দেখো বাবা, আমরা মাথা গুণতিতে অনেক, তোমরা কম, অর্থাৎ বেশি ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই করতে যেও না, মাথা ফাটিয়ে দেব, সোজা বাংলায় এরকম বার্তা-ই কি আমরা দিচ্ছি না? আরেকটা সমস্যার কথাও খুব কুৎসিত আকারে উঠে আসছে। বলার চেষ্টা হচ্ছে, হ্যাঁ বিজেপি দলটা হয়তো বা সাম্প্রদায়িক, কিন্তু সিএএ, নির্দিষ্টভাবে এই ধারাটা মোটেই সাম্প্রদায়িক নয়। কারণ এই আইনটার ফলে হিন্দুদের মধ্যে যারা তথাকথিত নিম্নবর্গ তাদের একদল লাভবান হবে। অর্থাৎ হিন্দুদের মধ্যে যারা দলিত যেমন নমঃশূদ্র বা মতুয়া সম্প্রদায়, সিএএ তাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে। এর ফলে কী হল, হিন্দু নিম্নবর্গ ও মুসলমান, এই দুইয়ের মধ্যে একটা চমৎকার ভেদরেখা তৈরি করে দেওয়া গেল। এবং কেউ কেউ ইতিমধ্যে সেই টোপটা গিলে বসে আছেন৷ অর্থাৎ বিভাজনের রাজনীতিকে একটা চরম জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিরোধ, হিন্দুদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ, এবং হিন্দু দলিত ও মুসলমান নিম্নবর্ণের মধ্যেকার বিরোধ। এইবার, একটা রাষ্ট্র যদি এতগুলো বিরোধ নিয়ে চলতে চায়, তাহলে তার হাতে তো ভয় দেখানো ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। তাই ভয়ের আবহটা তারা এমনভাবে তৈরি করেছে। তাছাড়া সেই ভয়টা টপকে এদের রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করা যাবে, সেই লক্ষণটা কিন্তু এখনও নেই।

যদিও প্রতিবাদের স্বর দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-এই ছটা রাজ্যে বিজেপি সরকারের পতন হয়েছে। বিজেপির শেষের ঘণ্টা মৃদুস্বরে হলেও বাজতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতির মধ্যে দিয়ে এই যে পাঁচ বছর অন্তর সরকারের পরিবর্তন হয়, তাতে আসল জিনিসটা কি সত্যিই বদলাচ্ছে? কারণ হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিটা বিজেপি-আরএসএস যে মাত্রায় করছে তা অভূতপূর্ব হলেও, এই রাজনীতি যে আগে কখনও আমাদের দেশে হয়নি, তা তো নয়। বাবরি মসজিদ নিয়ে এই খেলাটা তো কংগ্রেস আমলেই শুরু হয়েছে। বাবরি মসজিদের বিতর্কের তালা খুলেছেন রাজীব গান্ধি। বাবরি মসজিদ যখন ভাঙা হচ্ছে, তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও, অর্থাৎ তখনও দেশের মাথায় কংগ্রেস সরকার। তাই গভীরভাবে দেখলে, সকল রাজনৈতিক দল বাদ দিয়েও এর একটা শ্রেণিগত ব্যাখ্যা আছে, যেখানে এদেশের উচ্চবর্ণ হিন্দুরা দেশটাকে শুধুমাত্র নিজেদের দেশ বলে মনে করছে, এবং যে রাজনৈতিক দলই সরকার তৈরি করুক না কেন, দু হাতে পুঁজিপতিদের কাছে দেশটাকে বিক্রি করে দিচ্ছে, ঋণ দিচ্ছে, কর ছাড় দিচ্ছে, নানারকম সুযোগসুবিধে দিচ্ছে৷ আজকে পুঁজিপতিরা দেখছেন যে তারা নিজেরা হিন্দু হোন বা না হোন, হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির কারবারিদের যদি তারা সমর্থন করেন, তাহলে আখেরে তাদেরই লাভ এবং এ দেশে বেশ আরামে থাকা যাবে। ফলে, এইভাবে ধর্মীয় বিভাজনের ইস্যুর দিকে সাধারণ মানুষকে ব্যস্ত রেখে রাজনীতিবিদ ও পুঁজিপতিরা দেশটার বিপুল সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিচ্ছেন৷ বিনিময়ে হিন্দুত্ববাদীরা পুঁজিপতিদের অর্থের একটা বিপুল শক্তিকে নিজেদের পাশে পেয়ে যাচ্ছেন, এটা তাদের জন্যও একটা বড় লাভ। ফলে সমস্যাটা যে সেই চিরকেলে হ্যাভস আর হ্যাভ-নটসদের সমস্যা, সেটাকে সাফল্যের সঙ্গে হিন্দু বনাম মুসলিম ইস্যুতে বদলে দেওয়া যাচ্ছে। তাই খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমরা আজ লক্ষ না করে পারছি না, প্রতিবাদের সামনের সারিতে ছাত্ররা আসছেন ঠিকই, কিন্তু শ্রমিক বা কৃষকেরা কি সেভাবে আসছেন? কেন আসছেন না? আসছেন না তার কারণ হয়তো তাদের মধ্যে কোথাও একটা বিভ্রান্তির বীজ রোপন করা গেছে, বিশেষ করে, আমার ধারণা কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে। কৃষকরা যেহেতু মাটির অনেক কাছাকাছি, তারা ধর্মেরও অনেক কাছাকাছি। এ হিন্দু, এ মুসলিম, এ অচ্ছুৎ– এই ভাবনাটা তাদের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া গেছে, প্রতিবাদটা তাই হয়তো ততখানি আসছে না তাদের কাছ থেকে। এবং প্রতিবাদ ওই স্তর থেকে না উঠে এলে কিন্তু এই শাসকের মতাদর্শকে প্রকৃতপক্ষে হটানো যাবে না। ছাত্রেরা এগিয়ে এসেছেন, বুদ্ধিজীবীরা এগিয়ে এসেছেন, বড় আনন্দের কথা, সাহসের কথা, কিন্তু শ্রমজীবীদের আমরা টেনে আনতে পারছি কি? পারছি না কেন? এই যে দেশজুড়ে যে ভয়ের আবহটা তৈরি করা হয়েছে, সেটাকে রুখতে হলে, যারা ভয় দেখাচ্ছেন, ভয়টা তাদেরকেই ফেরত দিতে হলে, দেশের শ্রমজীবী মানুষদের একটা বড় অংশকে আমাদের বিরোধিতার পাশে পেতে হবে৷ যতদিন সেটা না হচ্ছে, ধর্মীয় বিভাজনের এই ন্যারেটিভকে শুধুমাত্র সংসদীয় রাজনীতি ও সরকার বদলের সমীকরণ দিয়ে পরাজিত করা যাবে না৷