Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দুটি অণুগল্প

অরিন্দম রায়চৌধুরী

 

বর্ণপরিচয়

মলিনামাসির কাছে আজকের রাতের টাকাটা জমা করল রজত। রশ্মির ঘরে যাওয়ার জন্য উপরের তলার সিঁড়িতে পা রাখতেই মাসি পিছন থেকে ডাক দিল— ‘বাচ্চাটা জ্বালাচ্ছে না তো বাবু! ঘুমোয় তো ঠিকঠাক?’ রজত স্মিত হাসিতে ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিল সমস্ত পরিস্থিতিই অনুকূলে।

দরজায় দু’টো টোকা। রশ্মির চেনা আওয়াজ দরজা খুলতে সময় নিল মাত্র ক’টা সেকেন্ড।

ঘরে ঢুকেই রজত লাফিয়ে পড়ল সোজা বিছানায়। দেড় বছরের ছেলেটাকে ঘুম থেকে তুলে খেলাধুলা-গল্পগুজবে মেতে থাকল কিছুক্ষণ। একটা সন্তান অ্যাডপ্টের বিষয় নিয়ে বউয়ের সাথে প্রতিদিনকার ঝগড়াঝাঁটিকে তখন যেন অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে সে।

আচমকা চোখ গেল রশ্মির দিকে। আজ ওর বড় শান্ত সাজ। হাল্কা সবুজ রঙের একটা শাড়ি। কপালে একটা ছোট কালো টিপ। ব্যাস!

‘কীরে! টিউবটা নেবা এবার!’– পরম তৃপ্তির হাসি নিয়ে অনুরোধ জানাল রজত।

অন্ধকার ঘরে ছেলে আবার ঘুমিয়ে কাদা। মেঝেতে মাদুর পাতা। হ্যারিকেনের আলোর সামনে ওরা দু’জন। আর ক’টা বইখাতা। রজত ধমকের সুরে বলল— ‘এতদিনে এটুকুও যদি মনে না রাখতে পারিস ছেলেটাকে শেখাবি কী?’

 

শেষ থেকে শুরু

মায়ের এখনকার অবস্থা দেখে ঠিক মনে হচ্ছে যেন, চুরির দায়ে ধরা পড়েছে! অস্বাভাবিক রকমের ঘামছে। মুখে প্রায় কোনও কথা নেই। হাতের মুঠোয় বইটা এমন করে নিয়েছে, যেন এখুনি ছিঁড়ে ফেলবে ক’টা পাতা।

–কী হল মা! বইটা দাও শিগগিরি। স্ক্রিপ্টটা রেডি করে ফেলি। দেরি হলে স্যার কিন্তু খুব বকবেন।

আমার কলেজের বাংলা অনার্সের স্যার ডঃ কুন্তল দত্ত। ছোটমামার ক্লাসমেট। যদিও এখনও পর্যন্ত মামার কথা স্যারকে বলে উঠতে পারিনি আমি।

ডিপার্টমেন্টের একটা ছোট অনুষ্ঠানে স্যারের ইচ্ছে ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টদের দিয়ে ‘শেষের কবিতা’-র নির্বাচিত অংশ পাঠ করাবেন। আর এই নির্বাচনের দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর। গতকালই স্যার উপন্যাসের বইটা আমাকে দিয়ে বললেন— ‘রবিবারের মধ্যে সব রেডি করে ফেলো দেখি। সোমবার থেকে রিহার্সাল শুরু করব। আর তো বেশি সময় নেই।’

আজ সকাল থেকে সে বই-এর খোঁজ করে অবশেষে মায়ের ঘরে এসে দেখি– এই কাণ্ড!

–কী গো মা। বইটা দেবে তো! নাকি!

থতমত খেয়ে কোনওরকমে বইটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে মা রান্নাঘরের দিকে প্রায় দৌড়ই দিল।

পড়ার ঘরে বইয়ের প্রথম পাতা খুলতেই দেখি তুলির টানে বেশ নক্সা করে লেখা–

কুন্তলদা, তোমার জন্মদিনে সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিলাম।

ইন্দ্রাণী, ২৮/৪/১৯৮২

মনটা এবার খানিক অবাধ্য হতে চাইল।

জোর করে শাসন করলাম– ধুত্! আমার মা ছাড়া ইন্দ্রাণী নামের আর কেউ যেন এ পৃথিবীতে নেই!