Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘ক্রোধ’ ও প্রতিরোধ: সাম্প্রতিক বিজেপি রাষ্ট্র

অভিষেক ঝা

 




লেখক গদ্যকার এবং অনুবাদক। পেশায় শিক্ষক।

 

 

 

 

যে কথাটি মেনে নিতে ভারতের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের খুব অসুবিধা হয় তা হল এই সময়ের ভারতের বিজেপি নামক দলটি এবং বিজেপি নামক রাষ্ট্রটি (যা সাংবিধানিকভাবে ভারতীয় রাষ্ট্র বলেও এখনও অবধি পরিচিত) মোটেও বোকা এবং উদগাণ্ডু নয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই অগস্ট পরবর্তী ভারতবর্ষে ‘শিক্ষা’ ব্যবস্থায় চাষ থেকে শুরু করে ন্যানো প্রযুক্তি অবধি পরিসর কম শক্তিশালী থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী হওয়ার ভিত্তিগত আদর্শের উপরেই এখনও অবধি প্রতিষ্ঠিত। এই শক্তিশালীতর হয়ে ওঠার সুপ্ত ইচ্ছের জন্যই যেকোনও পরিসরের ‘শিক্ষা’ই একজন ভারতীয়কে কমবেশি অহংবোধ দেয়। সেই অহংবোধ ‘শিক্ষিত’ ভারতীয়কে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী একটি বড় অংশের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এই বিচ্ছিন্নতা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা নয়। এই বিচ্ছিন্নতা রুচিগত এবং বোধগতও। সর্বোপরি এই বিচ্ছিন্নতা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী একটি বড় অংশের ভারতীয়কে একটি অস্বাভাবিক হীনম্মন্যতা বোধ দেয় যা আস্তে আস্তে এই অংশের ‘স্বভাবজাত’ হয়ে ওঠে। এই ‘স্বভাবজাত’ হীনম্মন্যতার কারণে দেওয়াল উঠে যায় দুই শ্রেণির ভিতর। হীনম্মন্যতা বোধে ভুগতে থাকা অগণিত মানুষের ভারতীয় শ্রেণিটিকে, খুব অল্প সংখ্যক মানুষের ভারতীয় ‘শিক্ষিত’ শ্রেণিটি নিজেদের জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে বিবিধভাবে হেয় করে চলেছে একটি বিশাল কালখণ্ড জুড়েই। সেই হেয় করার পরিসরও বিস্তৃত বিবিধ স্তরে। খাদ্যাভ্যাস, পোশাকরুচি, পাঠরুচি, সিনেমারুচি, সঙ্গীতরুচি, অবকাশযাপনরুচি, হুল্লোড়রুচি সমস্ত কিছুতেই ক্রমাগতভাবে হেয় হয়ে চলা এই শ্রেণিটিকে ‘শিক্ষিত’ শ্রেণির বিপ্রতীপে নিয়ে আসে। ‘শিক্ষিত’ শ্রেণির দাপট ও ক্ষমতার (অপ)ব্যবহার বিপ্রতীপে থাকা ‘শিক্ষিত-নয়’ মানুষগুলিকে ক্রমশ কাছে এনে একটি বিপুল শক্তিশালী শ্রেণির জন্ম দেয় যাকে স্পষ্ট একটি হিংস্র মৌলবাদী অভিমুখে চালিত করতে পারা বিজেপি দল ও বিজেপি সরকারের সাফল্য। ‘শিক্ষা’কে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী শ্রেণির কাছে ‘অপর’ করে তোলায় বিজেপির তরফ থেকে বিজেপির সবচেয়ে বড় সাফল্য। আরও বড় সাফল্য আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে খুব নির্দিষ্ট ধরনের কিছু মানুষকে ‘শিক্ষিত বিপজ্জনক’ বলে চিহ্নিত করে ‘অপর’ করে তোলা এবং তাদের বিপজ্জনক বলে দাগিয়ে ‘শিক্ষিত’ ভারতীয় পরিচিত নয় এমন হিংস্র ধরনের আক্রমণ দিয়ে সেই মানুষদের ধ্বংস করতে চাওয়া। প্যারাডক্স এখানেই যে এই ‘খুব নির্দিষ্ট ধরন’টি ভারতবর্ষের ‘শিক্ষিত’ শ্রেণির ‘নির্দিষ্ট ধরন’-এর ধারণা ভাঙতে ভাঙতে এগোচ্ছে বলেই বিজেপি সরকারের এদের এত বিপজ্জনক ঠেকছে। উদাহরণ দিলে আরও একটু খোলসা করা যাবে। বিজেপির কাছে একজন ‘শিক্ষিত’ মানুষ নিজের ‘শিক্ষা’র পরিসরে থাকলে ততটা বিপজ্জনক নয় যতটা বিপজ্জনক ‘দলিত হিন্দু’ পরিসর অতিক্রম করে জামা মসজিদে প্রতিরোধের মুখ হয়ে ওঠা চন্দ্রশেখর আজাদ। ‘ইতিহাস চর্চা’র গভীরে নিমগ্ন থাকা ইরফান হাবিবের চেয়ে বিজেপির কাছে বেশি বিপজ্জনক বিরাশি বছরের প্রতিরোধ করা এক শিক্ষিত বৃদ্ধ। ‘দীপিকা পাড়ুকোন’-এর চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিরোধে উপস্থিত হওয়া বলিউডের হিরোইন। এই সমস্ত টুকরোটাকরা দেখাচ্ছে যে ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতে একটি বড় পরিসরে ‘শিক্ষিত’ শ্রেণির গণ্ডি ও সীমারেখা খানখান করে শিক্ষিত একটি প্রতিরোধের জন্ম হচ্ছে।

ভারতীয় ‘শিক্ষিত’ শ্রেণি গড়পড়তা যে প্রতিরোধ করে, সেই প্রতিরোধের শরীরী ভাষায় ‘ক্রোধ’কে প্রশমিত করে ‘যন্ত্রণা’কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। ‘যন্ত্রণা’ দ্রুত অসহায়তা প্রকাশ করতে পারে বলে সহানুভূতি আদায় করতে ‘যন্ত্রণা’কে একটি পরীক্ষিত কার্যকরী অনুভূতি বলেই মনে করে ভারতীয় ‘শিক্ষিত’ শ্রেণি। মজার ব্যাপার হল এই যে, বিজেপির কাছে এই ‘যন্ত্রণা’র অনুভূতির প্রকাশ যে বস্তুত বিজেপিকেই আরও শক্তিশালী করে তুলবে, তা বুঝতে ‘শিক্ষিত’ ভারতীয়রা না পারলেও, বা না চাইলেও; ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ কিন্তু বুঝতে পারছেন। খেয়াল করে দেখবেন প্রতিটি প্রতিরোধের শরীরী ভাষায়, স্লোগানিং-এ, এবং বিজেপি সরকারের মেশিনারির বিরোধিতায় আস্তে আস্তে ‘যন্ত্রণা’র চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মোটিফ হয়ে উঠছে ‘ক্রোধ’। ‘অহমিয়া জাতিবাদ’ বাঙালির পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক হলেও, এই কথা অনস্বীকার্য যে ‘ক্রোধ’কে ব্যবহার করে বিজেপি রাষ্ট্রকে প্রতিরোধের সফল উপায়ের প্রাথমিক আগুনটি জ্বালিয়েছেন অহমিয়া ছাত্রছাত্রীরাই সিএএ-র প্রেক্ষিত থেকে। খেয়াল করে দেখুন সেই একই আইনের ঠিক বিপ্রতীপ অবস্থানে থেকে ‘ক্রোধ’ দিয়ে নিজেদের প্রতিরোধের মেজাজ ঠিক করে জামিয়া ও আলিগড়। ঠিক কতখানি ভয় পেলে বিজেপি রাষ্ট্র বাধ্য হয় লাইব্রেরিতে গুলি চালাতে! ঠিক কতখানি ভয় পেলে বিজেপি রাষ্ট্র বাধ্য হয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিআরপিএফ নামাতে! ঠিক কতখানি ভয় পেলে বিজেপি রাষ্ট্র বাধ্য হয় মুখ ঢাকা গুণ্ডা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল ভাঙচুর করে ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের রক্তাক্ত করতে! এবার ভাবুন ঠিক কতখানি ক্রুদ্ধ হলে বিজেপি রাষ্ট্রের রেলস্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেন কিছু মানুষ! হ্যাঁ এবার স্বীকার করুন কতখানি ক্রুদ্ধ হলে বিজেপি রাষ্ট্র ও তার পূর্ববর্তী ভারতীয় রাষ্ট্রের দিকে পাথর ছুড়তে থাকেন কাশ্মিরের যুবসমাজ! দেখবেন আপনি ঠিক নিজের অনুভূতিশীল মনন দিয়ে সহানুভূতিশীল হয়ে উঠছেন বাঁচতে মরিয়া হয়ে উঠে ‘ক্রোধ’কে মোটিফ করে এগিয়ে যাওয়া সমস্ত মানবিক প্রতিরোধের প্রতি। ‘শিক্ষিত’ শ্রেণির ধারণাকে ভেঙে আপনার ‘ক্রোধ’ দিয়ে আপনি সাহায্য করছেন একটি শিক্ষিত সমাজ গড়ে তুলতে, যে সমাজ ক্রুদ্ধ সহিংস প্রতিরোধকে হিংসাত্মক অগণতান্ত্রিক ভাবার ভুল করবে না, ভারতীয় ‘শিক্ষিত’ শ্রেণি যে ভুল করে এখনও। এই সময়ের বিজেপি রাষ্ট্রে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের ‘ক্রোধ’-এর সবচেয়ে বড় অবদান এটিই।