Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিদ্রোহের সময়ে ‘দেশ’ নামক একটি মেয়েকে নিয়ে কিছু ছেঁড়া ভাবনা

সেঁজুতি দত্ত

 




লেখক প্রবন্ধকার, অধ্যাপক ও গবেষক।

 

 

এই ভারতীয় উপমহাদেশ মেয়েদের মায়ের জাত বলে এতকাল এমন উত্যক্ত করেছে যে টানা একথা শুনতে শুনতে এরা নিজেদের সন্তান থেকে পোষা কুকুর-বেড়াল, বাগানের গাছ থেকে অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ, সবেতেই বাৎসল্যরস খুঁজে পেতে শুরু করেন। যদিও এই নিয়ে মহিলারা একটা সময় অব্দি চুপচাপই ছিলেন কিন্তু বাধ সাধে স্বাধীনতার লোভ। লোভ বড় বালাই। কেউ একবার এর খপ্পরে পড়লে আর নিস্তার নাই। একদিনেরও শৃঙ্খল আর সহ্য হয় না। তদুপরি আজকাল এই লোভের দোসর হয়েছে শিক্ষা।

আজ প্রায় দেড়শ বছরেরও অধিক এদেশের মেয়েরা শিক্ষার আলো পেয়েছে। অধিকাংশের কাছেই এখন উপহারে পাওয়া পায়ের মল, বাজুবন্ধ, কণ্ঠমালা, ইত্যাদি ক্ষমতাবানের কাছে অধীনস্থ হয়ে থাকার চিহ্নস্বরূপ। তাই মাতৃস্বরূপা নারী, রূপবতী মনোহরা রমণী, ঈশ্বরী গৃহকর্ত্রী এরা সকলে তাদের অবগুণ্ঠন ধূলায় ফেলে পথে নামে নিজের জন্য, নিজের মতো বাকিদের জন্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপরের জন্যও। তারা মুক্তি চায়। কীসের মুক্তি? কী থেকে মুক্তি তা এই সমাজ বুঝে উঠতে পারে না।

কিন্তু দেহে শৃঙ্খলের চিহ্ন না থাকলে লোকে এদের চিনবে কী করে? কার কূলের বউ, কোন বাড়ির মেয়ে এইসব না জানলে সমাজ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে; পুরুষের সুখনিদ্রা ব্যহত হয়। দেহে জাত-ধর্মের চিহ্ন না থাকলে মেয়েদের আয়ত্তে আনা প্রায় অসম্ভব। এরকম নরমে গরমে বেশ চলছিল বটে ভারতবর্ষ। কিন্তু একটানা নিয়মভঙ্গ করা রাষ্ট্রের পছন্দ নয়। সমাজের প্রান্তিকে অবস্থিত মানুষদের নিয়ম ভাঙার অধিকার তো আরওই নেই। তাই একদিন রাষ্ট্র ঠিক করল যে প্রান্তিক দেহে নিয়মমাফিক পরিধান থাকতেই হবে। হিন্দু মেয়েদের আরও হিন্দু হতে হবে, চামার-মুচিকে নিজ অবস্থানে থাকতে হবে, আর মুসলমানের ঠাঁই নেই।

এই পরিস্থিতিতে ভাবি, এই যে আমরা থেকে থেকে দেশ এবং রাষ্ট্র এই দুই শব্দকে আলাদা অর্থে ব্যবহার করি সেখানে দেশ বলতেই যে নরম হয়ে যাই সেটা আসলে কেন? স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন রাষ্ট্রের কাছে দেশমাতৃকা এতটা গুরুত্বপূর্ণ একটা আইকন যেখানে পৃথিবী জুড়ে মেয়েরা মাতৃত্বের দ্বারা নিজেদের আইডেন্টিটি নির্ধারিত করতে চান না আর। চয়েস, এবং নিজের শরীরের ওপর অধিকার, এই কথাগুলো যখন এতটা গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে আসছে নারীবাদী ভাবনায়, তখন এই দেশমাতৃকার অর্থ কী?

যদি জাতীয়তাবাদীদের রেটরিক ধার করি, তাহলে দেশ আমাদের মা। আর যদি তার সঙ্গে আমাদের রোমান্টিকতা মিশিয়ে দিই তাহলে এই দেশ সুজলাং সুফলাং এক আদরের বাসস্থান। যদি জাতীয়তাবাদীদের কথা মেনে নিয়ে দেশকে নারীরূপে কল্পনা করি, আর তার সঙ্গে আমাদের নারী চিন্তাকে এক করে দিই তাহলে এই আদরের বাসস্থানের প্রতীক হল ‘দেশ’ নামক একটি মেয়ে (‘ওদের’ ভাষায় যদিও ভারতমাতা)। কিন্তু এই যে এত সহজে ওদের সঙ্গে আমাদের ভাবনাগুলোকে মিলিয়ে দিচ্ছি সেটা কি আদপেও সম্ভব? উত্তর হয়ত জানা।

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমরা এবং আমাদের ‘দেশ’ নামক মেয়েটি অবহেলিত। আমরা জানি, ভালো করেই জানি, নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণে যে সমস্ত কাগজ আমাদের কাছে চাওয়া হচ্ছে সেখানে শুধুই এদেশে জন্মানো অথবা এদেশে বেড়ে ওঠা যথেষ্ট নয়। ‘দেশ’কে তার পিতৃপরিচয়ের প্রমাণ দিতে হবে, প্রমাণ দিতে হবে কিসের ভিত্তিতে সে তার মাতা-পিতার সন্তান। এদেশের মানুষ, মাটি, জল, বায়ু তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। যে যে কাগজ আমাদের কাছে চাওয়া হচ্ছে, তার একটাও এই ‘দেশ’ নামক মেয়েটি দিতে পারবে না। কিন্তু সমস্যা হল যে ভারতমাতার কাছেও সেই কাগজ নেই, থাকতে পারে না। তবুও শুধুই (উচ্চবর্ণ হিন্দু) মা হবার জোরেই উনি নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। ওর মিলিটান্ট সন্তানেরা গায়ের জোরে ওকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেবে। আর যেহেতু সাংবিধানিকভাবে আমাদের ‘দেশ’ নামক আদরের মেয়েকে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ দেওয়া যায় না তাই জাতীয়তাবাদীরা সংবিধান বদলে দেবে; দিচ্ছেও।

ওদিকে ‘দেশ’ কোনও মেয়ের, কোনও মায়েরই অধিকার হননে বিশ্বাস করে না। তাই ‘দেশ’ সমস্ত মেয়েদের অধিকারের দাবিতে সরব হয়। সবার জন্য বাসস্থানের দাবিতে, সবার মৌলিক অধিকারের দাবিতে আমাদের ‘দেশ’ আজ ঘর থেকে বাহির, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি পথে নামছে। আজ যখন মুখোমুখি সংঘর্ষের সময় তখন প্রতিবাদী রক্তাক্ত মুখের নাম ঐশী। আজ যখন চোখে চোখ রেখে কথা বলার সময় তখন শাসকের নাকের ডগায় প্রশ্ন তোলা হিজাব পরিহিত মেয়ের উদ্ধত মধ্যমার নাম আয়েশা। আমাদের মা আজ শাহিনবাগে, আমাদের মা পার্ক সার্কাসে। মাইলের পর মাইলের ‘কিষাণ’ মার্চ-এ পথ চলা অনাবৃত রক্তাক্ত পায়ের ছবি আমাদের মায়েদের, আমাদের মেয়েদের। অবনতির বিস্ফোরণ দেশকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে অজস্র মেয়ের জন্ম দিয়েছে। রক্তবীজের মত এরা বেড়েই চলেছে। দেশের মানচিত্রে এরা আতসবাজির মত ছড়িয়ে পড়ছে। এরা অন্ধকার রাতে ঈদের চাঁদ, দীপাবলির প্রদীপ।

এসবের মধ্যে আমাদের প্রাপ্তি কিছু ভবিষ্যতের মেয়ে। বন্ধু শতাব্দী একটা পোস্ট দিয়েছিল। ওর মেয়ে নাকি খিদে পেলেই বলছে ‘ভুখমারি সে আজাদি’। সবাই যখন ওইটুকু মেয়ের শ্লোগান দেবার ঘটনায় আপ্লুত তখন শতাব্দী মনে করিয়ে দিচ্ছে যে ওর মেয়ে ক্ষুধা কী জিনিস জানে না। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোমান্টিক হতে ভালো লাগে। আজ পেট ভরে খেতে পাওয়া, শীতের রাতে নরম কম্বল জড়িয়ে শোয়া মেয়ে যখন মায়ের হাত ধরে মিছিলে যাচ্ছে, কাল যদি ওর পেট না ভরে, তখন যেন রাষ্ট্রের কাছে ভিক্ষা না করে সে খাদ্য ছিনিয়ে আনতে পারে এই সময় তো তারই প্রস্তুতি। কারণ আমরা ওই খুদেকে নিয়ে রোমান্টিক হতে পারি ঠিকই কিন্তু রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করি না। প্রত্যেকটা দেশ রাষ্ট্রের হাতে বঞ্চিত হয় আর তাই এই খুদে দেশও শ্লোগান শিখে যায়। এরাই ভবিষ্যতের ঐশী, আয়েশা।