Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বসন্তের এই মাতাল সমীরণে

সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়

 




লেখক কবি ও চিত্রনাট্যকার।

 

 

 

কলকাতার ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে যার জন্ম তার তো কোকিলের ডাক শুনে বসন্ত আসবে না সেটাই স্বাভাবিক। বসন্ত আসবে প্রেমে। কেবলমাত্র প্রেমে। আমার প্রথম প্রেম এসেছিল কবে? প্রেমের বোধের গায়ে রঙ লেগেছিল কবে? এখন আর ফিরে তাকালে সব অতটা স্পষ্ট করে দেখতে পাই না। তবু টুকরো টুকরো মনে পড়ে, লেটার বক্সের কোনও চিঠি, আমার খুড়তুতো ভাইয়ের হাতে ধরা সেই চিঠি নিতে আমার দৌড়, মনে পড়ে আমার একলা দুপুরের পাশ ফেরা আর বালিশ ভিজে যাওয়া চোখের জল। প্রেমে মানুষ কেন ‘পড়ে’ যায় আমি তখন থেকেই বুঝেছিলাম।জীবনে প্রেম এলে পা টলমল করে… সোজা হয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হয়। আসলে তখনও প্রেম এলে দুর্বল হয়ে পড়তাম, আমার বসন্তও তাই ছিল ভীষণ নরম… তুলতুলে আদুরে খরগোশের গায়ের মতো।

 

কী জানি সে আসবে কবে

পাড়ার এক বান্ধবী প্রেম করে। আর আমরা বসে থাকি সেই প্রেমের গল্প শুনব বলে। আমার কালো ফ্রেমের চশমা, লাল ফিতের বিনুনি, ব্রাহ্ম স্কুল… “হে সখা মম হৃদয়ে রহ” প্রার্থনা সঙ্গীত…! সেদিন বিকেলবেলা বান্ধবী ঢুকল আমাদের বাড়িতে, আমি আর আরেক বান্ধবী বসে আছি। সে ঢুকেই বলল “চুমুটা খেয়ে ফেললাম জানিস” আর আমি চশমার কাচের ভিতর দিয়ে দেখতে থাকলাম ওর কেঁপে ওঠা… আর বারবার বলতে থাকা “চুমুটা খেয়ে ফেললাম জানিস”। পুরনো দিনের বাড়ি, উঁচু সিলিঙের ডিসি ফ্যান, তার ঘোরার শব্দ, বড় বড় জানলা, সবুজ খড়খড়ি, ভেসে আসতে থাকল চুমুর গন্ধ! কেমন লাগে চুমু খেলে? কুলের আচারের মতো? আমি তো জানি না… সেই বান্ধবী হঠাৎ আমায় জড়িয়ে ধরল, আর আমি আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কী করে বুঝেছিলাম সেদিন? যে এক একটা চুমুর সঙ্গে জড়িয়ে আসে বিষাদ! আর বিষাদের গায়ে লেগে থাকে আশঙ্কা। হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা। প্রেমটাকে ওই মা পাখির মতো ঠোঁটের ডগায় নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছে করে… ইচ্ছে করে শরীরে লেপ্টে নিতে। প্রকৃত প্রেম বাৎসল্য ছাড়া আসে না, প্রেমে একবার না একবার প্রেমিকা মা হয়ে ওঠে, প্রেমিক বাবা, হয়ত উল্টোটাও! বসন্তে স্নেহ চলে আসে।

 

আমার এ ঘর বহু যতন করে

তখন আমার কলেজ, বসন্ত একদিন আমার আঙুল ধরল, হাতও, বসন্ত হাঁটল আমার সঙ্গে আর তারপর কোনও এক ঝিলপারে বসন্তকে রেখে আমি ক্লাসে ফিরে এলাম। আমার বসন্তরা চিরকালই আমার থেকে বড়, সমবয়সী বসন্তদের সঙ্গে প্রেম হয়নি আমার। আর তাই আমার বসন্ত ঘিরে থেকেছে বিষাদ, শান্ত স্বর, ঠান্ডা দূরত্ব, অস্থির শরীর আর গিলে নেওয়া কান্না! আমার বসন্তে টেডি বিয়ার আসেনি, আসেনি দোলনা, কাঠি আইসক্রিম কিংবা চাঞ্চল্য। প্রেম এসেছে বসন্তে কিন্তু ক্লান্ত প্রেম।আমাকে উঠে সেই প্রেমকে জায়গা করে দিতে হয়েছে, বলতে হয়েছে ‘বোসো, জল খাবে?’

 

যদি আমায় পড়ে তাহার মনে

এখন আমি আরও গম্ভীর। তেজী। চোখের কোণায় চিকচিকে এক রাগ ঝলসে ওঠে। সে আগুন আমি নেভাতে পারি না। আজ আর কোনও উঁচু সিলিঙের নিচে আমি ভাবতে চেষ্টা করি না চুমুর গন্ধ কেমন। কুলের আচারের মতো কিনা। কেমন সে স্বাদ। এখন আমি শান্ত থাকি। এখন হঠাৎ কোনও বসন্ত এলে আমার আর পা টলমল করে না কারণ আমি এতদিনে জানি, প্রেমে মানুষ অন্যকে খোঁজে না, খোঁজে কেবল নিজেকে। নিজের ভিতর থেকে নিজেকে নিঙরে না নিলে প্রেমের বোধ সম্পূর্ণ হয় না। আমাকে একটি মেয়ে বলেছিল ‘আমাকে ভোগ করে ছেলেটি চলে গেল? প্রেমটা আর রইল না আমাদের?’… আমি বলেছিলাম ‘তুমি বুঝি ভোগ করোনি তাকে?’ তার চমকে ওঠা গায়ে প্রলেপ লাগিয়ে বলতে চেয়েছিলাম, প্রেম সেই অলীক অনুভূতি যার কোনও শুরু নেই, শেষ নেই আর যে অনুভূতির মধ্যে আমরা ঢুকে পড়লে আমরা সকলেই ভোগ করি কিন্তু আসলে তা অন্য কাউকে নয়, নিজেকে। নিজের ওঠা, পড়া, কান্না পাওয়া, দুর্বল হওয়া, উঠে দাঁড়ানো… এই সবকিছুকে। “ভোগ” করার মধ্যে যে ছোট করে দেখা থাকে, উপভোগ করার মধ্যে কি থাকে তা? জীবনকে তো আমরা উপভোগ করি, না? আর যা কিছু উপভোগ করি সে প্রেম হোক বা জীবন, তা-ই কি বসন্ত?

 

সবাই গেছে বনে

রকিং চেয়ারে বসে এই লেখা লিখছি যখন, কী আশ্চর্য বাইরে সত্যিই ডেকে উঠছে কোকিল! ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে বসন্ত কি তবে সত্যিই চলে এল? কিন্তু এ কোন বসন্ত? বুড়ো বসন্ত? ক্লান্ত বসন্ত? কে জানে! বসন্ত আসে, বসন্ত চলেও যায়, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়না কখনও…! আর আমি সেই আশ্চর্য প্রদীপের মতো, যে প্রশ্ন করি না কখনও। তাকে জ্বালিয়ে দিলে সে জ্বলে, নিবিয়ে দিলে নেবে… কারণ সেই ছোট্টর থেকে বান্ধবীর চুমুর গল্প হোক, বা বসন্তের চিঠি আমি সবকিছুর মধ্যে দিয়ে বসন্তকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। অস্থির বসন্তের আকাশের রং চিনতে চেষ্টা করেছি। রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে এসি ফ্যানের অল্প শব্দে বসে আছি, আর কেন আমার কানে ভেসে আসছে “বসন্তের ওই মাতাল সমীরণে/আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে”।

 

যাব না এই মাতাল সমীরণে

বিকেল হয়ে আসছে, কোকিল ডাকছে, আমি তবু বসে আছি, হয়ত পাশাপাশি কোথাও রয়েছে বসন্ত, বলছে “রং খেলবে না?” আমি নিজের ভিতর মুখ ডোবাচ্ছি, নাক… কোন গভীরে লুকিয়ে রয়েছে আমার সমস্ত রঙ, আমার বসন্ত ঘ্রাণ, নিজের ভিতর থেকে খুঁজে বার করতে চাইছি সেই মেয়েটিকে, যে বসন্ত ফিরে যাওয়ার সময়, দোলের দিন রং হাতে চেঁচিয়ে উঠত ‘দো-ও-ও-ও-ও-ও-ও -ও-ল’! শুনে মনে হত যেন কোনও ছেলে সদ্য শট মেরেছে বলে! আর বল গড়িয়ে গিয়ে সোজা গোলপোস্টে!

 

এই নিরালায় রব আপন কোণে

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, নিজেই সরে আসব তার থেকে, বসন্ত কেবল প্রেম নয়… বসন্ত একটা উদযাপন, রঙিন উদযাপন, রং খেলি আর না খেলি, আমাদের হাসি কান্না রাগ, দুঃখ, অভিমানের রং ঝালিয়ে নেওয়ার সময়! বসন্ত থাকে আমাদের বুকের ভিতরে আর প্রেম সেই বসন্তকে খুঁজে চলার যাত্রাপথ। সারাজীবন আমরা নিজেদের সঙ্গে প্রেম করি আর দোষ দিই কোনও মানুষের অবয়বকে। অন্য কেউ আমার জীবনে বসন্ত আনতে পারবে এতদূর সহজ কি আমি কোনওদিন ছিলাম? ওই যে সেই প্রদীপের মতো, যাকে জ্বালালে সে নাকি জ্বলে, নেবালে নেবে। তা বুঝি অন্যের ইচ্ছেতে? উঁহু, তার নিজেরই ইচ্ছে করে জ্বলে উঠতে, নিবে যেতে, অস্থির হয়ে যেতে…! যেদিন আর ইচ্ছে করে না সেদিন অনেকগুলো দেশলাই জ্বালালেও প্রদীপ আর জ্বলে না! তখন বুঝে নিতে হবে বসন্ত আর নেই! গাছের রং বদলে গেছে, আকাশেরও। আমার রংও বদলে গেছে, লাল মেঝের, উঁচু সিলিঙের সেই বাড়িতে যেমন করে বসন্ত আসত এখন আর আসে না সেভাবে। ছাদের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকি। দূরে কোনও ছাদে একটি মেয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে ফোনটাকে ঠোঁটে নামিয়ে চুমু খায়… তারপর মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে পায়চারি করে। আমি বুঝি, এখন হয়ত আর চুমুর সঙ্গে ততদূর বিষাদ আসে না, সময়টা বদলে গেছে… তবু মনে মনে তাকে জড়িয়ে নিই, দূর থেকে বলি “কিছু হবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে”।