Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গণিতকে সিম্ফনির উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন মরিয়ম মিরজাখানি

আব্বস এদালাত

 

আদতে ইরানের মানুষ আব্বস এদালাত ইম্পীরিয়াল কলেজ অফ লন্ডনে কম্প্যুটার বিজ্ঞান ও গণিতের অধ্যাপক। Campaign Against Sanctions and Military Intervention in Iran (CASMII) গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। মরিয়মকে কাছ থেকে দেখেছেন।

 

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের অধ্যাপিকা ইরানের মরিয়ম মিরজাখানি – বিশ্বের প্রথম মহিলা হিসেবে গণিতের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক সম্মান ফিল্ড্‌স মেডাল-জয়ী মরিয়ম – মারণ ক্যান্সারের কাছে হার মেনে গত মাসের ১৫ তারিখ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, মাত্র ৪০ বছর বয়সে।

অনেকক্ষণ ধরে সামান্য এই কয়েকটি শব্দ লিখে ওঠার পর বারবার ফিরে পড়তে গিয়ে দেখছি, মরিয়ম সম্পর্কে এই বাক্যটি আসলে কিছুই বলছে না। স্রেফ কিচ্ছু না।

ঠিক যেমন, মরিয়ম ইরানের মানুষ, কেবল এটুকু বললে আসলে তাঁর সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। আদ্যন্ত প্রচারবিমুখ, গণিত-সাধনায় সাফল্যের তুঙ্গতম মুহূর্তেও প্রগাঢ় পরিবারকেন্দ্রিক, মেয়ের স্কুলের হোমওয়ার্ক আর ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির কঠিনতম আবিষ্কারকে অনায়াসে একসঙ্গে সামলে চলা মরিয়ম কীভাবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নিজের মধ্যে একটা গোটা এশিয়াকে বহন করে ফিরতেন, তা কি বোঝানো যায় কেবল এইটুকু দিয়ে? মরিয়ম সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বারবারই মনে হচ্ছে, কেবল নিষ্প্রাণ কিছু শব্দ দিয়ে মরিয়মকে বোঝা, তাঁকে বোঝানো, আদৌ সম্ভব নয়।

… যে-কথা বলছিলাম। মরিয়ম ইরানের মানুষ। জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা তেহরানে। স্কুলে যাওয়াও। কিন্তু স্কুলজীবনে তাঁর আগ্রহের তালিকায় কোথাও ছিল না অঙ্ক। মরিয়ম নিজেই নানা প্রসঙ্গে তাঁর বন্ধুদের একাধিকবার বলেছেনও সে-কথা। এমনকী মিড্‌ল স্কুলে পড়ার সময়েও, অর্থাৎ টিন-এজ বয়স পর্যন্তও মরিয়ম অনেক বেশি ভালবাসতেন সাহিত্য পড়তে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের বইপাড়া থেকে নানা ধরনের বই সংগ্রহ করে পড়ে ফেলা, আর নিজেও একটু-আধটু লেখালেখির চেষ্টা – এই ছিল তাঁর সবচেয়ে পছন্দের বিষয়।

কিন্তু হাইস্কুলে পৌঁছনোর পর আস্তে-আস্তে পালটাতে লাগল তাঁর ভাল লাগার জগৎ। দাদা নিছক গল্পের ছলেই একদিন বালিকা মরিয়মকে দেখালেন সংখ্যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য। শেখালেন, ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত পূর্ণসংখ্যাগুলির জোড় বাঁধানোর বিচিত্র এক কৌশল, যেখানে প্রতিটি জোড়েরই যোগফল ১০১ (১+১০০; ২+৯৯; ৩+৯৮; ৪+৯৭ ইত্যদি)। যেন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হল। সংখ্যার এমন বিচিত্র সব আলপনার সামনে দাঁড়িয়ে সেই থেকেই জীবনের পথ পালটে গেল মরিয়মের। গণিতের প্রেমে পড়ে গেলেন কিশোরী মেয়েটি। শুরু হল বিচিত্র সব নতুন সমস্যা নিয়ে পড়াশোনা, ভাবনাচিন্তা – সমাধানের খোঁজে গণিতের নানা অনতিচর্চিত রাস্তায় একলা হাঁটার রোমান্টিকতা। রোমান্টিক তো বটেই। রোমান্টিক না হলে কেউ স্রেফ আনন্দের জন্য কঠিন-কঠিন অঙ্ক কষতে বসে পড়ে? বিশেষ করে জীবনের শেষ কয়েক বছর, যখন শরীরে কোষে-কোষে  ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে দুরারোগ্য অসুখ –তীব্রতম শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও কেউ নিজেকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখতে পারে জটিল সব জ্যামিতির সমস্যার মধ্যে, রোমান্টিক না হলে?  

… গণিতের প্রতি এই দুর্মর রোমান্টিসিজ্‌ম থেকেই পরবর্তী জীবনে তিনি বক্রতলীয় ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির চর্চার দিকে ঝুঁকবেন, যাকে আধুনিক গণিতবিদেরা আদর করে সুররিয়াল জিওমেট্রি বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা।

১৯৯৪-এ ইরানের প্রথম মহিলা হিসেবে আন্তর্জাতিক গণিত ওলিম্পিয়াড-এ সোনা জিতলেন যখন, তখন মরিয়মের বয়স ১৭ বছর – ভাল করে কিশোরবেলাও কাটেনি। পরের বছর, ১৮-য় পা দিয়ে ফের গোল্ড মেডাল – এবারও গণিত ওলিম্পিয়াড-এ, পারফেক্ট স্কোর টেন অন টেন করার জন্য। তারপর তেহরানের শরিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে গবেষণার জন্য সটান হার্ভার্ড।

কীরকম গবেষণা? পিএইচডি থিসিসের জন্য বেছে নিলেন দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে সমাধান না-হওয়া জটিল এক ধাঁধা। কোনও বক্র তলের ওপর এক বিন্দু থেকে আর একটি বিন্দুতে পৌঁছনোর সবচেয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের পথ কী হতে পারে, সমস্যা তা নিয়েই। বহু বাঘা-বাঘা গণিতবিদ যে সমস্যা সমাধানের বিস্তর চেষ্টা করে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়েছেন। জটিল এই সমস্যা সমাধানের এমন অভিনব এক রাস্তা বেছে নিলেন মরিয়ম যে, তাতেই কিস্তিমাৎ। এভাবেও যে ভাবা যায়, কারও মাথাতেই আসেনি!

মরিয়ম যেটা করলেন, সেটা একেবারে নির্ভেজাল ব্রেনওয়েভ! বোঝার সুবিধের জন্য এভাবে বলি – তিনি ভাবতে শুরু করলেন একটা বক্রতলীয় বিলিয়ার্ড টেবিলে একটা বলের সম্ভাব্য গতিপথের নিরিখে। এতদিন তাবৎ আঁক-কষিয়েরা একটা বিলিয়ার্ড টেবিল নিয়ে ভাবছিলেন, মরিয়ম সেখান থেকে একটা কোয়ান্টাম লাফ দিয়ে সম্ভাব্য সমস্ত রকমের বক্রতলকে নিয়ে এলেন তাঁর গবেষণার আওতায়।

অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এর পর থেকে তাঁর সহপাঠী ও সহ-গবেষকরা মরিয়মকে ডাকতে শুরু করবেন গণিতের উইজার্ড বলে… হার্ভার্ডের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বের গণিতচর্চার আঙিনায়… তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে ভারচুওসো, জিনিয়াস প্রভৃতি সুপারলেটিভ শব্দের আমদামি ও ব্যবহার হতে থাকবে… তঁকে ডাকা শুরু হবে পায়োনিয়ার ইন দ্য ডাইনামিক্স অ্যান্ড জিওমেট্রি অফ কমপ্লেক্স সারফেসেজ বলে।

এবং বলা বাহুল্য যে, কেবল সেখানেই থেমে থাকবে না মরিয়মের কাজ। গণিতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ তাঁকে প্ররোচিত করবে অঙ্কের বিভিন্ন শাখাকে এক জায়গায় নিয়ে এসে সামগ্রিক গণিতকে আরও সর্বব্যাপী ও দার্শনিক স্তরে উত্তীর্ণ করার জন্য। সে এমন এক স্তর, যেখানে অনায়াসে মৌলিক গণিতের হাত ধরে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা – কোয়ান্টাম অভিকর্ষ থেকে কেয়স থিওরি, সবকিছুকেই তিনি মিলিয়ে দেন অঙ্কের অন্তর্নিহিত সঙ্গীতে। সে এমন এক দার্শনিক প্রতীতিসঞ্জাত অভিজ্ঞতা, যেখানে অঙ্কের সঙ্গে অর্কেস্ট্রার মৌলিক কোনও প্রভেদ নেই।

এই গবেষণারই স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে তাঁকে যখন ফিল্ড্‌স মেডাল দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয়, তখনও দেখেছি, কী আশ্চর্য গভীর মেধাসম্পন্ন অথচ কী নিরহঙ্কার মনের মানুষ মরিয়ম। পুরস্কার-প্রাপক হিসেবে মঞ্চ থেকে তাঁর নাম ঘোষণা করা হচ্ছে আর তিনি দর্শকাসনের সামনের সারিতে বসে লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে চেয়ারের তলায় সেঁধিয়ে যাচ্ছেন। সারা বিশ্বের প্রথম সারির গণিতজ্ঞরা দেখতে ভীড় করছেন প্রথম মহিলা ফিল্ড্‌স-মেডালজয়ীকে, আর তিনি ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলক থেকে কোনওমতে যেন পালাতে পারলে বাঁচেন। তারপর তাঁর চেক স্বামী ইয়ান ভনড্রাক, যিনি নিজেও স্ট্যানফোর্ডে কম্পিউটর ও ফলিত গণিতের অধ্যাপক, তাঁদের ছ’বছরের শিশুকন্যা অনাহিতাকে নিয়ে এসে তাঁর কোলে দিলেন, আর তিনি মেয়েকে আদর করতে লাগলেন– যেন ওই মুহূর্তটি উদ্‌যাপনের ওর চেয়ে ভাল কোনও উপায় তাঁর জানা নেই।

মরিয়মকে খুব কাছ থেকে দেখার একবার সুযোগ হয়েছিল আমার হার্ভার্ডে। ইরানের হাইস্কুলগুলিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিক্ষার প্রসারে ও আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কংগ্রেসের কাজে তিনি আমাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। ইরানের ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ বাড়ানোর বিষয়ে ওঁর উৎকণ্ঠা ও আন্তরিকতা ছিল একান্তভাবে আন্তরিক। এমনকী শেষদিকেও, অসুস্থতার মধ্যেও তিনি নিয়মিত দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন। ইরানে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারে একেবারে নীরবে কাজ করতে দেখেছি আমি ওঁকে। ইরানের মানুষের মনে ওঁর সম্পর্কে খুব উচুঁ ধারণাও আমি দেখেছি। ওঁরা মরিয়মকে দেখে, মরিয়মের নাম শুনলে কতটা অনুপ্রাণিত বোধ করেন, তাও আমি দেখেছি। মরিয়ম ওঁদের কাছে সত্যিকারের এক রোলমডেল। এবং, তা নেহাৎ অকারণে নয়। মরিয়ম বিশ্বাস করতেন, ইরানের মানুষ, বিশেষত ইরানের মেয়েরা, সারা পৃথিবীর মেয়েদের পাশে এক মঞ্চে দাঁড়ানোর যোগ্য। তিনি নিজের জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের মেয়েরা যে সমস্ত বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে মেধাচর্চা ও বিজ্ঞান-গবেষণায় নিজেদের সর্বোচ্চ জায়গায় নিয়ে যেতে পারে, মরিয়ম নিজে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

এত কিছু লিখে ফেলার পরেও আমি নিশ্চিত, মরিয়মকে কিছুই ধরতে পারলাম না। শব্দ দিয়ে ওঁকে বোঝানো যাবে না।

 

ছবিঋণ – ইন্টারনেট

মহাফেজখানায় যান