Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জেগে আছে মানবতার ছোট ছোট নিশানগুলি

রায়া দেবনাথ

 




লেখক সমাজকর্মী।

 

 

“তোমরা সাবধানে যাবে দিদি, আমাকে কিন্তু ফোন করবে, কোনও অসুবিধা হলেই সঙ্গে সঙ্গে জানাবে…”

সবে সবে কৈশোর পেরিয়ে আসা সে তরুণের চোখে মুখে তখন ঘোর উদ্বেগ। এইতো, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আলাপ। সদ্য পরিচিতদের জন্য চিন্তা নরম মুখের প্রতিটা পেশীতে ছলকে পড়ছে…

অপরিচিতদের জন্য ওই উদ্বেগের কাছে খানিক নতজানু হয়ে বসা যেত হয়তো… কিন্তু তখন ফেরার প্রবল তাড়া। ফিরতেই হবে আমাদের। পরিস্থিতি ভালো না! রাত বাড়ছে। আজকাল রাত ও চত্বরে একটু বেশিই অন্ধকার নিয়ে আসছে। আনছে দমবন্ধ করা আতঙ্কও। নিরাপদ আশ্রয়ের কাছে আমাদের যে পৌঁছাতেই হবে।

থাকার উপায় নেই। সেই সদ্য তরুণের উদ্বেগের উত্তরে খানিক আশ্বাস ছাড়া দেওয়ার মত আর কিছুই তখন নেই। “পৌঁছেই ফোন করব, তোরা সাবধানে থাকিস।’’

“পৌঁছে নয়, তুমি যেতে যেতে ফোন করে জানাবে। জানাবে কিন্তু… মৌজপুর দিয়ে যাবে, ওই দিক থেকেই তো সব শুরু হয়েছিল… আমি এগিয়ে দি খানিক?”

চমকে উঠলাম! এই ছেলের শরীরে দাঙ্গার ক্ষত শুকায়নি এখনও! সিএএ, এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের “অপরাধে” পুলিশের লাঠির ঘায়ে হাত ভেঙেছে! কানের পিছনে মাথার অংশে এখনও দগদগ করছে অত্যাচারের ইতিবৃত্ত। জমাট বাঁধা চাপ চাপ রক্তের দাগ পুরোটা উঠে যায়নি। এইতো দু’দিন আগে দাঙ্গাবাজরা যেদিন ওদের পাড়ার মসজিদে হামলা করেছিল, ধারালো অস্ত্রের কোপ বসিয়ে গিয়েছিল ওই বছর কুড়ির ঘাড়ের উপর, মাথার কাছে। আরও অনেকের উপর যেমন করে হামলা করেছিল ওরা। খুন করেছে। রক্তাক্ত করে গেছে নব্যতরুণের কাছের মানুষদেরও। সে ছেলে আজ কিনা হঠাতই আলাপ হওয়া আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে চাইছে? বিপদ আমাদের থেকে ওর অনেক বেশি। বুঝেও, নিজের কথা ভুলে বিশবর্ষীয় এখন আমাদের কথা ভাবছে? আর সহ্য হল না। হাতজোড় করেই বললাম “প্লিজ তুই আসিস না, দয়া করে এলাকা ছেড়ে একা বেরোস না। আসিস না এতদূর।’’ সেই নরম মুখ হয়ত খানিক কষ্টই পেল। দূরে সরিয়ে দিচ্ছি ভাবল কি?  হয়তো… কিন্তু কী করে বোঝাব ওকে, কীভাবেই বা ওই অনাবিল মুখের জীবনের ঝুঁকি নেব? আমরা না হয় মেট্রোয় উঠে যাব। তারপর? তারপর কী করে একা ফিরবে মুস্তাফাবাদে ওই ছেলে? রাস্তায় যদি ফের হামলা হয়? যদি ফের তুলে নিয়ে যায় পুলিশ? ইচ্ছামতো?

অথচ নয়া দিল্লি স্টেশনে নেমে আপাত দৃষ্টিতে সব কিছু ভীষণ স্বাভাবিকই মনে হবে। খানিক অস্বাভাবিক রকমের স্বাভাবিক। ব্যস্ত স্টেশন চত্বর, দৈনন্দিন ছন্দে চলা মেট্রোর ভিড়, রাজপথে জ্যাম আর কর্মব্যস্ততার রোজনামচা। সবাই কেমন রাজধানীর ছন্দ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। অথচ, এই শহরেই তো অন্য প্রান্তে দিন দুই আগেও একের হিংসার বলি হয়েছে অন্যে! অন্তত ৪৪ জন খুন হয়েছে! এখনও নালা থেকে যত্রতত্র উঠে আসছে মানুষের লাশ! কত মানুষ নিখোঁজ! আহতের হিসাব নেই! ধ্বংস হয়েছে জীবিকা! জীবন! এত রক্ত! এই অকারণ প্রবল হিংসা! এর মধ্যে সত্যিই কি এতটা নির্লিপ্ত থাকা যায়? সত্যিই কী এতটা ‘স্বাভাবিক’ থাকা সম্ভব?

নাহ, সম্ভব নয়। আদতে খুব একটা স্বাভাবিক নেই দেশের রাজধানী। মেকি হাসি আর নকল স্বাভাবিক থাকার তাড়নার আচ্ছাদনে দিল্লি যতই নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, বিজেপি খুব সফলভাবেই এ শহরের অন্তঃস্থলে ‘আমরা’-‘ওরা’-র বিভাজন তৈরি করতে আপাতভাবে সফল হয়েছে। ‘আপ’ নামক দলটি দিল্লির ভোটে জয় পেলেও সেখানে ধর্মীয় মেরুকরণ রুখতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে অথবা ইচ্ছা করেই চায়নি কিছু করতে। ঝাঁ চকচকে আধুনিক তথাকথিত প্রগতিশীল দক্ষিণ দিল্লিতেও তাই দাঙ্গাবিধ্বস্তদের জন্য ত্রাণ নিয়ে যাব শুনলে আগে কোন ধর্মের হাতে ত্রাণ উঠবে তার তথ্য তলাশ চালাতে থাকেন বাড়িওলা! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চান কোনওভাবে সেই ত্রাণের এক ছটাকও শাহিনবাগে পৌঁছাবে না তো! সরকারি ঘোষণায় ‘দাঙ্গা পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক’ বলার পরেও গন্তব্যস্থল মুস্তাফাবাদ, শিব বিহার মায় ব্রিজপুরা শুনলেও তৎক্ষণাৎ বুকিং ক্যান্সেল করেন একের পর এক হিন্দু নামধারী অ্যাপক্যাব ড্রাইভার! ভরা বাজারে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীর দিকে ছুটে আসে উড়ো হুমকি! “ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে এরা! আমাদের পারমিশন নিয়েছে? দেখিয়ে দেব মজা…” ছুটন্ত বাইক থেকে ছুটে আসে এই রকমেরই বিবিধ মন্তব্য… কোনও রকমে গাড়ি পাওয়া গেলেও ড্রাইভার কেমন অবলীলায় গর্বের সঙ্গে সঙ্কোচহীন হয়ে বলতে থাকেন মুসলমানদের মেরেই ফেলা উচিত! হিংসার এমন খুল্লামখুল্লা আস্ফালনের ভয়াল চোরা স্রোতই আদতে এখন দিল্লির নয়া স্বাভাবিক বা নিউ নর্মাল! এই ‘নিউ নর্মাল’ই বোধহয় একই শহরের অন্য প্রান্তে মানুষের জীবন তছনছ হয়ে যাওয়াকে অগ্রাহ্য করতে শেখায়! সন্দেহ ছাড়া তাদের জন্য সার্বিক আর কোনও অনুভূতিই অবশিষ্ট রাখে না!

ওই সব কিছু ‘ভীষণ স্বাভাবিকের’ নকল পলেস্তারা হঠাৎ করেই দ্রুত গতিতে খসতে শুরু করে গাড়ি যখন দক্ষিণ দিল্লির ঝাঁ চকচকে বাহুল্য ছেড়ে ‘যমুনার এ-পারে’ প্রবেশ করে। এমনিতেও শ্রেণিগত ফারাকে দিল্লির এ অংশের রূপ, চরিত্র, যাপন বাকি অংশের চেয়ে বেশ আলাদা। এখন তো ফারাকটা যোজন কয়েকের। প্রতি মুহূর্তে চোখের সামনে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয় ধ্বংসের ছাপ! খাজুরিখাস মোড়ে পুড়িয়ে দেওয়া ঝলসানো মাজার দিয়ে যে ধ্বংসের দৃশ্যমানতার শুরু, তাকে বহন করে চলে রাস্তার ধারে পুড়ে যাওয়া একের পর এক বাড়ি। বা বলা ভালো বাড়ির দোমড়ানো মোচড়ানো কঙ্কাল। ভেঙে দেওয়া বাড়িগুলোর সামনে তখন ইট, কাঠ, চুন, সুড়কির স্তুপ। মাজারটা টপকে খানিকটা এগোলেই চোখে পড়বে একটা পেট্রলপাম্পের ধ্বংসাবশেষ। দাঙ্গার বীভৎসতার সাক্ষী আপাতত এই পাম্পও। এমনি সময়ে উত্তর পূর্ব দিল্লির ভীষণ ব্যস্ত ঘিঞ্জি এই অঞ্চলে দাঙ্গা-উত্তর সময়ের অপেক্ষাকৃত অনেক শুনশান রাস্তাঘাট বুঝিয়ে দেয় আদতে ঠিক নেই কিছুই। ইতিউতি জলপাই নীল পোশাকের আধাসেনার টহলদাড়ি, গলিগুলোর মুখে মুখে যত্রতত্র ব্যারিকেড। তাণ্ডবকালে নিষ্ক্রিয়তা আর তাণ্ডব পরবর্তী ‘অতিসক্রিয়তার’ সরকারি ব্যবস্থা টপকে পুলিয়া মোড় হয়ে মুস্তাফাবাদ ঈদগাহের রিলিফ ক্যাম্পে পৌঁছাতে ‘অরুণ মডার্ন সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল’ পেরোতে হয়। সেই স্কুল আপাতত শ্মশানে পরিণত হয়েছে। স্কুলের জানলা দরজা সিলিং ডেস্ক চেয়ার টেবিল সব ভেঙে তছনছ করেও শান্তি পায়নি দাঙ্গাবাজরা। পুড়িয়ে দিয়েছে বই, খাতা আর ৩৩ বছর বয়সী স্কুলের সমস্ত নথিপত্র! “ভাগ্যিস ওই সময় ইস্কুলে কোনও পড়ুয়া ছিল না…” বিলাপ করতে করতে, আপাতত এইটুকুই সম্বল অরুণ মডার্ন স্কুলের প্রিন্সিপালের।

ঈদগাহের রিলিফ ক্যাম্প প্রায় হাজার খানেক মানুষের অস্থায়ী আশ্রয়স্থল এখন। মূলত শিববিহারের মুসলমান বাসিন্দারা আশ্রয় নিয়েছেন এই ক্যাম্পে। কেউ কেউ আছেন আশপাশের কোনও আত্মীয়র বাড়িতে। কেউবা এক পোশাকে ঠাই নিয়েছেন স্থানীয় আল হিন্দ হাসপাতালে।

রিলিফ ক্যাম্পের মহিলাদের জন্য আলাদা করা শামিয়ানার নীচে তাঁদের কী প্রয়োজন জিজ্ঞাসা করে উত্তরে আদতে মিলেছিল হাহাকার। কারও পুত্রের শরীর হয়ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, ধারালো অস্ত্রের কোপানো স্বামীর ক্ষতবিক্ষত লাশ জুটেছে কারও কপালে। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে কারও আপনজন। কেউবা যৌন হেনস্থার সাক্ষ্য বহন করছেন শরীরে। দাঙ্গাবাজরা আসছে শুনেই আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে ছিলেন যারা, তাঁদের আজ বাড়িতে ফেরার উপায়ও নেই। মেয়ের বিয়ের জন্য তিল তিল করে টাকা, পয়সা জমিয়েছিলেন যে মা, গয়না গড়িয়ে রেখেছিলেন, তাঁর সমস্ত কিছু লুঠ করে নিয়ে গেছে জয় শ্রী রাম ধ্বনি তুলে ‘ওরা’। কিচ্ছুটি নেই আর। শুধু টাকা, পয়সা, গয়না নয়, লুট হয়েছে আসবাব, বাসন, এমনকী সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্তরও! দুঃখের বিষয় হলো ওই মায়ের বাড়ি একমাত্র নয়, যেখানে ভাঙচুর চালানোর পরে লুঠপাট চলেছে ব্যাপক হারে। ঈদগাহে আশ্রয় নেওয়া সব পরিবারের কাহিনিই এখন হরেদরে প্রায় এমনটাই। “কী নিয়ে আসব বলুন আপনার জন্য?’’ আমতা আমতা করে করা সেই প্রশ্নের জবাবে সেই মা, মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে খানিক তাকিয়ে ছিলেন। সেই দৃষ্টিতে যে অসীম বিষণ্ণতা ছিল তার সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা যখন হারাচ্ছিল প্রশ্নকর্ত্রী, পরিস্থিতি এড়াতে, সেখান থেকে পালিয়ে যেতে খানিক জোর করেই ফের প্রশ্নের শরণাপন্ন হয়ে জানতে চাওয়া “বলুন না, কী লাগবে?” উত্তর না, এসেছিল আকুতি। কন্যাসমর হাত জড়িয়ে সেই মা বলেছিলেন “থোড়া ইনসাফ মিলেগি বেটি?”

‘ইনসাফের’ সন্ধান তাঁর এ বেটির কাছে নেই। বলে আসা হয়নি সেই মাকে। নিজেদের অক্ষমতা জাহিরের সাহসটুকুও তখন ছিল না যে!

ঈদগাহ থেকে বেরোনোর মুখে ফুটফুটে তরুণী হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল পারলে আর একটু বেশি করে অন্তর্বাস যেন নিয়ে আসা হয়… আর স্যানিটারি ন্যাপকিন।

“বাড়ি ফিরবে না? এখন তো অনেক শান্ত সব কিছু।’’
“ভয় করে, যদি আবার আসে…”
“এখনতো প্রচুর পুলিশ টহল দিচ্ছে দেখলাম…”
“ওদেরকেই তো বেশি ভয় করে…”

যে দেশের নয়া প্রজন্ম সেই দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার অংশবিশেষকে এতটা আতঙ্কের চোখে দেখে, প্রশাসন যেখানে দাঙ্গাবাজদের সমার্থক বা আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে তাদের কাছ, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার চরম ব্যর্থতার খতিয়ানের জন্য বোধহয় জিডিপির টানাপোড়েন না বুঝলেও চলে! এই কি যথেষ্ট নয়?

মুস্তাফাবাদ থেকে শিব বিহারের দিকে গেলে ডান দিকে পড়ে আল হিন্দ হাসপাতাল। এই সেই হাসপাতাল, যে হাসপাতালের ডাক্তাররা দিন রাত এক করে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই সেই ছোট্ট হাসপাতাল যার স্বল্প ক্ষমতার একতলায় তিল ধারণের জায়গা নেই। প্রত্যেক বেডে রক্তাক্ত যন্ত্রণা কাতর মানুষ হাঁপ ছাড়ছে, কোনও রকমে। হতাশ, অসহায় কিছু মানুষ। শরীর আর মনের যন্ত্রণার আঁকিবুঁকি সেই মানুষদের মুখ জুড়ে খুব স্পষ্ট! “সেদিন পুলিশ অ্যাম্বুলেন্সও আটকে দিয়েছিল, জানেন? মরণাপন্ন রোগীদেরও এখান থেকে বেরোতে দিচ্ছিল না। কয়েকজন হয়ত বেঁচেও যেত… আমাদের এখানে তো এত ব্যবস্থা নেই…” যিনি বলছিলেন পেশায় তিনি ডাক্তার। শুধু বলার সময় কেঁপে যাচ্ছিল গলা, সেই রাত সেই দিনগুলোর কথা বলতে বলতে তাঁর গাল বেয়ে নেমে আসছিল অশ্রুধারা…

মুস্তাফাবাদ আর শিব বিহারের মাঝে পরিবর্তিত পরিস্থিতির হঠাৎ তৈরি হওয়া “সীমান্ত” অঞ্চল জুড়ে রয়েছে দুটো স্কুল। রাজধানী কনভেন্ট স্কুল আর ডিআরপি স্কুল। এই মুহূর্তে দুটোরই স্ট্যাটাস ‘বিতর্কিত’। স্থানীয়দের দাবি ওই স্কুল দুটোতে দু’দিন ধরে জড়ো হয়েছিল বহু বহিরাগত। তারা ইস্কুলেই মজুত করেছিল ইট, লাঠি, রড, পাথর সহ বিবিধ অস্ত্র। ওইখান থেকে বেরিয়েই নাকি শিব বিহারে মুসলমানদের উপর হামলা চালানো হয়েছিল। অন্যদিকে, বিজেপির দাবি ওই ইস্কুলগুলোতে নাকি ‘গুন্ডা’ মজুত রেখেছিল অ্যান্টি সিএএ লোকজন! স্কুলদুটোর বহিরাঙ্গে ছাপ তেমন না পড়লেও ভেতরে ঢুকলে ধ্বংসলীলার মাত্রাটা বোঝা যায়! ওই অরুণ ইন্ট্যারন্যাশনলের পুনরাবৃত্তি বলা চলে যাকে। শিব বিহারের চিত্রটা বেশ ‘আকর্ষণীয়’। মুসলমান নামের ছিটেফোঁটা লেগে থাকা দোকানগুলোর পোড়া শরীরের পাশে, বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই, বিনা আঁচড়ে, হিন্দু নামের দোকানগুলো টিকে আছে। ইতিউতি গুঁজে থাকা গেরুয়া পতাকা আর দেওয়ালে বাঁকা হাতে ‘জয় শ্রী রাম’ লেখা যে আদতে তাণ্ডব রুখতে ‘সেফটি মার্ক’ তা বুঝতে একটা গোটা লহমারও প্রয়োজন পড়ে না বোধহয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই লোকসভায় দাঁড়িয়ে দিল্লি পুলিশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ২৪ তারিখের মধ্যে ‘দাঙ্গা পরিস্থিতি’ নিয়ন্ত্রণের দাবি করুন না কেন, তথ্য বলছে ২৬ ফেব্রুয়ারি আগুন লাগানো হয়েছিল শিব বিহারের আউলিয়া মসজিদে। কীভাবেই বা তার পরেও খুন হলেন এতজন? কী করে নামাজ পড়ার সময় মসজিদে হামলা চালাতে পারলো সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা? প্রাণ বাঁচাতে মসজিদের ছাদ থেকে লাফ মারছিল যখন মানুষ, কেন একজন পুলিশকেও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে দেখা গেল না? তথ্য বলছে, সোম-মঙ্গল সাড়ে ১০ হাজারের উপর ফোন কল গিয়েছিল পুলিশের কাছে ব্রিজপুরি, গোকুলপুরী, বাবরপুর, চান্দবাগ, জাফরাবাদ থেকে। তারপরেও কী করে পুড়িয়ে ফেলা গেল গোকুলপুরীর মসজিদ? কী করে দুদিনে খুন হলেন এতজন? সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পরা একের পর এক ভিডিও থেকে দেখা গেছে শুধু উন্মত্ত জনতা নয়, তাণ্ডবে পুলিশেরও সরাসরি অংশগ্রহণ। ধর্ষণের হুমকি দেওয়া ‘হিন্দুবীর’ যুবকের পুলিশকে দেখিয়ে নিজেদের সাথী বলে পরিচয় দেওয়ার ভিডিও তো কবেই সব্বাই দেখে ফেলেছে! পুলিশের পাথর ছুঁড়তে উৎসাহ দেওয়া, সিসিটিভি ভেঙে ফেলা, গুলি চালানো, বাড়ি বাড়ি ঢুকে হামলা করা সওওব ভিডিওইতো বহুল প্রচারিত! লাঠির ঘায়ে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে দেওয়া ওই যে যুবকদের রাস্তায় শুইয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইয়ে পৈশাচিক উল্লাসে মাতল যে বর্বররা, খুনও করল তাদের মধ্যে একজনকে, প্রকাশ্যে তাদের চেহারা দেখা গেলেও কেন মামলা দায়ের হল “আনআইডেন্টিফায়েড” ব্যক্তির নামে? উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ক’দিন আগে অবধি যখন তখন মুসলমান যুবকদের ‘ডিটেইন’ করেছে পুলিশ। পুলিশের হেফাজতে রাত কাটিয়ে যারা বাড়ি ফিরতে পেরেছে তারা প্রত্যেকেই শরীরে বেধড়ক অত্যাচারের চিহ্ন বহন করছে। বারবার অভিযোগ জানিয়েও সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর মেলেনি, এখনও! বন্দুক উঁচিয়ে পুলিশের দিকে ছুটে যাওয়া শাহরুখের গ্রেফতার বা অভিযুক্ত আপ এমএলএ-কে হেফাজতে নেওয়া সঠিক পদক্ষেপ, মেনে নেওয়ার পরেও এই ধরনের ‘সঠিক পদক্ষেপ’, সমস্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেন অন্যদের ক্ষেত্রে নেওয়া হল না? উত্তর আসেনি! শুধু আমরা জেনেছি দাঙ্গা, দেশের মানুষের প্রাণের থেকেও লোকসভার স্পিকারের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব! আমরা জেনে গেছি প্রকাশ্যে হেটস্পিচ ছড়ানো কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুররা বহাল তবিয়তে রাজধানীতে ঘুরে বেড়াতে পারে, তাদের নিরাপত্তার বেষ্টনী সরকারি নির্দেশেই দৃঢ়তর হয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাওয়া বিচারকেরা বদলি হয়ে যান! রাতারাতি!

এতগুলো কেন-র উত্তরও হয়ত জানা আমাদের, জানা নেই শুধু ওই সেই ‘ইনসাফের’ ঠিকানা।

অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রশাসন অ্যান্ড কোং জলকামান চালিয়ে কিছু প্রতিবাদী পড়ুয়াকে ছত্রভঙ্গ আর মন্ত্রীসভা সঙ্গে করে ‘শোকজ্ঞাপন’ করে দায় সারার যে নির্লজ্জ প্রচেষ্টা চালিয়েছে এই মুহূর্তে তাদেরও ‘ইনসাফের’ বিপরীত মেরুর বাসিন্দা ভেবে নেওয়াটা অমূলক হতে পারে না।

বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, দিল্লির এই দাঙ্গাকে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বলে দিলে সরলীকরণ হয় বড্ড বেশি। সত্যের অপলাপও হয়। সরকারি দাবিতে দিন দুই আর বাস্তবে দিন চারেকের দাঙ্গায় অন্তত তিনটে মসজিদ আর একটা মাজারে তাণ্ডব চালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনও মন্দির ধ্বংসের খবর এখনও অব্দি পাওয়া যায়নি। ঘর বাড়ি ছেড়ে মূলত যারা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাঁদের সিংহভাগই ধর্মে মুসলমান। দোকানপাট লুঠ করে, ই রিক্সা (টোটো) ভেঙে ভাতেও যাদের মেরে ফেলার চেষ্টা চলেছে তাঁরাও সিংহভাগ মুসলমানই। পরিচয়পত্র দেখাতে না পারলে প্যান্ট খুলে যাদের ধর্ম পরিচয় খতিয়ে দেখে খুন করা হয়েছে তারাও মুসলমানই। কারণ খালিদ সইফিরা হাঁটতে হাঁটতে জেলে ঢুকলেও বেরোবার সময় দুটো অকেজো পা নিয়ে তাঁদের হুইলচেয়ারের আশ্রয় নিতে হয়েছে। ষাট শতাংশ ও খানিক বেশি সংখ্যাগুরু অধ্যুষিত উত্তর-পূর্ব দিল্লির এই দাঙ্গায় সরকারি হিসাবেও মৃতদের অনুপাত সংখ্যাগুরু : সংখ্যালঘু = ১১ : ৫০। আহত বা ‘নিখোঁজ’দের হিসাব নিকাশ কষলে এই পার্থক্য আরও বৃহত্তর, আরও দৃশ্যমান হয় বৈকি! হ্যাঁ, এই দাঙ্গায় মূলত সংখ্যালঘুরা টার্গেট হলেও ১১ জন সংখ্যাগুরুও যে খুন হয়েছে, বাস্তব কিন্তু সেটাও। গেরুয়া রাজনীতির হিংস্র আধিপত্যবাদের কাছে এই ১১ জনের প্রাণ হয়ত কোল্যাটারাল ড্যামেজ, এই দেশের মানুষের কাছে তো নয়! ধর্মের জিগিরে ২০২০ সালে এসে এইভাবে মরে যাওয়ার কথা ছিল না তো এদের কারওই! অঙ্কিত শর্মারা তো আর উলুখাগড়া নন!

অঙ্কিত শর্মরা উলুখাগড়া নন, কারণ এ দেশে এখনও নিঃশ্বাস ফেলেন খুরশিদ, মমতা সিংহরা।

বাড়ির একমাত্র রোজগেরে, দুই শিশু সন্তান, বৃদ্ধ বাবা-মা, আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার মুস্তাফাবাদের খুরশিদের। ২৪ তারিখ সন্ধ্যায় দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে ফেরার সময় দাঙ্গাবাজদের কবলে পড়েছিলেন খুরশিদ। পরিচয় পত্রে তাঁর মুসলমানী নাম দেখে নির্দ্বিধায় খুঁচিয়ে তাঁর দু’চোখ রক্তাক্ত করেছে দাঙ্গাবাজরা। বেধড়ক মেরে ভেঙে দিয়েছে তাঁর পা। মারের চোটে যখন অচৈতন্য খুরশিদ, মৃত ভেবে তাঁকে পাশের নালায় ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। উদ্দেশ্য ছিল যদি মারে না মরে, নালায় ডুবে শ্বাস বন্ধ হয়ে মরবে নিশ্চয়ই খুরশিদ! তাও কিভাবে যেন বেঁচে গেলেন তিনি। আপাতত একটি চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ হারিয়ে অন্য চোখে সামান্য দৃষ্টি নিয়ে ভাঙা হাত পায়ে বাড়ির বিছানাতেই আবদ্ধ তিনি। এরপরেও কলকাতা থেকে আসা সম্পূর্ণ অপরিচিত ভিন ধর্মের পাঁচজনকে নিজের বাড়িতে ভরসা করে ঢুকতে দিয়েছিলেন তিনি ও তাঁর পরিবার! আদর করে ডেকে খাওয়াতে চেয়েছেন। বিশ্বাস করেছেন! এ বিশ্বাস কী প্রাপ্য ছিল? দাম দিতে পারবো এই ভরসার? উনি তো তাড়িয়েই দিতে পারতেন! সেটাই যে পাওনা হত! সংখ্যাগুরুর সুবিধা পেয়ে বেড়ে ওঠা কয়েকজনের তো এখন খানিক অপমানই যে ডিসার্ভ করার কথা ছিল! এই গ্লানির ভার বহন করা যাবে কী? এই রকম হাজারো প্রশ্ন যখন মাথায় নিরন্তর ঘুরপাক খাচ্ছে, মোক্ষম শিক্ষাটা দিলেন খুরশিদই। “ওরা তো দেশের সংবিধানটাই বদলে দিতে চাইছে। এ হিন্দু, মুসলমানের কথা নয় বোন, এখানে কেউই কারও কথা শোনে কই? একটু তো কথা বলে দেখো, একজন অন্যজনের সঙ্গে…”

শিব বিহারের মমতা সিংয়ের বড় ছেলে খুন হয়েছেন দাঙ্গায়। বাড়ির বাইরে ঝামেলা হচ্ছে দেখে, মুখ বাড়িয়ে দেখতে গিয়েছিলো। ব্যস, তখনই গুলি এসে এফোঁড় ওফোঁড় করে গেছে সে ছেলের হৃদয়। সদ্য সন্তান হারা মা বিজেপির হাজার উসকানির পরেও দৃঢ় গলায় জানিয়েছেন তিনি জানেন না নির্দিষ্টভাবে কোন সম্প্রদায়ের হাতে খুন হয়েছে তাঁর ছেলে। একই রকম স্পষ্টভাবে জানান, “গুলি তো তখন চালাচ্ছিল উভয়ই, কী করে জানব মারল ঠিক কে? কেন হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি করব? আমাদের পড়শি মুসলমানদেরও তো সব গেছে। সব হারিয়েছেন ওরা, অনেক বেশি সংখ্যায়! আগে তো এখানে এই হানাহানি ছিল না! হঠাত এ কী হল!”

জীবনে জমা থাকা সমস্ত প্রগতিশীলতা, সম্প্রীতি বোধের পাঠ আপাতত তাই জমা রইল, খুরশিদ, মমতা সিংদের পায়ে। হিংসার অপর প্রান্তে প্রত্যক্ষভাবে থেকেও যারা মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা অন্বেষণের ক্ষমতা রাখেন, ঘৃণার চরম বেসাতিতেও মানবতার নিশান বোধহয় বহন করেন তারাই, তাঁদের ভালোবাসার, পারস্পরিক বিশ্বাসের জেরে বোধহয় ধ্বংসের মুখ থেকেও ঘুরে দাঁড়ায় মানবসভ্যতা। এই সব বিপুল ভালোবাসার নিরলস আকুতির জন্যই সব হারানো মেয়ের বিয়ে দেয় হিন্দু-মুসলমান সবাই জোট বেঁধে, আকস্মিক পরিচিতদের মুখে অন্ন না তুলে নিজে এক গরাসও খেতে অস্বীকার করে বিশবর্ষীয় নরম মুখ…

আর হতাশায় ডুবতে ডুবতে আমরা তখন মরার আগে একে অন্যকে আঁকড়ে একসঙ্গে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টাটুকু অবলম্বন করে ফিরে আসি…

মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার সম্পর্ক যে ভাঙতে নেই! বন্ধন মনে করিয়ে ফোন আসে কলকাতায়, দিল্লির বছর কুড়ির কাছ থেকে…

“দিদি, আবার আসবে তো, বলো? এলে আমাদের এখানে থাকবে তো?”

দূরভাষে তখন হাতছানি দিয়ে যে ডাকে, তাকেই দেশ বলে মানি। মানুষ হওয়ার দায় তার কাছেই বাঁধা দিয়ে আসি…