Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কাছের মানুষ, বড় মানুষ প্রদীপদা

সৌমিত্র দস্তিদার

 




লেখক তথ্যচিত্রনির্মাতা, গদ্যকার।

 

 

 

এখন বলতে তো আর কোনও দ্বিধা নেই। সত্যি বলতে কি, আগের রাতে ভাল করে ঘুমই হয়নি। বিছানায় ছটফট করতে করতে ভেবে গেছি আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই সকাল হতে না হতেই দেখা হবে স্বপ্নের মানুষটির সঙ্গে। ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কোচ ও ফুটবলার পি কে ব্যানার্জির ইন্টারভিউ নিতে তাঁর বাড়িতে যাব। সকাল নটা- সাড়ে নটার মধ্যে পৌঁছাতে বলে দিয়েছেন আরতি বন্দ্যোপাধ্যায়, পিকের স্ত্রী। বলে দিয়েছেন মানে পইপই করে সতর্ক করে দিয়েছেন যে একটু দেরি হলেই কিন্তু তোমাদের প্রদীপদা চটে যাবেন। সময় মেনে না চললে উনি কাউকে রেয়াত করেন না।

সবে সবে খেলার সাংবাদিকতা করছি। তখনও কলেজ ছাড়িনি। মফস্বলের ছেলে। একেবারেই স্মার্ট নই। তার মধ্যেই সাপ্তাহিক ‘খেলার মাঠ’ পত্রিকার এডিটর একদা ময়দানের কিংবদন্তি গৌর ভট্টাচার্য নির্দেশ দিলেন প্রদীপ ব্যানার্জিকে ইন্টারভিউ করতে হবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। তাও অনেক কষ্টে সাহস করে ল্যান্ড ফোন নম্বর জোগাড় করে ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম প্রদীপ ব্যানার্জির বাড়িতে। তখন তো আর মোবাইল ফোন-টোন ছিল না। ল্যান্ড ফোনই ভরসা।  ও প্রান্তের মহিলাই যে আরতি বন্দোপধ্যায় পরে বুঝেছিলাম। আরতিদি-ই উদ্যোগ নিয়ে পরের দিন ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঠিক সময়ে পৌঁছে গেলাম। বুকের ভেতর কেমন করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কাইজার স্ট্রিটের অসাধারণ এক প্রাচীন ঘোড়ানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে না উঠতেই একটু যেন বিরক্ত গলায় আওয়াজ এল- কী চাই?

মিনমিন করে কী যে বললাম নিজেও শুনতে পেলাম না। অন্যদিক থেকে ধমক এল- যা বলবে স্পষ্ট করে বলবে। কে তুমি? সম্ভবত হাঁকডাক শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলা। আন্দাজে বুঝলাম ইনিই কাল ফোন ধরেছিলেন। প্রদীপ ব্যানার্জির স্ত্রী আরতি বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি নিজেও তখন পশ্চিমবঙ্গের মহিলা ফুটবল দলের কত্রী। আরতিদি সামান্য বকুনি দিলেন। তারপর বললেন, “আরে, ও তো সৌমিত্র। আমি ওকে আসতে বলেছি তোমার ইন্টারভিউ নিতে। খুব ভালো ছেলে। দেখো মস্ত বড় হবে এই ছেলে।” আমি তো থ আরতিদি এমন এক মুখ করে হাসলেন যেন কতদিন আমাকে চেনেন।

মুখ দেখে মনে হল প্রদীপদা মোটেও খুশি হননি। সকাল সকাল অচেনা অজানা কেউ ঢুকে পড়লে কে-ই বা খুশি হন! কিন্তু বউয়ের কথা ফেলতেও পারছেন না। গিলতেও পারছেন না। আরতিদি প্রদীপদার অসহায় অবস্থা দেখে মজা পাচ্ছেন মনে হল। মিটমিট করে হাসতে হাসতে বললেন, “পাঁচ মিনিট কথা বললে কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। ওকে আমিই আসতে বললাম।” যে প্রদীপদা পাঁচ মিনিটও সময় দিচ্ছিলেন না, তাঁর সঙ্গে কথায় কথায় আমার আড়ষ্ট ভাবটা কখন কেটে গেছে টেরও পাইনি। সে কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে প্রদীপ ব্যানার্জির। পাঁচ মিনিট ততক্ষণে দেড় ঘণ্টা হয়ে গেছে। দু-দুবার চা বিস্কুট এসে গেছে। প্রদীপদা আর ছাড়েন না। “বোস বোস, কোথায় যাবি!” কখন যে প্রদীপদা তুই এ নেমে এসেছেন বুঝিনি।আরতিদি একবার আড়াল থেকে মুচকি হেসে চলে গেলেন। ভাবটা এই, তোমাদের প্রদীপদা এরকমই।একবার পছন্দ হয়ে গেলে আর ছাড়তে চান না। এখন ভাবি প্রদীপদার মধ্যে সহজ সরল এক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি বসু পরিবারের উত্তমকুমারের চরিত্রের মতো কেমন যেন একান্নবর্তী পরিবারের এক বড়দা লুকিয়ে ছিল। ভালবাসার লোকজনকে আঁকড়ে ধরে থাকতেন সবসময়।

এযটা ঘটনা যে কোনও অজ্ঞাত কারণে আমৃত্যু আমি সত্যিই আরতিদির অকৃপণ স্নেহ পেয়েছি। প্রথম দিনই উনি আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন, কেন তা আজও বুঝিনি। কিন্তু তা যে অন্ধ স্নেহ ছিল তা শুধু আমি নয়, সারাজীবন প্রদীপদাও বুঝতেন। পরে যখন প্রদীপদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়েছে, তখনও কোনও কোনও সময় ইন্টারভিউ দিতে প্রথমে হয়তো রাজি হননি। তারপর আমি একটু চাপাচাপি করতেই প্রদীপদা কৃত্রিম অভিমানে বলে বসলেন- “না না, তোমাকে তো ইন্টারভিউ দিতেই হবে। না হলে তো আমার ওপরতলায় নালিশ যাবে। তুমি তো আবার আরতির লোক।”

চলে যাবার পর কত কথা কত স্মৃতি মনে পড়ছে। ততদিনে আমি প্রদীপ ব্যানার্জির বাড়ির লোক হয়ে উঠেছি। প্রদীপদারা সল্টলেকে নতুন বাড়িতে উঠে যাবার পর একবার সপরিবারে গেছি। রাত্তিরে নেমন্তন্ন খেতে। পরিবার মানে একেবারে বৃহৎ দস্তিদার পরিবার। আমি আমার স্ত্রী মেয়ে, আমার বোন, কাজিন বিখ্যাত অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং আরও দু-একজন। আড্ডা হচ্ছে প্রদীপদার ড্রইংরুমে বসে। যথারীতি বক্তা একজনই। গৃহকর্তা স্বয়ং। সে আড্ডায় ফুটবল থেকে উত্তমকুমার কী নেই! প্রদীপদা বলে চলেছেন। একদিকে ময়রা স্ট্রিট অন্য দিকে ভবানীপুর। আমার সে যে কী অবস্থা। সুপ্রিয়া দেবী আর গৌরীদেবী দুজনের টানাপোড়েনে আমার ত্রাহি মধুসূদন দশা। দুপক্ষের কাছেই আমি একমাত্র গ্রহণযোগ্য লোক। এ বলে তোমাকে বিচার করতে হবে আর ও বলে যে তুমি ঠিক করে দাও!

যা হোক, ডিনারের আগে সবাই মিলে গল্প হচ্ছে। প্রদীপদা নানা অভিজ্ঞতার কথা বলে যাচ্ছেন আর আমরা মুগ্ধ হয়ে সব শুনে যাচ্ছি। বলা হয়নি, আমাদের খাওয়াদাওয়াটা যাতে ঠিকঠাক হয়, তাই প্রদীপদা নিজে হাতে চিংড়ি মাছ মাংস বাজার করে নিয়ে এসেছেন। গল্প চলছে, এমন সময় দুম করে শব্দ, কী যেনএকটা ভাঙ্গার শব্দ। তাকিয়ে দেখি চিনামাটির একটা পুতুল মাটিতে পড়ে আছে টুকরো টুকরো হয়ে। পুতুলটা ছিল জানলার ওপর। সম্ভবত পর্দা উড়ে কোনওভাবে সেটা ধাক্কা লেগে পড়ে ভেঙ্গে গেছে। কাছাকাছি ছিল আমার দু’বছরের ছোট্ট মেয়ে। প্রদীপদার ধারণা ও খেলতে গিয়ে সেটা ভেঙ্গে গেছে। মুহূর্তে পরিবেশটা পাল্টে গেল। হায় হায় করে প্রদীপদা চেঁচিয়ে উঠলেন, “না জেনে তুই এ কী করলি মা! এ জিনিস আর কখন পাব না! জাপানের সম্রাট হিরোহিতো নিজের হাতে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।”

সে এক দৃশ্য। প্রদীপদা প্রায় চুল ছিঁড়ছেন আর আমার মেয়ে মুখ চুন করে মার বকুনি খাচ্ছে। মুস্কিল আসান হয়ে আসরে আবার ঢুকে পড়লেন সেই আরতিদি। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিষয়টা বুঝে নিয়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন- “ধুস, তিলকে তাল করা তোমাদের প্রদীপদার চিরকালের বদভ্যাস। ওই পুতুলটা আমি নিউমার্কেট থেকে কিনে এসেছিলাম। গেছে যাক। আবার কেনা যাবে। শুধু শুধু বাচ্চাটা বকুনি খাচ্ছে। না রে মা, তোর কোন দোষ নেই। তোর এই দাদুটাই দুষ্টু।” প্রদীপদা মুহূর্তে স্বাভাবিক। “ও এটা নিউ মার্কেটের? আমি ভাবলাম সেই জাপানের পুতুলটা….!”

পরবর্তীকালে পলার সঙ্গেও আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়েছে। পলা ছিল একাধারে প্রদীপদার মেয়ে, সচিব এবং পরম অভিভাবক। ছোট পিক্সিও ছিল বাবার অবলম্বন। মজা হচ্ছে, পলা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হবার পর প্রদীপদা ফের বলতে লাগলেন, “এখন তো তুই আবার আমার মেয়েরও বন্ধু। তোর সামনে কিছু এদিক ওদিক করে ফেললেই আমি কেস খেয়ে যাব।”

আরতিদিকে বাদ দিয়ে পিকে সম্পর্কে কোনও আলোচনাই সম্পূর্ণ হতে পারে না। দুজনে দুজনের পরিপূরক ছিলেন। দীর্ঘদিনের সঙ্গী আরতিদি চলে যাবার পর অনেক দিন বড় বিমর্ষ ছিলেন প্রদীপদা। মুখ দেখে বোঝা যেত না। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে সবাই বুঝতেন প্রদীপদা কত একা হয়ে গেছেন। বড় মেয়ে পলা আমেরিকা থেকে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থেকে যাবার পর প্রদীপদার জীবন আগের মতো না হলেও অনেকটা ছন্দে ফিরল।

চলে যাবার পর থেকে বর্ণময় প্রদীপদার নানা স্মৃতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মানুষ প্রদীপদাকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টার বলে যেতে পারি। ভারতসেরা ফুটবলার পিকেকে নিয়ে ইতিমধ্যেই কতজন কতভাবে কতকিছু লিখছেন, লিখবেন, আমি তাতে বাড়তি কী আর যোগ করব!

প্রদীপদার ভোকাল টনিক নিয়ে তো রীতিমতো গবেষনা হতে পারে। প্রদীপদার পাড়ার ফুটবল টিমও যদি মারাদোনার আর্জেন্টিনার সঙ্গে খেলতে নামতো তখনও পাড়া ফুটবলারদের উদ্বুদ্ধ করতেন- ওদের একজন মাত্র মারাদোনা আর আমি বিশ্বাস করি তোমরা সবাই এক-একজন মারাদোনা। তোমরা পারবে। তোমরাই জিতবে।

কত্ত কিছু যে শেখার ছিল প্রদীপদার কাছ থেকে তা বলে বোঝানো যাবে না। বলতেন- “মুখ হচ্ছে মনের আয়না ।খুটিয়ে মুখ দেখলে বুঝতে পারবি কে কেমন মানুষ বা সে এখন কী অবস্থায় আছে!” জামশেদপুর থেকে এসে অনেক লড়াই করে যে ছেলেটা ভারতীয় ফুটবলের নক্ষত্র হয়েছিল সে কখনও নিজের অতীত ভুলে যায়নি। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আমার বন্ধু অশোক কুমার দাশগুপ্ত ছিল দাশগুপ্ত স্পোর্টসের বাড়ির ছেলে। পারিবারিক ব্যবসা ভাগবাটোয়ারা হয়ে অশোক আর ওর বাবা স্বরাজ দাশগুপ্ত সম্পত্তির প্রায় কিছুই পাননি। ফড়েপুকুরের এক অন্ধকার এক চিলতে গ্যারেজে একদা দাশগুপ্ত স্পোর্টসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্বরাজ দাশগুপ্ত কোনওরকমে খুব ছোট একটা ব্যবসা করতেন ওই খেলার সরঞ্জামের। একদিন কাছাকাছি রাস্তা দিয়ে কোনও কারণে যাচ্ছিলেন তখনকার ইষ্টবেঙ্গল কোচ পিকে ব্যানার্জি। পিকে পিকে চিৎকার শুনে বাইরে আসতেই স্বরাজ দাশগুপ্তকে দেখে ফেললেন প্রদীপ ব্যানার্জি। গাড়ি মুহূর্তে ব্যাক করলেন। দরজা খুলে এগিয়ে এলেন আধময়লা ফতুয়া গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রবীণ মানুষটির কাছে। এসেই প্রণাম করলেন স্বরাজ দাশগুপ্তকে। হা হা করে স্বরাজ জড়িয়ে ধরলেন প্রিয় ফুটবলারকে। কান্নাধরা গলায় বললেন,”তোর আমাকে মনে আছে, প্রদীপ?” ততক্ষণে অজানা অখ্যাত এক বুড়ো আর বাঙালির প্রানের প্রদীপকে দেখতে ভিড় জমে গেছে। পিকে জটলার মাঝে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন- “চেনো এঁকে?” তারপর এক্কেবারে নিজস্ব স্টাইলে আবেগমাখানো গলায় বলে উঠলেন- “আমার পকেটে যখন পয়সা ছিল না, তখন এই লোকটি, এই ক্ষয়াটে চেহারার মানুষটি তখন বিনা পয়সায় দিনের পর দিন আমাকে খেলার শ্যু বানিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর তৈরি জুতো পায়েই আমি এশিয়াড খেলেছি।”

এই নরমসরম প্রদীপ ব্যানার্জিকে খুব কম লোকই চিনতেন। অমল দত্ত-পিকে ব্যানার্জির ব্যক্তিত্বের সংঘাত মিডিয়া অনেক কিছু রটালেও, প্রদীপদা তা নিয়ে কখনও কিছু বলতেন না। অন্তত আমার মতো জুনিয়রদের সামনের কোনওদিন তেমন কিছু বলতে শুনিনি। একবার শুধু মজা করে বলেছিলেন- “আচ্ছা, অমলদা সবসময় নিজের দাদামশাই-এর কথা তোলেন। জানো তো আমি অক্ষয় বড়ালের নাতি। আমি বুঝি না যে ফুটবল মাঠে অক্ষয় বড়ালের অবদান ঠিক কী!”

যতটুকু দেখেছি খেলার মাঠে একবারই চাপে ছিলেন প্রদীপদা। অমল দত্তের ডায়মন্ড সিস্টেম নিয়ে যে বার  খুব মাতামাতি হচ্ছিল। ডার্বি ম্যাচে অমল দত্তের মোহনবাগানকে ৪-১ গোলে পিকের ইস্টবেঙ্গল হারিয়ে দেবার পরের দিন বাড়িতে যেতে প্রদীপদাকে শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত লেগেছিল।

কত বিষয়ে যে অগাধ জ্ঞান ছিল প্রদীপদার তা ভাবলে অবাক হতে হয়। প্রদীপদাকে নিয়ে কিছু কিছু ঘটনা ভারতের ফুটবল লোককথার অংশ হয়ে গেছে। সম্ভবত সে বার ভারতের কোচ ছিলেন পিকে। যেকোনও কারণেই হোক ভারতের ফল সেবার খুব খারাপ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই চারদিকে নিন্দেমন্দের ঝড় বইছে। তখন ফিল্ড মার্শাল ম্যানেকশ ভারতীয় ফুটবলের বড়কর্তা। তাঁর নেতৃত্বে প্রদীপদার ‘বিচার ‘সভা বসল। সবাই একে একে পিকের সমালোচনায় সোচ্চার। তিনি এই ভুল করেছেন। ওই অন্যায় করেছেন ইত্যাদি। প্রদীপদা চুপচাপ সব শুনছেন। সবার শেষে প্রদীপদার সুযোগ এল আত্মপক্ষ সমর্থনের। প্রদীপ বন্দোপধ্যায় অন্য কারও দিকে চেয়েও দেখলেন না। সোজাসুজি জেনারেল ম্যানেকশর দিকে তাকালেন। তারপর ফুটবল নিয়ে একটা শব্দও খরচ না করে খোদ ফিল্ড মার্শালকে সমরাস্ত্র নিয়ে বলতে শুরু করলেন। এফ সিক্সটিন মিরাজ মিশাইল ইত্যাদি কোন অস্ত্রের কী উপকারিতা, আর তার সঙ্গে ফুটবলের সম্পর্ক তাই নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দেবার পর সিটে বসতে না বসতেই ম্যানেকশ স্বয়ং উঠে এসে জড়িয়ে ধরলেন প্রদীপ বন্দোপধ্যায়কে। বললেন, “প্রদীপ, তুমি মিলিটারি, যুদ্ধ এসব নিয়ে এত জানলে কী করে!” প্রদীপদা জবাব দিয়েছিলেন, “ফুটবলও কিন্তু যুদ্ধ স্যার।আধুনিক অস্ত্র ছাড়া তাতেও জেতা যায় না।” বলা বাহুল্য, পিকের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ খারিজ হয়ে গেল নিমেষে। এই ছিলেন পিকে। এসব কথা কিন্তু একবারও প্রদীপদা আমাকে বলেননি। অন্য অনেকের কাছে শুনেছি।

ফুটবল যে কোন অস্তিত্বের গভীরে ছিল প্রদীপদার তা একটা ঘটনার কথা বললে স্পষ্ট হবে। আমি তখন অনেকদিন হল খেলাধুলোর জগত ছেড়ে দিয়েছি, ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাই। একটু-আধটু পরিচিতিও হয়েছে। তা নিয়েও প্রদীপদার গর্বের শেষ নেই। আমার তৈরি সব ছবির খুঁটিনাটি খবর রাখতেন। পলা বাবাকে বলে দিত, আমার কোন ছবি লোকে কীভাবে নিয়েছে, কী বলেছে সমালোচকরা ইত্যাদি ইত্যাদি। সেবার মাওবাদীদের গোপন ডেরায় গিয়ে তাদের জীবনযাপন নিয়ে একটি বিতর্কিত ছবি করার কিছুদিন পর এক বিখ্যাত বাংলা চ্যানেলে গেছি লাইভ প্রোগ্রাম করতে। শেষ করে বাড়ি যেতে না যেতেই পলার ফোন। দারুন হয়েছে, চমৎকার বলেছো, ইত্যাদি বলে তারপর বললো, ধরো ড্যাডি কথা বলবেন। প্রদীপদা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলেন- “কনগ্রাটস মাই বয়। ওয়েলডান। ফাটিয়ে দিয়েছো। বিপক্ষকে নড়তে দাওনি।” এখানে বিপক্ষ বলতে অ্যাঙ্কর মেয়েটি। আমি একটু আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই ফের প্রদীপদা- মেয়েটি একবারও তোমার ডিফেন্স ভাঙতে পারেনি। তুমি কাউন্টারে গেলেই ওর ডিফেন্স তছনছ হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে। অসাধারণ ম্যাচ….” এই ছিলেন প্রদীপ ব্যানার্জি। যেকোনও সময় যেকোনও বিষয় নিয়ে আলোচনাতেই উনি অক্লেশে ফুটবলে ঢুকে পড়তেন। এমন নিখাদ ফুটবল প্রেম ছিল বলেই সর্বকালের সেরা, অন্যতম নক্ষত্র ফুটবলার ও কোচ হতে পেরেছিলেন প্রদীপদা।

প্রথম দিন ওকে দেখব বলে প্রায় সারারাত ঘুমোতে পারিনি। আর এত বছর পরে প্রদীপদা চিরকালের মতো চলে যাবার পরেও ছটফট করছি। ঘুম আসছে না।