Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নোভেল করোনা ভাইরাস— স্প্যানিশ ফ্লু আর ভগত সিং: এলোমেলো কটা কথা

প্রবীর মুখোপাধ্যায়

 




লেখক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসেন।

 

 

 

ঠিক যে সময়ে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমরা তখনই নোভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ আমাদের এক অভূতপূর্ব সঙ্কটের সামনে এনে ফেলল। সশক্ত রাজনৈতিক ইচ্ছা আর তার সঙ্গে প্রতিটি নাগরিকের দায়বদ্ধতার মাধ্যমেই এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব। আর সে কারণেই মনে পড়ছে শহীদ-এ-আজ়ম ভগত সিং-এর কথা।

২৩ মার্চ ১৯৩১ লাহোরে ফাঁসি হয় ভগত সিং, রাজগুরু আর শুখদেবের। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ থাকায় সভা-সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, সে কারণে স্বাধীন ভারতে এই প্রথম এই শহীদদের স্মরণে কোনও অনুষ্ঠান করা গেল না ২০২০ সালের ২৩ মার্চ। অথচ ঠিক একদিন আগে ২২ মার্চ নির্ভয়া মামলার অপরাধীদের ফাঁসি নিয়ে যথেষ্ট কোলাহল করা হল। গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ জোর দিয়ে সকলকে বাড়ির মধ্যে থাকতে বললেন। কিন্তু আজ টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পেলুম উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সপারিষদ ‘রাম জন্মভূমি’তে রামলালার পূজা অনুষ্ঠানে ব্যস্ত! অবশ্য আজকের ভারতে শহীদ বলতে শুধু কর্তব্যরত অবস্থায় মারা গেছেন যে পুলিশ বা মিলিটারির লোক তাদেরই বোঝানো হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যাঁরা আত্মবলিদান করেছিলেন তাঁদের কথা এখন আর মনে পড়ে না। থাকগে সে কথা।

কেন আজ বিশেষ করে ভগত সিং আর তাঁর বীর সহকর্মীদের কথা মনে পড়ছে?

আজকে ভারতে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি তার সঙ্গে এসেছে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিরাট চ্যালেঞ্জ— নোভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ। প্রায় একই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা হয়েছিলাম ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে তথাকথিত ‘স্প্যানিশ ফ্লু’-র আক্রমণে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশ্ব-অর্থনীতিতে তখন মন্দা আর ডামাডোল। ভারতে সমাজের নিচুতলার মানুষেরা নিজেদের অধিকার নিয়ে ক্রমশ সচেতন হচ্ছেন আর সম-অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের পথে নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করেছেন। তার মধ্যে এল এই মারণ ফ্লু-এর সংক্রমণ। আজকের সঙ্গে পার্থক্য শুধু একটাই— শাসনক্ষমতা সে সময়ে ব্রিটিশদের হাতে।

পেছনে ফিরে ১৯১৮-২০র ঘটনা আর ভারতে তার অভিঘাত সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে ঐ সময়ে সারা দুনিয়ায় স্প্যানিশ ফ্লু-এর সংক্রমণে কত লোক মারা গিয়েছিল তার সংখ্যা কেউ বলেন দেড় কোটি, কারও মতে দশ কোটি। যুদ্ধের কারণে ‘মুক্ত দুনিয়া’র বড় দেশগুলি যেমন ইংল্যান্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংবাদ প্রকাশ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। স্পেন নিরপেক্ষ ছিল যুদ্ধে, তাই তাদের দেশের মৃত মানুষের সঠিক সংখ্যা প্রকাশিত হয় আর তাদের দেশের নামেই রোগটির নামকরণ হয়ে যায়, যদিও অন্য সব দেশে অনেক বেশি লোক মারা গিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে কত লোক ঐ রোগে মারা গিয়েছিল তার হিসেব নিয়েও নানা মত আছে— সিদ্ধার্থ চন্দ্র আর তাঁর সহযোগী গবেষকদের মতে প্রায় এক কোটি ঊনচল্লিশ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল, যদিও ডেভিসের মতে সংখ্যাটা এক কোটি বাহাত্তর লক্ষ। যে অঙ্কটাই ঠিক হোক না কেন ১৯১১ সালের জনগণনার তুলনায় ১৯২১ সালে ভারতের জনসংখ্যা যে হ্রাস পেয়েছিল এটা স্বীকৃত তথ্য। আর জনগণনা শুরু হওয়ার পরে যেকোনও দশকে এই একবারই জনসংখ্যা কমে গিয়েছিল। সুতরাং স্প্যানিশ ফ্লু সংক্রমণের গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।

মহাত্মা গান্ধিও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অবশ্য তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। এই মহামারি যখন তার থাবা বসাল তখনই প্রকট হয়ে গেল ব্রিটিশ ভারতে জনস্বাস্থ্যের হাল কতটা বেহাল। চিকিৎসাব্যবস্থার পরিকাঠামো কতটা অপ্রতুল সেটা কয়েকদিনের মধ্যেই বোঝা গেল। Pale Rider: The Spanish Flu of 1918 and how it changed the world এই বিখ্যাত বইটির লেখিকা ল্যরা স্পিনন্যে (Laura Spinney) লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক প্যাট মরিসনকে এক সাক্ষাৎকারে যে সব কথা বলেন তার বেশ কয়েকটি আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি জানান যে “ব্রিটিশ ডাক্তারদের অনুপস্থিতিতে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক মারা যাচ্ছে। ব্রিটিশ ডাক্তারেরা অধিকাংশ সময়েই যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন আর তার ফলে [চিকিৎসা পরিকাঠামোর] ফাঁক-ফোকরগুলি প্রকাশ্যে চলে আসছে।” চিকিৎসা পরিকাঠামোর এই শূন্যতা পূরণ করে এই মারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। ল্যরা স্পিনন্যে আরও বলছেন “চিকিৎসার এই ফাঁক-ফোকর ভরাট করতে যারা এগিয়ে আসছে তাদের মধ্যে জঙ্গি মনোভাবাপন্ন হবার ঝোঁক আছে, কারণ স্বাধীনতার জন্য জঙ্গি সংগ্রামে যারা ইতিমধ্যেই নেমে পড়েছে সেই একেবারে তৃণমূলস্তরের জঙ্গি কর্মীরাই জানে কীভাবে বর্ণবেষম্যের বাধা অতিক্রম করে এককাট্টা হয়ে এক সম্পূর্ণ পৃথক লক্ষ্য অর্থাৎ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা যায়।” এই মারণ রোগের কারণে মৃত্যু আর তার থেকে উদ্ভূত দুর্দশা ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্রোধে ইন্ধন জোগানোর ব্যবস্থা করল। স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণের ব্যাপক অংশ ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করল। স্প্যানিশ ফ্লু যেমন জনগণের জন্য নিয়ে এল অপরিসীম দুর্দশা তেমনই ভেঙে চুরমার করে দিল ভারতের অর্থব্যবস্থা আর উপরিকাঠামো। মৃত্যুর সুনামির সঙ্গে এল স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হওয়ার গণসমর্থন।

ফিরে আসি ভগত সিং-এর প্রসঙ্গে। ভগত সিং-এর যে সময়ে জন্ম তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই পাঞ্জাব ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সামাজিক পরিবর্তনের এক জোয়ার এসেছিল। সমাজের নিচের তলা থেকে উঠে আসা দার্শনিকেরা নতুন দুনিয়ার জন্যে নতুন এক অধ্যাত্মবাদের জোয়ার নিয়ে এলেন। গুরু নানকদেব থেকে শুরু করে কবীর, রবিদাস, বাবা ফরিদ, মীরা বাঈ, নামদেব, একনাথ কত নাম সামনে ভেসে আসে। ইতিহাস নতুনভাবে লেখা শুরু হল, সামাজিক বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন র‍্যাডিক্যাল দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছেন এই সব কবি আর সমাজ-চিন্তকেরা। কবি, দার্শনিক আর গুরু নানকদেবের শিষ্য ভাই গুরুদাসের ভাষায় ‘গঙ্গা তখন উলটোপথে বইতে শুরু করেছে।’ কবীর ঘোষণা করলেন তিনি রাম আর আল্লাহ-র সন্তান, এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করলেন রাম আর আল্লাহ্‌-র নাম। সময়ের সঙ্গে, ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেল তাঁর নাম, ‘উলট বংশি’ (উলটো বাঁশি) নামে জনপ্রিয় হয়ে গেলেন। সুফি অধ্যাত্মবাদ আর হিন্দু দর্শনকে একসূত্রে বাঁধার দুঃসাহস দেখালেন বাবা ফরিদ। সমাজের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে অদ্বৈতবাদ আর সামাজিক সাম্যের ধারণা নতুনভাবে ব্যাখ্যা করলেন রবিদাস। শুধুমাত্র দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করাই যথেষ্ট নয়, একে পাল্টাতে হবে— এই মৌলিক পরিবর্তনের ঐতিহ্যের আবহে জন্ম হয়েছিল ভগত সিং-এর।

উনিশ শতকের শেষভাগ আর বিশ শতকের শুরুতে পাঞ্জাব ছিল ভূমি আন্দোলনের এক কেন্দ্রবিন্দু। ভগত সিং-এর বাবা আর দুই কাকা জেল খাটছিলেন এই আন্দোলনে সামিল হওয়ার অপরাধে। ইতিহাসের এমনই রসিকতা যে ১৯০৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর যেদিন ভগত সিং জন্মালেন ওঁর বাবা-কাকারা সেদিনই জেল থেকে ছাড়া পেলেন। এই সময়ে পাঞ্জাবের সব শিশুই সম্ভবত প্রতিরোধের উত্তরাধিকার নিয়েই জন্মেছিলেন। সেই কারণে সমাজতন্ত্রের ধারণা যে তাদের সহজাত এটা ভেবে নেওয়া বোধহয় খুব ভুল হবে না।

ভগত সিং প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িত হয়েছিলেন ছাত্রাবস্থা থেকেই নওজোয়ান ভারত সভা প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে। ১৯২০ সালে তৈরি করলেন হিন্দুস্থান স্যোসালিস্ট রিপাবলিক্যান অ্যাসোসিয়েশন। তাঁর সারা জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করে, তাঁর চিন্তাভাবনা আমাদের ঋদ্ধ করে, সমৃদ্ধ করে, যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে শিক্ষিত করে। সেই কারণে আজকের এই জটিল পরিস্থিতিতে তাঁর কথা বেশি বেশি করে মনে পড়ে। আজকের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতে তাঁর অমোঘ ঘোষণা “পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের দিন শেষ হওয়ার পথে” আমাদের কাছে আশার আলোকবর্তিকা। তাঁর সময়ের প্রেক্ষিতেই নয়, যে মহান আদর্শের জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন আর প্রাণ দিয়েছেন সেই আদর্শের কথা বারবার আমাদের স্মরণ করতে হবে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও নির্ভীক এই যোদ্ধা সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল ছিন্ন করে আমাদের এই মহান দেশে স্বাধীন মুক্ত গণরাজ্য প্রতিষ্ঠার আদর্শে অবিচল ছিলেন।

ফাঁসির আদেশ হাতে আসার পরে ভগত সিং নিজের আর সহকর্মীদের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ সরকারকে একটা চিঠি লেখেন। গভর্নরকে তিনি লেখেন “আদালতের আদেশের ভিত্তি দুটি অনুমান— এক, ব্রিটিশ রাষ্ট্র আর ভারত রাষ্ট্র পরস্পর এক যুদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। [আর দুই] আমরা [ভারতের নাগরিকেরা] সেই যুদ্ধের অংশীদার…… দ্বিতীয় অনুমানটি আমাদের পক্ষে খুবই তোষামোদকারী।” চিঠিটি ভগত সিং শেষ করছেন এই বলে যে “পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের দিন শেষ হওয়ার পথে।” [“the court order is based on two assumptions: One, there exists a state of war between the British state and Indian state. and, that we are part of the war… The second assumption is really flattering for us”. The letter ended by saying that “the days of capitalist and imperialist exploitation are numbered”.]

কেবলমাত্র এই আদর্শে বলীয়ান হলেই আমরা শুধু নোভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে যে নিজেদের রক্ষা করতে পারব তাই না, বরং আমাদের সব সমস্যা সমাধান করে সামনে এগিয়ে যাবার সাহস ও পাথেয় জোগাড় করে নিতে পারব। এ কারণে আজ বারবার ভগত সিং-কে মনে করা দরকার।


[ঋণ স্বীকার — এই প্রবন্ধ রচনায় Opinion পত্রিকায় ১৫ মার্চ ২০২০-তে প্রকাশিত শ্যাম এ কৃষ্ণ লিখিত How the Spanish flu changed the course of Indian history প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি তথ্য গ্রহণ করা হয়েছে।]