Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দেখনদারি বা অযথা ভয়— কোনওটা দিয়েই এই অভূতপূর্ব সঙ্কটের মোকাবিলা করা যাবে না

পড়গুম্মি সাইনাথ

 





লেখক সাংবাদিক, নিবন্ধকার, 'পিপলস আর্কাইভ ফর রুরাল ইন্ডিয়া'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। বর্তমান নিবন্ধটি গত ২৬শে মার্চ 'দি ওয়ার'-এ প্রকাশিত হয়।

 

 

 

করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত তাঁর প্রথম ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদি দেশবাসীকে থালাবাসনের বাদন সহযোগে ভাইরাসের ভূত ভাগানোর বার্তা দিয়েছিলেন।

আর তাঁর দ্বিতীয় ভাষণে, ভয়ের চোটে আমাদেরই আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে পড়ার যোগাড়!

ভাষণে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে দরিদ্ররা কীভাবে অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী পাবেন সে ব্যাপারে কোনও বার্তা না দিয়ে এক অন্য ভয়ের জন্ম দিলেন তিনি। ফলস্বরূপ, মধ্যবিত্তদের মালপত্র কেনার ভিড়ে দোকান লুঠ হওয়াটাই বাকি থাকল শুধু, গরিব মানুষ পেল না কিছুই।

ভাষণে নিজেদের গ্রামের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের উদ্দেশে কোনও কথা বলা হল না, দেওয়া হল না ছোট ব্যবসায়ী, অন্যের বাড়িতে কাজ করা মানুষজন বা এবারের রবিশস্য ঘরে তুলতে না পারা কৃষিশ্রমিকদের জন্য কোনও বার্তা। ভাষণে বাদ রয়ে গেলেন লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক মানুষও।

অবশ্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত আপদকালীন প্যাকেজে কিছুটা মুখরক্ষা হল, বলা হল প্রত্যেক নাগরিককে তিন মাসব্যপী বিনামূল্যে পাঁচ কেজি চাল দেওয়ার কথা। এই পাঁচ কেজি পূর্ববর্তী পিডিএস-এর আওতায় প্রদেয় পাঁচ কেজি চালের অতিরিক্ত। তবু সংশয় থেকে গেল, আগের পাঁচ কেজি চাল তাহলে কি বিনামূল্যে পাওয়া যাবে নাকি কিনে নিতে হবে?

কিনতে হলে, তা মোটেই কাজের কথা হল না।

প্যাকেজের অধিকাংশ ঘোষণাই নতুন কিছু নয়, আগেই এগুলির অস্তিত্ব ছিল। MNREGA প্রকল্পের কুড়ি টাকা বেতনবৃদ্ধি সেই পূর্ববর্তী ঘোষণার মধ্যেই পড়ে, যা কিনা এখনও বকেয়া রয়েছে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত দিনের কথা উল্লেখ করা হল না কেন? সেই প্রকল্প কি এখনই শুরু করা হবে, হলে সেই কাজগুলি কী ধরনের, তাতে কি সামাজিক দূরত্বের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সুযোগ থাকবে?

আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সেইসব প্রকল্প শুরু করতে যদি আরও বেশ কয়েক সপ্তাহ দেরি হয়, ততদিন মানুষ কী করবে বা কী খেয়ে বাঁচবে? তাঁদের স্বাস্থ্য কি তখন সেই কাজ করার উপযুক্ত থাকবে? না, যতদিন এই সঙ্কট চলবে, কাজ থাকুক বা না থাকুক, MNREGA-র অধীনে থাকা প্রতিটি শ্রমিক ও কৃষক যাতে তাদের দৈনিক মজুরি পান, তা আমাদের সুনিশ্চিত করতেই হবে৷

পিএম-কিসান প্রকল্পের দুহাজার টাকার সুবিধা আগে থেকেই ছিল— নতুন কী যোগ করা হল? শুধু প্রতি ত্রৈমাসিকের শেষ মাসে যে টাকাটা দেওয়া হত, তা এখন থেকে প্রথম মাসেই অগ্রিম হিসেবে দেওয়া হবে।

অর্থমন্ত্রীর প্যাকেজে ঘোষিত ১.৭ লক্ষ কোটির অর্থ কোন কোন খাতে খরচা করা হবে তার কোনও সুনির্দিষ্ট বিভাজন নেই, এর মধ্যে নতুন কোনও খাত যোগ হল কিনা বলা নেই। এই অর্থ বরাদ্দের প্রকল্পগুলির কতটা দুর্যোগ-পূর্ববর্তী, কতটা দুর্যোগকালীন, বোঝা গেল না কিছুই।

বলা বাহুল্য, এই ঘোষণাগুলি আপৎকালীন সুযোগসুবিধা হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্যই নয়। এছাড়াও, বিধবা মহিলা, পেনশনার বা প্রতিবন্ধীদের জন্য ঘোষিত এককালীন ১০০০ টাকার সাহায্য তিন মাসে দুদফায় পাবেন? জনধন যোজনার আওতায় থাকা কুড়ি কোটি মহিলার জন্য প্রদেয় ৫০০ টাকা কি আগামী তিন মাসের প্রতি মাসে দেওয়া হবে?

সন্দেহ নেই, ব্যাপারগুলো দেখনেপনার চেয়েও খারাপ। এগুলো অশ্লীল।

সেল্ফহেল্প গ্রুপের কর্মীদের ঋণের পরিমাণের ঊর্ধসীমা বাড়ানো হল, কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলাবে না কারণ যেকোনও সাধারণ ঋণ পেতেই তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। এই প্যাকেজ নিজের গ্রাম থেকে অনেক দূরের শহরে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের কোন কাজে লাগবে?

শ্রমিকদের পাশে থাকার যে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, তা একেবারেই যথেষ্ট নয়। জরুরি অবস্থায় কিছু কার্যকরী আপৎকালীন প্যাকেজের পরিকল্পনা করতে না পারা যেমন এক চরম ব্যর্থতা, নীতিনির্ধারকদের ধ্যানধারণা আরও ভয়াবহ। তাদের ধারণাতেই নেই দেশে কী ধরনের সঙ্কট ঘনিয়ে আসছে!

ঠিক এই অবস্থায়, সামাজিক সুরক্ষার কোনও আশ্বাস না পেয়ে সম্ভবত রিভার্স মাইগ্রেশনের দিকেই হেঁটে যাচ্ছে দেশ। এই মুহূর্তে এর গতিপথ পরিবর্তন আর সম্ভব নয়। বিভিন্ন রাজ্যের তথ্য থেকে এ ছবি পরিষ্কার যে কর্মস্থল অর্থাৎ দূরের শহর থেকে নিজেদের গ্রামে ফিরে আসছে এক বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক।

এই মুহূর্তে প্রাপ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম ব্যবহার করছেন তাঁরা— অর্থাৎ হাঁটা দিয়েছেন। কেউ সাইকেলে ফিরছেন। একটা বিরাট অংশ বন্ধ হয়ে যাওয়া বাস ট্রেনের ভরসা করে মাঝপথে আটকে গিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে। খুব স্বাভাবিক, দুর্ঘটের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে এই অবস্থায়।

কল্পনা করুন, বিরাট সংখ্যক মানুষ গুজরাটের শহর থেকে ফিরছে রাজস্থানের গ্রামে, কখনও হায়দ্রাবাদ থেকে দূরের তেলেঙ্গানা বা অন্ধ্রের গ্রামে অথবা দিল্লি থেকে উত্তর প্রদেশ বা বিহারে, কিংবা মুম্বই থেকে কেউ জানে না এমন হাজার হাজার গন্তব্যে। তারা বাইরে থেকে কোনওরকম সাহায্য না পেলে, তাদের ক্রমশ শেষ হয়ে আসা খাবার ও জলের সঞ্চয়, এক নারকীয় পরিস্থিতির জন্ম দেবে৷

এই মহামারির পাশাপাশি তারা কলেরা বা ডাইরিয়ার মতো পুরনো রোগগুলোর প্রকোপে পড়বে খুব তাড়াতাড়ি।

তাছাড়া, আর্থিক বিপর্যয় ক্রমশ যে পরিস্থিতির দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে, তাতে ক্রমশ এক বিরাট অংশের শ্রমিক এবং তরুণ সমাজ মৃত্যুর মুখে পড়বে। এ বিষয়ে পিপলস হেলথ মুভমেন্টের গ্লোবাল কোঅর্ডিনেটর টি সুন্দরারামন বলছেন:

“লকডাউন পরিস্থিতির জের যেভাবে জরুরি স্বাস্থ্যপরিষেবাকেও পঙ্গু করে দিয়েছে, অর্থনৈতিক সঙ্কট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনও হতে পারে যে অন্যান্য রোগভোগে মৃত্যুর সংখ্যা করোনা-জনিত মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাপিয়ে যেতে পারে।

করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে ঝুঁকির জায়গায় আছেন সমাজে ৬০ বা তার বেশি বয়সের মানুষেরা যারা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব, স্বাস্থ্যসেবার ক্রমসঙ্কোচন এবং অমিল, বিরাট সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ ও সমাজের তরুণতর অংশকে শারীরিকভাবে ঝুঁকির জায়গায় নিয়ে আসবে।

ন্যাশনাল হেলথ সিস্টেম রিসোর্স সেন্টারের প্রাক্তন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ডক্টর সুন্দরারামন আরও বলেন,

রিভার্স মাইগ্রেশনের প্রবণতা আটকে তাদের উপার্জনের পথটি সুনিশ্চিত করা আশু প্রয়োজন। তা না হলে দরিদ্র মানুষের করোনা ভাইরাসজনিত মৃত্যুকেও খুব তাড়াতাড়ি ছাপিয়ে যাবে অপুষ্টি ও অন্যান্য সাধারণ রোগ থেকে আসা মৃত্যু।

বিশেষ করে রিভার্স মাইগ্রেশন এভাবে বাড়তে থাকলে, শহরে পড়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকরা খিদের কবলে পড়বে, কারণ তাদের ন্যূনতম বেতনটুকুই তারা একটা সময় জোগাড় করতে পারবে না।

অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিকরাই যে সাইটে কাজ করেন, সেখানেই থাকেন। কাজের জায়গাগুলোতে শাটডাউন হয়ে গেলে, তাঁদের চলে যেতে বলা হলে, তাঁরা কোথায় যাবেন? যে বিশাল দূরত্ব পেরিয়ে তাঁরা এসেছেন, সেখানে হেঁটে ফেরা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। অত শারীরিক ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই আছে। তাঁদের রেশন কার্ড নেই, কোথা থেকে তাঁরা খাবার পাবেন?

আর্থিক দুরাবস্থা কিন্তু ইতিমধ্যেই দ্রুতগতিতে বাড়ছে।

সবমিলিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে যে পরিযায়ী শ্রমিক, গৃহসহায়িকা, বস্তিবাসী মানুষসহ অন্য গরিব মানুষেরাই করোনার বাহক এমন কথা সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করানো গেছে। অথচ প্রকৃত সত্য হল,   SARS-এর মতোই করোনারও বাহক উড়োজাহাজে চড়া শ্রেণির মানুষজন, অর্থাৎ আমরা। তা স্বীকার না করে, আমরা যেন শহরকে স্যানিটাইজ করে, এইসব ‘আবর্জনাদের’ ধুয়েমুছে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এখন, মনে করুন, আমাদের শ্রেণি থেকে এইসব পরিযায়ী শ্রমিকদের কারও কারও মধ্যে যদি এই ভাইরাস সংক্রামিত হয়, তারপর তাঁরা যখন বাধ্য হয়ে নিজেদের গ্রামে পৌঁছে যাবেন, মহামারি কী আকার ধারণ করতে পারে?

এমনিতেই কাজের জায়গা একই রাজ্য বা পড়শি রাজ্য হলে পরিযায়ী শ্রমিকেরা সাধারণত হেঁটেই ফেরেন। পথে চায়ের দোকান বা ধাবায় সামান্য কাজ করে, সেখানেই ঘুমিয়ে রাতটুকু কাটিয়ে তারা বাড়ি ফেরেন। এ অবস্থায় সবকিছুই যদি শাটডাউন থাকে, তারা কী করবেন?

আপাতত সমাজের স্বচ্ছল ও মধ্যবিত্ত অংশের এরকম একটা ধারণা হয়েছে যে ঘরে আবদ্ধ থেকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চললেই, সব ঠিক হয় যাবে। অন্তত ভাইরাস থেকে তো সুরক্ষিত থাকা যাবে। তাঁরা একেবারেই মাথায় আনছেন না, আর্থিক ক্ষতি কীভাবে টুঁটি চেপে ধরতে আসছে! অনেকের কাছে, সামাজিক দূরত্বের অন্য অর্থ হয়। হাজার দুয়েক বছর আগে সামাজিক দূরত্ব যাপনের এক শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করেছিলাম আমরা, সেটা হল বর্ণবৈষম্য। আমাদের শ্রেণিগত এবং বর্ণগত বিদ্বেষ এধরনের লকডাউন প্রতিক্রিয়ার একেবারে শিকড়ে ঢুকে আছে!

প্রতিবছর আড়াই লক্ষ ভারতীয় যক্ষ্মার কবলে পড়ে মারা যান, এটা আমাদের তেমন নাড়া দেয় না। প্রতি বছর ডায়রিয়া হয়ে এক লক্ষের কাছাকাছি শিশু মারা যায়। আমরা তেমন পাত্তা দিই না কারণ ‘ওরা’ তো আর আমরা নই।

অথচ, আতঙ্কের সূত্রপাত হল যখন দেখা গেল, দেশের সুন্দর স্বচ্ছল নাগরিকেদেরও এমন একটা ভয়াবহ রোগের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ নেই। সার্স-এর ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। অথবা সুরাটে ১৯৯৪ সালের ভয়ঙ্কর প্লেগ। দুটোই ভয়ঙ্কর রোগ, যদিও এর ফলে আমাদের দেশে যতটা মৃত্যু ঘটতে পারত, তা ঘটেনি।

তবে দুটো রোগই আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল।

সুরাটের প্লেগের সময় একবার আমি লিখেছিলাম, “প্লেগের জীবাণুর কুখ্যাতি আছে শ্রেণিবৈষম্যের প্রতি তেমন ভ্রুক্ষেপ না করার কারণে। অধিকতর আশঙ্কার কথা, এরা বিমানের ক্লাব ক্লাসে চড়ে নিউ ইয়র্কে গিয়েও সংক্রমণ ছড়াতে পারে।”

আমাদের মনে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে আমরা বোধহয় একটাই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছি আর সেই লড়াইতে জিতলেই আমাদের বাদবাকি সব যুদ্ধ জেতা হতে যাবে। কোনও সন্দেহই নেই যে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে আমাদের জোরদার লড়াই করতেই হবে, সম্ভবত ১৯১৮-র মহামারির (যাকে ভুলবশত ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে ডাকা হয়) পর এটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মহামারি (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯১৮ থেকে ১৯২১-এর মধ্যে এই মহামারিতে শুধু ভারত থেকেই প্রায় ১৬-১৭ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ গেছিল। এমনকি এখনও অবধি শুধুমাত্র ১৯২১ সালের জনগণনাতেই ভারতের গ্রামীণ জনসংখ্যার সংখ্যায় গুরুতর হ্রাস লক্ষ করা গেছিল)।

কিন্তু শুধুমাত্র কোভিড ১৯-কে ফোকাস করে বাকি বৃহত্তর সব সমস্যাকে ভুলে যাওয়া মানে অনেকটা ঘরের সব জলের কল খুলে রেখে ঘরের মেঝে শুকনো রাখার চেষ্টা করার মতোই হাস্যকর ব্যাপার। আমাদের দরকার এমন একটি ভাবনাচিন্তা করা যেখানে জনস্বাস্থ্য সচেতনতা ও অধিকার একসাথে রক্ষিত হয়।

১৯৭৮ সালে বিশ্বের স্বাস্থ্য পরিষেবায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাক্তিত্বের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ডিক্লারেশন অফ আলমা আটা— এমন একটা সময় যখন পাশ্চাত্য নিয়ন্ত্রিত কিছু কর্পোরেট স্বার্থ ডব্লুএইচও-কে মাথা নত করতে বাধ্য করেনি। সেই চুক্তিতেই বিখ্যাত ঘোষণাটি ছিল ‘হেলথ ফর অল বাই ২০০০’।

সেই ঘোষণা সম্ভবত এই বিশ্বাস থেকে ছিল যে বিশ্বের সকল মানুষ পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ এবং পর্যাপ্ত ব্যবহার করবে।

আশির দশক থেকে স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন নিয়ন্ত্রকের সম্বন্ধে বোঝাপড়া বাড়তে লাগল বিশ্বজুড়ে।

কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি বিষয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকল, খুব দ্রুত, আর তার নাম নিওলিবারেলিজম।

আশির দশকের শেষে এবং নব্বইয়ের দশকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান সংক্রান্ত মানবাধিকারের চিন্তাভাবনা যথেষ্ট মার খেতে শুরু করল।

নব্বইয়ের মাঝবরাবর থেকে সংক্রামক রোগের বিশ্বায়ন শুরু হল। কিন্তু সেই সমস্যাকে মোকাবিলা করতে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিবর্তে অনেক দেশ তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেই বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে গেল। ভারতে বেসরকারি প্রাধান্য বরাবরই ছিল। বিশ্বের প্রেক্ষিতে ভারতের স্বাস্থ্যখাতে খরচ সবচেয়ে কম— জিডিপি শেয়ারে যার পরিমাণ ১.২ শতাংশ। নব্বইয়ের দশক থেকে ধারাবাবিকভাবে দুর্বল জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা সচেতন, পলিসি নির্ধারিত কাজকর্মের ফলে আরও দুর্বল হতে গেল। বর্তমান সরকার জেলা স্তরের হাসপাতালগুলিরও বেসরকারিকরণের দিকে মন দিতে শুরু করল।

দেশে বর্তমানে গ্রামীণ পরিবারে ঋণের সবচেয়ে বড় অংশ হল স্বাস্থ্যখাতের খরচ। ২০১৮-এর জুনে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ২০১১-১২ সালে দেশের ৫৫ মিলিয়ন মানুষ দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত হয়ে গেছিল, শুধুমাত্র স্বাস্থ্যক্ষেত্রে খরচের সঙ্গে পেরে না উঠতে পেরে। এদের মধ্যে ৩৮ মিলিয়ন মানুষ শুধুমাত্র ওষুধপত্র কেনার চাপে দারিদ্রসীমার নীচে চলে গেছিল।

দেশের হাজার হাজার পরিবার যারা কৃষক আত্মহত্যার ঘটনায় জর্জরিত, তাদের মধ্যে একটা সাধারণ ফ্যাক্টর কাজ করছে, তা হল স্বাস্থ্যখাতে বিশাল খরচের সঙ্গে তারা পেরে উঠছে না, অনেক সময়ই এই টাকাটা বাইরের সুদখোর মহাজনদের কাছ থেকে ধার করা হচ্ছে।

আমাদের এই বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ, কোভিড-১৯ এর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য সবচেয়ে কম প্রস্তত। ট্র্যাজেডি এটাই, আসছে বছরে আবার কোভিড অন্য নামে আসতে চলেছে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে থেকেই সার্স ও মার্স (করোনা ভাইরাসের আরও দুটি রূপ) ও অন্যান্য বিশ্বব্যাপী অসুখের প্রকোপ আমরা দেখেছি।

১৯৯৪ সালে আমরা সুরাটের প্লেগ দেখেছি। একের পর এক সঙ্কেত আসতে শুরু করেছিল, কী ধরনের পৃথিবী আমরা তৈরি করছি।

গ্লোবাল ভিরোম প্রজেক্টের অন্যতম কর্ণধার অধ্যাপক ডেনিস ক্যারল এ ব্যাপারে বলছেন, “আমরা এমন একটা ইকোজোনের গভীরে ঢুকে পড়ছি, যার সম্বন্ধে আমরা আগে কোনওদিন ওয়াকিবহাল ছিলাম না।”

তাঁর কথায়, বিরল জনসংখ্যাযুক্ত প্রাকৃতিক অংশে তৈল এবং খনিজ সম্পদ উত্তোলনের যথেষ্ট মূল্য আমাদের দিতে হচ্ছে। ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রে আমাদের ক্রমাগত হস্তক্ষেপের ফলে শুধুমাত্র যে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে তাই নয়, পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিপর্যয়ও নেমে আসছে। মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীদের ক্রমাগত বেড়ে চলা যোগাযোগের কারণে বাড়ছে সংক্রমণের সম্ভাবনাও, এমনকী নাম-না-জানা নানা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবও।

অর্থাৎ, আমাদের এরকম আরও অনেক কিছু দেখতে হবে।

কোভিড ১৯-এর ক্ষেত্রে দুধরনের নিয়তি আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে:

এক, ভাইরাস আমাদের স্বার্থে মিউটেট করে কয়েক সপ্তাহ পরেই শেষ হতে যাচ্ছে,

অথবা— অথবা সে তার নিজের স্বার্থে মিউটেট করে সংক্রমণের প্রবণতা বাড়িয়ে তুলবে, আর তাই যদি হয়, সাক্ষাৎ নরক নেমে আসছে ভারতবর্ষে।

তাহলে আমরা ঠিক কী কী করতে পারি? আমি কিছু প্রস্তাব রাখছি, যার বেশ কিছু ইতিমধ্যেই দেশের অনেক সমাজকর্মী এবং বুদ্ধিজীবীরা করণীয় হিসেবে পেশ করেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, কেরল সরকার এর মধ্যে বেশ কিছুই শিক্ষণীয় হিসেবে তাদের রাজ্যে গ্রহণ করে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ঘোষণা করতে পেরেছে।

করোনা প্রকোপ যদি আগামী দু সপ্তাহ বজায় থাকে, দেশের কৃষকদের খারিফ মরসুমে খাদ্যশস্য উৎপাদনের অনুরোধ করা আপাতত সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ঠিক একই ভাবে, কোভিড-১৯-এর এই সময়কাল যে ইতিহাসের এক পরম উন্মোচক মুহূর্ত তা যেন আমাদের নজর এড়ায় না। এটা একটা সন্ধিক্ষণ, যখন আমরা ঠিক করব আমাদের কোনদিকে যেতে হবে। এ সময় অসাম্য ও স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিতর্কগুলিকে নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার সময়।