Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লকডাউন নয়, ভারতের আরও টেস্টিং প্রয়োজন

. পার্থসারথি রায়

 



ড. পার্থসারথি রায় কলকাতার আই আই এস ই আর-এর অধ্যাপক, যিনি বিশ্বের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর মধ্যে অন্যতম, যাঁর সঙ্গে WHO করোনা সংক্রান্ত গবেষণা ও পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করেছে। মূল সাক্ষাৎকারটি দি উইক-এ প্রকাশিত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রবি ব্যানার্জি।

 

 

 

করোনা ভাইরাস কোথা থেকে এসেছে? এর উৎসের ব্যাপারে কী নিশ্চয়তা পেয়েছেন আপনারা?

এটি মূলত এসেছে অন্য প্রাণী থেকে। চিনের উহানের বন্যপ্রাণ মূলত এর উৎস। সেখান থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমণ হয়েছে বিশেষ কিছু প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। এভাবেই অন্য প্রজাতির থেকে মানুষের দেহে আসতে পারে এই ভাইরাস।

কোন কোন প্রাণীতে এটি সংক্রামিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে?

দেখা গেছে বাদুড়ের দেহে থাকা একটি ভাইরাসের সঙ্গে এর ৯৬ শতাংশ মিল পাওয়া গেছে, এবং ৯৯ শতাংশ মিল পাওয়া গেছে প্যাঙ্গোলিন-এর দেহে পাওয়া ভাইরাসের সঙ্গে। গবেষণা করে দেখা গেছে, প্রথমে বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিন, প্যাঙ্গোলিন থেকে শেষে মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়েছে এই রোগ।

WHO-র পক্ষ থেকে এই রোগকে কেন অতিমারি বলা হয়েছে বলে আপনার মনে হয়?

দেখুন, মারণ ক্ষমতা এবং সংক্রমণ করার ক্ষমতা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। সাধারণত যে ভাইরাস প্রচণ্ড ভিরুলেন্ট এবং ঘাতক বা মারণ ক্ষমতার অধিকারী, তার সংক্রমণের ক্ষমতা কম হয় এবং প্রচণ্ড সংক্রমণের ক্ষমতা আছে এমন ভাইরাস সাধারণত অতটা মারণক্ষম হয় না। যেমন, ২০০৩-এর সার্স ভাইরাস, যা প্রচণ্ড ঘাতক হলেও ততটা সংক্রামক ছিল না। করোনা কিন্তু প্রচণ্ড সংক্রামক, বিশ্বের প্রায় সবাইকেই সংক্রামিত করার ক্ষমতা রাখে এটি।

তার মানে আপনি একেবারেই এটিকে মারণ ভাইরাস বলছেন না?

একেবারেই মারণ ভাইরাস নয়। শুধুমাত্র বয়স্ক মানুষ এবং কো-মর্বিডিটি আছে এমন ব্যাক্তিদের ক্ষেত্রেই এটি সমস্যা করতে পারে।

ঠিক যেমন, WHO বলেছে আমাদের এই ভাইরাসের সঙ্গে টিকে থাকা অভ্যাস করতে হবে।

একদম। আমরা কি টিবি বা ইনফ্লুয়েঞ্জার সঙ্গে বসবাস করছি না? বলা যেতে পারে, এটা এক ধরনের দুর্বলতাসাধন প্রক্রিয়া। ভাইরাস যত বেশি মানুষকে সংক্রামিত করে তাদের মৃত্যুর কারণ হবে, তত তাড়াতাড়ি এর ক্ষমতা কমবে এবং আরও বেশি মানুষকে সংক্রমণ করার ক্ষমতা হারাবে। এভাবেই ভাইরাসটি অভিযোজিত বা মিউটেটেড হয়ে জনসাধারণের মধ্যেই শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে। এটাকে এন্ডেমিক বলে, এক একটা সময় এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে। একমাত্র, কম ইমিউনিটি আছে বা অপুষ্টি ও গুরুতর অসুখে ভুগছেন এমন ব্যক্তিরাই এতে মারা যাবেন। এধরনের বিক্ষিপ্ত এবং এন্ডেমিক ভাইরাস আর এখনকার মতো উচ্চ মারণক্ষমতার অধিকারী না থাকলেও মাঝে মাঝেই কিন্তু ফিরে আসবে। এখন, আমার প্রশ্ন হল, এটি এখনই মরছে না কেন? সরকারের পক্ষ থেকে অপুষ্টি কমানোর জন্য আদৌ কিছু চেষ্টা করা হচ্ছে কি?

আপনি WHO-কে কীভাবে সাহায্য করছেন?

যখন উহানে প্রথম সংক্রমণ ঘটল, তখন থেকেই WHO বিশ্বের প্রচুর সংখ্যক বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং পরামর্শ নিয়ে আসছে।

কী ধরনের প্রশ্ন এবং সাহায্য তারা আপনাদের থেকে চাইছেন?

তারা মূলত জানতে চাইছেন এই রোগের গতিপথ, ভাইরাস কত ধরনের ভ্যারাইটির জন্ম দিতে পারে বা মিউটেট হলে এর পরবর্তী রূপ— এইসব প্রশ্ন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ভাইরাসের জেনোটাইপ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারণা।

এই জেনোটাইপ সংক্রান্ত শিক্ষা আমাদের পরবর্তী সময়ে কীভাবে সাহায্য করবে?

সারা বিশ্ব জুড়ে এই ভাইরাসের ওষুধ বা ভ্যাক্সিন তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এক এক ধরনের ভ্যাক্সিন বিশেষ কিছু জেনোটাইপের ক্ষেত্রে সক্রিয় হলেও অন্যান্য জেনোটাইপের ক্ষেত্রে হচ্ছে না।

এখনও পর্যন্ত এর কটা জেনোটাইপ পাওয়া গেছে?

গোটা বিশ্বের মলিকিউলার বায়োলজিস্টদের পক্ষ থেকে গবেষণায় মোট ২৯টি জেনোটাইপ পাওয়া গেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, ভারতে এখনও পর্যন্ত মাত্র দুটি জেনোটাইপের খোঁজ পাওয়া গেছে। বাকি জেনোটাইপগুলি খোঁজার কোনওরকম চেষ্টা নেই, শুধু লকডাউন নিয়েই লোকজন শোরগোল করে চলছে।

এই দুটো জেনোটাইপ নিয়ে একটু বিস্তারিত বলবেন….

সারা পৃথিবীতে স্যাম্পলিং করে যেখানে মোট ২৯টি জেনোটাইপ পাওয়া গেছে সেখানে ভারতে করোনা ভাইরাসের দুটি মাত্র জেনোটাইপ পাওয়া গেছে। আমরা ভারতে দুধরনের স্যাম্পল পেয়েছি যেখানে ভাইরাসটির দুধরনের জিন দেখা গেছে। ভারত থেকে ভাইরাসটির চরিত্র শনাক্ত করতেই সমস্যা হয়ে যাচ্ছে, ফলত এই রোগটির প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ব্যাপারে আমরা এখনও কোনও ক্লু পাচ্ছি না।

তার মানে মলিকিউলার বায়োলজিস্টরা লকডাউন সমর্থন করছেন না?

দেখুন, আমি শুধু আমার কথা বলতে পারি। লকডাউন তখনই কার্যকর ও সফল হবে যখন সন্দেহভাজন জনসংখ্যার উপর আপনি রোগের পরীক্ষা করতে পারবেন। লকডাউনের ফলে মানুষ বাড়িতে থাকছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির লোকেরা এর ফলে সংক্রামিত হচ্ছেন। লক্ষণ চলতে থাকলে তাঁরা চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। কিন্তু ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে লকডাউন শেষ হলে এরা বাইরে বেরিয়ে অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে মিশে তাঁদের সংক্রামিত করছেন এবং ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আবার বেড়ে যাচ্ছে।

ঠিক এমনটিই হয়েছিল ১৯১৮-র স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জার সময়ে। প্রচণ্ড প্যান্ডেমিক এই ভাইরাস প্রকৃত H1N1 ভাইরাস ছিল। ভাইরাসটি যখন এভাবে দ্বিতীয়বার ফিরে এল, তখনই অধিকাংশ মৃত্যু ঘটিয়েছিল।

তাহলে সরকার লকডাউন করছেন কেন?

সেটা সরকারই ভাল বলতে পারবেন। হয়ত একটা ভয় থেকে বা টেস্টিং এড়িয়ে যেতে এই সিদ্ধান্ত। WHO-র পক্ষ থেকেও বারবার টেস্টিং-এর কথা বলা হচ্ছে। ভারতের উচিত যারা প্রথম এই ভাইরাস এদেশে ঢুকিয়েছিল সেই অংশটাকে চিহ্নিত ও আলাদা করে তারপর অসংখ্য টেস্টিং করা।

ইতালি, স্পেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

দেখুন, ওইসব দেশের সঙ্গে আমাদের একাসনে বসবেন না প্লিজ। ওইসব দেশগুলির জনসংখ্যার বিশাল সংখ্যক অংশ বয়স্ক মানুষ। ইতালির জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ মানুষের বয়স ষাটের উপরে। তাছাড়া, ইতালি পর্যটন শিল্পের থেকে আসা আয়ের রাস্তাটা বন্ধ করতে চায়নি। তাই বাইরে থেকে আসা বিশাল সংখ্যক পর্যটক নিয়ন্ত্রণের দিকেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

কিন্তু তাঁরা তো এখন লকডাউন ঘোষণা করেছেন …

সে তো টেস্টিং করার জন্য। টেস্ট করতে এবং কিছু চিকিৎসাব্যবস্থা বন্দোবস্ত করতেই মূলত এই সাময়িক লকডাউন। প্রকৃতপক্ষে টেস্ট করতে, হাসপাতালের পর্যাপ্ত বেড বাড়াতে, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুযোগসুবিধা ও অন্যান্য পরিষেবার জন্য লকডাউন একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে।

আপনি বলছেন, ভারত সেটা করছে না?

একেবারেই করছে না। ইতালি যেখানে জনসংখ্যার প্রতি মিলিয়ন পিছু টেস্ট করছে ৫০০০ জনকে, ভারত সেখানে করছে মাত্র ১৮ জনকে। যদি এই সময়টা টেস্ট না করান, হাসপাতালের আইসিইউ, বেড বা অন্যান্য চিকিৎসা পরিষেবা না বাড়ান, কী হবে লকডাউন করে?

কিন্তু আমাদের তো যথেষ্ট পরিমাণে কিট নেই!

এটা কোনও অজুহাত হতে পারে না। আমাদের দেশে অন্তত ১০০০০টি মলিকিউলার টেস্টিং ল্যাবরেটরি আছে, যেখানে এধরনের টেস্টিং করা হয়।

সেখানে কীভাবে টেস্টিং করা যাবে?

আমাদের একজন সন্দেহভাজন ব্যাক্তির রক্তের নমুনা এবং করোনা পজিটিভ এমন একটি রক্তের নমুনা প্রয়োজন যাতে দুধরনের নমুনার মধ্যে জিনের তুলনা করা যেতে পারে। ১০০০ টাকারও কম অর্থে এধরনের টেস্ট সম্ভব। দুসপ্তাহ আগেই আইআইএসআর-এ আমরা এ বিষয়ে কস্ট এস্টিমেট করে দেখেছি যে খরচ পড়ছে মাত্র ৭০০ টাকা।

কিন্তু এধরনের পরীক্ষা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

বাজারে আসা হাজারটা অজানা টেস্টিং কিটের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি এটা শুনে যে ভারত সরকার থেকে টেস্টিং কিটের মাধ্যমে টেস্ট করতে প্রতি টেস্ট পিছু খরচ নির্ধারণ করেছে ৪৫০০ টাকা। কিছু বিশেষ কোম্পানিকে সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। আমরা ভাবতেই পারছি না। কর্পোরেট দুনিয়ার একটা অংশ এর মাধ্যমে সাংঘাতিক লাভবান হচ্ছে।

আপনি কি সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন?

এটাই খুব দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারগুলির পরিকাঠামো অনেক দেশের তুলনায় ভালো। এমনকি WHO-র পক্ষ থেকেও গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য আমাদের ল্যাবগুলিকেই ভরসা করে। কিন্তু কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার কারও পক্ষ থেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।

কিন্তু ভারত তো WHO-র নির্দেশিকা মেনেই কাজ করছে!

WHO বলেছে রোগীদের স্বতন্ত্র করে তারপর বেশি বেশি করে টেস্ট করার কথা, কখনওই লকডাউনের কথা বলেনি। ভারত শুধু লকডাউন করছে, টেস্ট করছে না। যদি টেস্ট না করেন, ভাইরাসের ভ্যারাইটি বা মিউটেশন কোনও ব্যাপারেই ধারণা করা যাবে না।