Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

করোনা আসুক বা না-আসুক, ওরা রোজই হোম আইসোলেশনে

মৌ ভট্টাচার্য

 






লেখক সমাজবিজ্ঞান-গবেষক, নারী ও শিশুঅধিকারকর্মী

 

 

বারান্দা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালেই ভয় করছে। সকালবেলায় কিছু গাড়ি চললেও বিকেলে একদম ফাঁকা। সামনের রাস্তার লাইটও কিছুদিন হল খারাপ হয়ে আছে, তাই একদম শুনশান। দু-একটা আ্যম্বুলেন্সের হাড়-হিম-করা আওয়াজ। বিশ্রাম নিতে-নিতে ক্লান্তি তাড়া করে আমায়… আমাদের…

বন্দিদশা কী, তা কিন্তু আমরা সত্যি কখনও বুঝিনি। সে অর্থে, সার্বিকভাবে, এই প্রথম। গৃহবন্দি থাকার দুশ্চিন্তা আমাদের অনেককেই ভাবাচ্ছে। কীভাবে কাটবে এতদিন। কী করে সামলাব এত কাজ, বাড়ির পরিচারিকাদের ছাড়া। ইউটিউবে রান্নার রেসিপি ডাউনলোড থেকে শুরু করে নেটফ্লিক্স, হইচই-এ সিনেমা দেখার মতো বিলাসিতায় ভরা, ওলটপালট করে দেওয়া এইসব চিন্তার মাঝে হঠাৎই মনে পড়ল সেইসব মেয়েদের মুখ যারা দিনের পর দিন ‘শেল্টার হোম’ নামক যন্ত্রণাটার মধ্যে আটকা পড়ে থাকে। করোনা ভাইরাস আসুক বা না-আসুক, তাদের রোজই লকডাউন– রোজই হোম আইসেলেশন। না আছে যোগাযোগ বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে, না বাড়ির লোকেদের সঙ্গে। বাড়ির লোকের সঙ্গে হয়তো কখনও-কখনও কথা হয়, কিন্তু এই যেমন আমরা ইচ্ছে হলেই ভিডিও কল করছি বন্ধুদের, সেইরকম যোগাযোগের কোনও উপায়ই নেই।

আমাদের গৃহবন্দিদশার তিন সপ্তাহ প্রায় হতে চলল। তাতেই আমরা হাঁফিয়ে উঠছি, অবসাদে ভুগছি– যা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু যারা দিনের পর দিন বন্দিদশায় থাকে, তারা? একবার ভাবুন তো, নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই শাস্তি ভোগ করতে হয়। একদিন দুদিন নয়, দিনের পর দিন– কখনও এমনকী বছরের পর বছর। এরপর তাদের মানসিক অবসাদে ভোগা কি স্বাভাবিক নয়? এরপরও কি তাদের হোম থেকে পালানোর প্ল্যান করা স্বাভাবিক নয়? এরপরও কি মারপিট করা, একে অন্যকে দোষারোপ করা স্বাভাবিক নয়? খবরে দেখছিলাম, চিনে দীর্ঘদিন লকডাউনের ফলে বিবাহবিচ্ছেদ নাকি প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গিয়েছে।

আবার অন্যদিকে যেখানে আমরা জানি যে, একমাস কি হয়তো আরও কিছুদিন বাড়বে এই লকডাউন, তারপর আস্তে আস্তে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরব, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে দেখা হবে আবার। কিন্তু ওদের এই বন্দিদশা অনিশ্চিত। কবে ঘুচবে, কেউ জানে না। সে এক জটিল রাষ্ট্রযন্ত্রের ফাঁদ, আইনের জটিল হিসেবনিকেশ পেরিয়ে তবেই সেখানে পৌঁছতে পারবে, তবে দেখা হবে মা-বাবার সঙ্গে।

হ্যাঁ, আমি সেইসব মেয়েদের কথাই বলছি যারা পাচারের শিকার হয়ে আসে বাংলাদেশ থেকে, নেপাল থেকে অথবা ভারতের মধ্যেই অন্য কোনও রাজ্য থেকে। তারপর দীর্ঘদিনের লড়াই চলে তাদের দেশে ফেরার– ঘরে ফেরার। বন্দিদশায়, কেন জানি না, এদের কথাই বারবার মনে হচ্ছে। অপেক্ষার চোখ নিয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলো যেন বলছে “দ্যাখ, কেমন লাগে।”

আমরা যারা সমাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, বিশেষ করে যারা পাচারের শিকার হওয়া শিশুদের নিয়ে কাজ করি, তাদের মধ্যে অনেকেরই শেল্টার হোমে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা আছে। সেরকমই একটি মেয়ে, ধরুন, শাহনাজ।

শাহনাজের (নাম পরিবর্তিত) বয়স ১৩। গ্রাম ঝালোকাঠি, বরিশাল। ইন্ডিয়ায় চলে এসেছে কাজ করতে। আসার সময় বোঝেনি যে, কোনও মন্দ কাজের জন্য তাকে নিয়ে আসা হচ্ছে। সে শুনেছিল, ইন্ডিয়ায় গিয়ে ভাল কাজ করে পাশের বাড়ির আপু। তার হাত ধরেই মা-বাবাকে না-জানিয়ে চলে আসা। প্রথমে পৌঁছয় কলকাতা, তারপর মুম্বই। কলকাতা পৌঁছেও শাহনাজ বুঝতে পারেনি, তাকে কোথায় কী কাজ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে মুম্বই। হিন্দি বোঝে না সে। তাদের দেশে হিন্দিতে তো কথা বলে না মানুষ। শুধু বলিউড ফিল্ম দেখে। তাও পুরোটা বুঝতে কি পারা যায়? ভাষা না-বোঝায় যাতায়াতের পথে কারও কোনও কথাই সে বুঝতে পারেনি। একটা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাকে তোলা হয়। সেখানে তার মতো আরও কিছু মেয়ে ছিল, বাংলাদেশ থেকে আসা। তারা কিন্তু হিন্দিতে বেশ কথা বলতে পারছিল। পাশের বাড়ির আপু অবশ্য ততদিনে বেপাত্তা।

অন্য একটি মেয়ে শাহনাজকে জানাল, ওই আপুকে আর পাওয়া যাবে না। সে এই বাড়ির মালিকের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। মেয়েটি আরও জানায় যে, পালানোর চেষ্টা যেন না-করে। সে একবার করেছিল। আর তারপর তার ওপর শুরু হয়েছিল অসম্ভব অত্যাচার। এইসব শুনে শাহনাজের কান্না পাচ্ছিল। এইভাবে ঠকাল সেই আপু। প্রায় দেড় থেকে দুবছর শাহনাজ ওই বাড়িতে নোংরা কাজ করত। এক-একদিন কত খদ্দের যে তাকে বসাতে হত, আর মনে পড়ে না। কোথাও বেরোতে পারত না। সারাদিন ওই বাড়ির একটা চার ফুট বাই চার ফুট ঘরে আবদ্ধ জীবন। এও তো একধরনের আইসোলেশন, যেখানে তাকে কোনও অপশনই দেওয়া হয়নি অন্য কোনও বিকল্প বেছে নিতে। এইভাবে থাকতে-থাকতে একদিন পুলিশ রেড করে তাদের সবাইকে উদ্ধার করে কলকাতার এক শেল্টার হোমে পাঠিয়ে দেয়। আজ আড়াই বছর হয়ে গেল শাহনাজ সেই হোমে গৃহবন্দি। কোর্টে কেস চলছে। কবে শেষ হবে, কেউ জানে না। আইন তার পাচারকারীদের শাস্তি দিতে চায়, তাই সে শেল্টার হোমে বন্দি, আর তার পাচারকারীরা রাস্তায় বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

শাহনাজের সঙ্গে আমার মাঝে-মাঝেই কথা হত। বাড়ির কথা বলত ও, দেশের কথা। বন্ধুদের কথা। এইসব শুনতাম, আর আমার মনে ওর গ্রামের একটা ছবি ভেসে উঠত। ভারী সুন্দর ভাটিয়ালি গাইত শাহনাজ। নদীমাতৃক দেশে জন্মালে যা হয়। বাড়ির পাশের ছোট নদীটির সঙ্গে তাদের প্রতিদিনের যোগাযোগ। হাওয়া দোল দেয় নদীর পারের গাছে, আর শাহনাজের চোখ জলে ভরে ওঠে। এই বন্দিত্ব থেকে কবে মুক্তি তার। দিনের পর দিন বন্দিদশায় কাটাতে-কাটাতে ওরা ভুলে যায়, কবে এসেছিল এ-দেশে।

আমি জানতে চেয়েছিলাম ইন্ডিয়ায কবে এসেছে সে। উত্তরে ও বলেছিল, ওদের দেশের বাড়ির গাছে তখন সদ্য আমের বোল ধরেছিল। সেই আম খেয়ে আসা হয়নি। আমার ফোন থেকে ওর বাড়িতে ফোন করে ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়েছি। মা ওকে জানিয়েছে, এ বছরও আমের বোল এসেছে। আম পেকে উঠলে মা-বাবা-ভাই-বোন– বাড়ির সকলে মিলে খাবে। কী মিষ্টি সেই গাছের আম। সে কি এই বছরও যেতে পারবে না বাড়ি? আমি কোনও উত্তর দিতে পারিনি। শুধু বলেছি, “আমার সময় শেষ, শাহনাজ। এবার আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।”

তারপর গ্রিলের তালা খুলে যায়, আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। সন্ধে নামছে। বাড়ি ফিরতে হবে। গ্রিলের ওপারে শাহনাজের করুণ মুখ। “দিদি, সাবধানে যেও।” বাড়িতে অপেক্ষারত আমার মায়ের  মুখের সঙ্গে শাহনাজের মায়ের অপেক্ষা মিলেমিশে যায়।

শাহনাজের মতো এইরকম অজস্র মেয়ের বন্দিত্বের গল্প লেখা যায়, যারা সিস্টেমের শিকার হয়ে বাধ্য হয়েছে দীর্ঘদিনের বন্দিদশা মেনে নিতে। আমরা প্রয়োজনে যেমন বাজারে বেরোতে পারছি, ওদের কিন্তু সেই অনুমতিও নেই। রাষ্ট্রের চোখে ওরা বিদেশি। অনুপ্রবেশকারী। ওরা পালালে আরও বিপত্তি। তাই শক্ত হাতে বাঁধো।

শেল্টার হোমের জানলা দিয়ে ওরা তাই বাইরের একফালি আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। ওখানেই তাদের মুক্তি। আকাশে উড়তে থাকা পাখি দেখে শাহনাজ একদিন বলে উঠেছিল, “দিদি, আমি পাখি হলে এখনই উড়ে মায়ের কাছে চলে যেতাম।”… ভাবছিলাম, আমরা তো নিজেদের বাড়িতেই রয়েছি লকডাউনের দিনে। তবুও এত দীর্ঘশ্বাস। ওরা অচেনা অজানা জায়গায় যে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনের পর দিন থাকতে বাধ্য হয়– ভাবুন তো, এমন হলে কী অবস্থা হত আমাদের। তাই, মনে হয়, আমাদের গৃহবন্দিদশার বিলাসিতা নিয়ে আমরা ওদের আইসেলেশনকে কোনওদিনই মাপতে পারব না।

সেদিন বাড়ির কাজ সারতে-সারতে হঠাৎ জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির আমগাছে চোখ চলে গেল। গাছ ভরে উঠেছে ফলে। আমের ভারে নুয়ে পড়েছে ডাল। শাহনাজ, খুব মনে পড়ছে তোর কথা। তোর শেল্টার হোম আইসোলেশন কি ঘুচল? এইবার কি বাড়ির সকলের সঙ্গে বসে মিষ্টি আমের স্বাদ নিতে পারবি তুই?