Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আমার ইস্টবেঙ্গল

আমার ইস্টবেঙ্গল : বিষাণ বসু

বিষাণ বসু

 

বাঁকুড়া জেলার মফস্বল শহরে জন্ম, বেড়ে ওঠা, স্কুলে পড়া। জায়গাটা এমনই ঘটি-অধ্যুষিত, যে, বাঙাল শব্দটা প্রায় গালাগালি হিসেবে ব্যবহার হত। এর মাঝে বাবার প্রতি নিখাদ সহমর্মিতা বা সহানুভূতি বাদ দিলে আমার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সাপোর্টার হওয়ার দ্বিতীয় কোনও যুক্তি পাওয়া মুশকিল। কিন্তু, যুক্তি দিয়ে কবেই বা প্রেম হয়!!

অতএব, বাবার মুখে মাঠের গল্প বা রেডিওতে আশ্চর্য জীবন্ত ধারাবিবরণী শুনতে শুনতেই ক্লাবটাকে ভালোবেসে ফেললাম। প্লাস, ওই যে শুরুতেই বললাম, শুধু বড় ম্যাচ নয়, যেকোনও ম্যাচে হারলেই বাড়ি বয়ে এসে বেশ কয়েকজন হাসিমুখ কাকু হাসিঠাট্টা করে যেতেন। পাংশুমুখ বাবার পাশে ছেলে হিসেবে দাঁড়ানোর ব্যাপারটাও অবচেতনে ছিল, সম্ভবত।

পাশের বাড়ির কাকু কাঠবাঙাল। কথাতেও বাড়াবাড়ি রকমের স্পষ্ট বাঙাল টান। কিন্তু, তিনি আবার গোঁড়া মোহনবাগানি। এখনকার মত বাড়িতে বাড়িতে টিভির ব্যাপার ছিল না, অন্তত ছোট শহরে। সবাই মিলে একসঙ্গে টিভিতে খেলা দেখার চল ছিল সেইসময়। বেনসন-হেজেস ইত্যাদি ক্রিকেটের দিনে এলেও, লিগ-শিল্ডের খেলা দেখতে অবশ্য কাকু আসতেন না। বলতেন, তোদের টিভিতে খেলা দেখলেই খালি মোহনবাগান হেরে যায়।

তখন অবশ্য বড় ম্যাচ বলতেই, অ্যাডভান্টেজ ইস্টবেঙ্গল। মহামেডানও তখন বড় ক্লাব— যদিও, পড়তির দিন শুরু হয়েছে। এই দুই ক্লাবেই বিদেশি প্লেয়ার খেলতেন। মোহনবাগানের ধীরেন দে পুরনো কলকাত্তাই বাবুয়ানায় ভিনদেশি খেলোয়াড় নিয়ে নাক সিঁটকাতেন। শুনেছি, একটু-আধটু নিম্নবর্গীয় বা কালো গায়ের রঙের ফুটবলারও ওনাদের মনে ধরত না। সেসবই অবশ্য অন্যের মুখে শোনা। মোটের উপর, এইসব এক অন্য টাইম জোনের গল্প, অন্য বিশ্ব, অন্য দুনিয়ার কাহিনি।

জ্যোতিষবাবু বা নৃপেনবাবুর সময়কার ক্লাবের গল্প বাবার মুখেই কিছু শুনেছি। তবে, আমার সচেতন সমর্থকজীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত পল্টুবাবু। তারও আগে দলবদলের গল্প— জীবন-পল্টু জুটির বিপক্ষের শিবির থেকে তারকা খেলোয়াড় ভাঙিয়ে আনার প্রায় অলৌকিক কাহিনি। বললামই তো, এইসবই এক ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন জীবনের গল্প। হ্যারি পটারের দুনিয়া যাদের অতি নিকট বাস্তব, আমাদের সময়টা তাদের কাছে অপরিচিত ঠেকবে হয়ত। রাত জেগে প্লেয়ারের বাবা-মাকে ম্যানেজ করে প্লেয়ারকে ক্লাবে সই করানো, এই বর্তমান বাজার অর্থনীতিশাসিত সময়ে অকল্পনীয়। খেলা-দলবদল সবকিছুর মধ্যেই ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকত আবেগ, সেন্টিমেন্টালিটি।

ও হ্যাঁ, বলা হয়নি বোধহয়, আমারও জন্মদিন ১৩ই অগাস্ট। কাজেই, আই শেয়ার মাই বার্থডে উইথ— কার কথা বলছি, আন্দাজ করতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। কাজেই, অন্য ক্লাবের সমর্থক হওয়ার সম্ভাবনা হয়ত জন্মক্ষণেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।

সুতরাং, এই লেখা এক সমর্থকের গল্প, এক প্রায়ান্ধ সমর্থকের গল্প। ক্লাবের প্রতি ভালোবাসার গল্প। যে গল্পে সন-তারিখ খোঁজার চেষ্টা বৃথা, এমনকি তথ্য সঠিক কিনা সেও খোঁজার মানে হয় না। এমন এক সমর্থক, যার কিনা মাঠে গিয়ে লালহলুদ জার্সির ঝলমলানি দেখার সুযোগই হয়নি বিশেষ। প্রিয় ক্লাবের দরজা ঠেলে ঢোকাটুকুও হয়নি আজও। কিন্তু, দূর থেকে, বা বলা ভালো, হয়তো, দূর থেকে বলেই, যার ক্লাবের প্রতি ভালোবাসায় একটুও চিড় ধরেনি কোনওদিন।

ইস্কুলে সহপাঠীদের মধ্যে সহমর্মী ছিল না একজনও। হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন, পুরো ক্লাসে, আমাদের সেকশনে একমাত্র ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার ছিলাম আমি। এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু অবশ্য, নেহাতই মায়ার বশে সম্ভবত, বড় ম্যাচে হারের পরের দিনগুলোতে পাশে থাকত। কিন্তু, সে আর কতটুকু!!

যেমন ধরুন, সেইবার, এক ম্যাচ বাকি থাকতেই আমরা লিগ জিতে গেলাম। অপরাজিত। হ্যাঁ, লিগ বলতে কলকাতা লিগ। কাগজে দেখলাম, ক্লাবে পতাকা তুলেছেন অধিনায়ক বলাই মুখার্জি। ডগমগ খুশিতে ইস্কুলে যেন উড়ে বেড়ালাম। আর তারপর? গুরুত্বহীন ম্যাচে বিএনআরের কাছে হার। ব্যস!! অপরাজিত লিগ চ্যাম্পিয়ন তো আর হওয়া হল না। বাবার কাছে ম্যাচ-হারার-আগেই-তো-লিগ-জিতে-গেছি-তাহলেও-অপরাজিত-বলা-যাবে-না-কেন এইসব ঘ্যানঘ্যান করে দাবড়ানিও খেলাম। (বাবাও তো একইরকম আপসেট)। আর, তার পরের দিন ইস্কুলে? থাক না হয় সেসব দুঃখের কথা।

রেডিওর ধারাবিবরণী শোনা একরকম, আর পরবর্তীতে টিভি আসার পর খেলা দেখা অন্য ব্যাপার। কলকাতা দূরদর্শন। একটিই চ্যানেল। অ্যান্টেনা, বুস্টার সব মিলিয়ে খেলা দেখা। ঝড়ে অ্যান্টেনা ঘুরে গেলে বা কাক বসলে খেলা দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে আবার বাংলাদেশের ওভারল্যাপিং। ছবিই বোঝা যায় না। ঢেউ খেলতে থাকে— অ্যাসবেস্টসের ছাদের মতো ঢেউ উঠতে বা নামতে থাকে টিভির পর্দা জুড়ে। তবু, লাল-হলুদ জার্সির রঙ চোখের সামনে দেখা। খবরের কাগজের ছবি তো সাদা-কালো। এমনকি, খেলা বা খেলার আসরের প্রচ্ছদ বাদ দিয়ে বাকিসবই তাই। সেই সাদাকালো ছবিই কাগজ থেকে কেটে খাতায় সাঁটিয়ে রাখতাম।

টিভি এলে, প্রথমবারের জন্য দেখতে পেলাম কৃশানুর সেই অনবদ্য পায়ের ঝিলিক। বা ধরুন, সেই ম্যাচটা। মহামেডানের সঙ্গে। প্রথমেই একগোলে পিছিয়ে পড়া। কৃশানু বেঞ্চে। চোট আছে। খেলার কথা নয়। বিরতির পরেও গোল শোধ হয়নি। কৃশানু ওয়ার্ম আপ করছেন। মাঠে নামলেন। নেমেই অনবদ্য ডিফেন্সচেরা পাস। কেউই ঠিকঠাক ফলো করেনি অবশ্য। গোল হয় না। কিন্তু, মহামেডানের ডিফেন্স কেঁপে যায়। তারপরেই গোল। বিকাশ পাঁজিই বোধহয়। বক্সের ঠিক ভেতর থেকেই কোণাকুণি ভলি। আবার ম্যাজিক। সেই অসামান্য থ্রু। এইবার দেবাশিস রায় তক্কে তক্কে ছিলেন। গোল। গ্যালারিতে ক্ষিপ্ত মহামেডান সমর্থকেরা। খেলা ভেস্তে যায়।

কে কোচ ছিলেন মহামেডানের? মনে নেই এখন আর। তখনও তো বিদেশি কোচেদের রমরমা হয়নি। কিন্তু, দেশির বদলে বেঞ্চে মরোক্কান কোচ এলেও, কলকাতা ময়দানে হার নিশ্চিত জেনে খেলা ভেস্তে দেওয়ার ট্র‍্যাডিশনের পরিবর্তন হয়নি, তাই না? একদিকে আমার ক্লাব। উল্টোদিকে হার নিশ্চিত জেনে ল্যাজ তুলে খেলা ছেড়ে পালানো প্রতিপক্ষ। কয়েক দশকের ব্যবধানেও কিছু কিছু ছবি একই রয়ে যায়। (প্লিজ, অপোনেন্ট সমর্থকরা চটে যাবেন না— বলেইছি তো শুরুতেই, এ লেখা সমর্থকের জবান— নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ কিছু নয়)।

ক্লাব নিয়ে লিখতে বসা ভারি মুশকিল। এত স্মৃতি। সবই এত ছাড়াছাড়া। গুছিয়ে ওঠা যায় না। খাপছাড়া কিছু দৃশ্য। পেনারোলের বিপক্ষে আমরা। অসম যুদ্ধ। বল নিয়ে এগোতে এগোতে মাঝমাঠ ছাড়িয়েই মনোরঞ্জনের দূরপাল্লার শট। ক্রসপিসের উপর দিকে লেগে বলটা বেরিয়ে গেল। কোনওরকম আবেগের বাড়াবাড়ি না দেখিয়ে মনোরঞ্জন ফিরে আসছেন, ডিফেন্সে, নিজের পজিশনে। এর পরে মনোরঞ্জনের ফ্যান না হয়ে পারা যায়!!

না, আমেদ খান বা পঞ্চপাণ্ডব ছেড়ে দিন, বলরামের সময়ের খেলারও ধারাবিবরণী শুনিনি। পিন্টু চৌধুরীর অসম্ভব স্কিল বা সুভাষ ভৌমিকের ছারখার করা বুলডোজার ফুটবলও বাবার মুখে শোনা। এমনকি, সুরজিত সেনগুপ্তর ডজ, নিখুঁত ক্রস, খর্বকায় সুধীর কর্মকারের দক্ষতা-স্কিলে অভাবনীয় উচ্চতায় পৌঁছানো— সে-ও। আমাদের ছেলেবেলার ইস্টবেঙ্গল মানে, বেঞ্চে কোচ পিকে। অনেক কোচের মাঝে পিকে-ই কেন, বলা মুশকিল। অমল দত্ত-ও তো কোচ ছিলেন— তবু, আমাদের কোচ বলতেই, সেই পিকে। বোধহয়, সেই গাড়ির গল্পের জন্যে। একবার ক্লাব থেকে সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে তাঁকে গাড়ি দেওয়া হবে বলে ভাবা হয়। মারুতি জেন। পিকে জেন না নিয়ে বাড়তি টাকাটুকু নিজের থেকে দিয়ে কিনেছিলেন ওপেল অ্যাস্ট্রা। আমাদের মফস্বলে মারুতি আটশো তখন বড়লোকির জগতে শেষ কথা। জেন কালেভদ্রে। ওপেল অ্যাস্ট্রা স্বচক্ষে দেখিনি তখনও। কল্পনার সেই ওপেল প্রায় লিম্যুজিন মনে হত। প্রায় স্বপ্নে ভাবতাম, শ্যফার-ড্রিভেন বিলাসবহুল গাড়ির কালো কাচ নামিয়ে হাত নাড়ছেন কোচ। মাঠে মনোরঞ্জন, পাশে তরুণ দে। পেছনে অকুতোভয় ভাস্কর। মাঝমাঠে সুদীপ চ্যাটার্জি। কৃশানু-বিকাশ। আর, তার পরবর্তীকালে তুষার রক্ষিত, যিনি কিনা খেলোয়াড় জীবনের একেবারে শেষপ্রান্তে এসেও তৎকালীন কোচের মধুসূদন দাদা। সামনে একের পর এক সুযোগ নষ্ট করতে করতে মাঝেমধ্যে গোল করেন, এমন অজস্র নাম। যাদের ভিড়ে হঠাৎ করেই একজন বাইচুং এসে পড়েন। পরের দিকে অনবদ্য অ্যালভিটো। ঠিক কোন পজিশনে খেলতেন তিনি? ওই দক্ষতা, অমন কমপ্লিট ফুটবলার কজন এসেছেন এইসময়ের ভারতীয় ফুটবলে? ফুটবলার হিসেবে কতটুকু সাফল্য বা স্বীকৃতি জুটেছে আমাদের অ্যালভিটোর? আমার কাছে তাই অ্যালভিটো চিরকালীন ট্র‍্যাজিক হিরো হয়েই থাকবেন।

আর, অবশ্যই বিদেশিরা।

ছেলেবেলার সেই সময়ে, ময়দানে বিদেশি মানে ইরানি। মজিদকে দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু, জামশিদকে দেখেছি। টিভিতে। সুব্রতকে গায়ে নিয়ে ইনস্টেপ ভলিতে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে গোল। বা বক্সের ভিতরে সেন্টারে জ্যাব করে। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে আসা প্রথম নামকরা প্লেয়ার চিমা। মহামেডানে। গাজোয়ারি বাদে কিছুই মনে হয়নি। আর, গোলার মত শট। আমাদের রোগাপটকা বাঙালি ছেলেদের পাশে ওই পাওয়ার ভারি অন্যায্য বোধ হত। পরে, সেই চিমার খেলার ক্রমবিবর্তনের সাক্ষীও আমরা।

আমার সেই মফস্বল শহরে একটা টুর্নামেন্ট হত। কলকাতার বড় মাঠে খেলা না দেখতে পারার দুঃখ ভুলতাম ওই শিল্ড দেখেই। ময়দান থেকে ভাড়া করা প্লেয়ার আনার চলও ছিল। বিশেষ করে শেষের দিকে। মানে, ওই সেমিফাইনাল বা ফাইনালে। না, খুব বড় নাম নয়, ওই সুখেন সেনগুপ্ত বা প্রদীপ তালুকদার পর্যায়ের। তাঁদের স্কিল দেখে সুদীপ-কৃশানুর আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা করতাম।

আর কালেভদ্রে দেখার সুযোগ হত কিছু চ্যারিটি ম্যাচ। সেই ছোট শহরে। এমনই এক ম্যাচে এসেছিল ইস্টবেঙ্গল। স্থানীয় ক্লাবের এক কর্তাকে ধরে একটি ছোট নোটবুকে সই নিয়েছিলাম ক্লাবের সব প্লেয়ারের। কৃশানুর হাতের লেখা প্রত্যাশিতভাবেই সুন্দর। কিন্তু, চিমার শিল্পীসুলভ হস্তাক্ষর দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আর, সেই ম্যাচে, মনে পড়ে, চিমার একখানা শট বারে লেগে ফিরে আসে। অন্তত পাঁচ-দশ সেকেন্ড বারটা থরথর করে কেঁপেছিল।

ক্লাবে খেলে যাওয়া অজস্র বিদেশিদের ভিড়ে কত উজ্জ্বল নাম। মজিদ থেকে শুরু। দেখা হয়নি যদিও। অবশ্য, রোম্যান্সের নায়কদের না দেখতে পাওয়াই ভালো। প্লাস, ওই উচ্ছৃঙ্খলতার গল্প— নিজেকে নিজেই শেষ করে দেওয়া— যা-ই বলুন, হিরোর গল্প ট্র‍্যাজিক না হলে সে কি আর স্বপ্নে থেকে যাওয়ার লেভেলে পৌঁছাতে পারে!! আমাদের টিভি দেখার সময় জামশিদ— তার ঠিক পরে, চিমা— কিন্তু, তাঁরা তেমন হিরো কি আর?? পরবর্তীতে ইয়াকুবু। মাইক ওকোরো— আমার ক্লাবে আমার দেখা সেরা প্রতিভা, সম্ভবত। স্যামি ওমোলো। উগা ওপারা। সুলে মুসা। র‍্যান্টি মার্টিন্স। ডগলাস— প্রায় কমপ্লিট ফুটবলার, অন্তত আমাদের চোখে। লিস্ট বাড়াতে চাইলে সেই নিয়েই একখানা আলাদা লেখা হয়ে যায়। কিন্তু, এরই মাঝে মাঝে এসে যাঁরা হারিয়ে গিয়েছেন, যাঁদের নাম অনেকেই ভুলে গিয়েছেন, তাঁদের কিছু টুকরো স্কিলের ঝলক মনে রয়ে গিয়েছে। যেমন বাংলাদেশের রুমি-মুন্না। বড় ম্যাচে বরিসিচের সেই অসামান্য ড্রপভলি। অ্যালান গাও-এর ফ্রিকিক, যার তুলনা গাও-এর আগে বা পরে দেশের মাটিতে আর দেখিনি কখনোই। না, দং-এর ফ্রিকিকে জোড়া গোল অভাবনীয় হলেও, বলে বলে অমন ফ্রিকিক গাও-কেই মারতে দেখেছি।

আবার, সমর্থক হলে যা হয়, আর্চরাইভাল দলে খেলা বিদেশিদের খেলা উপভোগ করতে পারিনি জীবনে। যেমন ধরুন, ব্যারেটো বা ওডাফা, বছরভর এঁদের ব্যর্থতাই চেয়ে এসেছি। শুনেছিলাম, ব্যারেটোর নাকি আমাদের হয়েই খেলার কথা ছিল শুরুতে— কিন্তু, সব ঘেঁটে গিয়ে চলে গেছিলেন ওদের দিকে— সেই ভেবে বড্ড আফসোস হতো। যাক সে কথা!! ছোট দলে খেলে যাওয়া বিদেশিরাও তো মনে থেকে যায়। প্রয়াগে খেলতেন কার্লোস হার্নান্ডেজ— যেদিন মেজাজে থাকতেন, অমন প্লেয়ার এদেশের ক্লাবে খেলেছেন কি আর কখনও? শুধু হার্নান্ডেজকে দেখার জন্যেই বাঁকুড়ার কর্মজীবনের কত অলস উত্তপ্ত দুপুরে গুরুত্বহীন কলকাতা লিগের ম্যাচে টিভির সামনে বসে থেকেছি, প্রয়াগ ইউনাইটেডের (নাকি চিরাগ ইউনাইটেড) খেলা যখন যেটুকু পেরেছি, দেখেছি। আর সঙ্গে লালকমল ভৌমিক— সেইসময়ের বাংলার ফুটবলে সেরা প্রতিভা মনে হত— কতটুকুই বা আলোয় আসতে পারলেন? সে তো আমাদের দীপঙ্কর রায়ও নিজের প্রতিভার পুরোটা মেলে ধরতে পারলেন না। কিন্তু, বিদেশিদের কথা বলতে, বিশেষত অন্য দলের বিদেশি, ওডাফা, আঃ, অমন স্ট্রাইকার!!

বাঁকুড়ার তেতে ওঠা দুপুরে কলকাতা লিগ দেখতে টিভি খুলে বসেছি— মোহনবাগান বনাম ছোট দল— ব্যাটারা যদি হারে, নিদেনপক্ষে একটা ড্র। প্রথমার্ধের মাঝামাঝি মোহনবাগান এক গোল খেয়ে গেল— ফার্স্ট হাফ, আর গোল নেই— মোহনবাগান খেলতেই পারছে না— ওডাফাকে তিনজন ঘিরে আছে— কিছুই করতে পারছেন না। আমার প্রত্যাশার পারদ তুঙ্গে। আর মাত্র পনেরো মিনিট, ব্যস!! সাতাত্তর থেকে পঁচাশি মিনিট— ওডাফার হ্যাটট্রিক— প্রতিটিই প্রায় একক কৃতিত্বে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে টিভি বন্ধ করার সময় মনে হত, ব্যাটা যদি এই কাজটা শুরুর পনেরো মিনিটে করত, তাহলে দেড় ঘণ্টার এই আশানিরাশার গর্ভযন্ত্রণাটুকু সইতে হত না!!

ওডাফার কথায় মনে পড়ল, ছেলেবেলা থেকে মাঠে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। পরবর্তীতে সুযোগ থাকলেও নিয়মিত মাঠে যাওয়ার অভ্যেসটা হয়নি। যেটুকু গিয়েছি, ক্লাব জিতে ফিরেছে এমনটা ঘটেছে এমন কালেভদ্রে, যে, মাঠে যাওয়ার সাহস হয় না। এমনই এক আইলিগের ম্যাচ। প্রতিপক্ষ চার্চিল ব্রাদার্স। ওডাফার চোট, কাজেই মাঠে নামার সম্ভাবনা নেই। এক গোলে এগিয়ে গেলাম। লুই ভিনসেন্ট গোল শোধ করলেন। আবারও গোল দিলাম আমরা। এইবার জয় নিশ্চিত। খেলা শেষের মিনিট দশেক আগে ওডাফাকে নামানোর চেষ্টা শুরু হল। প্র‍্যাক্টিকালি দাঁড়াতেই অসুবিধে হচ্ছে ওডাফা ওকোলির। তাও নামলেন। দৌড়ানো দূরে থাকুক, হাঁটছেনও খুঁড়িয়ে। কিন্তু, তাতেই আমাদের ডিফেন্স কেঁপে গেল। এরই মধ্যে ওডাফা একেবারে সহজ সুযোগ পেয়ে গেলেন। চোটের জন্যে বলই ধরতে পারলেন না, পৌঁছাতেই পারলেন না। কিন্তু, ডিফেন্সের কাঁপুনির সুবাদে একেবারে ইনজুরি টাইমে গোল শোধ করে দিলেন, আবারও, ভিনসেন্ট। না, প্রতিপক্ষ হলেও, ওডাফার ওই সাঙ্ঘাতিক চোট নিয়ে মাঠে নামার দায়বদ্ধতাকে কুর্নিশ না করে পারিনি। পরবর্তীকালে, যে টিমের হয়ে, বারবার চোট নিয়ে মাঠে নেমে নিজেকে উজাড় করে নিজেরই ফুটবলজীবন হ্রস্বায়িত করেছেন তিনি, সেই টিম তাঁকে মনে রেখেছে কি? চোট নিয়ে একের পর এক ম্যাচে খুব সাধারণমানের টিমকে উতরে দেওয়ার পরে, একটা ম্যাচে আটকে গেলে সমর্থকদের গালিগালাজ তাঁর প্রাপ্য ছিল কি?

যাক গে, অবান্তর প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি। পরনিন্দা ছেড়ে নিজের ঘরে ফিরি।

আমার ছোটবেলা, আমার বেড়ে ওঠা, স্কুলজীবন বা পরবর্তীর সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আমার ক্লাব, এই লালহলুদ রং। আগেই বলেছি, মাঠে নিয়মিত নই, ক্লাবে তো যাওয়ার সুযোগই হয়নি কখনও। টিভিতে আস্ত বড় ম্যাচ দেখি না আর, বড্ড টেনশন হয়। না, এই না দেখে টেনশনের অভ্যেসও অনেকদিনের। বিখ্যাত ডায়মন্ড ম্যাচেও টিভির সামনে যাইনি। তিন-এক হওয়ার পরে টিভির সামনে বসতে পেরেছিলাম। আর এখন তো আরওই না। বাড়িতে বসে বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিই। মুহুর্মুহু ফোন করি, কী খবর, কেমন খেলছি এইসব। হেরে গেলে অকারণ খিটখিট করি সবার সঙ্গেই। কেউ কারণটা বোঝে, অনেকেই বোঝে না। আশেপাশের অনেকেই যখন বলে, যে, তারা ম্যাঞ্চেস্টার বা রিয়াল মাদ্রিদ কি বার্সেলোনার সমর্থক, কেমন একটা তাজ্জব লাগে। চারপাশটা কেমন দ্রুত বদলে গেল!!

ডেটা-স্মার্টফোন-মল-মাল্টিপ্লেক্স-ফ্লাইওভারের এই শহরে আমার ক্লাবও আধুনিক হচ্ছে। হতেই হচ্ছে।

সময় বদলে যাচ্ছে। স্বপ্নের সেই কৃশানু দে চলে গিয়েছেন কবেই। মাঝমাঠ থেকে নেমে স্টপার বা লিবেরো— সুদীপ চ্যাটার্জিও। ডাকাবুকো ভাস্কর বা পিন্টু চৌধুরীকে চেনা যায় না আর। বাবাদের সময় থেকে আমাদের সময়— সেতু হয়ে ছিলেন যিনি— পিকে চলে গেলেন এই সেদিন।

আমি, আমরাও কি বদলে যাচ্ছি না?

আমাদের দেখার মধ্যেই ইস্টবেঙ্গল হয়ে গেল কিংফিশার ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ম্যাকডাওয়েল মোহনবাগান। দুই ক্লাবের স্পনসর এক— আমরা, সমর্থকরা, লড়ে গেছি তবুও।

সেখান থেকে কোয়েস ইস্টবেঙ্গল— ক্লাবের অধোগতিতে আমরা রক্তাক্ত হলেও— কোয়েস কর্তাদের কাছে সে কতটুকু!! অবশ্য, তেমন করে আহতই বা হই কোথায় আর? আমাদের আবেগের ক্লাবে বাংলায় কথা বলে, এমন প্লেয়ার কই? ওদের ক্লাবেও নেই। ভিনরাজ্যের প্লেয়ার এসে আগে আমাদের নিজেদের লোক হয়ে যেতেন আগে— বলরাম বা হাবিব, আমেদ খান কিম্বা জার্নেল সিং— সে দিন গিয়েছে কবেই। আমরা ক্লাব আঁকড়ে রয়ে গেছি। মোহনবাগান আইএসএল খেলার দাম হিসেবে নিজের আইডেন্টিটি বিক্রি করে ফেলল কিনা, সে নিয়ে তর্ক জমানোই যায়। আজ না হোক আগামীকাল আমরাও নিশ্চয়ই খেলব আইএসএল— যে নামেই খেলি, আমাদের সেই ইস্টবেঙ্গল খেলবে কি!! মাঠের বাইরে গ্যালারিতে টিভি ক্যামেরা যখন ধরবে নীতা আম্বানির বোটক্স-লাঞ্ছিত হাসি, আমাদের লজেন্সদিদি তখন কোথায়?? আর গ্ল্যামারের চোখধাঁধানো সেই মুহূর্তে, আমার আবেগ যদি তেমন বিক্রয়যোগ্য পণ্য না হয়ে ওঠে, লজেন্সদিদির মতোই অপাংক্তেয় হয়ে যাব আমরা। আর হ্যাঁ, আপনারাও— যাঁদের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সবুজমেরুন, আপনারা, যাঁদের আমরা মাচা সাপোর্টার বলে চিনি— উই আর ইন দ্য সেম বোট, ব্রাদার।

তবু, তবুও, এক চিলতে লালহলুদ রঙের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের ছেলেবেলা, অতীত। বর্তমানও কি জড়িয়ে নেই? আশা করা যাক, ভবিষ্যতও জড়িয়ে থাকুক এমনই আষ্টেপৃষ্টে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, কিশোর বাইচুং-কে আগলে রেখে একটু একটু করে পরিণত করে ভারতীয় ফুটবলের আইকন করে তোলা, সেও এই ক্লাবেই। শ্যামল ঘোষ বোধহয় সহকারী কোচ ছিলেন সেসময়। বিশ্বাস করতে ভালো লাগে, একমাত্র আমাদের ক্লাবই এমন করে ভাবতে পারে। এইটাই আমাদের অহঙ্কার। আমরা পারি, আমরাই পারি এমন করে আগলে রাখতে। আমাদের ক্লাবের জার্সি পরেই এশিয়ার সেরা ফুটবলারকেও পরম অহঙ্কারে বলা যায়, ইউ চাইম্যান, আই ষষ্ঠী দুলে। টুডে আই হিরো, ইউ জিরো।

জড়িয়ে থাকুক সেই অহঙ্কার। শত দুর্বিপাকেও আমরা সঙ্গে থাকি, পাশে থাকি। হাজার কঠিন মুহূর্তেও আমরা মাঠ ছেড়ে পালাই না। কর্পোরেট লোভ দখল করে নিচ্ছে ময়দানের সবুজ ঘাস… টিমটিমে বাতি বদলে নিয়ে উজ্জ্বল সাইকোডেলিক আলোয় ভরে উঠবে আপনাদের শতাব্দীপ্রাচীন তাঁবু, শুধুমাত্র সেই দুর্মর আশায় বিকিয়ে গিয়েছে আপনাদের আবেগের ক্লাব… আমরাও হয়ত সেই পথে এগোব আগামীকাল, না হলে পরশু… মুখে যতই আমরা আমরা বলি, আমাদের কথায় কতটুকুই বা চলে আমাদের ক্লাব! আপনাদেরও হয়ত তা-ই… হয়ত, এই-ই অনিবার্য, যুগের নিয়ম, নিজেকে সুদক্ষ কৌশলে বিক্রি করতে পারাটাই টিকে থাকার একমাত্র পথ। তবু, এখনও, অন্তত আজকের এই মুহূর্তটাতে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস করা যাক, আমাদের হৃদয়ের রং লাল-হলুদ।