Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রকৃতি ফিরছে নাকি, আর মানুষ?— একটি অসমাহিত প্রশ্ন

সুরমিতা উস্রি

 

ইদানিং ফেরার গল্প শোনা যাচ্ছে খুব। যদিও কিছুদিন আগে পর্যন্ত হারানোর কথাই শুনছিল সবাই। কত কী বিলুপ্তির পথে। বাঘ থেকে শুরু করে, কচ্ছপ, নানান ধরনের পাখি, মাছ। বিলুপ্তির একশেষ। মানুষ ছাড়া সবকিছুই এন্ডেঞ্জার্ড। পরপর বেশকিছু অরণ্যর ধ্বংস হয়ে যাওয়া নজর করা গেল। অ্যামাজন। অস্ট্রেলিয়ার জীববৈচিত্র‍্যে ভরা প্রাচীন অরণ্য। আগুন ছড়াচ্ছিল ক্রমশ। এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধ। কেবলি অরণ্য পুড়ছে। বন্য প্রাণী পুড়ে পুড়ে মরছে। তারমধ্যেই গভীর হচ্ছে জলসঙ্কট। গত গ্রীষ্মেই চেন্নাই পুরো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। জলব্যাপারীরা একলিটার জলের দাম নিল ৪৫০-৫০০ টাকা। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ভয়ঙ্কর ভিডিও শেয়ার হল খুব। আন্টার্কটিকা মহাদেশের বরফের প্রাচীর ভাঙছে। আর তাতে নাকি বেরিয়ে আসছে হাজার বছরের জীবাশ্ম। হাজার হাজার বছর ধরে চাপা-পড়া ভাইরাসও নাকি মুক্তি পাচ্ছে। মোদ্দায় ধ্বংসের মধ্যেই আমরা ছিলাম আমরা। একটা ভয়াবহ ধ্বংস। খবরের কাগজে, সোশাল মিডিয়ায় ধ্বংসের কতপ্রকার ছবি। আমরা দেখছিলাম। তারপর ভুলছিলাম। না-ভুললে আমাদের চলেও না।

আর তার ঠিক পরেই একটা ভাইরাস হানা দিল মানুষের শরীরে। দাবানলের আগুনের থেকেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সে। কোত্থাও বাকি নেই। সমস্ত দেশে, শহরে, গ্রামে ভাইরাসের রাজত্বি। মানুষকে সে আটকে দিল বাড়ির ভিতর। পৃথিবী, মানুষের পৃথিবী লকডাউন।

এইবারে শুরু হল, ফিরে আসার গল্পগুলো। ভেনিসে ডলফিন, রাজহাঁস, জার্মানির রাস্তা নাকি দখল নিয়েছে হরিণ। শয়ে শয়ে ফ্লেমিঙ্গো মুম্বাইয়ে। রাজপথে ময়ূর। গাড়োয়াল হিমালয়ে নাকি প্রচুর পরিমাণে ফুটেছে ব্রহ্মকমল। অনেকগুলো বছর পরে। উড়িষ্যার উপকূলে কচ্ছপ। কলকাতার ঘাটগুলিতে উঁকি দিলেই নাকি চোখে পড়ছে গাঙ্গেয় ডলফিন। মানে শুশুক। আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। জল পরিষ্কার হয়েছে৷ কলকাতার আকাশও বেশ স্বচ্ছ। বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ বলছেন, আমরা নাকি প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে ফিরে গিয়েছি। এত পরিষ্কার হাওয়া— বহুদিন পৃথিবীতে নেই।

তো এই যে, ফিরে আসা মাছ, পাখি, ফুল— এদের নিয়ে আমরা সবাই বেশ গদগদ। সেটা স্বাভাবিকও। শুধু মুশকিল এটাই, মানুষ এই ফিরে-আসার গল্পে সামিল হতে পারল না আজও। সে গৃহবন্দি। বাড়িতে ছাদের ওপর, জানলা বা বারান্দা দিয়ে যতটুকু নজর করা যায়, তাতে সে এটাই শুধু অনুভব করছে, প্রকৃতি ফিরে এসেছে।

হ্যাঁ, তবে এটা ঠিক, প্রকৃতি নিয়ে বিশাল কিছু সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার অবস্থা এখনও হয়নি। বাতাস পরিচ্ছন্ন  হয়েছে, জল স্বচ্ছ হয়েছে। আর দূরে চলে গিয়েছিল যেসব প্রাণী, তারা মানুষের জায়গাগুলো দখল নিয়েছে একে একে। আরও কিছুমাস যদি লকডাউন চলে, আরও বেশি করে ফুল পাখি মানুষের রাস্তাঘাটের দখল নেবে। তবু, এ ঠিক বদল নয়। বা প্রকৃতির সেরে ওঠাও নয়। সেরে ওঠার একটা সামান্য চেষ্টা বলা যেতে পারে। তাছাড়া, প্রাণ-প্রকৃতির খুব অল্পই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। অধিকাংশটাই আমাদের আড়ালে। জলের গভীরে তেমন কোনও বদল হচ্ছে কিনা— আমরা জানি না। যে অপচয় ও ধ্বংস প্রকৃতির হয়ে গেছে, তার সেরে ওঠা অন্তত এক শতাব্দীর  কাজ৷ তবু এটুকু সান্ত্বনা পেতে ভালোই লাগে, যে কিছুটা হলেও, না-ফোটা ফুল, না-দেখতে পাওয়া ডলফিন, শিকারির ভয়হীন কচ্ছপ নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু গলার কাঁটার মতো যে প্রশ্নটা বিঁধে রয়েছে, তা হল— এরপর কী?

তার উত্তর আমাদের জানা নেই। খোঁজার চেষ্টাও নেই। মানুষ মানুষকে নিয়ে এখন ব্যস্ত। সব মানুষকে নিয়ে নয়। কিছু মানুষকে নিয়ে সে ব্যস্ত। ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে৷ হয়তো আবিষ্কার হয়েও যাবে কিছুদিনে৷ মানুষ কোভিড ১৯-এর হাত থেকে রেহাই পাবে৷ তারপর লকডাউন উঠলে সে ফের রাস্তায়। আবার অগুন্তি গাড়ি? খনি খালি করে বহুজাতিক হাঙরদের লাফালাফি? আবার গাছ কেটে ট্যুরিজম?

আর আবার পরপর বেঁচে-যাওয়া অরণ্য নিধন?

এভাবেই কি ওই চক্রাবত-পরিবর্তনন্তের নিয়মে পৃথিবীটা ঘুরবে?

এই নিয়ে কোথাও কোনও আলোচনা নেই, কোনও কমিটি এর জন্য তৈরি হচ্ছে না। এই কোভিড-পর্ব থেকে একটা নতুন শুরুয়াৎ হতেই পারত হয়তো। কিন্তু গোটা পৃথিবী জুড়ে সবাই ফিরতে চাইছে পুরনো ছন্দেই। পুরনো ছন্দ মানেই প্রকৃতির সঙ্গে শোষণের সম্পর্কে বাঁধা মানবজীবন। পুঁজির চেনা সার্কিট ধরেই পৃথিবী জুড়ে করোনার প্রাদুর্ভাব। করোনা যদি চলেও যায়, তাহলেও নতুন কোনও রূপে নতুন মহামারি মানুষের জীবনে ফিরে আসতেই পারে। অন্তত ফিরে আসাটাই স্বাভাবিক, যদি না এতদিনের হিসেবনিকেশগুলো মানুষ বদলায়।

ইতিমধ্যে শোনা যাচ্ছে, শ্রমের সময় বাড়বে। আট ঘণ্টার কাজের বদলে বারো ঘণ্টা কাজ। এতদিনের অনুৎপাদন সুদে-আসলে ফিরে উসুল। এই অনুৎপাদনের অধিকাংশটাই পুঁজি-নির্ভর উৎপাদন। বিধিনিষেধহীন লাগামছাড়া প্রকৃতিধ্বংস মুনাফার জন্যে। মাথায় রাখতে হবে, প্রকৃতির ফিরে আসা নিয়ে যতই আহ্লাদ থাকুক আমাদের— বৃহৎ পুঁজির শাসন থেকে আমরা মুক্ত নই। আর সে প্রকৃতি নিয়ে আহ্লাদী নয়। ফলে, ভয় রয়েই যাচ্ছে। আমাদের সবথেকে বড় সঙ্কট মনে হয় না, করোনা। জোর করে তাকে বিশাল করে দেখালেও, সবথেকে বড় সঙ্কট দাঁড়িয়ে আছে করোনা-পরবর্তী সময়ে। কীভাবে বাঁচবে মানুষ? সে তার চাহিদা, তার প্রায়োরিটিকে কীভাবে বদলাবে, সে আদৌ এই ফিরে-আসা প্রকৃতিকে বাড়িয়ে তুলতে চাইবে কিনা, তার জন্য উপযুক্ত কোনও পদক্ষেপ নেবে কিনা— তার ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা ভবিষ্যৎ। নইলে প্রকৃতির সঞ্চয়ে মারণ ভাইরাস ভালোই রয়েছে। মহামারি প্রস্তুত।

আমাদের প্রতিদিনের আলোচনায় ভবিষ্যৎ যতটা উঠে আসছে, তাতে অর্থনীতিতে ধ্বস নামবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত। কোটি মানুষ ইতিমধ্যে কাজ হারিয়েছেন। আরও কোটি মানুষ হারাবেন। কিন্তু অর্থনীতি কি আরও শোষণমূলক হবে? প্রকৃতির যেটুকু বেঁচেবর্তে আছে, সেটুকুও কি ছিনিয়ে নিতে যুদ্ধ বাধবে প্রায়? এর ব্যতিক্রমী কোনও অবস্থান আজও দেখা দিল না। অথচ মানুষ নাকি করোনা ঠেকাচ্ছে, চেষ্টা করছে। এই বাস্তবতা অচিরেই আবার বিশাল কোনও সঙ্কট নিয়ে আসতে চলেছে আসলে।

এই প্রশ্নের সমাধান না হলে, প্রকৃতির এই ফিরে আসাও বুদবুদের মতোই। ডলফিন কচ্ছপেরা আসলে বিলুপ্ত। ওই নেভার আগে শেষবার জ্বলে ওঠার মতোই হয়তো ফিরছে তারা।