Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কবন্ধ

কবন্ধ -- বর্ণালী ঘোষ দস্তিদার

বর্ণালী ঘোষ দস্তিদার

 

কাঁধ থেকে জলের বিশ লিটারের জলের বোঝাটা নামিয়ে এক বুক শ্বাস ছেড়ে পাছড়িয়ে বসল কমলাকান্ত।  পরনে সেই নীল ঢোলা প্যান্ট আর কলারওলা টি শার্ট। ঘাম মুছতে মুছতে ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো মেলে ধরল।

কী রে কমলা হাঁপাচ্ছিস যে? কাজ না করেই ঘেমে গেলি? পরমা বলল।
–যা বলেছ মামি। কাজকাম না থাকলেই যেন বেশি হাঁপপে যাই… কী করে চলবেক বলো দিকিনি দিনগুলান?

কাজে ডেকেছিল? ফোন এসেছিল? পরমা শুধোয়।
–ওরা একটা করে ছেলেরে ডাকতিছে। সব্বমোট চল্লিশটা ছেলে আমরা কাজ করি। সবায়েরে একদিন করে কাজ দেবে। একদিন করে ডাকবে বলতিছে কোম্পানি।

ও বাবা! তো মাসে তো চল্লিশটা দিনই নেই রে কমলা… পরমার ভুরু কুঁচকোয়।

খবরের কাগজটা সিকুরিটির কাছ থেকে কমলাই হাতে করে নিয়ে এসেছে। পরমা তার ওপর হুমড়ি খেয়ে  দেখছিল কোথায় কোন নতুন কেস ধরা পড়ল। কোন জায়গা রেড জোন বলে সিল করে দিল পুলিশ।

মাস্ক লাগানো মুখ আর গ্লাভস পরা হাতে উদবেড়ালের মতো দেখতে লাগছিল কমলাকে। তো শুধু ওকে কেন? ওরকমই তো লাগবে সব্বাইকেই। রকমারি লিপস্টিক আর কায়দার নাকছাবিও কি হার মানবে? রংবেরঙা নেলপালিশ? হাত ধুতে ধুতে হাজা হলে তো গ্লাভস পরার নিদানই আসবে। সইসাবুদ করার সময় পরমার খাওয়া খাওয়া নখগুলো দেখে নাক সিঁটকাবে না কেউ। আলমারি উপচে ওঠা শাড়ি আর কি পরতে পাবে পরমা? আরও কত মানুষের কত অসংখ্য শাড়ি-গয়না-জামা-কাপড়, একবাড়িতেই হালফ্যাশনের হরেক মডেলের গাড়ি… এসব আর কি কোনও কম্মে লাগবে? তবে হ্যাঁ। নতুন নতুন ডিজাইনার মাস্ক আসবে বাজারে। ডিজাইনার গ্লাভস। পাতি রাবারের একঘেয়ে গ্লাভস আর লোকে থোড়ি পরবে।

–তো কী মনে হচ্ছে? সারাটা মাস যে কাজ হল না কোম্পানি স্যালারি দেবে?
–সেইডাই তো ভাবতেছিলাম মামি।

তাহলে পরের মাসটায় কী করবি ভেবেছিস কিছু? আট হাজার টাকা কম নাকি? ছেলে-মেয়ে-বৌ নিয়ে সংসার। কাজ না হলে বেতন দেবে কিনা… সে ব্যাপারে কোম্পানি জানিয়েছে কিছু? এমনি তো একদিন না গেলে মাইনে কাটে… বিরক্তি পরমার কথায়।
–আমারা তো নিজে কামাই করি নাই… তুমি ছুটি দেছ… তালে বলো মামি আমাদের সেলেরি কেন দেবে না?
–তো কোম্পানি যদি বলে, কাজ বন্ধ ছিল, বেতনও বন্ধ। তাহলে কী করবি? কেড়ে-কামড়ে আদায় করবি?
–সেইটাই ভাবতেছি মামি। আমরা চাষি-বাসি— জাল-জেলের মানুষ। দুদিন আপিসে বাবুদের মতো কাজ করতে গেলাম… কিন্তু ফের যে চাষের কাজে ফিরে যাব… জমিও তো নাই। সেও তো সরকার নেছে। এমনই লকডানের ঠ্যালা, যে আমি এই মাটির ছেলে, আমাকেই আটকাচ্ছে?

কে রে? কে তোকে আটকাল? এত বড় আস্পদ্দা কার? পরমা কথাটা বলেই মনে মনে একটু হাসে।
–ওই যে গো, তুমাদের এখেনে কোমেটি আছে না? সেখানে মোটামতো টাকমাথা লোক, বলে কিনা আমাকে, নাকি ঢুকতেই দেবে না হাউসিঙে। উনি বলল, আর সিকুরিটি দরজাই খুললে না। আম্মাদেরই জায়গা-জমি-পুকুর। ফেলাট বানিয়েছ তুমরা, আর আম্মাদেরই ঢুকতে দিবে না?

সেই তো। খুবই খারাপ। পরমা সান্ত্বনা দেয়। আসলে লকডাউন চলছে তো! সরকারি নির্দেশ… ওরাই বা কী করে বল? দশাসই জোয়ান মর্দ লোকগুলো রোগের ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে আছে।
–তো মামি, এই যে নুতুন একটা রোগ বাজারে বেরিয়েছে ও রোগ ধরলেই কি মানুষ মরে যাবে? চিকিচ্ছে-ওষুধ-পথ্যে সারবে না? আজকাল তো শুনি ক্যানসারেও কত মানুষ বেঁচে যায়।
–আসলে ওষুধ বেরোয়নি তো। আর এ রোগ হচ্ছে বড্ড ছোঁয়াচে। একজনা থেকে চারজনায় চারজনা থেকে ষোলজনায় নাকি ছড়ায়, বলছে ডাক্তাররা।
–ও। আর সেই জন্যই গোটা দেশটাকে তালাচাবি বন্ধ করে রেখে দিয়েছে সরকার।
–ডাক্তাররাও তো তাইই বলছেন। যতদিন ওষুধ না বেরোয়… মানুষকে এভাবেই সাবধান থাকতে হবে।
–তাহলে মামি, গরিব মানুষগুলা তো না খেতে পেয়েই মারা যাবে। ঘর থেকে বার হওয়া যাবে না, দোকানপাট  খোলা যাবে না, ব্যবসাপাতি বন্ধ থাকবে, তো উপায় না কল্লে গরিব মানুষ খাবে কী? সবাই তো আর সরকারের চাগরি করে না… যে ঘরে বসে বসে মাইনে পেয়ে যাবে।

ঠিক কথাই বলেছে কমলাকান্ত। পরমা সরকারি চাকুরে। কলেজের অধ্যাপক। গত মাসে ঠিক সময়ে বেতন পেয়েছে। যদিও প্রচুর টাকা কাটা গেছে ইনকাম-ট্যাক্স বাবদ। তবু যা পেয়েছে কম নয়। তাই দিয়ে কাজের লোকদের মাইনে, ড্রাইভারের বেতন অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচাপাতি সব দিয়েথুয়েও গোটা মাস ভালোভাবে চালিয়ে নেবার সঙ্গতি আছে তার। কিন্তু সত্যিই তো টানা লকডাউনে কী করে পরিবারকে সামাল দেবে ওই মোড়ের চা-দোকানের গীতা আর ওর স্বামী সুভাষ? ঝিনুক দিল্লি থেকে ল্যান্ড করেই বাজারের কোণটায় মনপ্রাণ ভরে ফুচকা খেতে যায় যার কাছে সেই ফুচকাওয়ালার? এছাড়াও পথচলতি দেখা যায় কত মানুষ তাদের জীবিকা চালাচ্ছে ছোটখাটো ব্যবসা করে, মিষ্টির দোকান, জামাকাপড়-বালিশ-বিছানা, বই-খাতা-পেনের স্টেশনারি, ঝাড়ু-ঝাঁটা বাসন-কোসন, ঘর গেরস্থালির অবশ্যপ্রয়োজনীয় হরেক মাল… লোকগুলোর কতটুকুই বা পুঁজি, লাভই বা হয় কতটুকু, কতজনের হাতেই বা মাসের পর মাস সংসার চালানোর মতো জমানো টাকা থাকে! মনে মনে একটু লজ্জা করে পরমার। অনেক বাড়তি ফেসিলিটির জায়গায় আছে পরমা। ইনকাম ট্যাক্স বাঁচাতে একটু বেশি টাকা লোন করে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছিল এই অভিজাত পাড়ায় বছর দুই আগে। ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা থেকে এসে চারপাশে বেশ ফাঁকা জায়গা দেখে। দক্ষিণ খোলা দু কামরার শৌখিন ছিমছাম ফ্ল্যাট। নতুন কিনেই কমলাকান্তকে পেয়ে গিয়েছিল পরমা আর সুসান। রোগা ছিপছিপে কালো বেঁটেখাটো একটি ছেলে প্রায় মাটি ফুঁড়ে উঠে প্রথম দিনেই সুসানের সামনে দাঁড়িয়ে একগাল হেসে বলেছিল মামাবাবু জল লাগবেনি? খাবার জল?

এখন অধিকাংশ বাড়িতেই অ্যাকোয়াগার্ড। পরমা আর সুসান এই অন্ত্যেবাসী ক্ষুদ্র পরিষেবা ব্যবসায়ীদের  বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোনওদিনই অ্যাকোয়াগার্ড কেনেনি। নামীদামি কোম্পানির সেলস পার্সনরা তো দরজায়  কম ধাওয়া করেনি। চোদ্দবার ফোন করে করে পাগল করে তুলেছে। কিন্তু সুসান কিনবে না কিছুতেই। ওর এক কথা, সব ব্যাপারে মাল্টিন্যাশনালের সেবা করতে পারব না।

জলদাতা হিসেবে বহাল হল কমলাকান্ত। একদিন অন্তর। ঝিনুক দিল্লিবাসী হবার পর থেকে টোনাটুনির সংসার। কতটুকুই বা লাগে। দেখতে দেখতে জল দেওয়া ছাড়াও হাজারো কাজে কমলাকান্ত। হেই কমলা, এটা করে দে। কমলা, ওটা করে দে। কমলার হাসিমুখ। কঠোর পরিশ্রমী, সৎ। শরীরে রাগ-অভিমানের বালাই নেই।

সকাল সকাল একবার এই উচ্চবিত্ত আবাসনের লকডাউন থিওরি ভেঙে ছুতোয়-নাতায় ঢোকা চাইই কমলার। কারও জল লাগবে। কারও বাজার। আর পরমা-সুসানের ঘরে তো ওর অবাধ যাতায়াত। জিনিসবোঝাই ভারি সুটকেস লফ্টে তুলতে হবে, ডিভান সরিয়ে তলা পরিষ্কার করতে হবে, রান্নাঘরের চিমনি সাফ করতে হবে, ব্যালকনিতে কাপড় মেলার দড়ি টাঙাতে হবে, এছাড়াও হাট-বাজার-দোকান-পাট, প্রতিবেশী বন্ধু অনিন্দ্যর বাড়িতে বা দাদাবৌদির ফ্ল্যাটে পরমার বানানো শখের আইটেম পৌঁছে দেওয়া, সবেতেই সাইকেল পায়ে খাড়া কমলাকান্ত।

সেই কমলাকে কি না সিকুরিটি আটকাচ্ছে?

খুব ডাঁট ছিল না তোর? “আমায় কে আটকাবে? আমায় কে আটকাবে?”… এবার? দিল তো আটকে তোকেও? ঘরের ভেতর থেকে কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে উঠে এসে বলে সুসান।

আমারা কুত্থাও কখুনো যায় নাই মামি জানো? এখানেই আমাদের সব। ঠাকুরদাদা এলাকা বিককির করি দিল একবারে জলের দরে। লেখাপড়া করি নাই মামি। ইশকুলেই যাই নাই। জ্ঞান হওয়া থিকে কাঁটায় কাজ। আমাদের চুক্ষের সামনেটায় জমি-খেতের ওপর মস্ত ফেলাট বাড়ি উঠল। কমপেলেক্স তৈরি হল। জমি বিচে বিচে খেয়েচে আমাদের বাপ-ঠাকুদ্দা। এসব জমিরই তো আমরাই মালিক ছিলাম। আমাদের জ্ঞাতি-গুষ্টি। অই সেখানটায় দেখছ মাঠ-জমি… খালি পড়ি আছে এখুনো… কিন্তু আমাদের নাই আর। সব সরকার নেছে। কুনোটার পয়সা দেছে। কুনোটার দ্যায় নাই। আগে আগে চাইতে যেত বাপ-দাদারা। হাঁকিয়ে দিত। আজ নয় কাল। কাল নয় পরশু। এখন সেসব তামাদি হয়ে গেছে। এখন কে কাকে পয়সা দ্যায়?

কথাগুলো একনিঃশ্বাসে বলে একটু থামে কমলা। হাসিখুশি সদাপ্রসন্ন ছেলেটার মুখে অসহায় বিষাদের ছায়া।

আচ্ছা, তোমরা নিজেদের জোত-জমি সব দিয়ে দিলে কেন কমলা? চাষবাস তো করতে পারতে? পুকুর-জলায় মাছ হত? পরমার আপাত সরল প্রশ্ন।

সে চেষ্টারও তুরুটি হয়নি মামি। সরকারের তরপের লোক বুঝিয়েছে। উন্নয়ন হবে। চাকরি হবে। কাজকর্মের সুরাহা হবে। বাপ-ঠাকুদ্দা তো শউরে ছিল না, গেরামের সিধে-সরল মানুষ। বিশ্বাস করেছে। কতিপয় যেনারা জমি ধিতে না চে গুঁয়ার্তুমি করিছে… লাশ পড়ে গেচে গো মামাবাবু… হুই যে বিল আচে… বুজানো হচ্ছে… ফেলাট উটবে… ওই বিলের পাঁকে বাদাবন ছিল… আমার এক জ্ঞাতি কাকা উইখানেই… সন্ধেবেলা এ গেরামের কেউ ও তল্লাটে যায় না মামি… রাতে যে কবন্ধ ঘোরে… হেইডা আমার কাকা।

কমলা তোর কাছ থেকে কিন্তু এলাকার গল্প শুনতে মন্দ লাগে না। তো হ্যাঁরে ওই যেখানটায় শপিং মল… ওখানটায় কী ছিল? সুসানের প্রশ্ন।
–কী আবার? জমি ছিল। চাষ হত। সরকার নেল। বিল্ডিং তুলল। জমি যাদের ছেল তাদের ঘরের দুটা ছেলে কাজ পেল।
–মোটে দুটা? বাকি সব?
–কী যে বলো মামাবাবু… দুইজনা পেয়েছে এই না ঢের। বাকি কুথায় গেল কে জানে? বেশ মনে আছে ঢের ধরাকরা করে ওই দুজনার চাকরি হয়েছেল।
–কাকে ধরেছিল?
–লালাবাবু। এ তল্লাটের পাণ্ডা ছিল একসময়। তারপর তো জল কত গইড়ে গেল… সেই দল গেল। এই দল এল… আমারা যে তিমিরে সে তিমিরেই… শুধু মানতে পারি না এলাকায় কেউ আমার চলাফেরা আটকে দিলে। কুথাকার কুন বেপাড়ার ডেসপরা সিকুরিটি আমায় বলে কিনা… ভেতরে ঢুকতে পারবে না। মাক্স পরতে বলিচে, পরিচি। হাতে গেলাভস পরতে বলেচে, পরিচি। তাও বলে কিনা সেকেটারির মানা। ঢুকতে দিব না।
ওরে, কুতায় ছিলি রে তোরা……? যখন এই জল-জঙ্গল-জমি সব আমাদের ছেল। চাষজমিতে সকাল থিকে সন্ধে কত খেলা করেচি আমরা। বাপেরা জমিতে নাঙল দিত আমরাও সাথে সাথে…… ধান উঠতো। সরষে-কলাই-আলু….. সব কেড়ে নিয়ে ভিকিরি করে দিয়ে এখন আমাদেরি ভাগাচ্ছে…. আমাদেরই  চোখ রাঙাচ্ছে ।

চোখদুটোয় ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে কমলার। গলার শির ফুলে যায়। রাগে-অপমানে দপদপ করে ওর মাথা।

— মামি, বলে দিও আমাকে যেন আটকাবার চেষ্টা কেউ না করে।

— আসলে সরকারেরই কড়া নিয়ম-কানুন  সব। এরাও খুব ভিতু। রোগের ভয়ে মরছে। তাই আরকি আগাম  সতর্কতার ব্যবস্থা……. কমলাকান্তকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে সুসান।

— শউরে মানুষদের আর আমি ভয় পাই না মামি। ধিনের পর ধিন মিথ্যে কথা বলে বলে সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছো তুমরা আমাদের। এখন ফের মিথ্যে বলছো। নিষেধ। বারণ। আসতে দেব না। ঢুকতে দেব না। আর মানবো না কারুখে। আমি কমলাকান্ত। এ অঞ্চলে আমার জন্ম-কর্ম-সাতপুরুষের বসবাস। আমাদের উৎখাত করে ফেলাট বানিয়েছো তোমরা। তারপর সেই সেখান থেকেই ফের উপড়ে ফেলবে আমাদের?

সুসান আর পরমা লক্ষ্য করে দুঃখ আর অপমানের যন্ত্রণাকে রাগ আর প্রতিশোধস্পৃহায় রূপান্তরিত করেছে কমলাকান্ত। নিমেষে  সব সাজিয়ে তোলা শৌখিন ভদ্রলোকি নিয়মকানুন ভেঙে-গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিতে পারে আনপড় হদ্দ গেঁয়ো চাষাভুষো যুবকের রুখে দাঁড়ানোর দুঃসাহস।

পরমা দেখে ঘরের কোণ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে চলেছে সংখ্যাতীত অগণ্য লাল পিঁপড়ের মৌনমিছিল। সুসানকে বলে, “ওদের ঘর দখল করেছিলাম আমরা। ওরা এবার এসেছে বদলা নিতে।”