Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কোথাও কৃষ্ণচূড়া। অথবা জন্মদাগ

কোথাও কৃষ্ণচূড়া। অথবা জন্মদাগ : শ্রীজাতা গুপ্ত

শ্রীজাতা গুপ্ত

 

অমলতাস

আলো ঢলে পড়েছে দক্ষিণে৷
সামনের গলি দিয়ে হেঁটে যায় অলস প্রহর
পরনে পাজামা, শার্ট
ঝুরো অমলতাস
কখনও মলিন শাড়ি। চুড়িদার।
কোলে-কাঁখে জ্বলজ্বলে শিশু
মরশুমি ফুল, যেন, ঝরে যাবে বেলা পড়ে এলে।
কার্নিশে গাওয়া ঘি। মিঠে সুবাতাস
টাটকা মাছের মুড়ো সাঁতরায় সর্ষের ঝালে
এসব ঝুলিতে ভরে পথ চায়,
নিরবিলি এ পাড়ায়,
যে যা পারো, সামান্য সাহায্য দাও

 

রোম্যান্স

সমস্ত পুরনোর দিকে ফিরতে-ফিরতে

সমস্ত সজীবতা, নীল, আর লোডশেডিং-এর রোম্যান্সের দিকে পিছোতে-পিছোতে

সমস্ত নৈশঃব্দকে কাছে টেনে হেডফোনে সারাউন্ড সাউন্ড-এ ডুবে

‘ভাত-দাও। একটু-ফেন-দাও’ সংলাপে ঢুকে পড়ছি।

ছোটগল্পে নয়। নাটকে নয়। উডকাট ছবিতেও নয়।

এই, আমাদের নিরিবিলি গলিতে। শনিবারের বারবেলায়

 

ফোড়ন

প্রতিবেশীর রান্নায় ফোড়ন
ঝাঁঝালো শুঁটকি
ছেলেটির মুখস্থ রিডিং
চায়ে ক’চামচ চিনি
মেয়েদের হাঁফ-ধরা প্রাণ
কত বড় পিস্ হবে
কর্তার মাছের
বৃদ্ধের আতঙ্ক, জ্বর
সুইসাইড নোট, অতঃপর,
সব আজ ধরা আছে কুরুশের কাজে

 

দরজা

দরজাটা খুলতে পারলেই পরের জানলা খোলা যাবে
তারপর বাক্স
গায়ে মিনেকারী কাজ। জয়পুর থেকে আনা।
বাক্স থেকে বয়াম। ভেতরে টকঝাল কুলের আচার।
খুলবে? দেখা যাবে বন্ধ দু চোখ
বেলা তো অনেক হল, এইবার ডেকে দাও
খুলে দাও শোক।
শোকের পরেই আছে ডানা। ডানা মেলে
মুক্ত করো মেঘচরাচর।
মেঘ ভাঙলেই, দেখো, ঢাকা দেওয়া মৃতদেহ
শুয়ে পরপর।
মৃত্যুর পরে কী হয়?
নখের আঁচড়ে নাম রাখা থাকে বন্ধ দরজায়।

 

চিঠি

শেষ চিঠি লেখা যার কাজ, মৃত সৈনিকের বকলমে…

‘প্রিয়তমা, মনে রেখো, আমাদের শেষ নৈশাহার, বড়দের প্রণাম দিও,
ছোটদের অনুশোচনা। স্নেহ।’

তার আয়ু বিস্তৃত পৃথিবীর চূড়ান্ত ইতি, অন্তিম অক্ষরে।

সে যেন সুস্থ থাকে, পত্র দেয় আকাশে আলোকে

নিজের মৃত্যুর ঠিক পরে

 

কবিতা

পেপার-কাট। অসন্তোষ। সকালের আড়মোড়া।
বিপ্লব। অবান্ধব। দুপুরে ক্যাকটাস।
কোথাও কৃষ্ণচূড়া। অথবা জন্মদাগ। প্রেমিকের অস্থি-পাঁজর।
যেভাবে বিজ্ঞাপনে হাত কাটে।
কাটাছেঁড়া বেড়ে যায় কব্জির ভাঁজে।
কলমে আখর, তাতে কদাচিত ফোঁটা ফোঁটা ডালিম দানার মত রক্তের চোখ।
কবিতা লেখে।

(ঋণ: অগ্নি)

 

স্টেশন-মাস্টার

হতে চেয়েছিলাম ছোটখাটো রেল-লাইনে স্টেশন-মাস্টার। শঙ্কর যেমন।

যে স্টেশনে মালবাহী গাড়ী কালে-ভদ্রে থামে৷

প্যাসেঞ্জার ট্রেনদের সিগ্ন্যালে এগিয়ে দেবো পথ। আত্মীয়স্বজন রওনা হলে সামান্য এগিয়ে দেওয়া, তেমন।

প্ল্যাটফর্ম, এই, সুরকি-ইঁট গাঁথা। সস্তার ক্যালেন্ডারের  ফিনফিনে পাতা।

পরপর ট্রেন, সবুজ পতাকায় বিদায় জানানো দীর্ঘতর দিন।

সেই রং, সেই স্বর। ঘটাং! ঘটাং!

সন্ধে হলে কুপি জ্বেলে জানালায় যাই।

দূরগামী কামরার গরাদে গাল ঠেকিয়ে হু-হু হাওয়া খেতে খেতে প্যাসেঞ্জার কিশোরী ভাবে, ‘ওই ঘরে থাকে কে? কী তার রাতের খাবার? তার বুঝি খেলা ফেলে সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসে পড়া চাই?’

 

মাত্রাজ্ঞান

ভালোবাসি
দেখেছি হয়ত একবার
প্রশ্ন করি, মন খারাপ কেন?
আজকাল, মন ভালো থাকে না আমার
জানলায় দাঁড়িয়ে থাকি
ও বাড়ির বড়ছেলে সন্দেহে দেখে
দুচোখ ছাপিয়ে জল
এপাশে, পর্দার আড়ালে
সুপুরির গাছে ওঠে সর-সর হাওয়া।
হাঁড়িচাচা, বেনেবউ ছোটখাটো পাখিদের ঠোঁট।
ভেসে আসা ভিক্ষুকের কাঁপা কণ্ঠস্বর।
কেঁদে উঠি অনিয়মে। বদভ্যাসে।
ভালোবাসি। তাকে আমি ভালোবাসি বলে
পা বাড়াই।
যেভাবে লতিয়ে ওঠে পুঁইলতা
অক্ষরবৃত্ত না জেনে
নতুন সখ্যতায়। কবিতার প্রথম খাতায়,
কেবলই ছড়িয়ে যাই পংক্তি ভেঙে, দূরে,
আসলে,
অপূর্ণ রয়েছে পাঠ যথাযথ ছন্দমাত্রাজ্ঞানে

 

চন্দ্রাহত

রাখাল ছেলের লোভে, আমি বাঁশি কিনেছিলাম।
গ্রামের হাটে। মেলার ভিড়ে।
অন্তরঙ্গ বাঁশবাগানে
কেমন হবে রাখাল আমার,
পাতার ফাঁকে যেটুকু স্থান সুরের থাকে
তাদের
কানে বলে এলাম।

কদিন ধরে, সকালবেলা
কে যেন তার বাঁশির সুরে ডাকছে আমায়।
যেসব সুরে পাহাড় বাঁধা। অসুখ যেসব সুরের সাথী
আমি আমার অন্তরে আর
তার বিরহে বংশীধারী,
আমরা যে যার মোহনভ্রমে,
বন্দি থাকি।

মাথার ভেতর কী গান বাজে
আর কারও তো মূর্ছনা নেই,
নাই বা হল।
এমন চন্দ্রাঘাতের টানে
সারাজীবন বন্দিদশায় থাকতে পারি
আমি, আমার রাখাল ছেলে,
যার লোভে, সেই গহীন মাঠে,
কিনেছিলাম ভ্রান্ত-বাঁশি