Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ডিটেনশন ক্যাম্প: এক নতুন কাব্যভাষা

বেবী সাউ

 

সমকালীন প্রেক্ষাপট যখন ভীষণ অস্থির, সে সময়ে, ডিটেনশন ক্যাম্প বললেই মনে পড়ে এক ভিন্ন দেশের প্রেক্ষিত। মনে পড়ে যায় এশিয়া মাইনর অঞ্চলের সেই তুর্কিদের কথা, যারা ক্রুসেডের সময় একটার পর একটা অঞ্চলে যাযাবর হয়েই ঘুরে বেড়াতেন অটোমান সাম্রাজ্য তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত। মনে পড়ে যায় ইহুদিদের উপর জার্মান নাজিদের অত্যাচারের কথা। মনে পড়ে যায় পৃথিবীর সমস্ত শাসকদের অত্যাচারে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মানুষের একাকিত্ব, সংগ্রাম এবং তারই মধ্যে উঠে আসা তাঁদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা। অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ প্রকৃত প্রস্তাবে এমন এক রাজনৈতিক ভাষ্যের কবিতার বই, যার ছত্রে ছত্রে ইতিহাসচেতনার সঙ্গে মিলে মিশে গিয়েছে আবহমান অবচেতনার এক একটি দৃশ্যকল্প। যেন বা ইতিহাস খনন করতে গিয়ে উঠে এসেছে এক অন্তরালে থাকা সময়। যে সময়কে অনেকদিন ধরে ভুলেছিলাম আমরা।

ডাকবাংলোর ধারে বসে আছি।
এখুনি এখান দিয়ে হরিণ ছুটে যাবে
আমি তাদের ধরব না
গায়ে হাত তুলব না
সেই কবে কেউ একজন বলেছিল
হরিণ হল সময়
হরিণ হল নদী
হরিণ হল কাল।
টিলার উপর যে-নারী বাসা বাঁধে
হরিণের দৌড়ের কাছ দিয়ে
সে জানে হরিণ হল না-নাগরিক
যার দেশ-কাল নেই।

(১০ নং কবিতা)

এই না-নাগরিক আমরা আসলে সবাই, যারা নিজেদের শিকড়ের খোঁজেই প্রকৃতপক্ষে হয়ে গেছে শিকড়হীন। যে হরিণ কাল, যে হরিণ নদীর মতো প্রবহমান, তার ঘাটের কাছে অনন্তকাল ধরে যেন বসে আছি আমরা। ওই ডাকবাংলো এক অদ্ভুত রহস্যঘন প্রতীক হয়ে আমাদের কাছে ধরা দিচ্ছে। একটু কি পরাবাস্তবতার ছোঁয়া রয়েছে এখানে? থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ সময় মানেই তার ভিতর বুড়বুড়ি কাটে অধিচেতনা এবং পরাবাস্তবতা। যেহেতু বাস্তবতা বলতে কী বোঝায়, তা আমরা কেউই জানি না। আপাত বাস্তবতার মধ্যে তাই ঘুরপাক খাই আমরা। যেন জীবনটাও একটা ডিটেনশন ক্যাম্প এবং আমরা সেই ক্যাম্পে বন্দি।

আমার নিজস্ব কোনো হরিণ নেই
আমার নিজস্ব কোন গৃহ নেই
আমার কোনো নারী নেই
তবুও
আমার নিজস্ব হরিণ খেলা করে
আমার নিজস্ব গৃহ রঙিন হয়
আমার গৃহিনী চুল বাঁধে।
অথচ
আমি একাকী ছিলাম ও আছি
একাকী পথ হাঁটতাম ও হাঁটছি
একলা বসি আলপথে।
হরিণী শূন্যতা না-জানে।

(৪ নং কবিতা)

শব্দকে যে অর্থের ঘেরাটোপে পড়তে পড়তে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, শব্দ আসলে তার থেকে বেরিয়ে পড়ে। একই শব্দের তাই থাকে কিছু কাছের অর্থ, আবার থাকে কিছু দূরের অর্থ। অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী এই কাব্যগ্রন্থে শব্দের প্রায় সবরকমের কাছের এবং দূরের অর্থগুলিকে নিয়ে কাজ করেছেন। এর ফলে শব্দের একরৈখিকতা তো আর নেইই, তার সঙ্গে শব্দের বহুমাত্রিকতার এক স্তর উন্মোচিত হয়েছে এই কবিতাই বইয়ে। যার উদাহরণ হিসেবে এই গ্রন্থের প্রায় সমস্ত কবিতাকেই তুলে ধরা যায়।

কৌশিকী নদীর ধারে শ্রীগৌতমের বাড়ি।
একশো দিনের পুরনো দেল-টালি-খড়
সে ও তার বউ অঙ্গনা
ছাগল পালে।
ঘরে নিয়ে শোয়।
সে বলে, এই দোকানঘর খুব ভালো
এই পঞ্চায়েতের ছাগল খুব ভালো।
শুনেছি সোঁদরবনের পঞ্চায়েত হরিণ দেয়
এদিকে তার ব্যবস্থা করা যায় না?
বেশ হয়, হরিণের সহিত বসবাস।
বেশ লাগে তাদের ওঠা-পড়া।
হরিণ থাকলে মুনি-ঋষিরা আসবেন
তারা আশ্রম রচনা করবেন।
কুটির বানাবেন।
বলি, তোমার মেয়ের নাম বুঝি শকুন্তলা?
সে বলে, দূর! আমার কোনো দেশই নেই।
তবে? কে আছে তোমার? ছেলে?
সে বলে, কেবল উদ্বেগ উদ্বেগ আর উদ্বেগ।

রাজনৈতিক ইঙ্গিতময়তার সঙ্গে প্রতীকি ব্যঞ্জনার ভাষা মিশে গিয়ে এ কাব্যগ্রন্থে যে ভাষাপ্রবাহের জন্ম হয়েছে, তা অনন্য। এই শক্তিশালী কাব্যভাষা বাংলা কবিতার অন্দরমহল এবং বহির্মণ্ডলকে উদ্দীপ্ত করুক, এই আশা।