Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘পদ্মব্যূহে নিম অন্নপূর্ণা’ — একটি আলোচনা

গৌতম বসু

 

‘পদ্মব্যূহে নিম অন্নপূর্ণা’ (২০১৯) সোনালী চক্রবর্তী-র প্রথম কবিতার বই নয়, হলেও বিস্মিত হবার কিছু ছিল না, কারণ পূর্ববর্তী বইটির (‘জামার নীচে অলীক মানুষ’/২০১৭) সঙ্গে এ-বইয়ের প্রায় কোনও সুসম্পর্ক নেই। তাঁর ভাবনাসূত্রগুলি কোনও আভ্যন্তর সংঘর্ষের মুখে পড়ে, ছিঁড়ে গিয়ে, এইরকম কাব্যপঙক্তির জন্ম দিয়েছে; ‘অন্ধকার যেমত সর্বগ্রাসী’। কাব্যগ্রন্থের শিরোনামে, এমন কি, উৎসর্গপত্রেও, কমলকুমার মজুমদার-এর ছায়া দেখা গেলেও কেবল এই উপাদান দিয়ে সোনালী-র লেখার বিবর্তনের আকৃতি সম্পূর্ণ ধরা পড়বে না। বস্তুত, এতরকমের একমুখী এবং ভিন্নমুখী চিন্তাশক্তি একইসঙ্গে কাজ করে চলেছে যে, সেগুলিকে আলাদা-আলাদা করে শনাক্ত করা কেবল কষ্টসাধ্য নয়, হয়তো অপ্রয়োজনীয়ও। কবিতার সবটুকু অতিসহজে বোঝা গেলে রসহানি ঘটা, বোধকরি, অনিবার্য। আবার, একটি বইকে যদি একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবস্তু ধার্য করা হয়, তা হলে, আমরা, পাঠকরা, কখনও-কখনও, লেখক সম্বন্ধে একটা অভিযাত্রার প্রত্যাশা বহন করি। আমরা অনুমান করে নিই, লেখক, তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দেবেন। চিন্তার এই সাযুজ্য, অথবা বলা যেতে পারে, একটা নির্দিষ্ট গতিরেখায় কোনও বই চিহ্নিত হতেই পারে, কিন্তু এমনটা হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। লেখক কখনও উদ্দীপ্ত কখনও মুহ্যমান, কখনও বাঙ্‌ময় কখনও বাক্যহারা, তাঁর লেখাতেও নানারকমের স্বাধীন বাতাস খেলে বেড়াবার অবসর পায়। ‘পদ্মব্যূহে নিম অন্নপূর্ণা’ও এমনই, ফোটা ফুলের মতো একটি বই, পাপড়িগুলির মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই, আবার একই সঙ্গে, কোনও পাপড়ি হুবহু অন্য পাপড়ির মতো নয়। এক ফোঁটা শিশিরের ভারে কেউ হয়তো সামান্য ন্যুব্জ, কারুর ফুটে ওঠাই হয়নি এখনও।

কবিতার ভাষার ভিতর দিয়ে আমরা নিজেদের কথা বলতে চাই, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিপদ এই যে, কবিতারও নিজের একটা মন আছে। লেখকের মনও মন, কবিতার মনও মন; কে যে কখন কথা বলে ওঠেন, তা এক রহস্যঘন প্রসঙ্গ। লেখক যখন নিজেই সারাক্ষণ বকর্‌ বকর্‌ করে যান, আমরা পাঠকরা দ্রুত উৎসাহ হারাই। কিন্তু যখন তা হয় না, যখন কবিতাকে এগিয়ে দিয়ে লেখক নিজে নেপথ্য সরে যান, অথবা, যখন ঠিক এর বিপরীত ঘটনাটি ঘটে, কবিতাই যখন লেখককে পথ ছেড়ে দেন, তখনই রস উৎপন্ন হয়। এক অর্থে এটি অনেকটা সঙ্গীতশাস্ত্রের বাদী-বিবাদী স্বরের মতো, আবার অন্য অর্থে, তা নয়, কারণ, কোন্‌টা যে লেখকের কণ্ঠস্বর আর কোন্‌টা যে কবিতার, তা নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য, এবং দুঃসাধ্য বলেই আরও রহস্যময়। ‘পদ্মব্যূহে নিম অন্নপূর্ণা’ থেকে দু’টি ভিন্ন স্বরের লেখা তুলে এনে আমি এই কুহক আস্বাদন করার চেষ্টা করছিলাম।

প্রথম কবিতা:

প্রস্থান

ছেড়ে যেতে গেলে ভুলিয়ে যাওয়াই বিধি? শচী মাতা থেকে রতন, আমি অজস্র আয়নায় অসহায় প্রতিবিম্ব দেখি। হাঁটু জলে ডোবানো সালতি ভেসে গেলে শ্যাওলার বুক ছেঁড়ে, এখনও কত মায়া লেগে, আঁচলের হলুদ সাক্ষী। কখনও চাঁদ আসেনি এই ঘিঞ্জি জনপদে তোমার উঠোনে, আজ শেষ চাবি ঘুরানোর সময় আকাশ ভেঙে তোমারই পথ ভাসায়। কত গভীর ছিল ক্ষত, শিকড় কার নাম, ছেড়ে না গেলে ভালোবাসা বোঝে?

দ্বিতীয় কবিতা:

স্বপিণ্ডদান, আত্মশ্রাদ্ধ ইত্যাদি লোকাচার

গত রাত্রি একাদশী ছিল, আজ শ্রাবণের দ্বিতীয় সোম দ্বিপ্রহরে উচ্চারণ করি― ‘নমস্বধায়ৈ স্বাহায়ৈ নিত্যমেব তবস্থিতি।’ নাও, অনামিকা ছুঁয়ে নেমে গেল অসংখ্য তিল, যে সমস্ত সন্তানদের আগমন সম্ভাবনাকে আমি হত্যা করেছি ডাকিনী মায়ায়, তাদের শিশু মস্তকগুলি ডুবে গেল ক্রমে প্রবল শ্রাবণে। মরিচাদুষ্ট নিমের ডাল কটি দুয়ারে রাখা আছে। যে হাঁড়িতে আমার অন্ত্যেষ্টির চাল ফুটছিল, পোড়া লাগা হেতু পিণ্ডগুলি সে প্রসব করেছ নিরন্তর ঘ্রাণময়। মাঙ্গলিক যে সবুজ পত্রটিতে আঁকা ছিল কড়ি ও চেলী, তার রম্ভা মূলাংশের সামনে কুশের আসন। অগ্রদানী উপস্থিত নেই। উৎসর্গ দানের অপেক্ষায় বুভুক্ষু কাকের সারি। বিধিমতে শ্রাদ্ধশান্তি বহু আগে শেষ। কিছু কি বাকি? আজ এই অসম্ভব নীলে, যদি শান্তি তর্পণ না হয়, তবে কোনওকালেই প্রেতযোনি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। এমনই নক্ষত্র ইঙ্গিত ছিল গত ষোড়শ প্রহরে। কালব্যাধি নির্ণয়ের পর একশত দিবস ছিল আরোগ্যের। মৃত শবের ফিরে আসা ছিল মাতৃক্রোড়ে। ভ্রম নয়, সে ছিল শূন্য দর্শন কারণ আত্মারামের কলস ভূমিতে আছড়ে ভাঙার পর আমি তাকিয়েছিলাম ফিরে। তখনও আমার চিতা আগলে চণ্ডালটি বসে শেষ আগুন উসকানোর ফিকিরে। আত্মার স্বস্ত্যয়ন আজ সম্পন্ন হল। আমি মুক্তি নিলাম না দিলাম সেই উত্তরের সঙ্কেত গাঁথা তন্ত্র ও অলীকে।

বলা বাহুল্য, প্রসঙ্গটি অমীমাংসিত রয়ে যায়, অমীমাংসার ভিতর থেকেই গজিয়ে ওঠে অন্য একটি প্রসঙ্গ। এই লেখা দুটিতে এবং অন্য অনেক লেখাতেও, ভাবনা নিয়ে, ভাষা নিয়ে, ও সবচেয়ে বেশি, অনুষঙ্গ নিয়ে, সোনালী বিষম ঝুঁকি নিয়েছেন, দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে গেছেন বহুবার। একটিও অনুষঙ্গের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় যদি না থাকে, তা হলে পাঠের ক্ষেত্রে বিপত্তি ঘটা প্রায় অনিবার্য। আবার, অন্য দিকে, লেখকের দিক থেকেও নিয়ন্ত্রণ হারাবার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছেই! হলুদ চাঁদ, রাত্রিকালীন ফাঁকা রেল স্টেশন, বিষণ্ণ সেতার, নির্জন পূকূড়পাড়― কত নিরাপদ বাক্‌প্রতিমাই তো আকাশেবাতাসে নিরন্তর ঘুরছে, সেগুলি পরিহার করে তিনি কখনও যুগপৎ উপেক্ষিত ও আটপৌরে চিত্র বেছে নিয়েছেন, কখনও দেখা গেল, ধুলোয় চিক্‌ চিক্‌ করছে দুঃস্বপ্নের অভ্রকণা। যেখানে শব্দচিত্রের দ্বারা সহজেই কাজ সেরে নেওয়া যেত, সেখানে সমস্ত বর্জন করে লিখে বসলেন: ‘অন্ধকার যেমত সর্বগ্রাসী’। ভাবছিলাম, পাঠকের অভ্যাসকে আক্রমণ করতে পারলে লেখক নিজের অভ্যাসকেও আঘাত করতে পারবেন। এই ক্ষতি স্বীকার করবার জন্য যিনি প্রস্তুত, অনিশ্চয়তায় নিজেকে ঠেলে দিতে যিনি ভীত নন, তাঁর লেখার কাছে আমাদের ফিরে আসতে হবেই।

‘পদ্মব্যূহে নিম অন্নপূর্ণা’/ সোনালী চক্রবর্তী / বাক্‌ প্রকাশনী, ডিসেম্বর ২০১৯