Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চামড়ার তলায় নজরদারি

স্বপন ভট্টাচার্য

 


লেখক প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

 

 

 

আন্ডার দি স্কিন সারভেইলেন্স— চামড়ার তলায় ঢুকে নজরদারি। কথাটা আমার নয় ইউভাল নোয়া হারারির, যিনি স্যাপিয়েন্স নামক বেস্টসেলার লিখে বিখ্যাত হয়েছেন। করোনা পরবর্তীকালে সভ্যতায় বা অ-সভ্যতায় কোন কোন পরিবর্তন আসতে চলেছে তার উত্তরে হারারি বলেছেন, আগামী পৃথিবী হবে চামড়ার তলায় ঢুকে নজরদারির পৃথিবী।[1] আগে মানুষের উপর নজরদারি চালাতে এফবিআই, কেজিবি বা স্টাসি-র মত সংস্থা বিরাট গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক অপারেট করত। প্রতিটি মানুষের জন্য ফাইল, প্রতিটি মানুষের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, পছন্দ, বইপড়া, চিঠি লেখা— সব কিছু রাষ্ট্রের নজরের তলায় এবং এই ব্যবস্থা করতে গিয়ে একটা বহুস্তরি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক তৈরি রাখতে হত। অরওয়েলের ১৯৮৪ অলীক মনে হত না। এখন, এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে এই নজরদারির জন্য এই বিপুল গুপ্তচরতন্ত্রের দরকারই হচ্ছে না। সেই কাজ করে দিচ্ছে আমাদের ফোনে একটা দু অক্ষরের ভারি পছন্দের ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস— অ্যাপ।

দেশের সমস্ত মানুষকে স্বাস্থ্যের কারণে একটা নেটওয়ার্কে সামিল করার কাজটি প্রথম করে চিন। ২০০২-০৩এর SARS মহামারির পরে চিন দেশ জুড়ে একটা প্রযুক্তিনির্ভর অ্যালার্ম সিস্টেম চালু করে যেটাকে অভ্রান্ত এবং সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে সক্ষম বলেই ওরা ভাবত এবং SARS পরবর্তী যে কোনও মহামারির ক্ষেত্রে এটাকেই তারা ফ্রন্টলাইন ইমিউনিটি বলে ভেবে নিয়েছিল বলে মনে হয়। অর্থাৎ মানুষের হাড়ে-মজ্জায়-রক্তে-মাংসে অনাক্রম্যতার যে অমোঘ সঙ্কেতগুলি মহামারির পূর্বাবস্থা ঘোষিত করে তার চেয়ে প্রযুক্তিগত সঙ্কেতের উপর তাদের ভরসা ছিল বেশি। চিনের ন্যাশানাল ডিজিজ রিপোর্টিং সিস্টেম (NDRS) হল এমন একটা নেটওয়ার্ক যা দেশের ১৪০ কোটি মানুষের প্রতিজনকে পঁয়ত্রিশটি সংক্রমণযোগ্য অসুখের পরিপ্রেক্ষিতে নজরে রাখতে পারে।[2] এটাকে এক ধরনের মাস সার্ভেলেন্স নেটওয়ার্ক বলা যেতেই পারে কেন না প্রতিটি মানুষের রোগসংক্রান্ত তথ্য তার ন্যাশানাল আইডি-ভিত্তিক তথ্যের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া চিন সারা দেশে ১৪৫টি ডিজিজ সার্ভেলেন্স পয়েন্ট (DSP)-এর মাধ্যমে র‍্যান্ডম স্যামপ্লিং–এর সাহায্যে বয়স, লিঙ্গ, অন্য ধরনের অসুস্থতা, জীবিকা, রোজগার ইত্যাদির উপর নির্ভর করে যে কোনও জায়গার মানুষের গড়পড়তা সংক্রমণ প্রবনতার একটা হদিশ দিতে পারে বলেই বিশ্বাস ছিল SARS পরবর্তীকালে। SARS Cov2–এর ক্ষেত্রে দেখাই গেল যে সিস্টেমটা প্রত্যাশামাফিক কাজ করতে পারেনি। অনুমান করা যায় স্থানীয়ভাবে যখন চিকিৎসকরা মনে করছিলেন নতুন একটি ভাইরাল সংক্রমণের হদিশ পাচ্ছেন তাঁরা, তখন তার প্রযুক্তিগত সমর্থন নেই সিস্টেম থেকে। ঠিকঠাক কাজ করলে এই সিস্টেম থেকে বেইজিং খুব দেরি হবার আগেই জানতে পারত কী আসতে চলেছে। এই নেটওয়ার্ককে তারা জুড়ে দিয়েছে একটি কনট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপ-এর সঙ্গে যা কেন্দ্রীয় ডাটা ব্যাঙ্কে জমা হওয়া তথ্যের মাধ্যমে মানুষকে ভাগ করে দিচ্ছে সবুজ-হলুদ- লালে। আপনার হাতের স্মার্টফোনে থাকা অ্যাপটি আপনাকে জানিয়ে দেবে মেট্রোয় যার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সে আপনার পক্ষে নিরাপদ (সবুজ) না কি আপনার সরে যাওয়াই বাঞ্ছনীয় (হলুদ) না সে ইতিমধ্যেই লাল, অর্থাৎ সংক্রামিত।

২০২০র এই অতিমারি পরবর্তীকালের পৃথিবীটা কেমন হবে তা অনুমানসাপেক্ষ, কিন্তু দেখাই যাচ্ছে রাষ্ট্র কীভাবে অসুখকে সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। এই করোনাকালে আমাদের দেশেই পার্লামেন্টকে এড়িয়ে, গণবিক্ষোভের সম্ভাবনাগুলোকে বাইপাস করে যেভাবে একের পর এক জাতীয় সংস্থাগুলিকে মায় রেলকে পর্যন্ত বিক্রি করে দেবার কর্মসূচি নেওয়া হল, যেভাবে তেমন কোন বিতর্ক ছাড়াই দেশের প্রধানমন্ত্রী যজমানি সেরে রামমন্দির গঠনের কাজ শুরু করে দিতে পারলেন, তাতে অন্তত এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে মানুষ সবচেয়ে ভয় পায় রোগের জুজুকে। অতিমারি এই কথাটার মধ্যেই যেন এমন এক মহা-সর্বনাশের ইঙ্গিত আছে যা মানুষকে নাগরিকে পরিণত করে দিতে পারে। সুনাগরিক। অতিমারিকালের যা সওয়াবে তাই সয় নাগরিক। সংক্রমণ চলে যাওয়ার পরেও মানুষ যে অনেক কিছুই মেনে নেওয়ার বা মেনে চলার মত ‘প্রোগ্রামড’ হয়ে থাকবে ধরে নিয়েই হয়ত বা বিশ্ব জুড়ে নানা পন্থায় এসে যাবে চামড়ার তলায় ঢুকে নজরদারির যুগ।

এই প্রসঙ্গে ইউভাল নোয়া হারিরির কথা আর একবার শোনা যেতে পারে।[3] হারারি বলছেন আপনার শরীরের তাপমাত্রা, আপনার খুশি বা আপনার বিরক্তি, আপনার অসুস্থতা নির্ণায়ক কিছু লক্ষণ অ্যাপ রেকর্ড করে যাবে চব্বিশ ঘন্টা। সে আপনার তাপমাত্রা থেকে, হয়ত টাচস্ক্রিনে স্পর্শ থেকে মেপে নিতে পারবে কোন বিশেষ সময় আপনার রক্তে সেরাটোনিন বা ডোপামিনের মাত্রা, স্ট্রেস হরমোন বা খুশির হরমোনের সম্ভাব্য মাত্রা। ধরুন, আপনি যদি নর্থ কোরিয়ান হন আর সে দেশের টিভিতে যখন কিমের ভাষণ চলছিল তখন আপনার আপনার স্মার্টফোনে থাকা হেলথ অ্যাপখানা আপনাকে রেকর্ড করল-বেশ চাপে আছেন। স্ট্রেসে ভুগছেন। লোকটাকে আপনার ভালো লাগছে না বলে আপনি যতই অবিচলিত থাকার চেষ্টা করুন না কেন কিছু ফিজিওলজিক্যাল পরিবর্তন আপনার ভিতরে আসবেই। তো এই রেকর্ড ওদের মূল সার্ভারে জমা থাকল। এরকম হতেই থাকল পৌনঃপুনিকভাবে কিছুদিন। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার হিট হয়ে যাবার পরে সার্ভার সিগন্যাল দিল— বিপ। তারপরে আপনার অবস্থাটা কী হবে ভাবুন তো? কোভিড পরবর্তী যুগে মানুষ হয়ত স্বাধীনতার আগে স্বাস্থ্যকেই অগ্রাধিকার দেবে। ভবিষ্যতে এমন দিন আসছে, যে এরকম হেলথ অ্যাপ ফোনে না থাকলে আপনি প্লেনের টিকিট পাবেন না, ট্রেনে উঠতে পারবেন না, সুতরাং, হারারির মত, কোভিড সেই সুযোগ করে দিল যাতে আগামি দিনে রাষ্ট্র আমাদের শরীরের তাপ, চাপ, হরমোনের সঙ্গী হতে পারে। হারারি বলছেন, এই ২০২০র অভিজ্ঞতার পরে মানুষ সংক্রমণের ভয়ের থেকে বড় ভয় মনে করবে না চামড়ার তলায় নজর রাখা কৃত্রিম গুপ্তচরকে।

 

ন্যাশানাল ডিজিট্যাল হেলথ মিশন

ভারতে চিনের মতই বড় স্কেলে এরকম একটা প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল কোভিডের আগেই। নীতি আয়োগ ২০১৮তে ন্যাশানাল হেলথ স্ট্যাক (T21016/76/2018-eHealth dated 15 July 2019) তৈরির অভিপ্রায় ব্যক্ত করে জাতীয় স্তরে মতামত আহ্বান করেছিল। তখন পলিসি ডকুমেন্টখানার নাম ছিল ন্যাশানাল ডিজিট্যাল হেলথ ব্লুপ্রিন্ট।[4] অতিমারিকালে এই গত ৩রা আগস্ট সংবাদমাধ্যমে জানা গেল মন্ত্রীসভা তাতে সিলমোহর দিয়ে দিয়েছে।[5] মতামত পর্যালোচনাটা ঠিক কোথায় হল এবং কিভাবে হল তা জানা যায়নি কিন্তু সংক্রমণ, আগেই বলেছি, বড় দায়, বড় অছিলাও সন্দেহ নেই, তাই নীতিগতভাবে আমরা পেতে চলেছি ন্যাশানাল ডিজিট্যাল হেলথ মিশন। জানা গেছে মিশন চতুর্বাহু। চারখানা বাহু হল যথাক্রমে, স্বাস্থ্য সনাক্তকরণ সংখ্যা (National Health iD), ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য, ডিজি-ডক্টর এবং চিকিৎসাকেন্দ্রের পঞ্জিকরণ। উদ্দেশ্য সাধু— সরকার স্বাস্থ্যব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দিতে এবার বদ্ধপরিকর। এতে আপনার স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য এবং আপনার চিকিৎসকের দেওয়া আপনার চিকিৎসার যাবতীয় রেকর্ড একই সার্ভারে থাকবে। দরকারমত, এবং আপনাকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে আপনাদের উভয়ের অনুমতিক্রমে, সেই তথ্য আদান প্রদান হতে পারবে। বলা হচ্ছে, তথ্যের মালিক থাকবেন আপনিই কিন্তু আপনাকে এর সুবিধাগুলি পুরোপুরি পেতে গেলে আপনার ইউনিক হেলথ আই ডি আপনার আধার সংখ্যার সঙ্গে জুড়তে হবে। একই ভাবে হাসপাতাল, ডাক্তার, ডায়গোনিস্টিক ল্যাব সবাই এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হবেন। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ বা টেলিমেডিসিনের সুবিধাও এই মিশনের মাধ্যমে পাওয়া যাবে। মিশন হবে অবশ্যই অ্যাপভিত্তিক। ডাক্তারবাবুরা ডিজিট্যাল সিগনেচারের মাধ্যমে এটির মাধ্যমে প্রেসক্রিপশনও করতে পারবেন। দেশের একশো ত্রিশ কোটি মানুষকে এই ছাতার তলায় আনতে গঠিত হয়েছে ন্যাশানাল হেলথ অথরিটি (NHA) যারা হবে এই প্রকল্পের সমন্বয়সাধক সংস্থা। আপনাকে যথেষ্ট আশ্বস্ত করে বলা হচ্ছে এটি সম্পুর্ণভাবে ঐচ্ছিক, চাইলে আপনি এর বাইরেও থাকতে পারেন। অনুমান করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী আগামী ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে এটি রামমন্দিরের মত এটিকেও জাতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে পারেন।

ইস্তেহার পড়ে আবার ইউভাল নোয়া হারারির কথা মনে পড়লে অপরাধ নেবেন না মান্যবর। যতই বলা হোক না কেন তথ্যের মালিক আপনি, কতটা নিশ্চিন্তে আপনার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কতটা তথ্য আপনার চাকুরিদাতা সংস্থা, আপনার ইন্সিওরেন্স কোম্পানি বা আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আপনি শেয়ার করতে চাইবেন বলুন তো? কতটা তথ্য এবং আপনার স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কোন কোন তথ্য আপনার ডাক্তারবাবুকে আপনি নিশ্চিন্তমনে শেয়ার করতে দেবেন সরকারি নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে? যারা মনোরোগী, যারা সম্পূর্ণ সুস্থ দেহের অধিকারী হলেও সময়ে সময়ে কাউন্সেলিং-এর সহায়তা নিয়ে থাকেন তাদের চামড়ার নীচের তথ্য চিকিৎসক হয়ে, অ্যাপ হয়ে, আধার হয়ে, সরকারের হাতে পৌঁছলে আমার দেশ কি আমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারে যে আমি তার পরেও সর্বস্তরে সম্পদ- মানবসম্পদ বলে বিবেচিত হব? সিএএ এবং এনআরসি-র ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে জল মাপা চলছে এখনও। তার সঙ্গে এসে জুড়ে যেতে চলেছে আপনার স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার সমানাধিকার। রাম না জন্মাতেই রামায়ণের মত শোনালেও ঘর পোড়া গরু তো ডরাবেই। তবে মেনে আমরা একরকম নিয়েইছি। আরোগ্য সেতু ছাড়া কোভিড রুগীর রক্ত পরীক্ষাই হবে না, সে ভর্তি হতে পারবে না হাসপাতালে, হয়ত মরতেও পারবে না অ্যাপ ছাড়া।  আগামী কৃত্রিম মেধার যুগে এই আপাত নিরীহ অ্যাপখানাও যে আপনাকে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে মাপতে শুরু করবে না সে কথা আজকে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না ঠিকই, কিন্তু হারারির অনুমান আগামী দিনের  পৃথিবী হল এই আন্ডার দি স্কিন সারভেইলেন্স-এর পৃথিবী। আর সেই পশ্চাদপটেই বাজারে আসতে চলেছে ভারতবর্ষের জাতীয় স্বাস্থ্য নেটওয়ার্ক।

কোভিডের শেষ দেখা যাচ্ছে না এখনও। আবার এরকম অতিমারি এড়ানো যাবে তাও হলফ করে বলা যাবে না, কিন্তু এড়াতে চাইবেই মানুষ এককভাবে বা সমষ্টিগতভাবে । চামড়ার নীচে নজরদারি হয়ত সে জন্যই জরুরী বিবেচিত হবে। সেটা হবে আপনার উষ্ণতার বিনিময়ে। কে বলতে পারে, একটু উষ্ণতার জন্য আপনি কোনদিন বাতিল বিবেচিত হবেন কী না?


[1] Yuval Noah Harari: The world after coronavirus. FT. March 20, 2020
[2] https://www.nytimes.com/by/steven-lee-myers
[3] টীকা ১ দ্রষ্টব্য
[4] Govt.of India memo no. T21016/76/2018-eHealth dated 15 July
[5] https://www.businesstoday.in/current/economy-politics/personal-health-ids-e-records-doctors-registry-part-of-centres-digital-health-ecosystem-plan/story/411812.html?utm_source=whatsapp&utm_medium=WEB