Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পাঁচটি কবিতা

পাঁচটি কবিতা -- অমিতরূপ চক্রবর্তী

অমিতরূপ চক্রবর্তী

 

আবাসিক

বৃষ্টি নেমেছে। ভালো লাগছে ঠিক এই সময়ের বৃষ্টি। বৃষ্টি যদিও খুব তীব্র নয় কিন্তু সারাদিনের গরমের পরে আকাশের এই উপহার বেশ ভালো লাগছে। টিনের ঢেউ বেয়ে জল জল পড়ছে। জলধারার পেছনে একটা সাদা আলো জ্বলছে বলে জলধারার দরদরিয়ে গড়িয়ে পড়া দেখতে পাচ্ছি। ভালো লাগছে। আজ নিজেকে ছুটি দিলাম। নিশ্ছিদ্র ঘুম আর স্বপ্নের নতুন একটা সিরিজের জন্য। এখন আমার অবস্থান এই বৃষ্টিঘেরা ঘরবাড়ির মধ্যে তে-তলার আবাসিকের মতো। যে অকারণ জানালায় তাকিয়ে বৃষ্টি দেখে। মনের ভেতরে ক্ষীণ এক বিক্রিয়াও সাইমলটেনাসলি চলে। একটি আলোকবিন্দু বহুদূরে পাড়ি দেবার জন্য উড়তে শুরু করে। তে-তলার আবাসিকের মতো শুনি নীচে দিনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন চলছে। মেঝেয় বাসন পড়ার শব্দ। গরম তেলে সবজি ছেড়ে দেবার ছাত করে শব্দ। কলের হাতল চাপার শব্দ। ওপরের আবাসিকদের ঘর অন্ধকার। দরদরিয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে। আমার মনে হয় যদি আমার একটা দেওয়াল সম্পূর্ণ কাচের হত। তার বাইরের গা দিয়ে এমন করে বৃষ্টির জল দরদরিয়ে গড়িয়ে নামত, এপাশ থেকে আমি তাকে ছুঁয়ে দেখতাম। একটা স্বচ্ছ নৈকট্য কিন্তু প্রবঞ্চক 

বৃষ্টি নামলে যে এখনও রোমাঞ্চ হয়, আমার এটাই আশ্চর্য লাগে। তার মানে এই যে এখনও এমন কোনও বেসমেন্ট অবশিষ্ট আছে আমার মধ্যে, যেখানে রোমাঞ্চের যন্ত্রপাতিগুলো সচল, কাজ করে। বিভিন্ন তারে পরিবাহিত হয়ে পৌঁছয় এই আবাসনের বিভিন্ন অংশে। কালো চাদর পরে দাঁড়িয়ে থাকা ঘরে ডিভাইন শাওয়ারের মতো বাতি জ্বলে ওঠে। চলতে চলতে থেমে যাওয়া একটি গান আবার চলতে শুরু করে। কখনও মনে হয় এই এইটুকুই কী যথেষ্ট নয়? যদি হঠাৎ আমি বুঝতে পারি এমন সারা শরীর ছেয়ে যাওয়া শজারুর কাঁটার নীচে কদমফুলের মতো মাংস আছে, হৃৎস্পন্দন আছে? যদি আমার পূর্বোক্ত তেমন একটা কাচের দেওয়াল থাকত, নিঃসন্দেহে তার গায়ে হাত রেখে দরদরিয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির জল দেখতে দেখতে এই আত্মপ্রশ্ন আরও আরও মূর্চ্ছনাময় হত। অনেকটা ডানা মেলে উড়ে আসা চিঠির মতন। যে চিঠিটি উড়ে এসে ডানা থামিয়ে পড়ে থাকত একটা পুরনো গ্রামোফোনের গায়ে। বলা দরকার, এই গ্রামোফোনটি এমনি একটা সামগ্রী যেটা সবাই সারাজীবন বহন করে। হয়তো এরই নীলকণ্ঠ ফুলের মতো গলায় থাকে মানুষের স্তুপাকার স্মৃতি, জমানো চিঠির পাহাড় আর নানারকমের জীবাশ্ম 

নিশ্চিত নই, এ শুধুমাত্র সম্ভাবনা। আবাসিকেরা সম্ভাবনার চেয়ে বেশি এগোতে পারে না

 

পোকা

একটা রঙিন পোকা উড়ে এসেছে আমাদের অদৃশ্য পরস্পরের মধ্যে। পোকাটির পিঠে খয়েরি মখমলের ওপর হলুদের নকশা, একটি জ্ঞানচক্ষুর মতো চিহ্ন। পোকাটি উড়ে আসার পর আমাদের নীরব ঢেউ তুলে তুলে চলে যাওয়া ভালো-না-লাগা, শীতল হাওয়ার সংস্পর্শে এসে ঠান্ডা হতে থাকা ভালো-না-লাগা তার নিজের ভেতরে চকচকে সুতোর মতো বিঘৎখানেক স্রোত খুঁজে পেল। রঙিন পোকাটি ধীরেধীরে আমাদের পরস্পরের মধ্যে হাঁটছে। কত খাদ, চড়াই-উৎরাই ভেঙে তোমার স্তনযুগলে যাচ্ছে আবার আমার হাতে ফিরে আসছে। কখনও খুব ঝুঁকে দেখছে তলবর্তী শূন্যতা, নীলিমা হয়ে থাকা পাথর ও জঙ্গল। পোকাটির শেষে ধানের টুকরোর মতো একটি অংশ। বোধহয় ওর বিষগ্রন্থি। আত্মরক্ষার নরম উপায়। আমাদের মধ্যে আত্মরক্ষা নেই। বিষগ্রন্থি চুপসে গিয়ে স্নিগ্ধ একটি ক্ষতচিহ্ন হয়ে আছে। যেন টেবিলে রাখা অন্তকালের ফুলদানি আর নগ্নদেহী স্টিলের চামচ 

পোকাটি এখন নেমে গোঁয়ার মানুষের মতো ওর পছন্দমতো এককোণে হেঁটে গেল তারপর দেওয়াল ও বিছানার সন্ধিরেখা ধরে ধরে আবার ফিরল। সুদৃশ্য এই পোকাটিকে আমরা কেউই তাড়িয়ে দিচ্ছি না। এমনকী ও যখন ভীষণ আক্রমণাত্বক ভঙ্গিতে ফিরে আসছে— তখনও। হয়তো আমরা এই পোকাটিকে জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনার মত মনে রাখতে চাই। হয়তো এই পোকাটিকে কোনও প্রতীক হিসেবেও মনে রাখতে চাই। আমাদের ভেতরে যে অন্য আরেক সংসার, রক্তমাংসের দেহ বাস করে— তার অল্প আনন্দের জন্য। তাদের একটি সোনা-ভাঙা দিন উপহার দেবার জন্য। আমাদের ঘিরে বৃত্তাকারে বর্ষা নামিয়ে দেবার জন্য আকাশে মেঘেরা প্রস্তুত হচ্ছে। পাতার মতো ভাসতে ভাসতে আরেকটি কৌমার্যমাখা দিন চলে যাবে আমাদের বিন্দু বিন্দুতে অপরিবর্তিত রেখে। আমাদের অদৃশ্য পরস্পরের মধ্যে পাতলা কিছু দেহবিনিময় হবে, যার কোনও পরিণাম নেই। শুধু কুণ্ডলীপাকানো ভেজা ধোঁয়ার অঙ্কুর ফোটানো ছাড়া 

 

মড়ি

কী যেন কিন্তু কিন্তু করে ওঠে বুকের ভেতরে। ঠিক বুকের ভেতরেও নয়, পাঁজর অতিক্রম করে যে দুর্ভেদ্য মাংস— তারই কোথাও। কোনও একটা অংশে। আমার চোখে দ্যূতিময় চশমা উপোসী প্রজাপতির মতো বসে আছে। নিবিষ্ট মনে আদর করছে ত্বকের ভাঁজগুলোকে। বারবার ঘুরেফিরে মনে আসছে একটা দৃশ্যপট, যেখানে হঠাৎ কী করণে যেন সমুদ্রের ধার থেকে অনেক সাদা সাদা লম্বা গলার পাখি শব্দ করে উড়ে উড়ে যাচ্ছে। কেন এমন একটা দৃশ্য মাথায় ভেসে ভেসে উঠছে আজ? একটু আগে শেকলের দেশ থেকে ঘুরে এসেছি। দেখে এসেছি শেকলেগুলো একে অপরকে আঁকড়ে ধরে নির্জীব হয়ে ঘুমোচ্ছে। তাদের পায়ের দিকে বিছানার চাদর কুঁচকে আছে। সেখানে কিছু অদৃশ্য কাঠমল্লিকার মতো ফুল পড়ে আছে। তাদের গা থেকে উত্তাপের মতো গন্ধ ছড়াচ্ছে। এখন হয়তো একপ্রস্থ অ-রাজসিক বৃষ্টি হবে। তেমনই বিষে অত্যন্ত কালো হয়ে আছে আকাশের ঠোঁট। বৃষ্টি নামলে আমার কাচের মতো পাহাড় বনান্তরাল প্রাচীন গাছের জঙ্গল কাঁপে। সপ্রশ্ন চাঁদ নেমে আসে। কিন্তু সবসময় চাঁদ অভিপ্রেত নয়। তার কলঙ্ক অভিপ্রেত নয় 

আমাদের কিছু ক্ষতস্থান বেশ শুকিয়ে এসেছে। আজ তুমি পিঠে চুলের পর্দা সরিয়ে দেখিয়েছ-ও। আমি দেখেছি ক্ষতস্থান শুকিয়ে শুধু একটা নীল ধোঁয়া ধোঁয়া দাগ হয়ে আছে এবং তোমার সোনালি প্রান্তরের মতো পিঠে বেশ ভালোই লাগছে। এটাই হয়তো কারণ ওই সাদা সাদা পাখি উড়ে যাবার দৃশ্য বারবার মনে-মাথায় ঘুরেফিরে আসার। আমি তোমার অলক্ষ্যে আমার ক্ষতস্থানেও হাত দিয়েছি। দেখেছি আমার ক্ষতস্থান এখনও ভিজে ভিজে। শেকড় এখনও মাটির ভেতরে ঢোকানো। এখনও বাকলে পিঁপড়ে। তবে কাপড় টেনে নামালে আগের মতো চিৎকার করে ওঠে না। আমার মন বলছে তুমি আজ আবার বাঘের মুখোশ পড়ে জঙ্গল থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসবে। সেই চিরপরিচিত হাসির ফুলকি নিয়ে। শুরু করবে আমার পায়ের দিক থেকে আর কোমরের ওপর থেকে অবশিষ্ট আমি প্রাণপনে নিজেকে প্রস্তুত করব। রগে, শিরায় আরও বেশি রক্তের সমাগম ঘটিয়ে, চুলের খাড়িতে আরও বেশি নোনতা জলের মাত্রা বাড়িয়ে। যেমন প্রতিবার করি, যেমন প্রতিবার হয়। তোমার অন্তিম কামড় গলায় ধারণ করে শুধু নীরব একটা জ্যোৎস্নাখচিত থকথকে হরিণ হয়ে যাই 

 

সমকাম

আজ কেমন শীত শীত করে উঠছে গা। বিষণ্ণতার ডালে একটি চেক কাটা চেক কাটা পাখি বসে আছে। একটি গলে গলে পড়ে নিভে যাওয়া মোমের দিকে তাকাতেই মনকেমন করে ওঠে। আমার খসখসে গাল আমি ছুঁয়ে দেখি। পাপাত্মা ঠোঁট ছুঁয়ে দেখি। সমস্ত রোমকূপে মনোবিকারের অদ্ভুত গন্ধ। বুক থেকে আমি একটা সাদা চুল টেনে ছিঁড়লাম। তারপর অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম চুলটির দিকে। এইরকম উপড়ে আনা সাদা চুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দিন সপ্তাহ বছর উট ও ভেড়ার পাল নিয়ে পার হয়ে যায়। ওদের হইহই চিৎকারধ্বনি একসময় কানের ভেতরে অন্ধকার হয়ে জমে। আমার পিঠে ক্রস এঁকে শুয়ে আছে কেউ। তার গরম জলের মতো শরীর। জ্যা-হারানো চুল 

যারা মাংস খান, পাচিত মাংস ক্ষীর হয়ে জমে তাদের গালের টিলায়, চিবুকের শীর্ষে। সকালের রোদ তাতে পিছলে যায়। তাদের প্রকোষ্ঠ নক্ষত্র নক্ষত্রে ভরা। আমি এমন সুন্দর উজ্জ্বল মানুষ দেখলেই তাকিয়ে থাকি। তাদের সবকিছু ঠিকঠাক। সাইপন বেয়ে জল নেমে যায় একবারে অতলে। সকাল নিয়ম করে তাদের নাভিতে উদগার রাখে। তার নীচে সুগন্ধের পাত্র। এইসব মানুষের জন্য দোকানের কাচের উইন্ডো, ভাসমান পদ্মপাতার মতো রেস্তোরাঁ ও তুলোর পরত দেওয়া আকাশে ঝুলন্ত ঘর। আমি এইসব কথা তোমাকে শুনিয়েছি কপালে ঘামের প্রান্তর অতিক্রম করে যেতে যেতে। জল পড়ার মতো নিঃশব্দ ছিল আমাদের সেইসব দিন। আমার বুকের চুল তখন চিরবসন্তের বনভূমি। সেখানে হরিণ ও বাঘের কাম, বরফটুকরোর মতো মাটিতে অনন্তের চাঁদ 

আজ কেমন শীত শীত করে উঠছে গা। কেউ কোথাও নেই, তবু মনে হচ্ছে আমার লজ্জাঙ্গের ওপর যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সেইসব উজ্জ্বল সুন্দর মানুষেরা 

 

ট্যাপেস্ট্রি

আমি মনে মনে তোমাকে বললাম ‘চলো উঠি, ও দিকটায় যাই’। ধরো ওদিকে একটা লোহার পাইপ দিয়ে বানানো রেলিং। ওপাশে অফুরন্ত নদী। হাওয়া ছুটে আসছে নদীর গায়ে পা ফেলে ফেলে অথবা বুক নীচু করে উড়ে। পেছন থেকে পড়া আলোয় তোমার ফুলদানির মতো চকচকে শাড়ি পরা দেহ আর আমার বেঁটে গাছের মতো দু খণ্ড দেহ দেখা যাচ্ছে। আমাদের মুখের দিকটায় অন্ধকার। হাওয়া ঝাপট মারছে। সেই ছায়ার মধ্যেই দেখলাম তোমার বাঁ কানের পাশ দিয়ে চুল উড়ে গেল। এমন রেলিং ধরে হয়তো যুগের পর যুগ দাঁড়িয়ে থাকা যায় কিন্তু আমি তো তোমার প্রতিক্রিয়া জানি না। তোমার বেগুনি ঠোঁট একবার ঘষে নিল নিজেদের, তারপর অফুরন্ত নদীটার অন্ধকারে তোমার আবছা চোখ চেয়ে রইল। আমাদের ডানপাশে একটা সুরম্য ভবন। তার দ্বিতীয় তলার জানালার সামনে একটি গাছ। সেই ভবনের প্রতিটি জানালায় আলো। একটি জানালা দিয়ে ছাদের নকশা দেখা যাচ্ছে। ট্যাপেস্ট্রির কিছুটা। একটি বারান্দার তেলতেলে দরজার গায়ে শঙ্খের ঝালর। পাশে একটি উঁচু টুলে হাতভাঙা মাটির মূর্তি 

‘কী ভাবছ’ আমি মনে মনে বললাম। তুমি মনে মনে আমাকে জানালে ‘একটি দীর্ঘশ্বাস নেব’। তুমি দীর্ঘশ্বাস নিলে। তোমার অন্তর্সঞ্জাত কিছুটা বাতাস এই সীমাহীন বাতাসের জলে মিশে গেল। লোহার পাইপে আমাদের হাত অন্ধকারে পাশাপাশি। যেন দু জোড়া পোষা ময়ূর। তত্ত্বাবধানে থাকতে থাকতে নিজেদের কাম ক্রোধ রোমাঞ্চ হারিয়ে ফেলেছে। তবুও ময়ূর। মনে মনে বললাম ‘পালকে হাত বোলাই’। তোমার দিক থেকে উত্তর এল ‘সাবধানে ওর পালকগুলো শেকড় থেকে ছেঁড়া’। আমি আমাকে তোমার পাশে রেখে, ময়ূরের পাশে রেখে মনে মনে অনেকটা পিছিয়ে আসি, যেখান থেকে তোমার শাড়িপরা ফুলদানির মতো শরীর দেখা যায়। জড়িয়েমড়িয়ে থাকা রেলট্র্যাকগুলি দেখা যায়। দূরে ভূতের চোখের মতো লাল সিগনালের আলো দেখা যায়। ওয়েটিংশেডের নীচে সাদা শূন্যতা দেখা যায়। বসার জায়গাগুলি দেখা যায়। পেছনের আমি সামনে তোমার পাশে থাকা আমিকে প্রশ্ন পাঠালাম ‘জিজ্ঞেস করো শেষ ট্রেন কবে এসেছিল?’ তুমি মনে মনে উত্তর দিলে ‘এই, একটু আগেই তো! কনকনে বাতাসের মতো পার হয়ে গেল’